আমি ভেবেছিলাম আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই ক্লাসের পড়া শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাব। রোজ রোজ রাত জাগতে ভাল লাগেনা। তাছাড়া আম্মু ঢাকার বাইরে গেছেন অফিসের কাজে। আম্মুর অনুপস্থিতিতে লক্ষী মেয়ে হয়ে চলাটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কিভাবে কি হল জানিনা,সারা বিকেল ফেসবুকে গুঁতাগুতি করে যখন পড়ার বই খুললাম তখন বাজে রাত দশটা।
গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়তে বসেছি,এমন সময় হঠাৎ করে একটা কাক “কা-কা” করে কেমন যেন আর্তচিৎকার করে উঠল। আমি খুব-ই অবাক হলাম। রাতের বেলা কাক ডাকে,তাও আবার এরকম আর্তচিৎকার করে—সেটা এই প্রথম শুনলাম। যাইহোক,ব্যাপারটাকে বেশি পাত্তা না দিয়ে আমি পড়া শুরু করলাম। মাঝে দুই-এক বার কাক ডেকে আমার পড়ার মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টা করছিল,কিন্তু গুরুত্ব দেইনি। পড়া শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। এখন ঘুমানো যায়। আড়াইটা বাজে প্রায়। আব্বু মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। আমি পা টিপে টিপে ডাইনিং রুমের দিকে গেলাম। যদি মুড়ি-টুড়ি কিছু বাসায় থাকে তাহলে উদরপূর্তি করা যাবে! ডাইনিং রুমের টেবিলের উপর রাখা টিনটাতে একটা ঝাঁকি দিলাম। ঠন ঠন করে টিনের মধ্যে শব্দ হল। যতটা জোরে হওয়া উচিত,তার থেকে অনেক জোরে। আমি একটু চমকে ঊঠলাম। টিনটা খুলে দেখলাম ফাঁকা। আশ্চর্য তো! এত জোরে শব্দ হ্ওয়ার কারণ কি? আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগল। গা ছম-ছমে একটা ভয়।
যেভাবে পা টিপে টিপে ডাইনিং রুমে গেছিলাম,সেভাবেই আমার নিজের রুমে ফিরে আসলাম। নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর ডিপ ডিপ করে শব্দ হতে লাগল। আমার ঘরটা আজকে অন্যরকম লাগছে। অনেক বেশি ঠান্ডা আর নীরব। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। চারপাশটা কেমন যেন নিকষ কালো হয়ে আছে। অন্যদিন সাধারণত আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলোতে অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে। আজকে সেই আলোর চিহ্নমাত্র নেই। এরকম তো কখনো হ্ওয়ার কথা না। ভাল করে আবার বাইরে তাকাতেই দেখি শোঁ শোঁ করে একটা শব্দ হচ্ছে। ঝড় হচ্ছে নাকি? বুঝতে পারছিনা। ঝড় হলে বাতাস থাকার কথা। কিন্তু বাইরে বাতাস নেই। শুধু শব্দ। শব্দটা তীব্র হচ্ছে ক্রমাগত। আমি আর বেশি কিছু চিন্তা না করে লাইট অফ করে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে গেলে দুনিয়ার সব ভয় ঠান্ডা। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর দেখি আর ঘুম আসেনা। চুপ করে শুয়ে আছি আর কি সব যেন আগামাথাহীন ভাবে ভাবছি। এমন সময় খাটের নীচ থেকে হঠাৎ হিসহিস শব্দ ভেসে এল! আতঙ্কে আমি একেবারে জমে গেলাম। খাটের নীচে উঁকি দেওয়ার চিন্তাটা মাথায় এসেই আবার মিলিয়ে গেল। এই মুহূর্তে খাটের নীচে উঁকি দেওয়ার মানেই নেই। তার চেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়াই উত্তম। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা,ভয়ংকর গোঙ্গানির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি নিথর হয়ে শুয়ে গোঙ্গানিটার উৎস খোজার চেষ্টা করছি। একবার মনে হচ্ছে খাটের নীচ থেকে শব্দ আসছে,আর একবার মনে হচ্ছে ড্রেসিং টেবিলের কাছ থেকে। এখন যে রাত কয়টা বাজে সেটাও বুঝতে পারছিনা। বাথরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু ভয়ে বিছানা থেকে ঊঠতে ইচ্ছা করছেনা। ভূত-প্রেতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই—আমি আসলে ভাবছি,খাটের নীচে চোর-টোর লুকিয়ে আছে কিনা! গোঙ্গানির শব্দ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আব্বু পাশের রুমে ঘুমাচ্ছে। একবার ভাবলাম আব্বুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। কিন্তু পরে মনে হল সেটা ঠিক হবেনা। এমনিতেই আব্বুর ব্লাড প্রেসার বেশি থাকে সবসময়। আর তাছাড়া আমি তো ভয়ে বিছানা থেকে নামতেই পারছিনা!
