প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
আসাদ যেরকম হুট করে নারায়নগঞ্জে এসেছিল,সেরকম ছয় মাস থাকার পর হুট করেই একদিন নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে গেল। তার তুষার ভাইয়ের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে ভাল লাগছিল না। তুষার ভাই ওকে অনেকবার থাকতে বলেছিলেন,আমার সামনেই বলেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই আসাদ রাজি না হ্ওয়ায় শেষে বন্ধুকে বলে আসাদের জন্য ঢাকায় একটা মেসের ব্যবস্থা করে দিলেন তখনকার মত। আসাদ নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকা আসার দিন সকালে আমিও আসাদের সাথে একই বাসে করে সানরাইজ যাব বলে ঠিক করে ফেললাম। বাসের মধ্যে আমি আসাদের চেয়ে অনেক আগে উঠলাম। তারপর পাশে আসাদের জন্য একটা জায়গা রেখে দিলাম। আসাদ বাসে ঊঠা মাত্র ডাক দিলাম—
--এ্যাই আসাদ! আসাদ!
--আরে নীতু! তুই কি করিস এই বাসে?!
--কোচিং যাব।
--তুই তো অন্য বাসে যাস।
--আজকে এই বাসে যাব। আয় আমার পাশে বস।
--তোর পাশে বসব?
--কি সমস্যা পাশে বসলে?! আমার পাশাপাশি হাঁটা যায় আর বসা যায়না? অপবিত্র হয়ে যাবি নাকি?
--না না,তা না।
আসাদ খুব-ই ধীরে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমার পাশে বসে গেল।
--বড্ড গরম রে বাসে!
--তোর গরম লাগছে নীতু? আমার কিন্তু লাগছে না। দ্যাখ জানালা দিয়ে কি সুন্দর বাতাস আসছে!
--ভাল। হাওয়া খাইতে থাক। আসাদ শোন,তুই এবার কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দিবিনা?
--নাহ! এই বছরটা পড়াশোনা করি নিজে নিজে। ভর্তি কোচিং ছাড়া কোথাও চান্স পাওয়া টাফ।
--হুম। ঠিক বলেছিস।
আমার মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। আসাদকে নিয়ে আমি এই কয়েক মাস অনেক স্বপ্ন বুনেছি একা একা। আসাদ এই একটা বছর লস দিলে আমার চেয়ে জুনিয়র হয়ে যাবে। ব্যপারটা মন থেকে মানতে পারছিলাম না কিছুতেই! বাস ছেড়ে দেওয়ার পর আসাদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। আমার দিকে ফিরেও দেখছেনা দেখে একসময় বিরক্ত হয়ে গেলাম।
--আসাদ! কথা তো বলবি। আবার কবে আমাদের দেখা হবে?
--দেখা হবেই। চিন্তা করিস না। নারায়নগঞ্জ আমি প্রায়-ই আসব। তুষার ভাইয়ের সাথে আমার অনেক কাজ।
--কি এত কাজ?
--বলা যাবেনা!
আসাদ হাসল। রহস্যময় হাসি। আমি ওকে আর ঘাঁটালাম না। একবার যখন বলা যাবেনা মুখ দিয়ে বের করেছে তখন কিছুতেই সেই গোপন কথা আসাদের কাছ থেকে বের করা যাবেনা!
--নীতু তোর এভাবে আমার সাথে ঢাকা যাওয়া ঠিক হচ্ছেনা।
--আমি কি তোর সাথে ঢাকা যাচ্ছি নাকি? আমার এত ঠেকা কিসের? আমি কোচিং যাচ্ছি।
--তারপর্ও! তুষার ভাই শুনলে রাগ করবেন।
--ক্যান? উনি রাগ করবেন ক্যান? সব কাজ কি উনাকে বলে করতে হবে নাকি? কোন সংবিধানে লেখা আছে?
--তুই কি আসলেই বুঝিস না নীতু?
--কি বুঝিনা?
--তুষার ভাই যে তোকে অনেক পছন্দ করেন?
--তুই কি বুঝিস না আমি তোকে অনেক পছন্দ করি?
হঠাৎ আমাদের দু’জনের মাঝে বরফ শীতল নীরবতা নেমে এল। আমি সবসময় অনেক বেশি কথা বলি। তার ফল হুট করে এই কথাটা বলে ফেলা। প্রচন্ড লজ্জা লাগতে লাগল আমার। মনে হচ্ছে—হে ধরনী দ্বিধা হ্ও! আসাদ কথাটা শোনার পর সেই যে মুখে কুলুপ আঁটল আর কোন কথাই বলল না অনেকক্ষণ। আমি ও কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। একসময় আসাদ নিজেই নীরবতা ভাঙল—
--নীতু,আমি তোকে কয়েকটা কথা বলি।
--বল।
--আমি এই কয়েকমাসে ঠিক-ই টের পেয়েছি তুই আমাকে পছন্দ করিস। খুব-ই স্বাভাবিক বুঝে ফেলা,না?
