প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
সাব্বির দেড় ঘন্টা ধরে বারডেমের চক্ষুবিভাগের আউটডোরে বসে আছে। সাব্বিরের সাথে এসেছে দুলাভাই আর নয় বছরের ভাগনী তন্বী। দুলাভায়ের চোখে ছানি অপারেশনের পর চেক আপের জন্য বারডেমে আসা। আউটডোরে সাব্বির ডাক্তারের চেম্বারে দুলাভাইকে নিয়ে ঢুকতে যাবে,এমন সময় ডাক্তার কড়া গলায় সাব্বিরকে বলেছে,"শুধু রোগী ভেতরে আসবে,আর কেউ না”। সাব্বিরের খুব অপমান লাগছে। সে নিজেও ডাক্তার,শুধু যে তাই না—এখানকার মেডিকেল কলেজের লেকচারার--এই তথ্যটা ডাঃ কুদ্দুস হামিদের মুখের উপর বলে আসতে পারলে একটু শান্তি লাগত। কিন্তু সব জায়গায় সব কথা বলা যায়না। সাব্বির এখন বসে বসে বিরক্ত মুখে হাই তুলছে। পনেরো মিনিট হয়ে গেল দুলাভাইয়ের বের হ্ওয়ার কোন নাম নাই।
“কয়টা বাজ়ে মামা?”
“এগারটা। ক্ষুধা লেগেছে? দুপুরের মধ্যেই তোমাদেরকে বাসায় রেখে আসব,মা।"
তন্বী গুরুগম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল। মেয়েটা বুবু-দুলাভাইয়ের শেষ বয়সের মেয়ে। ছোট মেয়েরা যেমন আহ্লাদী হয়,তন্বী মোটেই সেরকম না। চুপচাপ একটা মেয়ে। কোনদিন গলা উঁচু করে কারো সাথে কথা বলেনি। সবার বড় আদরের এই মেয়েটা।
কিছুক্ষণ পর সাব্বির দেখল দুলাভাই ফাইল হাতে আউটডোর থেকে বের হচ্ছেন। সাব্বির ঊঠার জন্য দাঁড়াতেই তন্বী হাত ধরে টান দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল,"মামা,উনি অনেকক্ষণ ধরে তোমার দিকে তাকিয়ে আছেন।"
সাব্বির তন্বীর দৃষ্টি অনুসরণ করে যাঁর দিকে তাকাল তাঁকে দেখে নিতান্ত-ই একজন ভদ্রমহিলা মনে হচ্ছে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সাব্বিরের যে জিনিসটা চোখে পড়ল,সেটা হচ্ছে মহিলা প্রেগনেন্ট। সাব্বির মনে মনে একটু অপ্রস্তুত হল। তার আসলে স্বভাব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মহিলার পেটের দিকে চোখ পড়ার কোন কারণ ছিল?
-------------
নিশাত আলমের জন্য ডায়াবেটিক চিনি কিনতে এসেছিল বারডেমে। চিনি কেনার পর মনে হল,কয়েকদিন যাবৎ চোখে সমস্যা হচ্ছে। চোখটা আঊটডোরে দেখিয়ে গেলে মন্দ হয়না। আউটডোরে চোখ দেখিয়ে যখন বের হতে যাবে,তখন চোখে পড়ল সাব্বির একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আর একটা পিচ্চি মেয়ের হাত ধরে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলছে,”স্যার আসব?” ডাক্তার বিরক্তমুখে বললেল,"শুধু যিনি রোগী তিনি ভেতরে আসেন,সবার আসার দরকার নাই।" সাব্বির সাথে সাথে মুখটা বাংলা পাঁচের মত করে ফেলল। নিশাত এই মুখের সাথে পরিচিত। মেডিকেলে স্যাররা একটু ঝাড়ি দিলেই সাব্বির মুখটা এরকম করে ফেলত। নিশাতের কেমন একটা ছেলেমানুষী হাসি পেয়ে গেল সাব্বিরের ভ্যাবাচেকা মুখের দিকে তাকিয়ে। সাব্বিরকে এক দেখাতেই চিনে ফেলা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। কারণ,সাব্বিরের মাথার সামনে দুই-তিনটা পাকা চুল দেখা যাচ্ছে,আউলা-ঝাউলা চুলগুলো কেটে সমান করা। আগের চেয়ে বেশ মোটা হয়েছে সাব্বির। তারপর্ও এত সহজে ওকে চেনা যায় মুখে ঝিলিক দেওয়া ঔদ্ধত্য মেশানো ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকা হাসিটার জন্য। আশ্চর্য ব্যাপার! এতদিন পর সাব্বিরের সাথে দেখা হয়ে যাবে এভাবে—এটা কখনো ভাবেনি নিশাত। সাব্বিরের কথা মনে হতেই অপরাধবোধে কেঁপে ঊঠে সে।
অনেকক্ষণ ধরে সাব্বিরকে পর্যবেক্ষণ করল নিশাত। তার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ ছিল মানুষটা সাব্বির না। কিন্তু সাব্বির যখন পিচ্চি মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে নিশাতের দিকে তাকাল,নিশাত বুঝে গেল—কোন ভুল নেই। সাব্বির-ই। হ্যাঁ,সাব্বির-ই তো! নিশাত এগিয়ে গেল তাদের দিকে।
“আপনি—আপনি সাব্বির হোসেইন?”
