মূলঃ রাস্কিন বন্ড
‘The Eyes Are Not Here’ (Also Known as ‘The Girl on the Train’ and ‘The Eyes Have It’)
রোহানার উদ্দেশ্যে নিজে নিজেই রেলগাড়ির কামরায় উঠার পর, আমার পিছু পিছু একটা মেয়েও উঠল। এক দম্পতি, খুব সম্ভব মেয়েটার বাবা মা-ই হবে হয়তো, মেয়েটাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিল। তাদেরকে মেয়েটার নিরাপত্তা আর একই সাথে স্বাচ্ছন্দ্য যাত্রা নিয়ে বেশ শঙ্কিত মনে হলো। বিশেষ করে দম্পতিদের মধ্যে মহিলাটির এবিষয়ে চোখে-মুখে প্রবল উদ্বিগ্নতার ছাপ। তিনি মেয়েটাকে ট্রেনের কোথায় মাল-সামানা রাখতে হবে, কীভাবে রাখতে হবে সে বিষয়ে বিস্তর নছিহত দিলেন। সেই সাথে কখন ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া যাবে না, কীভাবে অপরিচিত যাত্রী আগ বাড়িয়ে আলাপ জমাতে এলে কৌশলে এড়াতে হবে ইত্যাকার সমস্ত তালিমও দিলেন।
যথারীতি বাবা-মা আর মেয়ের মধ্যে বিদায় নেওয়া হয়ে গেল। ট্রেন স্টেশন ত্যাগ করল। যেহেতু আমি সে সময় সম্পূর্ণ অন্ধ ছিলাম, আমার কাছে তখন আলো আর অন্ধকারের উপস্থিতি অনুধাবন করা ছাড়া জগতের আর কোন বস্তুর রঙ ও তার আকার আকৃতি অনুমান করা একেবারে অসম্ভব ছিল। যে মেয়েটা আমার কামরায় যাত্রী হিসেবে এলো, সে দ্যাখতে ক্যামন, তার উচ্চতা কিংবা গায়ের রঙ কোনটাই আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নই। ট্রেনের কামরায় উঠে আসা অবধি মেয়েটার নরোম কোমল পায়ের তলাকে যেভাবে চটি জোড়া অনবরত চপেটাঘাত করে যাচ্ছিল, সেখান থেকে কোনরূপ ভুল ছাড়াই এটা অনুমান করতে পেরেছিলাম, মেয়েটা পায়ে চপ্পল পড়ে আছে।
এটা ঠিক, তার সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা তৈরি করতে আমার যথেষ্ট সময় লাগবে অথবা এমনও হতে পারে আদৌ সেটা আমার পক্ষে সম্ভবই না। তারপরও অন্তত এটা বলতে পারি, তার কণ্ঠস্বরে যে সাঙ্গীতিক দোলা সেটা আমার ভারী পছন্দ হয়েছে, যেমনটা আমাকে আকর্ষিত করেছে তার পরিধেয় মোলায়েম পায়ের তলার চটি জোড়ার অনবরত চপেটাঘাতের সুর তরঙ্গ।
‘আপনি কী দেরা পর্যন্তই যাচ্ছেন?’ - কোনরূপ ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলাম।
সহসা সে আমার এমন জিজ্ঞাসায় ভূত দেখার মতনই চমকে উঠল। আদপে কামরায় যে আরো কেউ একজন আছে সেটা সে আন্দাজ করতে পারেনি। কামরার অন্ধকার কোণে ঘাপটি মেরে ছিলাম কী না। প্রত্তুত্যরে সে যথেষ্ট বিস্ময়াভিভূত হয়ে সশব্দে বলে উঠল, ‘এই ঘরে আরো কেউ একজন যে আছে, আমি তো জানতামই না।’
হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এমন হয়েই থাকে। প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন লোকজন ও ঠিক তাদের চোখের সামনে যা কিছু ঘটে, তার অনেক কিছুই অথবা কোন কিছুই দ্যাখতে পায় না। তাদেরই আবার কত কী দরকার হয়। তাদের সাথে করে কত কিছুই নিতে হয়। অথচ কী আশ্চর্য! যারা দ্যাখতে পায় না অথবা খুব ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির তাঁরা কেবল প্রয়োজনীয় বিষয়াদিই সাথে করে নেয়, যেগুলির বিষয়ে তাদের আগে থেকেই ধারণা থাকে।