হঠাৎ হাতের মধ্যে কিসের যেন স্পর্শ পেলাম,ধাতব কিছু। জোরে চিৎকার দিতে যাব,এমন সময় বুঝতে পারলাম আমার মোবাইলটা নিয়ে শুয়েছি। ধড়ে প্রাণ ফিরে এল যেন। সাথে সাথে বাটন টিপে মোবাইলের টর্চটা জ্বালালাম। টর্চ দিয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার দিকে আলো ফেললাম। ঘড়িতে দুইটা চল্লিশ বাজে। এতক্ষণে মাত্র দশ মিনিট পার হয়েছে। আমি মাত্র দশ মিনিট আগে শুয়েছি! সব কিছু কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে আমার। আমি খুব সাবধানে টর্চের আলো মেঝের দিকে নিলাম। মেঝেতে রক্ত! মেঝেতে জমাট বেঁধে আছে রক্ত!
আমি কান্ডজ্ঞানহীন ভাবে বিছানা থেকে ঊঠে ছুটে গিয়ে রুমের দরজার নবে হাত রাখলাম। প্রচন্ড শক্তি দিয়ে নব ঘুরিয়েও দরজা খুলতে পারছিনা। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে,ঘুমানোর আগে আমি দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছি। বিড়বিড় করে সূরা পড়তে পড়তে নিজেকে প্রবোধ দিলাম আসলে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আমি যা ভাবছি,শুনছি, দেখছি সব মিথ্যা। মনে হয় বেশি বেশি হরর মুভি দেখার ফল। আমি চিৎকার করে আব্বুকে ডাকতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলনা।
ঘরের ভেতর জান্তব গোঙ্গানি বেড়েই চলেছে। সাথে কান ফাটানো শোঁ শোঁ শব্দ। আমি কোন কিছু চিন্তা না করেই ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। বাথরুমের লাইট অন করেই দেখি আমার পায়ের পাতা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে! আমি নিজেই বুঝতে পারছিনা আমার জ্ঞান আছে কি নাই? হঠাৎ চোখে পড়ল বাথরুমের এক কোণে বাক্সে রাখা ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ার জন্য কেনা bones গুলোর দিকে। এক কাজিনকে দেব দেখে সেগুলো আর বিক্রি করা হয়নি। কেমন জীবন্ত হয়ে আছে হাড্ডিগুলো! মনে হচ্ছে এক একটা bones জোড়া লেগে কঙ্কাল হয়ে এক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর! আমি যথাসম্ভব চিৎকার করে বাথরুম থেকে বের হয়ে আছড়ে পড়লাম লক হয়ে যাওয়া রুমের দরজার উপর! আব্বুউউউউউ বলে চিৎকার ঢেকে গেল জান্তব অট্টহাসিতে!
পিছনে ঘুরে দেখি ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ার সুবিধার জন্য সবগুলো হাতের আঙ্গুল জোড়া লাগিয়ে বাঁধানো কঙ্কালের হাত ভেসে আসছে আমার দিকে। কব্জির কাছ থেকে নাই হয়ে যাওয়া অংশটুকু থেকে টপটপ করে ঝরছে রক্ত। আমি আরেকবার চিৎকার দেওয়ার আগেই আমার কন্ঠরোধ করে ধরল কঙ্কালের কাটা হাত......
............................................................
রাতের বেলা যে কেউ মেয়েটাকে এক নজর দেখলে ভাববে মেয়েটা ভুল করে মেঝেতেই ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু ভোরের আলো যখন মেয়েটার মুখে এসে পড়বে,তখন সবাই দেখবে মৃতা মেয়েটার ঠান্ডা গলার কাছে কালসিটে পড়া,সেখানে রয়েছে সরু একটা হাতের ছাপ!
উৎসর্গঃ অবশ্য-ই জনপ্রিয় ভৌতিক গল্পকার ব্লগার ত্রিনিত্রি-কে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১১ রাত ১২:০১