সম্প্রতি চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের আত্মহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে এই দীর্ঘ লেখা । 1st PERSON এ লেখা হলেও সবগুলো ঘটনা আমার ব্যক্তিগত ঘটনা নয় ।
এক চান্সে প্রফ পাস,পলিটিক্স এবং প্রেম-এ তিন জিনিস কখনো এক সাথে হয়না। মেডিকেলে ভর্তি হতে এসে প্রথম দিনই শুনলাম। উচ্চশিক্ষার্থে মফস্বল গমন-ভর্তি হলাম শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে(কেউ মাইন্ড করবেন না,এখন সাতক্ষীরাতেও মেডিকেল কলেজ চালু হয়েছে)।
মাইগ্রেশন করে চট্টগ্রামে থিতু। ফার্স্ট ইয়ারের সেই অদ্ভূত সময়। চারিদিকে শুধু নতুন মুখ । একেকটা দিন একেকটা সম্পর্কের শুরু , বন্ধুতার শুরু। ক্যাম্পাসের সিনিয়রেরা কিভাবে যেন তাকায়,কেমন করে যেন কথা বলে,কথায় কথায় “PAIN” বলে। ডিসেকশন টেবিলে,কলেজের করিডোরে,সন্ধানীর অফিস কিম্বা হোস্টেলের মেসে চোখাচোখি হতে হতে বন্ধু বাড়তে থাকে। ভাগ্যবানেরা অথবা চালু পাবলিকেরা জুটিয়ে ফেলে রিডিং পার্টনার। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারেনা(ভুল কথা)-কেউ কেউ ভাই-বোন বানায়। লাইব্রেরিতে ডেস্কের ওপাশে জুটি এপাশে একজন দলছুট। সেই নিঃসঙ্গ দলছুট এবং জুটির গল্প করছি।
হঠাৎ করেই একলা লাগার শুরু।বাসা থেকে অনেক দূরে। আমার খোলা বারা্ন্দা,পড়ার টেবিল,PC নিদেনপক্ষে টিভির রিমোট থেকে দূরে। বাসার বাইরে না থাকলে নাকি পৃথিবীটাকে বোঝা যায়না। ধাক্কাটা প্রথম লাগলো ক্যাম্পাসে এসে। ছোট ক্যাম্পাস-এখানে গান্ধী পোকা নড়াচড়া করলেও তার গন্ধ যায় সবার কাছে। আপনার যে কোন কাজে আপনার সম্পর্কে সবচেয়ে জঘন্য NEGETIVE ধারণা করবে এখানকার মানুষ। আপনাকে ছোট করতে পারলেই আমি বড় হব-BASIC PRINCIPLE । এখানে কথা বলতে হয় মেপে মেপে,SOCIAL SMILE দেবার আগে দুবার ভাবতে হয় হাসির INTERPRETATION না জানি কি হয়। “আমার এই মুহুর্তে একজন কথা বলার মানুষ দরকার"-১৮/১৯ বছরের রোমান্টিক একলা লাগা নয়,DIE HARD NEED একজন কথা বলার মানুষের। এভাবেই ভুল সম্পর্কে জড়ানোর শুরু।
স্কুল-কলেজের সেরা ছাত্র/ছাত্রী ফার্স্ট টার্মেই ফেল করে বসে এনাটমি/ফিজিওলজিতে। GUYTON-GANONG মোটামুটি পড়েও স্যারের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ি। CVS কার্ডে একবার একসপ্তাহ পড়ে গিয়ে ক্লাস টেস্টে একটা প্রশ্নও কমন না পেয়ে টেবিলের উপর খালি খাতা ছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম। ভাগ্যিস মমতাজ ম্যাডাম দেখেননি। স্যারদের কেমন শীতল ব্যবহার,তাহের স্যারের খুনি চোখ। DEMO দিতে আসে কোন কোন সিনিয়র কিন্তু নিঃস্বার্থ নয়। “ধুর বেটা এগুলা কোন ব্যাপার না”-পলিটিকাল ভাইয়েরা সিগারেট এগিয়ে দেয়। এসো নবীন দলে দলে- মিছিলে কিছু নতুন মুখ দেখা যায়। ক্যাম্পাস বন্ধুমহল শিক্ষকদের মাঝে যত পরিচয় বাড়ে ভেতরে ভেতরে SELF CONFIDENCE শুন্যে নেমে আসে।
