তুই কি আসলেই ঠিক করে ফেলেছিস ওয়ার্ড ফাইনাল দিবিনা?
হুঁ।
হুঁ আবার কেমন কথা?
সাব্বির দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলা ঘাসের ডগাটা মুখ থেকে থুঃ করে ফেলে দিয়ে বলল,"হুঁ মানে হ্যাঁ। হ্যাঁ মানে হচ্ছে এবার আমি কোন ফাইনাল-ই দিবনা। তুই এখন ভ্যাজর ভ্যাজর না করে এখান থেকে ভাগ।"
নিশাতের মুখটা অপমানে লাল হয়ে গেল। তবুও সে শান্ত গলায় বলল,"ঘাসটা থুঃ করে আমার জামার উপর না ফেললেও পারতি। ঘাসে তোর থুথু লেগে আছে। সাব্বির,তুই কোন কারণে আমার উপর রেগে আছিস। কারণটা কি?”
সাব্বির নিশাতের কথা শুনে হাত দিয়ে একটা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল। তারপর আক্কাস মিয়ার চা’এর দোকানের দিকে মুখ করে উদাস গলায় বলল, “তোর উপর রাগের কোন কারণ নাই নিশু। তুই বিদায় হ।"
এই কথার পরে অন্য কোন মেয়ে হলে বিদায় হয়ে যেত। কিন্তু সাব্বিরের কেন জানি মনে হয় নিশাতের মান-অপমান বোধ বেশ কম এবং সে কিছুটা হাবা টাইপের মেয়ে। সাব্বিরের সেই ধারণাকে সত্য প্রমাণ করতেই নিশাত সাব্বিরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে গেল।
“নিশাত,তুই কি কিছু বলবি? আমি একটু একা থাকব।
“পরীক্ষা দিবিনা কেন?
“প্রিপারেশন ভাল না—এই নিয়ে দশবার তোকে কথাটা বললাম।“
“আমি তোকে পড়িয়ে দেই সাব্বির?”
“শোন নিশাত,স্বয়ং আশফাক স্যার আমার ক্লাস নিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিলেও আমি পরীক্ষা দিবনা। তুই যা।"
নিশাত প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে একবার সাব্বিরের দিকে তাকাল। তারপর আর কিছু না বলে হোষ্টেলের দিকে হাঁটা দিল। সাব্বিরকে বুঝিয়ে লাভ নাই। নিজে যেটা ভাল বুঝে সেটাই করবে। সাব্বির ক্লাসের ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের একজন। কিন্তু সে তার মেধাকে নষ্ট করছে খামখেয়ালীপনায়। মেডিকেল ষ্টুডেন্টদের মধ্যে যে রেগুলারিটি থাকা দরকার তার সিকি ভাগ-ও সাব্বিরের মধ্যে নাই। এইরকম অহংকারী,খামখেয়ালী একটা ছেলেকে খুব বেশি পছন্দ করার কোন মানে হয়? কোন মানে হয় না! নিশাত এদিক ওদিক তাকিয়ে সাবধানে ওড়নায় চোখের পানি মুছে। চোখের পানি কেউ দেখে ফেললে কি লজ্জার-ই না একটা ব্যাপার হবে! এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কান্নাকাটি করছে—এর মত হাস্যকর আর কিছুই নাই।
-----------------
সাব্বিরের এখন একটু একটু মন খারাপ লাগছে। নিশাতকে এত কড়া ভাবে না বললেও হত। মেয়েটা ভাল। শুধু যে ভাল তাই না,বেশ ভাল। মেয়েদের যত রকম প্যানপ্যানে বৈশিষ্ট্য থাকে—সব-ই নিশাতের মধ্যে আছে। তারপর্ও নিশাত মেয়েটা বেশ আলাদা। ঢং নাই, আলগা ফ্যাশন নাই। মেয়েটার বুদ্ধি কম,কিন্তু পড়াশোনায় প্রচুর সিরিয়াস আর পরিশ্রমী। এরকম মেয়েরা জীবনে সাইন করে। সাব্বিরের কেন জানি মনে হয় নিশাত তাকে বড় ধরনের কোন ঝামেলায় ফেলবে। বোকা মেয়েরা ঝামেলা করে বেশি। নিশাত বোকা। কাজেই নিশাত ও ঝামেলা করবে। ঝামেলাটা অবশ্য-ই প্রেম-প্রীতি বিষয়ক হবে। সাব্বিরের দৃঢ় ধারণা নিশাত তাকে পছন্দ করে। কিন্তু বলার সাহস পায়না।
সাব্বিরের মধ্যে একটা ঔদাসীন্য আছে। সব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত থাকার এই ক্ষমতার জন্য-ই কিনা কে জানে,সবাই সাব্বিরকে সবাই খুব ভালবাসে--সেই ভালবাসার সাথে একটা সমীহও মিশে থাকে। কঠিন কোন স্যারের কাছে ভাইবা দেবার আগে সবাই যখন পড়তে পড়তে মাথার চুল তুলে ফেলছে,তখন দেখা যেত সাব্বির কাঁথা মুড়ি দিয়ে হোষ্টেলে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। যেন পৃথিবীর কোন কিছুতেই সাব্বিরের কোন যায় আসেনা।
