যাই হোক, ভাইভার দিন যথাসময়ে আমার ডাক পড়লো । ডিপার্টমেন্টের যে রুমটায় আমাদের কোর্স ভাইভা নেয়া হত সে রুমটা ছিল বেশ বড় । পুরো ঘরের মাঝ জুড়ে বিশাল এক টেবিল আর ৬-৭ টা চেয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না । টেবিলের সামনে বিশাল সাদা বোর্ড আর কয়েকটা মার্কার । স্টুডেন্টদের বসার জন্য মাঝারি একটা টুল ।
তো যথাসময়ে আমি রুমে ঢুকে বসে থাকা ম্যাডামদের দিকে তাকিয়ে সালাম দিলাম । এখানে বলে রাখা ভালো- ছাত্রীদের কাছে ম্যাডামরা এতই প্রিয় ছিল যে অন্যদের সর্বোচ্চ প্রশংসাও মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র মনে হত । ঠিক সেই সময়ে বিমল বাবু খেঁকিয়ে উঠলেন -''কি হে! আদাব টাদাব কিছু দাও ...'' । একটু ভয় পেয়ে গেলাম । ভদ্রভাবে বললাম- '' স্যার আপনার সাথে দু' মিনিট আগেই দেখা হয়েছিল, তখন একবার সালাম দিয়েছিলাম ... '' বলে চুপ মেরে গেলাম (দু' মিনিট আগেই স্যার ক্লাশে এসেছিলেন আমাদের সাবধান করতে যেন আমরা সবাই ঠিক মত সব প্রশ্নের উওর দেই নতুবা এক্সটারনালের সামনে উনার নাক কাটা যাবে !! তখন যে বেশ জোড়ে সোড়েই সালাম দিয়েছিলাম স্পষ্ট মনে আছে ।) । বুঝালাম বারবার সালাম দেবার প্রয়োজন বোধ করছিলাম না । আমার অভদ্র(!!) জবাব শুনে স্যার চুপ মেরে গেলেন (পরে শুনেছিলাম ভাইভা বোর্ডে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা ভাবে সালাম না দেয়াটা রীতিমত কঠিন বেয়াদবীর পর্যায়ে পড়ে) ।
টিচারদের প্রশ্নের যত উওম উওরই দেই না কেন বিমল বাবুর ঠিক পছন্দ হ্য় না, তিনি অন্য প্রশ্নে চলে যান । সেই প্রশ্নেরও যুতসই একটা জবাব যখন প্রায় রেডি করে ফেলি তখনই উনি অন্য প্রশ্নে চলে যাচ্ছিলেন । অর্থাৎ উনি প্রশ্ন করতে পেরেই খুশি ছিলেন, উওর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না ।
এভাবেই ভেবলাকান্তের মত আমরা ৩য় বর্ষের শেষ দিনটা পার করলাম ।
ফাইনাল ইয়ারের প্রথম দিনই আমাদের মেজাজ চরমে উঠলো । রুটিন মত বিমল বাবুর সাথে আমাদের ফার্স্ট পিরিয়ড । জানতাম একবার ক্লাশে ঢুকবেন তো সব টিচারের সব ক্লাশ শেষ করেই বের হবেন । তার চেয়েও বড় দুঃসংবাদ তিনি আমাদের কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াবেন । সবার মনেই একি কথা ঘুরঘুর করছে । থার্ড ইয়ারে যিনি কোয়ান্টাম নিতেম তিনি তো বেশ ভালোই ছিলেন তবে তাকে বাদ দেয়ার কি এমন দরকার পড়লো ??