সাব্বির অবাক চোখে মহিলার দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগল যে এই কন্ঠস্বর তার চেনা। একবার মেঝের দিকে তাকিয়ে সাব্বির আবার মহিলার দিকে তাকাল। একটা আবছা ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বারডেমের হইচই,পেসেন্টের ভীড় সব কিছু ছাপিয়ে সাব্বিরের চোখে ভাসছে লম্বা চুলের একটা প্রানবন্ত মেয়ের ছবি। সেই মেয়েটা এখন মহিলা হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর ভেঙ্গে গেছে,চোখ কোটরাগত,লম্বা চুলগুলো ঊঠে সামনের দিকটা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। রোগা শরীর ছাপিয়ে চোখে পড়ছে উঁচু পেট! কতদিন পর তার সাথে দেখা হচ্ছে! ছয় বছর,নাকি তারও কিছু বেশি সময় পর?!
“নিশাত!”
“যাক! চিনতে পেরেছ তাহলে! আমার তো পুরোনো কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তোমার সাথে অনেকদিন পর দেখা হল। কাউসার,হেনা,মাসুম ওরা কেমন আছে জানো?”
“হেনা কানাডায় চলে গেছে বিয়ের পর। কাউসার পিজিতে আছে। পোষ্টগ্রাজুয়েশন শেষের পথে। টুকটাক পেসেন্ট দেখে।"
“আর তুমি? কি করছ এখন? বিয়ে করেছ?”
“আমি বারডেমেই আছি। এখানকার কলেজের এনাটমি লেকচারার। এমফিল করছি মাইক্রোতে। আর নাহ! বিয়ে করিনি। তোমার কি খবর?”
“এই তো আছি! পিচ্চিটা কে? ভারী মিষ্টি দেখতে।” নিশাত তন্বীর রেশম চুলে হাত বুলায়।
“আমার ভাগনী। বুবুর মেয়ে।"
নিশাতের সাথে কথা বলতে বলতে ছাতা হাতে ভেজা জামাতে কয়েকটা মানুষকে বারডেমের ভেতরে ঢুকতে দেখে বিরক্ত গলায় সাব্বির বলে ফেলল,"ধুরো! বৃষ্টি হ্ওয়ার আর সময় পেলনা। এখন সিএনজি কই পাব?”
“তোমরা কোথায় যাবে?”
“মগবাজার। বুবুর বাসায়।"
“আমার সাথে গাড়ি আছে। তোমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে আসি? আমি মোহাম্মদপুরে থাকি।"
“না,না নিশাত। আমরা চলে যেতে পারব।" সাব্বির কিছুটা রুষ্ট হয়। গাড়ি তো নিজের না,জামাইয়ের। সেইটা নিয়ে ফুটানি!
“সাব্বির,তোমার ফোন নাম্বারটা দেওয়া যাবে? ডাক্তার মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখাটা ভাল।"
সাব্বির একটু ইতস্তত করল। নিশাতকে ফোন নাম্বার দিতে ঠিক ইচ্ছা করছেনা। কোন ঝামেলায় পড়ে কে জানে? নিশাত সাব্বিরের ইতস্তত মুখ খেয়াল করছিল হয়ত। সে শান্ত স্বরে বলল,"তোমার দিতে ইচ্ছা না করলে থাক।"
এই কথার পর আর ফোন নাম্বার না দিয়ে উপায় থাকেনা। সাব্বিরের মোবাইল নাম্বারটা নিজের ফোনে সেভ করে নিশাত তন্বীকে আদর করে দিয়ে চলে গেল। নিশাতের হাঁটার ভঙ্গিটা এত ক্লান্ত!