--হুঁ।
--ঠিক সেইরকম তুই ও জানিস তুষার ভাই তোকে পছন্দ করেন। জানিস তো?
--জানি। কিন্তু তুষার ভাই ক্যামন ক্যাবলা মার্কা।
--তুষার ভাই ক্যাবলা মার্কা না। তুষার ভাই ভালো ছেলে। তুই নিজেও জানিস সেটা।
--ফ্যানাচ্ছিস ক্যান? কি বলবি সেটা বল।
--তুষার ভাই ভাল দেখেই তোর উনাকে ক্যাবলা মার্কা লাগে। আমি অতটা ভাল না। যা বলি সেটা বেশ স্পষ্ট করে বলি। তাই তোর আমাকে ভাল লাগে। আমাকে পুরুষ মনে হয় তোর। আর তুষার ভাইকে তোর মেয়েলি মনে হয়। কারণ উনি অনেক দিন ধরে তোকে পছন্দ করার পরেও তোকে নিজে কিছু বলেননি।
--তোর ভ্যাজর ভ্যাজর শুনে মাথা ধরে গ্যাল। তুই সবকিছু বেশি বুঝিস।
--হ্যাঁ বেশি বুঝি। বুঝি দেখেই এটাও বুঝি আমার জন্য তোর একটা মোহ কাজ করছে। হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ আসা মোহ। আর তুষার ভাইকে তুই ভালোবাসিস। কিন্তু নিজে সেটা বুঝতে পারিস না।
--চুপ থাক আসাদ। আর একটা কথা বলবি না। বাস থেকে ধাক্কা দিয়া ফালাই দিব।
--তোকে একটা মজার গল্প বলি নীতু। তোকে তো বলেছি আমি ম্যাট্রিক পাশ করেছি বৃত্তি আর স্যারদের দেওয়া টাকায়। পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলাম। স্যাররা আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। আমার হাতের লেখা দেখে মুগ্ধ হতেন। ব্যাস ওই মুগ্ধতা পর্যন্ত-ই। আমাদের ক্লাসে খুব গাধা ছেলে ছিল। নাম টিপু। একদম পড়াশোনা করতে চাইতনা। স্যাররা ওকে অনেক বকতেন। কিন্তু ও যখন ম্যাট্রিক পাশ করল স্যাররা ওকে অনেক আদর করেছেন,অনেক। আমার চেয়েও বেশি। আমি আসলে বুঝতে পারতাম স্যাররা আমাকে ভালোবাসেননা। আমি সংগ্রাম করে বড় হচ্ছি দেখে মুগ্ধ হন। কিন্তু ভালোবাসেন টিপুদের,মমতা থাকে টিপুদের মত সহজ বোকা-সোকা ছেলেদের জন্য।
--এইটা দিয়ে কি বুঝাইতে চাইলি তুই?
--বুঝাতে চাইলাম আমি সারাজীবন মানুষকে মুগ্ধ করেছি। তোকেও মুগ্ধ করেছি। কারণ তোরা ভাবিস আমি এক বিষ্ময় বালক। কষ্ট করে বড় হয়েছি। আমার জন্য কারো ভালোবাসা থাকেনা। কারো না। আমার জন্য সবার মুগ্ধতা থাকে। আর তুষার ভাইয়ের মত বোকা ছেলেদের জন্য সবার থাকে ভালোবাসা।
--তুই দয়া করে দূরে গিয়া মর। প্যানপ্যানানি কথা শুনতে অসহ্য লাগছে।
--নীতু,আমি যা বলছি ঠিক-ই বলছি। তুই সত্যি করে বলত,আমার সাথে দেখা হ্ওয়ার আগে তুষার ভাইকে তুই মনে মনে পছন্দ করতি না? করতি। এরপর যখন আমাকে দেখলি তখন মুগ্ধ হলি। মোহে পড়ে গেলি। তোর মনে হতে লাগল তুই আমাকে ভালোবাসিস। আসলে সব কিছুই মিথ্যা। মোহ!
আসাদের মহাজ্ঞানী মার্কা কথা শুনে আমার আসাদের উপর অনেক রাগ হতে লাগল। চণ্ডাল রাগ। মনে হল একটা চড় মেরে দিই ওর গালে। কিন্তু কি মনে করে নিজেকে থামালাম। চুপচাপ বসে থাকলাম। আর দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই ঢাকা পৌঁছে যাব। ভাল লাগছে না কিছুই। আসাদের দিকে তাকালাম। ঘাড় কাত করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন দেখে মিটমিট করে হাসছে আসাদ। খুব মনোযোগ দিয়ে আমিও সেদিকে তাকালাম। দেখলাম দুইটা টোকাই ছেলে মারামারি করছে। দৃশ্যটা খুব দ্রুত মিলিয়ে গেল। কিন্তু আসাদ আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল না। আমি আসাদের দিকে তাকিয়েই থাকলাম। এই ছেলেটা আসলেই আর দশটা ছেলের মত না। আসাদ আমার ভালোবাসাটাকে সব সময় কিভাবে যেন এড়িয়ে যায়। আর এইজন্য-ই হয়ত আসাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়,পাশে বসা যায়,হাসা যায়! বড্ড মায়া লাগে ছেলেটার জন্য! বড্ড মায়া!