এইবার সাব্বির ঠিক করেছে সে সার্জারী ওয়ার্ড ফাইনাল দিবেনা। ওয়ার্ড ফাইনাল না দিতে চাওয়ার কারণটাও বেশ অদ্ভূত। কয়েকদিন আগে সার্জারী ক্লাসে আশফাক স্যার সাব্বিরকে বলেছেন,"তুমি তো ছেলে কাঁচিও ঠিক মত ধরতে পার না। তুমি যেভাবে কাঁচি ধরেছ,এইভাবে নাপিতেরা কাঁচি ধরে। তাহলে আর সার্জারী ক্লাস করার দরকার কি? নাপিত হইলেই পার।"
ক্লাসের সবাই বলাবলি করছে এই কথাটা নাকি সাব্বিরের খুব গায়ে লেগেছে। এজন্য-ই সে পরীক্ষা দিবেনা। যদিও সাব্বির নিজে থেকে এটা নিয়ে কিছু বলেনি।
------------------
বিকাল হয়ে আসছে প্রায়। সাব্বির হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে মাঠ থেকে উঠে দাঁড়াল। আক্কাস মিয়ার দোকানে বেশ কিছু টাকা বাকী পড়েছে। আক্কাস মিয়া অবশ্য হাসতে হাসতে বলেছে,"কুন সমস্যা নাই ভাইজান। আপনে যেদিন পারেন,হেইদিন ট্যাহা ফেরত দিয়েন। লন,এখন বইয়া এক কাপ চা খান।" কিন্তু তবুও তো আক্কাশ মিয়া গরীব মানুষ। তার কাছে এতগুলো টাকা বাকী রাখা ঠিক হচ্ছেনা। সাব্বির ঠিক করল আজকে হাসান ভাইয়ের মেসে একবার যাবে। হাসান ভাইয়ের কাছ থেকে সে কিছু টাকা পায়। যদি সেটা পাওয়া যায়। হাত একেবারে ফাঁকা। বুবুও এই মাসে টাকা পাঠায়নি। অবশ্য বুবুও বা প্রতি মাসে নিয়ম করে টাকা পাঠাবে কিভাবে? দুলাভাই হাত খরচের জন্য যা দেয়,সেটা বাঁচিয়ে বুবু টাকা পাঠায়। মাঝে মাঝে বাবা টাকা পাঠায়। সেটাও তিন-চার মাস পর একবার। অর্থকষ্ট বড় কষ্ট! সাব্বির দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
হোষ্টেলে ফিরে সার্জারী বইটা নিয়ে বসা দরকার। পরীক্ষা মিস দিয়ে লাভ নাই। নিশাত বেশ কষ্ট পাবে তাহলে। মানুষকে আজকাল আর কষ্ট দিতে ভাল লাগেনা সাব্বিরের। তার জীবনের অর্ধেক অংশ কেটে গেছে মানুষকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে। সে বাবাকে কষ্ট দিয়েছে,বুবুকে কষ্ট দিয়েছে,নিশাত যদি কোনভাবে তার বাউন্ডুলে জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়—তাহলে হয়ত সে নিশাতের মত হাবা মেয়েটাকেও কষ্ট দিবে।
হাসান ভাইয়ের মেসের দিকে যাওয়ার জন্য সাব্বির পা বাড়াতেই শুনল কে যেন খুব সুরেলা গলায় “সাব্বির ভাই! সাব্বির ভাই!” বলে ডাকছে। গলাটা পরিচিত মনে হচ্ছে। সাব্বির পিছন না ফিরেই গলাটা কার মনে মনে চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু বের করতে পারেনা। মেডিকেলের ফিফথ ইয়ারেই এই অবস্থা হলে বুড়া বয়সে স্মৃতিশক্তি কই যাবে—এটা চিন্তা করে সাব্বির বেশ বিরক্ত হয় নিজের উপর। ততক্ষণে সুরেলা কন্ঠস্বর কাছে চলে এসেছে।
“সাব্বির ভাই! কি এত ভাবেন ভ্রু কুঁচকে? সেই কখন থেকে ডাকছি!
"আরে তিতলী!"
সাব্বিরের মুখ হঠাৎ একশ ওয়াটের বাল্বের মত জ্বলে ঊঠে। এতক্ষণ মাথার মধ্যে টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তাগুলো মুহূর্তেই মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেল তার। তিতলীর গলার স্বর চিনতে না পারায় মনে মনে কিছুটা অনুতপ্তও হয় সাব্বির।
(চলবে)
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
শেষ পর্ব