----------------
সাব্বিরের দুলাভাই রহমত তালুকদার আউটডোরের সামনের বেঞ্চে বসে বসে সাব্বিরের সাথে মেয়েটার কথা বলা দেখছিলেন। সাব্বির ফিরে আসতেই সাব্বিরের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,"নারীঘটিত ব্যাপার নাকি,শালা?”
সাব্বির ভ্রু কুঁচকে দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল,"আমার পুরোনো বন্ধু।"
--------------
সাব্বিরের মাথা টনটন করে ব্যথা করছে। দুই কাপ চা আর একটা নাপা খেয়েও মাথা ব্যথা কমছে না। কাজের এত চাপ! পরীক্ষার খাতাগুলো দেখা শেষ করতে হবে। নিজের কিছু পড়াশোনা আছে। এর মধ্যে হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। নিশ্চয় শোয়েব ফোন করেছে থিসিসের ব্যাপারে। দরকারের সময় মানুষ হাজারবার ফোন করে। অন্য সময় খবর-ই থাকেনা। আজকাল মানুষ বড় স্বার্থপর! মোবাইলের স্ত্রীণে ভেসে ঊঠা নাম্বার না দেখেই ফোন ধরে সাব্বির বলল,"হ্যালো শোয়েব।"
“সাব্বির বলছেন?”
“জ্বী বলছি। আপনি কে বলছেন?”
“আমি—ইয়ে,আপনি আমাকে আসলে চেনেন না ভাই। আমি মুহিবুল্লাহ আলম বলছি।"
সাব্বিরের মেজাজ চরম খারাপ হল। সে তার চৌদ্দগুষ্টিতে মুহিব্বুল্লাহ আলমের নাম শোনে নাই। কাজের সময় বিরক্ত করার মানুষের অভাব নাই। সাব্বির কড়া গলায় কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। বয়স হচ্ছে,এখন এত অল্পে রাগারাগি ভাল না। সাব্বির অমায়িক গলায় বলল,''বলেন ভাই,মুহিবুল্লাহ আলম—আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?”
“আমি নিশাতের হাসবেন্ড। নিশাতকে চিনতে পারছেন?”
সাব্বির সব নাম ভুলে যেতে পারে—এই একটা নাম ছাড়া। তারপর ও গম্ভীর গলায় সাব্বির বলল,"কোন নিশাত,রাজশাহী মেডিকেলের?” মনে মনে ভাবল,না জানি আবার কোন ঊটকো ঝামেলায় ফেলে মেয়েটা! সারা মেডিকেল লাইফ তাকে জ্বালিয়েছে,অপরাধবোধে ভুগিয়েছে—এখন আবার হাসবেন্ড দিয়ে জ্বালাবে মনে হচ্ছে!
“জ্বী,রাজশাহী মেডিকেলের নিশাত। ভাই,ওর লেবার পেইন ঊঠেছে। এখন উইমেন্স এন্ড চাইল্ড কেয়ার হসপিটালে আছে। আমাকে আপনার ফোন নাম্বারটা দিয়ে বলল,একবার আপনাকে দেখতে চায়। কষ্ট করে একবার আসবেন ভাই,প্লীজ?"
সাব্বির বিরক্তির সব সীমা অতিক্রম করল। লে বাবা! তোর লেবার পেইন ঊঠেছে তো আমি কি করব? আমি কি গাইনীর ডাক্তার নাকি? আর এ আবার কেমন স্বামী? বউয়ের পুরোনো বন্ধুকে ফোন করে দেখা করার জন্য আসতে বলছে?