বললাম- ‘আমি আপনাকে দ্যাখতে না পেলেও’, ‘আপনার আগমন কিন্তু ঠিকই টের পেয়েছিলাম।’
কিন্তু এর মধ্যে আমি খুব ভয়ে ভয়েই আছি। কখন তাঁর কাছে ধরা পড়ে যায়। যদি কোনভাবে তাঁর কাছে আমার অন্ধত্ব লুকিয়ে রাখতে পারতাম। আমি আমার সীটে বসে থেকে কোনরূপ এদিক ওদিক না করলেই হয়তো সেটা সম্ভবও। এটা এমন খুব কঠিন হবে বলে আমার মনে হল না।
যখন এসব ভাবছিলাম, তখন নীরবতা ভেঙ্গে মেয়েটা বল্ল- ‘আমি সাহারানপুরে নেমে যাব। আমার কাকী সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
মনে মনে ভাবলাম ‘তবে তো আমার আর কথা বাড়িয়ে কোনই লাভ নেই’, উত্তরে বললাম- ‘কাকীরা সাধারণত খুব দুর্লভ কিছিমের প্রাণি হয়ে থাকে।’
- ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আগে দেরা যাব, সেখান থেকে মসৌরি।’
- ‘বাহ! কী সৌভাগ্যবান আপনি! আমার খুব ইচ্ছে মসৌরি যাবার। পাহাড় আমার খুব ভালো লাগে, বিশেষ করে অক্টোবরে।’
কোনমতে স্মৃতি হাতড়ে, বললাম, ‘হ্যাঁ, মসৌরি ভ্রমণের সর্বোৎকৃষ্ট সময়ের কথায়ই বললেন’। ‘এসময় পাহাড়গুলো বুনো ডালিয়ায় ঢাকা থাকে, সূর্যটা হয়ে উঠে নরোম কোমল। আর রাতে। রাতে আপনি চ্যালা কাঠের আগুনের উত্তাপ নিতে নিতে ব্রান্ডিতে একটু একটু করে চুমুক দিতে পারেন। বেশিরভাগ পর্যটক এসময় চলে যায়। ভীড় বাট্টায় দুমড়ানো-মুষড়ানো রাস্তাগুলো এসময় কী আশ্চর্য শান্ত হয়ে উঠে। এক রকম মরুভুমিই হয়ে পড়ে এসময়। হুম, ঠিকই, মসৌরি ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় অক্টোবরই।’
তার দিক থেকে নীরবতা। বরফ শীতলতা। ভাবছিলাম, আমার কথাগুলো কী তাকে খুব ছুঁয়ে গেছে? না কী সে আমাকে নিছক কল্পনাবিলাসী মূর্খই ভাবছে? কিন্তু এর মধ্যে আমি সবচে বড় ভুলটা করে ফেললাম।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘বাইরে কেমন দেখাচ্ছে?’
সম্ভবত এই প্রশ্নে কোন ধরণের হেয়ালিপনা অথবা অবাক হবার মতন কোন কিছুই খুঁজে পায়নি সে। আমার ভয় হল, তবে কী সে এর মধ্যে বুঝে ফেলেছে, আমি অন্ধ! কিন্তু তাঁর পরের প্রশ্নটা শুনে, যাক, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
কণ্ঠে সে সমস্ত দৃঢ়তা জড়ো করে জিজ্ঞেস করল- ‘আপনি নিজে দ্যাখে নিচ্ছেন না কেন?’
সহসা আমি খিড়কীর দিকে সরে গেলাম আর খিলানটা হাতড়ে দ্যাখলাম জানালাটা খোলায়ই ছিল। জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য মিছেমিছি বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটু নাটুকেপনার আশ্রয় নিলাম। ট্রেনের রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। শুনতে পাচ্ছিলাম ট্রেনের চাকার কু-ঝিঁক ঝিঁক, কু-ঝিঁক ঝিঁক শব্দ। আর অন্তর চক্ষু দিয়ে দ্যাখতে পাচ্ছিলাম একের পর এক বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলো ঝলকানি দিয়ে পেছনে ফেলে যাচ্ছি।
সহসা জিজ্ঞেস করলাম- ‘আপনি কী খেয়াল করছেন, আমরা কেমন পাথরের মতন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি আর অই যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, অই যে সবুজ গাছ-গাছালি, বন-বাঁদাড় মনে হচ্ছে কেমন দৌঁড়াচ্ছে?’
