কুয়ালালামপুরঃ
মালিন্দো এয়ারে চড়ে ঠিক ১২টায় এসে নামলাম কেলিয়া-২ এ। ব্যাগ বুঝে নিয়ে সোজা চলে গেলাম কেলিয়া এক্সপ্রেসের কাউন্টারে ৩৫ করে ৭০ রিঙ্গিতে ২টা টিকিট কাটলাম কেএল সেন্ট্রাল পর্যন্ত। খুব আরামদায়ক ভাবেই পৌছে গেলাম কেএল সেন্ট্রালে। পথে ফ্রি ওয়াইফাই তে ইন্টারনেট চালাতে চালাতে আর চারপাশের সুন্দর সব স্থাপনা আর উড়াল সেতুগুলো দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কেএল সেন্ট্রালে। এবার এখান থেকে যেতে হবে আমাদের হোটেলে। আমি লংকাউই থাকতেই কয়েকটি হোটেলে কথা বলে নিয়েছিলাম আর সেখান থেকেই একটা হোটেল ঠিক করে নিলাম। একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম এক্সপ্রেস ষ্টেশন থেকে। কুয়ালালামপুর ও এর আশে পাশে চলাচল করার জন্য অনেকগুলো পরিবহন ব্যবস্থা আছে। কয়েক ধরনের বাস, ট্রেন, উড়াল রেল, ট্যাক্সি ইত্যাদি। আপনি যদি এখানকার বাসের রুটটা একবার বুঝে ফেলতে পারেন তবে আপনি খুব কম খরচে ঘুরতে পারবেন। আর গো-ক্যাল বলে একটা বাস আছে যা একটা নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত যাতায়ত করে, যাতে আপনি সম্পূর্ণ বিনা খরচে ঘুরতে পারবেন সাথে ফ্রী ওয়াইফাই তো আছেই। রাস্তায় নেমেই বুঝতে পারলাম আমরা এখন আছি বেশ উন্নত একটা শহরে। চোখ ধাঁধানো সব স্থাপনা, উড়ালসেতু, সাজানো গোছানো সব কিছু আর খানিক বাদেই নজরে এলো বহু আকাঙ্ক্ষিত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাথে নিয়ে মিনারা কেএল টাওয়ারকে। খুব কাছেই মনে হচ্ছিল পরে জানতে পারলাম প্রায় সারা কুয়ালালামপুর থেকেই এই দুইটি টাওয়ার দেখা যায়। হোটেলে পৌঁছে রুম বুঝে গোসল করে নিলাম।
মিনারা কেএল টাওয়ার
কোন দিন কোথায় যাবেনঃ প্রথম দিনঃ
খালি বিকাল থেকে রাতটা পাচ্ছেন অতএব এই সময়ে বুকিত বিন্তাং, কে এল পার্ক, টুইন টাওয়ার আর মিনারা কেএল টাওয়ার দেখে আসতে পারেন। দুপুরের খাবার শেষ করে উঠতেই দেখলাম প্রায় চারটা বাজে। না আর এক মুহূর্তও নয় রুমে। বেড়িয়ে পড়লাম উদ্দেশ্য টুইন টাওয়ার। ট্যাক্সি করে পৌঁছে গেলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারে আর প্রথম যে শব্দটি আমি আর আমার স্ত্রী সমস্বরে উচ্চারণ করলাম তা হলো ওয়াও। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম কি যে সুন্দর করে বানানো এই টাওয়ারদ্বয়। বিশাল এলাকা নিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে। অদ্ভুত আধুনিক স্থাপত্য শৈলী। আমাদের টিকিট কাটা ছিল না উপরে রেস্টুরেন্ট আর অব্জারবেশন ডেকে যাবার তাই আমরা চলে গেলাম শপিং মলের মধ্যে। এতো আলোকিত একটা শপিং মল, কি নেই এতে? অন্তর্জাতিক প্রায় সকল ব্র্যান্ডের শোরুম খুঁজে পেলাম। অনেকটা সময় ব্যায় হবে যদি পুরোটা ঘুরে দেখতে চান। তবুও যতটুকু পারলাম ঘুরে দেখলাম। বউকে টুকটাক