সাব্বির ঠান্ডা গলায় বলল,"মুহিবুল্লাহ আলম ভাই,আমি তো এখন আমার কলেজে। আজকেই পরীক্ষার খাতা সাবমিট করার শেষ তারিখ। কখন আসতে পারব বলতে পারছিনা। তিনটার পর আমি আবার দুইটা ছোট ল্যাবে প্রাকটিস করি। আসতে দেরি হবে। আপনি হাসপাতালের ঠিকানাটা দিয়ে দিন। আমি সময় করে আসব। আসতে দেরি হলে একবারে আপনাদের সন্তানের সাথেও দেখা হয়ে যেতে পারে।"
আলম হাসপাতালের ঠিকানাটা দিয়ে ফোন কেটে দিল। গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক থেকে। তাঁর ধারণা ছিল,নিশাত সাব্বিরকে দেখতে চাচ্ছে শুনে সাব্বির গভীর আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসবে। নিশাতের পাশে বসার জন্য ব্যকুল হবে। সাব্বিরের থেকে এতটা উদাসীনতা আলম আশা করেনি। এরকম অহংকারী ছেলেকে নিশাতের মত মায়াবতী একটা মেয়ে ভালবেসেছিল কি করে? আলমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিশাত মেয়েটা বড় ভাল! বড় ভাল মেয়ে!
------------
খাতা দেখা শেষ করে মার্কস শীটে নাম্বার তোলার সময় একটা রোলে সাব্বিরের চোখ আটকে গেল। জান্নাতুস সাবিহা সামিহা। রোল তেরো। মেয়েটা চার নাম্বারের জন্য এনাটমিতে ফেল করেছে। হঠাৎ সাব্বিরের ভেতরটা কেমন যেন হয়ে গেল। নিশাতের রোল ছিল তেরো। নিশাতের সাথে খারাপ কিছু হলেই নিশাত বাচ্চা মেয়েদের মত ঠোট উলটে ফেলে বলত,"আমি জানতাম এরকম হবে। আমার রোল যে আনলাকি থার্টিন।" নিশাতের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বড় ভয় হয় সাব্বিরের। তবুও দাঁড়াতে হবেই আজ! চেপে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বুক থেকে বের করে দিয়ে সামিহার খাতায় চার নাম্বার বাড়িয়ে দিয়ে সাব্বির ছুটে গেল এনাটমির হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্ট সুলতানা বানুর কাছে।
“ম্যাডাম,আজকে সেকেন্ড ইয়ারের সাথে আমার যে ক্লাসটা ছিল,সেটা নিতে পারবনা। আমার এক বন্ধু খুব অসুস্থ,হসপিটালে যেতে হবে এক্ষুনি।"
সুলতানা বানু কোনদিন সাব্বিরের এরকম উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখেননি। উনি সাথে সাথে সাব্বিরের ছুটি মঞ্জুর করে দিয়ে বললেন,"ঠিকাছে,তুমি যাও। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস আমি নিয়ে নিব।"
সেদিন সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেমেয়ের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। আজকে সাব্বির স্যার নাকি ক্লাস নিবেন না। সাব্বির স্যারকে ছেলেমেয়েদের কেউ পছন্দ করেনা। উনি আইটেমে ইচ্ছা করে নাম্বার কম দেন,অযথা সব ছাত্র-ছাত্রীকে গালিগালিজ করেন। লোকটা বড় কাঠখোট্টা!
--------------
ট্রাফিক জ্যামে দুই ঘন্টা বসে থেকে সাব্বির উইমেন্স এন্ড চাইল্ড কেয়ারের সামনে পৌছাল। নিশাত আছে ৫১২ নং কেবিনে। লিফট দিয়ে পাঁচ তলায় ঊঠে ৫১২ নং কেবিনের দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখল চশমা পড়া একজন ভদ্রলোক বিষন্ন ভাবে বসে আছেন। সাব্বিরকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে এসে বলল,"আসেন ভাই। আপনি-ই তো সাব্বির,তাই না?”
“জ্বী। আপনি মুহিবুল্লাহ আলম। নিশাতের হাসবেন্ড।"
“আমাকে আলম বললেই হবে। নিশাতের কনডিশন ভাল না। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। ওকে ওটিতে নিয়ে গেছে।"
“বলেন কি?”