- ‘এটা কী বিশেষ কিছু?’ ‘এরকম তো সবসময় হয়। আপনি কোন প্রাণি দ্যাখতে পাচ্ছেন’- জিজ্ঞেস করল আমাকে!
একেবারে নিঃসঙ্কোচে বললাম- ‘না।’ আমি বেশ নিশ্চিত ছিলাম- এসময় দেরার কাছাকাছি বনের মধ্যে কোন প্রাণি দ্যাখতে পাবার কথা না।
আমি জানালার ধার থেকে সরে এসে মেয়েটার মুখের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের মধ্যে আবারো নীরবতা বিরাজ করল।
বললাম- ‘আপনার চেহারাটা বেশ আকর্ষণীয়।’ বুঝতে পেরেছিলাম এর মধ্যে আমি খুব সাহসী হয়ে উঠলাম, তবে আমার মন্তব্যটাও যথেষ্ট নিরাপদ। জানি, খুব কম মেয়েই আছে যারা প্রশংসা প্রতিহত করতে পারে।
সে খুব মোলায়েম একটা হাসি দিল। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, আমার মন্তব্যে সে ভীষণ আনন্দিত।
‘আমার চেহারাটা খুব চিত্তাকর্ষক, এটা শুনতে পারাটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য আনন্দদায়ক। আমি খুব সুন্দরী- এটা শুনতে শুনতে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’
আপনার চেহারাটা ভারি সুন্দর, এটাই তো আমি ভাবছিলাম মনে মনে। আমি সমস্বরে বললাম, ‘ঠিক আছে, আকর্ষণীয় চেহারাও অবশ্যই খুব সুন্দর হতে পারে।’
সে বল্ল- ‘আপনি তো বেশ প্রেমিক পুরুষ দেখছি।’ ‘কিন্তু সব কিছু এতো গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেন কেন বলুন তো?’
একথা শুনে, ভাবলাম, এখন অন্তত মেয়েটার জন্যে আমার একটু হাসি হাসি ভাব করা দরকার। কিন্তু হাসার বৃথা চেষ্টা করাটা আমাকে খুব অস্থির করে তুল্ল আর মনে হচ্ছিল রাজ্যের সমস্ত একাকিত্ব আমাকে ঘিরে ফেলেছে।’
কথার মোড় ঘুরিয়ে বললাম, ‘আপনার নেমে যাবার সময় চলে এসেছে।’ সামনেই তো আপনি নেমে পড়বেন।
- ‘যাক বেঁচে গেলাম, এই জার্নিটা খুব দীর্ঘ হলো না। দু-তিন ঘন্টার বেশি সময় ট্রেনে বসে থাকা আমার কাছে একেবারে অসহ্য!’
যদিও তখন আমি ভাবছিলাম আমি এরকম অনন্য সুন্দরী যাত্রীর পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে শুধুমাত্র তাঁর কথা শুনতে শুনতে যেকোন দূরত্বে ভ্রমণ করার জন্য আমি এক পায়ে খাঁড়া। তার কণ্ঠে ঝর্ণার কলকল শব্দের কী এক মোহময়তা। কিন্তু আমি জানি, সে যখনই ট্রেন থেকে নেমে যাবে, আর তার সাথে সাথে পেছনে ছুঁড়ে ফেলবে আমাদের মধ্যেকার এই অন্তরঙ্গতা। কিন্তু আমার সাথে তার রেস এই দীর্ঘ ভ্রমণ অবধি এমন কী এরপরেও আরো কিছুদিন থেকে যাবে।
ইঞ্জিনের শব্দ ধীরে ধীরে কমে আসছে। মেয়েটা আস্তে আস্তে তার জিনিস-পত্তর নামাতে শুরু করল। আমি কল্পনায় ভাবছিলাম, সে কী তার চুলগুলো খোঁপা করে রেখেছে, না কী বিনুনি করে রেখেছে! খুব সম্ভবত চুলগুলো তার কাঁধ অবধি এসে বাতাসে খেলা করছে অথবা আরো একটু ছোট করে ছাঁট দেওয়া চুল ঢেউ তুলছে?