দুপুর পর্যন্ত ক্লাস,বিকেলে ঘুমিয়ে উঠে আমার করার কিছু নেই। সময় কাটেনা সন্ধানী বা টিউশনি নেই,প্রতিদিন নিয়ম করে পড়শোনা করার অভ্যাস নেই। এদিকে আস্তে আস্তে পড়া জমে। আইটেমগুলো যেমন তেমন করে দিলেও কার্ড-টার্মের পড়া চক্রবৃদ্ধি হাড়ে বাড়তে থাকে। INFERIORITY COMPLEX এবং HEROSIM সমান্তরালে চলে। HEROISM কারণ এক সপ্তাহ টানা পড়ে সব কিছু শেষ করে ফেলতে পারবো। কাল ভোরে উঠে শক্ত পড়া দিবো,দেয়ালে বা টেবিলে নোট ঝুলাই-THINGS MUST BE DONE নতুন রুটিন। কিন্তু সেই কাল কোন দিন ও আসেনি। সব কিছু অগোছালো হতে থাকে-সকালে নাস্তার ঠিক নাই,চুল দাঁড়ি বাড়ছে বাড়ুক। বাসার সাথে যোগাযোগ কম,বন্ধুদেরও এড়িয়ে চলতে চলতে বিশেষ কারো উপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে।
এক হাতে তালি বাজে না-কখনো ছেলেটা DESPARATE কখনো মেয়েটা SEARCHING FOR BETTER OPTION অথবা VICE VERSA ।COMMITMENT বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব কিম্বা SUPER EGO । বন্ধুদের দলে EGO , বিশেষ কাউকে এক চুল SPACE না দেয়া অস্বস্তির জন্ম দেয়,ডেকে আনে নিসঙ্গতার সর্বনাশ । অবশেষে সবাই একা, নির্জন দ্বীপের মত ISOLATED ।
বাইকে স্পিড ৮০-৯০ পার হলে এক ধরনের নেশা পেয়ে বসে,আরো স্পিড বাড়ানোর নেশা-স্পিড মৃত্যু সীমা অতিক্রম করে।তেমনি চেপে বসা অস্বস্তি আরো DESPARATE করে । প্রথম প্রথম ৮টার লেকচার মিস,এরপর টিউটেরিয়াল। আইটেম পেন্ডিং হতে হতে সাপ্লির দুষ্ট চক্রে আটক। ক্লাসটাস না করায় ব্যাচমেটদের সাথে দূরত্ব বাড়ে ওরাও এড়িয়ে চলে।
মনের সব চেয়ে কাছে হলো শরীর। সব শাস্তি-অত্যাচার বেচারা শরীরের উপর। না খাওয়া,INSOMNIA । সারা রাত জাগার পর ভোর হলে খুব অসহায় লাগে। কখন আবার অন্ধকার হবে,আমি একটু ঘুমাতে চাই। প্রথম প্রথম ঘুম পেলেও একটু পর পর ঘুম ভাঙে।বৃষ্টির শব্দ অসহ্য লাগে। সারাদিন CONSTANT BACK PAIN হয়, অনেক ক্লান্তি। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা,অন্ধকারে বসে থাকতে ভালো লাগে,একই গান বার বার শুনি। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বিরক্ত লাগে,খুঁটিনাটি কারণে খুব রাগ হয়। সব সময় মন ছোট হয়ে থাকে,এটা ওটা ভুলে যাই,চশমা ভাঙ্গি অসাবধানে। মনে হয় কিছুই পারিনা,ভিড়ের মাঝে মনে হয় চিৎকার করি অথবা দূরে কোথাও চলে যাই যেখানে কেউ আমাকে চেনে না। আবার সব কিছু শুরু করি নতুন করে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিছু না করতে পারার অনুভূতি খুব খারাপ-একটানা সিনেমা দেখে কেউ,মিগে চ্যাট করে,রাতভর রেডিও শুনে কিম্বা মুঠোফোনে কথা চাষ,কেউ সিগারেট ধরে,বৃহস্পতিবার রাতের ডেক্সপোটেন সিরাপ নিয়মিত হয়,চাইলে গাঁজাও পাওয়া যায় এখানে সেখানে।