যেমন; একবার, তিনি এলাকার একরকম উঠতি নেতাকে নিয়ে খুব মোলায়েম, একটা গল্প লিখলেন। খুব, আশ্চর্যজনকভাবে, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে, পরিতোষ কুশারি গল্পটি লেখার ঠিক দিন তিনেকের মধ্যে মারা পড়লেন নেতা। পরবর্তীতে, তিনি, অর্থাৎ শ্রী পরিতোষ কুশারি, যিনি, হাল আমলে, তরুণদের কাছে ণীল জলের বাইম মাছের মতন আশ্চর্য রকমের জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, নেতার বিদেহী আত্মার প্রতি গভীরভাবে শোকাভিভূত, বিদগ্ধজনদের মধ্যে যারা শোক সভার আয়োজন করলেন, যেখানে শকুন ও চিলেরা জমায়েত হয়েছিলেন, খবরের কাগজে বিবৃতি ছাপালেন, তাদের নিয়ে গল্প লিখলেন।
ভীষণ রকমের অপ্রত্যাশিতভাবেই, পরিতোষ কুশারির গল্পের সেইসব চরিত্ররাও, একে একে মারা খেলেন। কেউ নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দে, পাছায় রামদা’র কুপে, কেউ আবার পকেটমারের থাবায়, কেউ মলম পার্টির ডলা খেয়ে। সকলেই মারা পড়লেন।
পরিতোষ কুশারির একনিষ্ঠ পাঠক, বিদগ্ধ ভক্তজন, অবিনাশ মহন্ত, খুব অনুনয় করে ভগবানকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে অনুরোধ করলেন। এমনিতে অবিনাশ মহন্ত খুব ধাম্মিক যুবক। ভগবানের ভক্ত। পরিতোষ কুশারি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। ভগবানকে নিয়ে গল্প লিখলে যদি অন্যদের মতন, ভগবানও মারা পড়েন, তো জগৎ সংসারে পরিতোষ কুশারির আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। পরিতোষ কুশারির চরম দুর্দিনে, একমাত্র ভগবানই ছিল আশ্রয়। ভগবান পরিতোষ কুশারিকে কী না দিয়েছেন। জলজ্যান্ত, ভোরের ঘাসে লেগে থাকা সতেজ শিশিরের মতন, একখানা জীবন, দিয়েছেন, একটা চাকরি। চাকরি দিয়ে বিয়ে দিলেন। বিয়ে দিয়ে ফুটফুটে একটা সন্তানও দিলেন। আবার চাকরিতে উত্তরোত্তর সাফল্যও দিলেন। পরিতোষ কুশারি জানেন, বিনিময়ে ভগবান কখনোই কিচ্ছু চাননি। বিনিময় দিতে গেলেই ভগবান খুব ব্যথিত হবেন এটা ভেবেছেন বহুবার। ভগবান শুধু পরিতোষ কুশারিকেই নয়, তার দেখা আরো ঢের লোককে, সাধ্যমত আশ্রয় দিয়েছেন। চালের জন্য চুলো দিয়েছেন। ভগবান কখনো বিনিময় প্রত্যাশা করেননি।
সেই ভগবানকে নিয়ে পরিতোষ কুশারি গল্প লিখার সাহস পান না। গল্পে ভগবানকে যথার্থরুপে বর্ণনা করা যায় না। তবুও পরিতোষ কুশারি ভগবানকে নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করলেন। একদিন, সোনাঝরা সন্ধ্যায় গল্প লিখার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিলেন। রওজা মোড়ে হেজেসের ধোঁয়ায় আঁধার নামালেন। রাজা উজির মেরে দিলেন। এর মধ্যে পরিতোষ কুশারি, ভগবানকে নিয়ে গল্প লিখার খবর চাউর হয়ে গেলে, ভেতরে ভেতরে সকলে রেগে গেলেন। বিশেষ করে, বিগত নেতার অনুসারীরা, যারা ভগবানের ভক্ত, সকল কাজে, এমন কী মাইনষের গালে চড় বসানোর সময়, বুকে লাত্থি মারার সময়, ভগবানের নামেই সব করেন, তারা তো একেবারে সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলেন। ভগবানের ভক্তকুল, ধর্মের কাণ্ডারি, সজ্জন সকলে ভগবানের প্রহসন সইবেন কেন?
সেই গল্প কোন এক চান্নি পসর রাইতের ধল প্রহরে শেষ হলেও, ছাপা হয়নি তখনো।
কু ডাক পাখি তখন তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠল। পরিতোষ কুশারি গল্পটি লেখার পর মুখ থুবড়ে পড়ে রইলেন তার লেখার টেবিলে। মেঝেতে জবজবা রক্ত। দেয়ালে ছিটকে পড়া মগজ লেপ্টে আছে।
গল্পটি অবিনাশ মহন্তের কাছে পৌঁছালে, শনিবারের সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপানোর জন্য পাঠালেন। কিন্তু পরিতোষ কুশারির গল্পের এবারের চরিত্রের স্রষ্টা আর থাকলেন না। ভগবান বেঁচে গেলেন কী না, সেটাও ঢের প্রশ্ন সাপেক্ষ। ভগবান মারা পড়েন না, এটাই সকলের অনুমেয়।
পরিতোষ কুশারির গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ ছিল ‘এ হচ্ছে সেই ভগবানদা’ আমাদের একমাত্র ভগবান দাশ, যে ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে, ধেয়ে আসা রোদ ছায়ায় নানান মানুষের মুখচ্ছবি আঁকতেন। তাঁর অঙ্কিত মুখচ্ছবিগুলো বাস্তবে রুপ ধারণ করত। শিক্ষকেরা একদিন তাঁকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আমরা পাঠ চুকিয়ে যখন হোমড়া চোমড়া হয়ে উঠেছি তখন ভগবান আমাদের মতন ছা’পোষাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন’।
পরদিন সকালে, নিত্যানন্দপুর বাজারের নদীর পাড়ে, উপুড় হয়ে থাকা একটা লাশ দ্যাখে পাড়ার কয়েকটা নেড়িকুত্তা ঘেউ ঘেউ করে উঠলে, অবিনাশ মহন্ত নদীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:৩১