স্যারের সেই বিশাল জ্ঞান রাজ্যে আমাদের বিচরণ শুরু হলো । বেসিক আর বেসিক । কোথায় কোয়ান্টাম কোথায় কি!! আমাদের বেসিক ক্লিয়ার করাটা এত বেশিই আবশ্যক ছিল যে বিমল বাবু অন্য কিছু টাচ্ করার সময়ই পেলেন না । বাকি সব পেপার গোল্লায় গেল । জীবন একেবারে তেজপাতা হওয়ার বাকি রইলো না ।
কিছুদিনের মাঝেই রোজা শুরু হয়ে গেল । সপ্তাহে ৫ দিন সকাল ৯-৩টা একটানা বিমল স্যারের লেকচার । বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা । একদিন কয়েকজন মিলে সাহস করে বলেই ফেললাম -'' স্যার আমাদের বাসায় যেতে অনেক দেরি হয়ে যায়, তাছাড়া রোজার দিন ... '' । স্যার গেলেন ক্ষেপে - '' তোমরা কেবল শুনে যাচ্ছ তাতেই এত কষ্ট!! আমি যে একটানা বলে যাই কই আমার তো খারাপ লাগে না । এমন হলে কিভাবে কি করবে? আমি তোমাদের দেখে অবাক হয়ে যাই, লজ্জায় আমার মাথা হেড হয়ে যায় । তোমরা তো কিছু পারই না, জানবার বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই । কেউ স্বচ্ছায় তোমাদের কিছু শেখাতে চাইলে তাতেও তোমাদের নানা বাহানা ... ইত্যাদি ইত্যাদি ।''
তখনও বেসিক টা সেইভাবে শেষ করা হয়নি । এরই মাঝে স্যার রিলেটিভিটি শুরু করলেন । থিওরী অব রিলেটিভিটি কোর্সটা আমাদের আগেই হয়েছিল- বিমল বাবু সেটা জানতেন । তবুও তিনি কোয়ান্টামের আগে রিলেটিভিটি শেষ(!) করাটাই প্রয়োজনীয় মনে করলেন । বিমল বাবু নাস্তিক মানুষ- আমরা সবাই মুটামুটি জেনে গেছি । সব সময় সৃষ্টিকর্তাকে অবজ্ঞা করে কথা বলা তার প্রিয় কাজের একটা । স্যার আমাদের যতভাবেই বোঝান না কেন আমাদের কারোরই স্যারের এই ঢাক ঢোল পিটিয়ে নাস্তিক ধর্ম প্রচার করাটা সহ্য হচ্ছিলো না । সবসময় এধরণের কথা বলতেন কারণ উনি টোকা দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন কে কে উনার কথায় বাঁধা দেয় । কে কে উনার চেয়ে ইসলাম কে বেশি গুরুত্ব দেয়-এটা দেখা উনার জন্য জরূরী ছিল । কেননা উনি আগেই বলে রেখেছিলেন যে ফাইনাল ইয়ারের ল্যাব+কোর্স ভাইভা =১৫০ মার্কস উনার হাতে । যারা যারা তার ক্লাশ করবে না ও তার অবাধ্য হবে তাদের উনি ল্যাবে ঢুকতে দেবেন না এমনকি উনি চাইলে ফাইনালেও ফেল করিয়ে দিতে পারেন । যদি উনি সেটা করেন তবে কারো পক্ষেই এই জনমে পাশ করা সম্ভব না । যদিও এই ভয়টা কারো মনেই খুব একটা ভীতি তৈরী করতে পারলো না তথাপি তিনি তার মত ভয় দেখিয়ে যেতে থাকলেন ।
রিলিটিভিটি পড়ানো শুরু হলো । পুরোটা জুড়েই থাকলো আইনস্টাইন সাহেব । কেননা স্যার আইনস্টাইনের সৃস্টির চেয়ে মানুষ বা স্রষ্টা আইনস্টাইন কেই বেশি প্রাধান্য দিলেন । এক্ষেত্রে বিমল বাবুর কিছু পছন্দের উক্তি ছিলো । উনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই থেকে পড়েছিলেন । কিংবা হয়তো কিছু কিছু জিনিস নিজেই বানিয়েছিলেন । যেমন - '' একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আইনস্টাইন ছাড়া রিলিটিভিটি বোঝে এমন ২য় লোক পৃথিবীতে নেই ...'' । আবার কখনো বলতেন ''আইনস্টাইনের সৃষ্টির ভুল ধরতে পারে এমন লোক নেই যদি কেউ তার থিওরী নিয়ে সন্দেহ দেখায় তবে আইনস্টাইনকে অপমান করা হবে । আর যদি কেউ আইনস্টাইনের সৃষ্টিকে ভুল প্রমাণিত করে তবে বুঝতে হবে স্রষ্টার সৃষ্টিতে নিশ্চয় কোন গোলমাল হয়েছে ...'' । আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না স্যার যতই বলুন না কেন ঈশ্বর বলে কেউ নেই তথাপি তিনিও মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে ঈশ্বর মনে করে ভুল করেন ।