কিছু জিনিস কিনে দেবার দুঃসাহসটাও করে ফেললাম। এবার বের হলাম মলের অন্য একটা দিক দিয়ে বের হয়ে আরো অবাক হলাম। ওখানে সুন্দর ছোট একটা লেক যার মাঝে অনেকগুলো ফোয়ারা সুরের ছন্দে আর নানা রঙ্গের আলোর সাথে জল ছিটিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর কিছু সময় কাটালাম আমরা। এরপর সেন্ট্রাল পার্ক দেখে চলে গেলাম কেএল মিনারা টাওয়ার দেখতে। এই টাওয়ারে সপ্তাহে প্রত্যেকদিন একটি নতুন রঙের আলো জলে উঠে আর সন্ধ্যা হতেই টাওয়ারটি সেই রঙের টাওয়ারে পরিনত হয়। এখান থেকে পুরো কুয়ালালামপুর শহরটা আপনি দেখতে পাবেন তবে তার জন্য একটু দামও দিতে হবে। টিকিট কেটে উঠতে হবে অব্জারবেশন ডেকে। আমরা সেখানেও উঠলাম না। আসলে আপনার সময় আর অর্থের যদি সীমাবদ্ধতা না থাকে তবে আপনি সবকিছুই দেখতে পারেন খুটিয়ে খুটিয়ে। মিনারা টাওয়ার শেষে বুঝতে পারলাম খিদাটা প্রচন্ড ভাবে জানান দিচ্ছে। তাই দেরি না করে চলে এলাম বুকিত বিন্তাং’এ। এখানে কয়েকশ খাবারের দোকান আর শপিং মল আছে।
প্যাভিলিয়ন শপিং মলের সামনে
এটি আসলে কুয়ালালামপুরের শপিং হ্যাভেন এলাকা নামে পরিচিত। প্যাভিলিয়ন, সেফোরা, ফারেনহাইট ৮৮ মল ঘুরে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। আর যদি ব্র্যান্ডের জিনিস কেনার শখ থাকে তবে যেকোন একটা মল থেকেই আপনি আপনার পছন্দের পোশাক কিনে ফেলতে পারেন।
চায়না টাউন
দ্বিতীয় দিনঃ
সকালে চলে যেতে পারেন গেন্টিং হাইল্যান্ড প্রায় পুরো একটা দিন লেগে যাবে। ট্যাক্সিতে শহর থেকে যেতে প্রায় ৩ ঘন্টা লেগে যেতে পারে। চমৎকার একটা জায়গা কেসিনো, নানান ধরনের রাইড, গেমস, আইস ওয়ার্ল্ড ইত্যাদি দেখতে দেখতে অনেকটা সময় চলে যাবে। দুপুরের খাবারটা ওখানেই খেয়ে নিতে হবে। রাতে এসে চায়না টাউনে গেলাম আসলে খুব একটা আহামরি কিছুনা। অনেকগুলো দোকান জামা, জুতা, ব্যাগ, ঘড়ি, প্রায় সবই পাবেন কিন্তু সবই চায়নিজ যা দেখতে অনেকটা আমাদের ফার্মগেইটের দোকানগুলোর মত এবং মজার বিষয় হলো প্রায় অধিকাংশ দোকানদারই বাংলাদেশী। এখানে আরো পাবেন অনেক ধরনের খাবার ও ফল। এবার লিটল ইন্ডিয়ার পালা এটি মূলত রাতের বেলা বেশী জমে উঠে। এটি আসলে এক টুকরা ইন্ডিয়া। সব পাবেন ইন্ডিয়ান খাবার থেকে শুরু করে জামা, জুয়েলারী ইত্যাদি। ভালোই সময় কাটবে আর নতুন নতুন পরিবেশ, মানুষ, আচার রিতি ইত্যাদির একটা ধারনা পাবেন। এখানকার পালা শেষ করে চললাম বীরজায়া টাইম স্কয়ার দেখতে। এটিও বিশাল একটা মল যার উপরের দিকে রয়েছে থিমপার্ক, সিনেমা হল, খাবার আর জামা, জুতা, ব্যাগ, মেয়েদের, ছেলেদের বিভিন্ন কিছুতো পাবেনই। বুকিত বিন্তাং এর এতো কাছে এসে সেখানে না গিয়ে হোটেলে ফেরত যেতে ইচ্ছে করছিল না। এই ব্যাপারটা সবারই ঘটে বারবার বুকিত বিন্তাং ফিরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এতো চমৎকার একটা এলাকা। তাই আবার চলে গেলাম ফারেন হাইট ৮৮, সেফোরা আর প্যাভিলিয়ন মলে খানিকটা সময় কাটিয়ে তবেই ফিরলাম হোটেলে।
তৃতীয় দিনঃ
পরিকল্পনা মাফিক সকালের দিকে বাতু কেভস যাবার কথা তাই একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম চাইলে আপনি বাসেও যেতে পারেন। খানিক বাদেই পৌঁছে গেলাম বাতু কেভস’এ এটি মূলত হিন্দু আর তামিলদের পাশাপাশি তিনটি মন্দির কিন্তু এর বিশালতা আর সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
বিশেষ করে রামায়ন গুহা আর তামিল মুরগান দেবের বিশাল মূর্তি এবং ২৭২টি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আসে পাশে বাঁদরের বাঁদরামি আপনার ভালো লাগবেই। এখান থেকে ট্যাক্সি নিলাম কেএল বার্ড পার্ক।
কেএল বার্ড পার্ক
টিকিটের দামটা একটু বেশীই মনে হল। তবুও ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকে আপনি অবশ্য হতাশ হবেন না। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, মাছ আর বানর পাবেন এখানে এবং সবগুলোই ছেড়ে দেয়া আপনার আশে পাশেই ঘুরতে থাকে এরা। ছবিও তুলতে পারবেন। এর আসে পাশেই আছে ডিয়ার পার্ক আর বাটারফ্লাই পার্ক চাইলে ঘুরে আসতে পারেন। এরপর আমরা চলে গেলাম সেন্ট্রাল মার্কেটে এখানে এসে পেয়ে গেলাম বাঙ্গালি হোটেল আর ফার্মগেইটের মত একটা ব্যাপার স্যাপার। আসে পাশে অনেক বাঙ্গালী পাবেন। দুপুরের খাবারটা পেট পুরে খেয়ে নিলাম একটা বাংলা হোটেলে রুই মাছের ঝোল, মুসুর ডাল আর ভাত দিয়ে। বিকাল থেকে রাত অবধি সময় কাটানোর জন্য চলে যেতে পারেন পুত্রজায়া। অনেক কিছুই দেখার মত আছে মসজিদ, পুত্রজায়া সেতু, বোটানিকেল গার্ডেন, লেক আরো অনেক কিছু।
শেষদিনঃ
এদিন রাখতে পারেন কেনাকাটা আর আরামদায়ক ভাবে এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করার জন্য। কুয়ালালামপুরে কেনাকাটা করার কয়েকটা মার্কেটের নাম হলোঃ সোগো, মালেকা, মাইডিন, পাসার সেনি, পাসার পুদু, বীরজায়া টাইম স্কয়ার এমন আরো অনেকগুলো মল রয়েছে। প্রায় সারা বছরই এদের মূল্যছাড় চলতে থাকে। মালয়েশিয়া এসে জুস, স্থানীয় ফল, সীফুড, নাস্যি গোরেং, নাস্যি কেন্দার, চিকেন স্যাতে, ম্যাকডোনাল্ড, সাবওয়ে, স্টারবাক্স’এ অবশ্যই খেতে ভুলবেন না।
এবার শেষ করতে হবে, ফিরে যেতে হবে দেশে, নিয়ে যাচ্ছি হাজারটা স্মৃতি যা অনেকদিন অনেকটা সময় আমাদেরকে আনন্দ, রোমান্স আর ভালো লাগা যোগাবে। অসম্ভব ভালো একটা ট্যুর শেষ করে ফেরত যাচ্ছি দেশে। যথাসময়ে চলে এলাম বিমান বন্দরে সময়মত বিমান ছাড়লো এবং দেশেও ফিরে এলাম আর যথারিতি প্রত্যেকবার যা হয় প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে দেশে ফিরতে হয়। আবার ফিরে যাবার ইচ্ছে পোষন করে শেষ করতে হয় আমাদের পথ চলা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