অভিমানী মেয়েটা বাথরুমে মুখ ধুতে গিয়ে একটু কেঁদে নেয়। জেদ করে মেয়েটা ANTI CUTTER কিম্বা ভাঙ্গা চুড়ি দিয়ে সাদা হাতে লাল আঁচর কাটে। নিজেকে HATE করা শুরু হয়-কখনো ADDICTION এ সমাধান খুঁজে। খুব SILLY কারণে ULTIMATE DECISION নেয়-৪০টা ঘুমের বড়ি।
মেডিকেলে FATHER FIGURE এর বড় অভাব যাকে দেখলে মনে হয়-ইসস যদি স্যারের মত হতে পারতাম বা ঐ বড়ভাইয়ের মত পড়তে পারতাম। এমন মানুষ কম যার সাথে সব কিছু শেয়ার করা যায়। খেয়ালখুশি মত পাশ করানো স্যারদের অবন্ধুসুলভ আচরণতো আছেই। এক ফার্স্ট প্রফে খারাপ করে কত বন্ধুর জীবনটাই বদলে গেল। ক্যারিয়ার নিয়ে কোন ধারণাই দেয়নি কেউ কখনো,শুধু জানি আমাকে পাস করতে হবে। পাস করার পর দেখি চারিদিকে ডাক্তারদের নিয়ে HATE CAMPAIGN । আমি নিজেও হতাশার বিজ্ঞাপন কম দেইনা।
লেখা শুরু করেছিলাম আত্মহত্যার খবর দিয়ে। আমি শুধু হতাশার শুরুটা বলতে চেয়েছি। ডুবন্ত পর্বতের চুড়ার কথা বলি। গত তিন চার বছরে মিডিয়ায় আসা কয়েকটা মেডিকেল ছাত্র বা ডাক্তারদের আত্মহত্যার ঘটনা এক লাইনে লিখছি(নাম উল্লেখ করবোনা কয়েকজনের)।
২০১২ এপ্রিল, ঢাকা মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। আত্মহত্যার কারণ- এক বছর আগে বড় ভাইয়ের মৃত্যু।
২০১১ ডিসেম্বর, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ১ম বর্ষের ছাত্রী। বাবা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের প্রফেসর।বুয়েটে চান্স পেয়েও মেডিকেলে ভর্তি হয়(সম্ভবত অনিচ্ছায়)।
আত্মহত্যার কারণ বলা হয়েছে ল্যাপটপ কিনে না দেয়ায়।
২০১১ নভেম্বর,হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী-কারণ পরীক্ষায় খারাপ করা।(আমার ব্যাক্তিগত মতামত-প্রাইভেট মেডিকেলে কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয় যারা মেডিকেলের পড়াশোনার সাথে পেরে উঠতে পারেনা)
২০১০ নভেম্বর, মেডিকেল ছাত্রী লিলিয়ানা(কলেজ উল্লেখ নেই)-কারণ ফর্সা না বলে বয়স্ক ব্যক্তির সাথে বিয়ে দেবার পর সংসারে আশান্তি।
“আজ স্যার যে অপমান করেছেন তা আমি কোন দিন ভুলবো না-শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ছাত্র মধুসূদন তার সুইসাইড নোটে লিখে রেখে গিয়েছিল। ডিসেম্বর ২০১০।
স্যারের অপমানের কারণ সে আইটেমের সময় তোতলানোর অসুবিধা ছিল। সাংবাদিক ছাগলের বাচ্চাগুলা পত্রিকায় লিখেছে ছেলেটা নাকি প্রতিবন্ধী ছিল। তোতলালে যদি প্রতিবন্ধী হয় বা স্যার অপমান করে তাহলে আইটেমে কেউ কোন দিন পাস করবেনা।