“জ্বী। তিতলী আর আমার মামী শাশুড়ি মানে তিতলীর আম্মা আছেন ও.টি-র সামনে। আমি আপনার জন্য-ই এখানে অপেক্ষা করছিলাম।"
তিতলী নামটা শুনে সাব্বির চমকে ঊঠে ঊঠল। তিতলী কেমন আছে? কতদিন হয়ে গেল তিতলীর সাথে দেখা নাই। কি করছে এখন? তিতলী-নিশাত কারো কোন খোঁজ নেওয়া হয়নি আর কখনো।
“সাব্বির সাহেব,নিশাত আপনাকে একটা চিঠি লিখেছে। এটা লিখার পরপর-ই তার লেবার পেইন ঊঠে। আপনাকে নিজের হাতেই দিতে চেয়েছিল,কিন্তু আপনি আসতে দেরি করলেন দেখে আমার হাতে দিয়ে তারপর ও.টি-তে ঢুকেছে।"
আলম ভাঁজ করা কাগজটা বাড়িয়ে দিল সাব্বিরের দিকে। সাব্বির প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে কাগজটা খুলল। ভেতরে নিশাতের গোটা গোটা হাতের লেখা ভেসে আছে। সাব্বিরের নিরাসক্ত চেহারাতে এই প্রথম আগ্রহের ছাপ দেখল আলম।
----------------
“সাব্বির,
কেমন আছিস? কতদিন পর তোকে আবার তুই সম্বোধন করছি। জানি,তুই আমার উপর অনেক রেগে আছিস। আমাকে কোনদিন তুই ক্ষমা করতে পারবিনা তাও জানি। তারপর ও এই চিঠিটা লিখছি। তোর জন্য। তোকে যে অনেক কথা বলার ছিল!
তুই নিশ্চয় ভুলে যাসনি,ছয় বছর আগে আমরা পরস্পরকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। না,তুই না—আমিই তোকে বলেছিলাম বিয়ের কথা। আমাদের আক্কাস মিয়ার চায়ের দোকানের কাছে আসার কথা ছিল। রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে করার কথা ছিল! কি সুন্দর স্বপ্নের মত দিনগুলো। কিন্তু আমি,হ্যাঁ আমি নিজেই সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছিলাম আমাদের। আক্কাস মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে অক্টোবরের ২২ তারিখ সন্ধ্যায় আমি আসিনি। আমি জানি,তুই এসেছিলি—হয়ত দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একসময় ফিরে গেছিস। পরে তিতলী বা অন্য কারো কাছে শুনেছিস আমার বিয়ে হয়ে গেছে অন্যকোন পুরুষের সাথে। খুব জানতে ইচ্ছা করে কতটুকু কষ্ট পেয়েছিলি তুই? অনেক বেশি? আমার চেয়েও বেশি?
আলমের সাথে ২৩ তারিখ সকালেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। আব্বা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন। অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম,লাভ হয়নি। বিয়ের প্রথম দিন-ই আমি আলমকে সব খুলে বলি-তোর কথা। আলম শান্ত ভাবে বলেছিল,ঠিকাছে নিশাত। সময় তোমাকে সব ভুলিয়ে দিবে। সাব্বিরকে ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। আমাকে তোমার খারাপ লাগবেনা দেখো।“ আলমের কথাই ঠিক ছিল। আলম ছিল একজন শ্রেষ্ঠ স্বামী,দায়িত্ববান,ভদ্র,হাসিখুশি একটা ছেলে। পৃথিবীর যেকোন মেয়ে আলমকে বিয়ে করে সুখী হতে পারত। কিন্তু আমি পারিনি। আলমকে অনেক কষ্ট দিয়েছি,অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। কেন জানি মনে হত আলম এত ভাল কেন? এত ভাল মানুষ তো আমার দরকার ছিলনা। আমার দরকার ছিল উড়নচন্ডী তোকে,তোর অবহেলাগুলো—যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা,যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা। তোকে ভুলতে পারিনি কখনোই। অথচ ভুলে যাওয়া দরকার ছিল। আলমের জন্য-ই। কিংবা তিতলীর জন্য।
