তোর কপালটা কত্ত বড়। ইশ্ আমার যদি এমন কপাল হতো, এই বলেই সখিনা খালা একটা চওড়া হাসি দিলেন!
ঠিক এমনই একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলেন তোরাব আলী সিকদার। খুব মোলায়েম। খুব নরোম, কোমল একটা গল্প। কিন্তু গল্পটা লিখতে গিয়ে, তোরাব আলী সিকদার খেয়াল করলেন, গল্পের চরিত্রগুলোর নিজস্ব কোন পরিচয় নেই।
তোরাব আলী সিকদারের চোখের সামনে ভেসে উঠল, প্রথম যেদিন স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন, পাড়ার বড় ভায়ের হাত ধরেই, নিজের নাম বলার পরও হেডমাস্টার জানতে চাইলেন, বাবা মায়ের নাম। সাথে বড় মামা আর বড় চাচার নামও বলতে হয়েছিল। কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে ফুফার নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর বড় ভাই, ব্যাচ, কত সালে মেট্রিক, বাড়ি, কোন ডিপার্টমেন্ট আরো নানা কিছু। হল, রুম নাম্বার। চাকরি নিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই, কার সাথে একদিন মাঠে খেটেছিল, কার সাথে জাম্বুরা তলায় গিয়েছিল এইসব পরিচয় দিতে হয়েছিল।
তোরাব আলী সিকদার খেয়াল করলেন তার নিজস্ব কোন পরিচয় নেই। অফিসের মিটিংয়ে, কোন ওয়ার্কশপে, ট্রেনিংয়ে, সব জায়গায় নিজের নামের পাশাপাশি আরো কিছু না কিছু বলতে হয়। তো নিজের নামটা, কিংবা সাক্ষাত জলজ্যান্ত মানুষটা কোন সত্ত্বা নয়। তার নিজের কোন পরিচয় নেই।
তোরাব আলী সিকদার একদিন ঠিক করলেন, কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে, শুরু করবেন এইভাবে- আমি অমুকের ছোটভাই, এখন অমুক আমার বস, তিনি খুব নাম করা লোক নিজের ক্ষেত্রে, যার সাথে এখন আমি কাজ করি তিনি তো প্রচন্ড মেধাবী, নিপাট ভদ্রলোক, আমার বাড়িটা একেবারে বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে, পাহাড় আর সমুদ্রের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেড়ে উঠে, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে, অমুক বিষয়ে পাঠ শেষ করে অমুক অর্গানাইজেশনে অমুক পজিশনে প্রথম চাকরি শুরু করি। আমি অমুক অমুক ক্ষেত্রে পারদর্শী। আমার অমুক বিষয়ে একটু দূর্বলতা আছে তবে সেটা আমি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। আমার মামা এই করেন। অমুক কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই। একই হল, একই ডিপার্টমেন্ট। এক সাথে ট্রান্সপোর্টে কত আড্ডা দিয়েছি। অমুক আমার বন্ধু। অমুকের সাথে কী যে খাতির!
- আপনার নামটা জানতে চেয়েছিলাম। তাই কিন্তু বলেননি।
- আমি জানতাম, আমার নাম বলার পর বলতেন, ব্যাস, এটুকুই?
আমার এখন ভালো লাগছে, আমার সব কিছু শোনার পর আমার নামটা জানতে চাইলেন। আমার নামের নিজস্ব একটা পরিচয় আছে, সেটা এতোদিন পর বুঝলাম। কিন্তু আমার নিজস্ব কোন পরিচয় নেই। এই যেমন, নাম বললে জন্মসাল, জন্মসাল বললে স্থান, স্থান বললে পড়াশোনা তারপর বড় ভাইদের নাম, বন্ধুদের নাম।
সখিনা খালার গল্পটা তোরাব আলী সিকদার শেষ করলেন না, নিজের গল্প বলতে গিয়ে। সখিনা খালার কপালের নিজস্ব কোন পরিচয় ছিল না। তাই তোরাব আলী সিকদারের কপালের মতন একটা কপাল চেয়েছিল।
এইভাবে পরিচয়হীন বেড়ে উঠে সকলে। একদিন চলেও যায় পরিচয়হীন আরেকটা জায়গায়। মানুষের নিজস্ব কোন পরিচয় নেই, থাকে না।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৭