এমনি ভাবে সময়ের তালে তালে তিনি আমাদের রিলিটিভিটি বুঝাতে থাকলেন । আসল ব্যাপার বুঝালেন কম তার স্রষ্টার(!) প্রশংসা করলেন বেশি ।
একবার বললেন -'' তোমরা মুসলিমরা মৃত্যু বিশ্বাস কর, আমি যদি বলি মানুষের মৃত্যু নেই । তোমরা কি প্রমাণ করতে পারবে আসলেই মানুষ মরণশীল? '' । আমরা বললাম - ''মুসলমানরা বিশ্বাস করে আল্লাহ্র সকল সৃষ্টির মৃত্যু আছে এবং মৃত্যুর পরে পুণরায় তাদের কে জীবিত করা হবে । যেটাকে অনেক ধর্মের লোকেরা পূনর্জন্ম মনে করে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে । আমাদের দেহের মৃত্যু হয় কিন্তু আত্মার কখনো মৃত্যু হয় না । ইসলামের কোথাও আত্মার মৃত্যুর কথা বলা হয়নি । অন্যভাবে বলা যায় আত্মাকেই এক স্পেস থেকে অন্য স্পেসে নিয়ে যাওয়া হয় । দেহকে নয় । দেহকে নিতে হলে তবে আত্মাকে দেহের সাথে যুক্ত করতে হবে । আত্মা ছাড়া দেহের কোন মূল্য নেই । আল্লাহ্ হাশরের দিন আমাদের দেহে আবার ও আত্মা ফুঁকে দিবেন । যদি স্যার আপনি বলেন আত্মার মৃত্যু নেই তবে আমরা মেনে নেব কিন্তু দেহের মৃত্যু নেই এটা আমরা মানতে পারবো না ... ''। স্যার আমাদের উওরের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে প্রমাণ করা শুরু করলেন '' মানুষের মৃত্যু নেই - ধরো ইনফিনিটি টাইমে, কোন স্পেসে, ছোট একটা বিন্দু ... ইত্যাদি ইত্যাদি ''।
আরেকবার খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল । ১৯৭১ সালে আসলে কি হয়েছিল তা বোঝাচ্ছিলেন । নিজেদের কথা কম ইন্ডিয়ার সুনাম বেশি । শুনতে শুনতে অসহ্য হয়ে শেষ মেষ বলেই বসলাম -''মেনে নিলাম ইন্ডিয়া না হেল্প করলে আমাদের দেশ স্বাধীন ই হতো না, ওরা আমাদের পরম বন্ধূ । ওরা ছাড়া আমরা অসহায়, নিরুপায় । কিন্তু স্যার ৭১ এ ওরা যে সব লুটেপুটে নিয়ে গেলো সেটার কি হবে ... '' । স্যারের যথারীতি হাসি মাখা উওর - ''এরম অকৃতজ্ঞের মত কথা বললে তো হবে না । তোমাকে কেবল দিয়েই যাবে আর প্রতিদানে কিছুই নেবে না? ইন্দিরা গান্ধী ...... আমরা যদি ওদের পায়ে সারাজীবন মাথা খুঁড়ি তাও প্রতিদান শূন্যেই থেকে যাবে ... '' । কিছু বলতে চাইলাম সবাই থামালো । মনে মনে বললাম ''নিজের খেয়ে আর কত অন্যের গীত গাইবেন?? ''
ঠিক করলাম সবাই মিলে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে যাব । আমাদের চিন্তা শুধু কল্পনাই থেকে গেলো । কেননা সেদিনই স্যার কোথা থেকে এসে বললেন '' তোমাদের মাঝে কে আছো যে আমার নামে কমপ্লেইন দিতে চাও । ও হে একবার সামনে আসো তো ... পরিণতি কি হবে ভেবে দেখেছো কি ?? ...'' । আমাদের আর যাওয়া হলো না । ভাবলাম কেউ আর কিছু বলবো না । বিমল বাবুকে কোন কিছু বোঝাবার চেষ্টা করে লাভ নেই । কেননা যে বুঝেও না বোঝার ভাব করে থাকে তাকে বোঝানো কারো পক্ষেই সম্ভব না । আর তাছাড়া উনি শুধু উনার নাস্তিকতা আমাদের মাঝে কিছুটা বিস্তৃত করতে চাইছেন । আমরা যত মাথা গরম করবো ততই উনি আমাদের পেয়ে বসবেন ।
এর কিছুদিন পরেই আমাদের ক্লাশ শেষ হয়ে গেলো । আমরা এবারের মত বেঁচে গেলাম ।
এখন ও মাঝে মাঝে ভাবি কেন স্যার কে কখনো শ্রদ্ধা করতে পারি নাই । আমাদের সমাজে এরকম অনেক শিক্ষক ই তো আছেন । অসম্মান করতে গেলে অনেককেই করতে হবে । যার যার প্রাপ্য সম্মানটুকু তাকে দেয়া উচিত । শিক্ষক হিসেবে সম্মানটুকু তাদের প্রাপ্য । উনারা কতটা এর যোগ্য সেটা তারাই হিসেব কষে দেখবেন। আমরা তো আমাদের দায়িত্ব কে অবহেলা করতে পারি না । পারি কি?
ডিপার্টমেন্টে নতুন হেড এসেছেন । বিমলবাবুর বিদায় ঘন্টা বাজতে আর বেশি দেরি নাই
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ৮:৪১