বাস ঢাকা পৌঁছানোর পর আসাদ কমলাপুরের কাছাকাছি এক জায়গায় এসে নেমে গেল। আসাদ নামার সাথে সাথে আমার মনে হল—মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। আসাদকে একটা কথা বলা হয়নি। কিছুদিন আগে আসাদের জন্য একটা শেষ না হওয়া কবিতা লিখছিলাম। সেটার কথা বলা হলনা! তারপর চিন্তা করলাম—থাক,বলার দরকার নাই। আসাদের জন্য যেদিন একটা সম্পূর্ণ কবিতা লিখতে পারব সেদিন তাকে বলব আমার লেখা ভালোবাসার কবিতার কথা।
অসম্পূর্ণ কবিতার মত আপাতত কিছু কথা অসম্পূর্ণ-ই থাক!
আসাদ ঢাকা চলে যাওয়ার পর কয়েকদিন আমি পড়াশোনা,অন্য কোন কাজ কিছুতেই মন বসাতে পারতাম না। আসাদকে নিয়ে লেখা কবিতাটা শেষ করার চেষ্টা করতাম মাঝে মাঝে। কিন্তু পারতাম না। চার লাইনেই সেই কবিতা থেমে থাকত। কোন কোন দিন দুপুরে অধ্যয়ণ থেকে ঘুরে আসতাম। অধ্যয়ণে ছাত্র দিন দিন বাড়ছে দেখে ভালোই লাগত। তুষার ভাইয়ের সাথে আশে-পাশের পাড়ার আরো কিছু ছেলে অধ্যয়ণে পড়াত। ছাত্রের পাশাপাশি শিক্ষক ও বাড়ছে। নারায়নগঞ্জে কাক বাড়ার হারে শিক্ষক বাড়ছে। একসময় দেখা যাবে ছাত্র আর শিক্ষক সংখ্যা সমান হয়ে গেছে। পার পিস ছাত্রের জন্য এক জন স্যার। হাহাহা।
আসাদ যাওয়ার আগে আমার চিন্তা গুলোকে জট পাকিয়ে দিয়ে গেছে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় তুষার ভাইকেও কি আমি ভালোবাসি? নিজেকে প্রশ্ন করি ঠিক-ই কিন্তু আগের মত আর মন থেকে কেউ কঠোর ভাষায় “না” বলেনা,বরং মনটা চুপ করে থাকে। উত্তর না পেয়ে কেমন জানি পাগল পাগল লাগে আমার। অস্থিরতা বাড়ে। এদিকে আমার ভর্তি পরীক্ষার সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। জোরেশোরে পড়াশোনা করা দরকার। আমি ভালোমত-ই জানি কোথাও চান্স না পেলে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেবেন। এখন-ই হন্যে হয়ে বড়লোক পাত্র খুঁজছেন। কিন্তু পড়া আর আগের মত জোরেশোরে হয়না। অনেক ধীরে ধীরে হয়। স্থবির সময়! স্থবির পড়াশোনা!
হেলাফেলায় জীবনটা ভালো-ই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই সবার মুখ ঘুরে একটা গুঞ্জন আমার কানে এসে পড়ল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভাবলাম ছোট পাড়া। মানুষের মুখে কথা রটতে বেশি সময় লাগেনা। কিন্তু তারপর্ও কেমন অশান্তি লাগতে শুরু করল। সত্যটুকু জানতে ছুটে গেলাম তুষার ভাইয়ের বাড়ি!
তুষার ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখি উনি বাড়িতে নাই। কাকী মানে তুষার ভাইয়ের মা বললেন তুষার ভাই অধ্যয়ণে গেছেন। উনার সাথে পাড়ার কিছু ছেলে আছে। আসাদ ও তুষার ভাইয়ের সাথে আছে। আসাদ কাল নারায়নগঞ্জে এসেছে।
আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আসাদ কাল নারায়নগঞ্জ এসেছে এটা কি আসাদ জানাতে পারতনা? তুষার ভাইয়ের বাড়ি থেকে আমার বাড়ি আর কতদূর? চার মিনিট-ও লাগে না আসতে। তবে কি যা শুনছি সব-ই সত্যি? আমার কাছ থেকে ওরা ব্যাপারটা লুকাল কেন? ঘটনা যদি সত্যি হয়েই থাকে তাহলে তুষার ভাই যা করবে করুক,কিন্তু আমি কিছুতেই আসাদকে এসব ঝামেলার মধ্যে জড়াতে দিব না। কিছুতেই না।
(চলবে)
শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪২