পঁচিশ হাজার টাকা লোন নেওয়ার ঠিক সাত দিনের মাথায় বর্গাচাষি আলমগীর মিয়া কোন ধরণের নোটিফিকেশন ছাড়াই মারা গেলেন।
তো ‘ধার-কর্যের বিনিময়ে দারিদ্র জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ক কর্মসূচি’র মাঠ কার্যালয় ব্যবস্থাপক জনাব মাসুদুল হাসান বর্গাচাষি আলমগীর মিয়ার আকষ্মিক মৃত্যু সংবাদ নিজে অবগত হবার অনধিক তেতাল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে এতদবিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে দিক-নির্দেশনা চেয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট বিষয়টি মৌখিক এবং লিখিত আকারে জানালেন। এসময় জনাব মাসুদুল হাসান খেয়াল করলেন যে, তিনি আলমগীর মিয়ার আকষ্মিক মৃত্যু সংবাদ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর সময় একটু কেঁপে উঠেছিলেন অথবা তিনি কেঁপে উঠেননি আদতে কেউ একজন তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য এও জানালেন যে, বর্গাচাষি আলমগীর মিয়া ছিলেন সেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ও তার অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা পঁচিশ হাজার টাকা উদ্ধারে জনাব মাসুদুল হাসান ও সংস্থাকে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হতে পারে। মূলত জনাব মাসুদুল হাসানকে বর্গাচাষি আলমগীর মিয়ার আকষ্মিক মৃত্যু, আলমগীর মিয়ার পরিবারের ভবিষ্যত বিষয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কিন্তু তার উদ্বিগ্নতা বর্গাচাষি আলমগীর মিয়া ও তার পরিবারের কোন কাজে আসছে না এই মুহুর্তে।
আলমগীর মিয়া নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জনাব মাসুদুল হাসানের আরো একবার মৃত্যু নিশ্চিত করে দিলেন। আলমগীর মিয়ার মৃত্যু, আলমগীর মিয়ার পরিবারের জন্য যতটা না দুঃখের, তার চেয়ে বেশি সমস্যার জনাব মাসুদুল হাসানের জন্য একই সাথে জনাব মাসুদুল হাসানের পরিবারের জন্যও।
তো যথাযথ কর্তৃপক্ষ সংস্থার ‘ধার-কর্যের বিনিময়ে দারিদ্র জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’র অন্যতম উপকারভোগি আলমগীর মিয়ার আকষ্মিক মৃত্যু সংবাদে অধিকতর বিচলিত হয়ে, অতি দ্রুত আলমগীর মিয়ার জানাজায় উপস্থিত হবার নির্দেশ দিলেন জনাব মাসুদল হাসানকে। এবং সেই সাথে এও স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, জানাজা শেষান্তে আলমগীর মিয়াকে কবরস্ত করার আগ মুহুর্তে দেনা-পাওনা বিষয়ে এলান দেবার সাথে সাথে যেন তিনি সংস্থার পঁচিশ হাজার টাকা আদায় নিশ্চিত করতে সক্ষম হন এবং সেটা যেকোন ভাবে নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দিলেন।
সংস্থার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে জনাব মাসুদুল হাসান আলমগীর মিয়ার জানাজার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলেন। সম্ভবত মাসুদুল হাসান হাঁপাতে হাঁপাতে আলমগীর মিয়ার জানাজায় উপস্থিত হলেন। তিনি ওযু করেছিলেন কী না সেটা খেয়াল করতে পারলেন না অথবা খেয়াল করলেও সেদিকে মনোযোগ দেওয়া সেই মুহুর্তে অত্যন্ত অজরুরি বলে তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন এবং মনে মনে এও সম্ভবত বললেন যে, আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি বিধায় তার কাছে ওযুর পাপের চেয়ে সংস্থার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মান্য করতে কিঞ্চিত দেরিকে অমার্জনীয় পাপ বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন।