ইস্টিশানে ট্রেন আস্তে করে থামল। বাইরে কুলি আর ফেরিঅলাদের হল্লাচিল্লা। এর মধ্যে আমাদের কামরার কাছে একটা নারীকণ্ঠের উচ্চকিত চীৎকারও শোনা গেল। খুব সম্ভবত মেয়েটার কাকী।
মেয়েটা বলল- ‘ভালো থাকবেন!’
সে আমাকে ঘেঁষেই দাঁড়িয়েছিল। এতোটা কাছে সে এসেছিল যে তাঁর মখমলের মতন নরোম মোলায়েম চুলের সুঘ্রাণ আমাকে মাতাল করে তুলেছিল। আমি হাত বাড়িয়ে তার চুলের পরশ নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এর মধ্যেই সে চলে গেলো। যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে এখনো তার চুলের মাতাল করা খোশবুর রেস ভেসে আসছিল।
কামরার দরজার দিকে কিছুটা ধন্দ লেগে ছিল আমার। একজন লোক কামরায় উঠে এলো আর তো তো করে ক্ষমা প্রার্থনা করছিল। এর মধ্যে কম্পার্টমেন্টের দরজাটায় সজোরে শব্দ হলো আর সেই সাথে আবারো বন্ধ হয়ে গেলো বাইরে পৃথিবী। আমি আমার জায়গায় ফিরে এলাম। গার্ড সজোরে বাঁশি বাঁজাল। আর সেই সঙ্গে ট্রেন ও চলতে শুরু করল। আমারও আবার নতুন করে নতুন যাত্রীর সাথে সেই খেলাটা খেলতে শুরু করতে হলো।
ট্রেন আবারো তার অদম্য গতিতে চলতে শুরু করল। ট্রেনের চাকাগুলোও কু-ঝিঁক ঝিঁক কু-ঝিঁক ঝিঁক ডাকতে শুরু করল। আমি জানালাটা খুঁজে পেলাম আর জানালার দিকে মুখ করে সূর্যের দিকে তাকালাম। যদিও বাইরে দিনের আলোয় উদ্ভাসিত মাঠ-ঘাট, চরাচর, কিন্তু আমি অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই টের পাচ্ছিলাম না।
জানালার বাইরে বাইরে কত যে কী ঘটে যাচ্ছে। বাইরে কী কী হচ্ছে সেটা অনুমান করা একটা খেয়ালী খেলা ও হতে পারে।
যে নতুন পুরুষ যাত্রীটা উঠে এলো, অকষ্মাৎ সে আমার চিন্তায় ছেঁদ ঘটালো।
‘আপনার পাশে থেকে যে অনন্য সুন্দরী যাত্রীটা মাত্র নেমে গেলো, তার মতন অতোটা আকর্ষণীয় যাত্রী আমি নয় আর এটা ভেবে আপনি নিশ্চয় খুব হতাশ হয়ে পড়েছেন।’
বললাম- ‘সে আসলেই খুব আকর্ষণীয় মেয়ে ছিল।’ ‘আচ্ছা আপনি কী বলতে পারেন- তার চুলগুলো লম্বা না কাঁধ অবধি ছিল?’
- ‘আমি মনে করতে পারছি না।’ আমার প্রশ্নে তাকে বিভ্রান্ত মনে হলো। ‘আমি তো তার অসাধারণ সুন্দর চোখজোড়া খেয়াল করেছিলাম, চুলের দিকে তাকাবার তো ফুরসতই মিল্ল না।’
‘তার চোখগুলো ছিল গভীর আর কারুকার্য খচিত, অনন্য সাধারণ। আফসোস এই চোখগুলো তার কোন কাজেই লাগলো না। খুব ভুল জায়গায় চোখ দুটো। সে তো সম্পূর্ণরুপে দৃষ্টিহীন, আপনি কী তা খেয়াল করেননি?’
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৩