তিতলীর কথা শুনে অবাক হচ্ছিস নিশ্চয়-ই। আমাদের তিতলী। সেই পিচ্চি মেয়েটা! কখনো কি বুঝতে পেরেছিলাম সেই পিচ্চি মেয়েটাই তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে? তুই বুঝেছিলি? যখন পালিয়ে বিয়ে করে ফেলার চিন্তা করলাম,সবার আগে তিতলীকে জানালাম। তারপর তোকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম আক্কাস ভাইয়ের হাতে। তিতলী কি করেছিল জানিস? আব্বাকে ফোন করে বলেছিল,নিশাত আপা আজ সন্ধ্যায় একটা বখাটে ছেলেকে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলবে। আব্বা সন্ধ্যার মধ্যে ছুটে এসেছিল রাজশাহীতে। আমাকে নিয়ে এসেছিল ঢাকায়। পরের দিন বিয়ে হয়েছিল আলমের সাথে। আমি আক্কাস ভাইয়ের দোকানের সামনে আসতে পারিনি ঠিক এই কারণেই। এই কথাগুলো তোকে বলা দরকার ছিল সাব্বির। গত ছয় বছর আমি তোকে ঠকানোর জন্য তীব্র অপরাধবোধে ভুগছি। সেদিন বারডেমে দেখা না হলে অপরাধবোধটা হালকা করার জন্য তোকে খুঁজে পেতাম না।
মেডিকেলে আমার রোল ছিল আনলাকি থার্টিন। তার প্রভাব পড়েছে আমার সারাটা জীবন ধরে। তোকে চেয়েছিলাম নিজের মত করে,পাইনি। মেডিসিনে ফেল করার পর আর পড়াশোনা করতে পারলাম না। রাজশাহী মেডিকেলে ফিরে যাওয়া হলনা। আমার শাশুড়ি আম্মা চাননি আমি পড়ালেখা করি। শাশুড়ি আম্মার মৃত্যুর পর আলম খুব করে বলেছিল,আবার পরীক্ষা দাও। দিলাম না। ডাক্তার হ্ওয়ার স্বপ্নের ওখানেই ইতি। বিয়ের পর আমার প্রথম সন্তান জন্মের সময় সিড়ি থেকে পড়ে গেলাম পা পিছলে। আমি বেঁচে গেলাম। আমার বাবুটা মরে গেল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম,খুব। শরীর তারপরেই ভেঙ্গে গেল। চুল পড়ে গেল। সেই সময় আলম সবসময় আমাকে আগলে রেখেছিল,ভালোবেসেছিল। এই সন্তান আমার দ্বিতীয় সন্তান। ডাক্তার খুব সাবধানে থাকতে বলেছে আমাকে। পেটের মধ্যে হাত দিলেই আমার প্রথম বাবুটার কথা মনে পড়ে। আমি একা একা কাঁদি। কষ্ট রে সাব্বির! খুব কষ্ট!
তোর মনে আছে? অনেকদিন আগে তুই বলেছিলি,আমার আর তিতলীর মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল আছে? মিলটা সেদিন তোকে বলিনি। আজ বলি,আমাদের দু’বোনের মধ্যে মিল হল—আমরা পাগলের মত ভালোবাসতে পারি। তিতলীর উপর বহুদিন অভিমান করে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত পারিনি। একদিন বুকে টেনে বললাম,”কেন ঐদিন আব্বাকে সব বলে দিয়েছিলি তিতলী?” তিতলী বাচ্চা মেয়েদের মত কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,” সহ্য করতে পারতাম না নিশাত আপা। সাব্বির ভাইকে তোমার সাথে দেখলেই মনে হত বিষ খেয়ে মরে যাই।“ চিন্তা করতে পারিস,ঐটুকুন মেয়ে আমাদেরকে মেডিকেলে সব সময় একসাথে দেখে কত কষ্ট-ই না পেত! কাউকে বুঝতে দেয়নি কিচ্ছু! আমি তিতলীকে সেদিনের পর থেকে মাফ করে দিয়েছি। তুইও মাফ করে দিস সাব্বির। তিতলী আজো তোর জন্য দু’হাত ভর্তি ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছে। ওকে ফিরিয়ে দিসনা প্লীজ।
এই লেখাটা লেখার পর অনেকখানি হালকা হলাম। ছয় বছর আগে অক্টোবরের ২২ তারিখ আমি তোর কাছে থাকার জন্য,তোর পাশে থাকার জন্য ছুটে আসতে পারিনি। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ ও করিনি। সেই অপরাধবোধ এখন কিছুটা কম মনে হচ্ছে। এই চিঠি তোর হাতে কখন পৌঁছাতে পারব জানিনা। ভাল থাকিস সাব্বির। তিতলীর সাথে দেখা করিস। ওকে কাছে টেনে নিস।
ইতি-
তোর পাশে সবসময় থাকতে চাওয়া বন্ধু—নিশাত।"
--------------
সাব্বির চিঠি পড়া শেষ করে আলমের দিকে মুখ তুলে তাকাল। মানুষটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“আপনি এই চিঠিটা পড়েছেন আলম ভাই?”
“হ্যাঁ,নিশাত পড়তে বলেছিল। আমার কাছে ও কোনদিন কোন কিছু গোপন করেনি। কিচ্ছু না!”