তো জনাব মাসুদুল হাসান সেই ধার-দেনা বিষয়ক এলান শোনার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি দেখলেন যে, আলমগীর মিয়ার বউ, তিনটে বড়, মাঝারি আর ছোট সাইজের বাচ্চা আর বুড়ো মা এবং সেই সাথে পাড়া প্রতিবেশি ফাঁসি থেকে রেহাই পেতে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে যেমন করে বিলাপ করে সম্ভবত ঠিক সেইভাবে, তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন, এবং মনে হলো যে, সেই ভাবেই ভীষণ করুণ সুরে সকলে কাঁদছেন। মাসুদুল হাসানের মনে হচ্ছিল যে, তিনি বোধহয় আর স্থির নেই। তিনি নিজের গলার উপরি অংশে হাত বুলিয়ে দেখলেন যে তার গলা ভেতরে শুকিয়ে গেছে। এমন শুকনো গলা তিনি সর্বশেষ গত বছর দেখেছিলেন আলমগীর মিয়ার ফসলি জমিতে যে বছর খরায় জমি জিরাত ফেটে প্রায় শুকাতে বসা ফোঁড়ার মতন। তিনি আরো খেয়াল করলেন যে, সেই শুকাতে বসা ফোঁড়ার মতন তার জিহ্বাটা ও শুকিয়ে গেছে। এবং তার মনে হচ্ছিল যে, চোখের পাতা ভীষণ ভারী হয়ে আসছে। ঠোঁট কাঁপছে। আর পায়ের তলা থেকে ক্রমশঃ মাটি সরে সরে যাচ্ছে। তিনি মনে করলেন যে, আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি বিধায় ওযু না করার পাপের চেয়ে সংস্থার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মান্য করতে কিঞ্চিত দেরি অমার্জনীয় পাপ। কিন্তু তিনি দেখলেন যে, দেনা-পাওনার এলান শোনার পর সকলে বল্লেন যে, তারা কেউই আলমগীর মিয়ার কাছে কোন টাকা পয়সা পান না অথবা পেলেও বলবেন না অথবা তারা সকলে আলমগীর মিয়াকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
ফিরে এসে মাসুদুল হাসান উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মৌখিক ও লিখিত আকারে প্রতিবেদন পেশ করলেন। তিনি এও বললেন যে, সেখানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে সেই মুহুর্তে টাকার কথা বলার মতন যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ অন্তত তার পক্ষে ছিল না।
এক সপ্তাহ পর।
জনাব মাসুদুল হাসান ঘুমাতে যাবেন এমন সময় তার তিন বছরের ফুটফুটে মেয়েটা আচমকা কেঁদে উঠলেন। এমনটা ইতোপূর্বে ঘটেছে কী না মনে করতে পারলেন না। জনাব মাসুদুল হাসান মেয়ের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন, এমন সময় খুব দূরে কোথাও কু-ডাক পাখির ডাক শুনলেন। ইতঃপূর্বে এমন অবস্থার সম্মুখীন যে তিনি হননি এমন না। এরকম ঘটনাবহুল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চাকরি করতে তিনি দীর্ঘদিন থেকে অভ্যস্ত। কিন্তু আজকের ঘটনাটি তাঁর কাছে সবিশেষ গুরুত্ব বহন করছিল।
চলতি মাসের বেতন থেকে আলমগীর মিয়ার পঁচিশ হাজার টাকা কর্তন করতঃ দায়িত্বে স্পষ্ট অবহেলার কারণে জনাব মাসুদুল হাসানকে তার বর্তমান চাকরি থেকে অব্যাহতির নির্দেশ সম্বলিত পত্র নিয়ে মাসুদুল হাসান অন্য একটি চাকরির বিজ্ঞপ্তির অপেক্ষা করলেন। মাসুদুল হাসান অবাক বিস্ময়ে বুঝার চেষ্টা করলেন অথবা কিছুতেই বুঝলেন না যে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে আসা নির্দেশগুলোর তীব্রতা, ঝাঁজ আর ক্ষীপ্রতা এতো বেশি হয় কী করে? এর মধ্যে মাসুদুল হাসান একটি উন্নয়ন সংস্থার ইতোপূর্বে পরিচিত একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে একদিন সময় করে ফোন দিলেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুযায়ী একদিন সময় নিয়ে দেখা করলেন। একথা-সেকথার পর মাসুদুল হাসান যে এখন যে কোন কাজে নিয়োজিত হবার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত সেটা জানানোর চেষ্টা করলেন। পরিচিত উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন যে, এ মুহুর্তে তাদের সংস্থায় ‘ধার-কর্যের বিনিময়ে দারিদ্র জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ক কর্মসূচি’ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে আপাতত কোন পোস্ট ফাঁকা নাই।
মাসুদুল হাসানের অব্যাহতির তৃতীয় দিনের মাথায় জনাব রকিবুল হাসান ‘ধার-কর্যের বিনিময়ে দারিদ্র জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ক কর্মসূচি’র মাঠ কার্যালয় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৭