সাব্বির নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,”নিশাতের যখন বেবীটা হবে আলম ভাই—আমি নিজে ওকে যেয়ে বলব,তুই কোন অপরাধবোধে ভুগিস না।"
“কেন?”
“কেন জানেন আলম ভাই? কারণ অপরাধবোধ আমার হ্ওয়ার কথা। নিশাত যদি ২২ অক্টোবর আক্কাস মিয়ার দোকানের সামনে যেত-,সে আমাকে পেতনা। কিন্তু একটা ছোট কাগজ পেত আক্কাস ভাইয়ের কাছে। কাগজে আমি লিখে রেখেছিলাম,আমাকে ক্ষমা করিস,নিশাত। আমি হেরে গেছি। আমি আসতে পারলাম না। তোকে বিয়ে করা হলনা।"
আলম শূন্য দৃষ্টিতে সাব্বিরের দিকে তাকাল। সাব্বিরকে বিয়ে করতে না পারার অপরাধবোধ ছয় বছর ধরে নিশাতকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে।
--------------
তিতলী ও.টির সামনে ক্লান্ত ভাবে বসে আছে। নিশাত আপাকে ও.টিতে নিয়ে গেছে এক ঘন্টা আগে। এখনো কোন ডাক্তার বের হয়নি। আপার খুব ব্লিডিং হচ্ছিল। এই বাচ্চাটাও মরে গেলে আপা বাঁচবেনা।
“তিতলী!”
“আমি জানতাম সাব্বির ভাই,আপার কথা শুনে আপনি আসবেন-ই।"
তিতলী মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। ডাক্তার ও হয়ে গেছে মনে হয় এতদিনে। মুখে আগের সেই কিশোরীসুলভ চপলতা নেই। সাব্বির তিতলীর পাশে বসল। তিতলীর চোখ-মুখ ফুলে আছে। অনেক কান্নাকাটি করেছে দেখলেই বুঝা যায়।
“মামী কোথায় তিতলী?”
“আম্মা জায়নামাজে দাঁড়িয়েছে। আপার জন্য নামাজ পড়ছে।"
“তোমার আপা আমাকে একটা চিঠি লিখেছে। তোমার কথাও আছে। পড়তে চাও?”
“না। আমি জানি আপা কি লিখেছে সাব্বির ভাই। নিশাত আপা রাগ করে আমার সাথে এক বছর কথা বলেনি। আমি পাপ করেছিলাম। আমি আপার সাথে একটা বড় ধরনের অন্যায় করেছিলাম।"
তিতলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
-----------
ও.টির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন সার্জন হাসিবুর রাহমান। মুহিবুল্লাহ আলমের সাথে কথা শেষ করেই উনি আবার ভেতরে ঢুকে গেলেন।
-----------
আলম সাব্বির আর তিতলীর কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর তিতলীর দিকে তাকিয়ে বলল,"তিতলী,আমার আর তোমার আপার একটা ছেলে হয়েছে। ছেলেটা ভাল আছে। কিন্তু আমাদের এখন একটা খারাপ সংবাদ পেতে হবে,বোন।"
সাব্বির,তিতলী দু’জনেই চমকে আলমের দিকে তাকাল। একজন পরাজিত মানুষের ছাপ তাঁর চোখে-মুখে।
তিতলী হাউমাউ করে কেঁদে ঊঠল। সাব্বিরের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। ঝাপসা চোখেই সে দেখতে পেল নিশাত যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উলটে বলছে,"দেখলি সাব্বির! বলেছিলাম না! বলেছিলাম না সব রোল থার্টিনের দোষ!”
তিতলীর কান্না কিছুতেই থামছে না। সাব্বির তিতলীর মাথায় ভালোবাসার হাত রেখে বলল,"কেঁদো না,তিতলী। পূন্যবতী মানুষের জন্য আমাদের মত পাপীদের কাঁদতে নেই।"
------------
হাসপাতালের মসজিদে মাগরিবের আযান দিচ্ছে। সেই আযানের ধ্বণিতে একটা মাতৃহারা নবজাতকের কান্নার চিৎকার ঢেকে গেল।
(সমাপ্ত)
পিডিএফ লিঙ্ক। লেখাটির পিডিএফ করে দেওয়ার জন্য ব্লগার রাতমজুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১০:১৫