২০১০ ডিসেম্বর, ঢাকা মেডিকেলের ৪৭তম ব্যাচের এক ছাত্র।২১ বছর ধরে ফাইনাল প্রফ ক্লিয়ার করতে পারেনি। পড়াশোনা DISCONTINUE করেছিল মাঝখানে। এরপর বেশ কয়েকবার ফাইনাল প্রফ দিলেও পাশ করায়নি স্যারেরা। হয়তো যোগ্যতা ছিলোনা কিন্তু পরিণতি এমন কেন হবে। এক্ষেত্রে বলে রাখি শুধু মাত্র পলিটিক্যাল কারণে কোন কোন ক্যাম্পাসে অনেককে সরকার বদলের পর ৪/৫বছর ক্যাম্পাসেই ঢুকতে দেয়া হয় না। আবার আমাদের ক্যাম্পাসে পলিটিকাল কারণে এক সিনিয়রকে গাইনীতে সাত বছর টানা ফেল করানোর ঘটনাও আছে(ম্যাডামের অবশ্য কারণ ছিল)।
জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ বাজিতপুরের এক ভাই ফাইনাল প্রফে বেশ কয়েকবার খারাপ করেন। বাবা মধ্যবিত্ত স্কুল শিক্ষক। বাজিতপুরেই একটু মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট মেডিকেল হিসেবে ভর্তি হয়। প্রতিবার খারাপ করলে বাড়তি খরচ দিতে হয়। সে খরচের টাকা যোগাড় করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেন। তিনি সম্ভবত ১১ত ব্যাচের ছাত্র(কেউ জানলে একটু CONFIRM করবেন)।
২০১০ অক্টোবর, ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের কারণে বাজিতপুর মেডিকেলে কর্মরত একজন চিকিৎসক আত্মহত্যা করেন(কারো জানা থাকলে CONFIRMকরবেন)।
তাঁর স্ত্রী তিন মাস আগেই সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন।
আমার দুজন ব্যাচমেট এই পথে হারিয়ে গেছে,ব্যাচমেটের সুইসাইড কিম্বা ATTEMPT এর কথা লিখবোনা একবন্ধুর কাছে প্রমিস করেছিলাম।
এই লেখার কোন CONCLUSION নেই।
মেডিসিন ওয়ার্ডে ইন্টার্নীর সময় অনেক মেডিকেল স্টুডেন্টকে ভর্তি হতে দেখেছি প্যারাসিটামল পয়সনিং নিয়ে। SEDATIVE POISONINGএর চেয়ে এটা যে ভয়াবহ এটা শুধু আমরাই(মেডিকেল পারসন) জানি,আরো নতুন কিছু INNOVATIVE IDEA বের হচ্ছে। ডেভিডসনে বলা আছে যারা একবার ATTEMPT নেয় বা SELF HARM(যেমন হাত কাঁটা) তাদের ২০% আবার নেবে এবং ১-২% তৃতীয় প্রচেষ্টায় মারা যাবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাদিন একটা জড় স্ক্রিনের সাথে কথা বলি পাশের মানুষটাকে জিজ্ঞেস করার সময় কোথায়-কেমন আছেন?
(চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের যে ইন্টার্ন আত্মহত্যা করলো গত কয়দিন ধরে তাঁর মুখ আমাকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। ওদের সাথে আমিও ৬মাস ইন্টার্নি করেছি। অনেককে হয়ত নামে চিনিনা কিন্তু চেহারায় চিনি। তামান্নাকে আমি চিনতাম না কিন্তু যাঁদের সাথে কাজ করেছি কিন্তু নাম জানিনা তাদের মুখ শুধু চোখের সামনে ভেসেছে গতকয়টা দিন। তাই নিজের কথাগুলো বললাম হয়তো একদিন আমিও এই গলির মুখে ছিলাম,জানিনা হয়তো গলিটা একটা কানা গলি কিম্বা ONE WAY ROAD । ধন্যবাদ UN । গলিটার শেষ মাথার দেয়ালে মানুষ চলে যাবার মত একটা ছিদ্র যেন করতে পারে আমার বন্ধুরা এই কামনায় এত বড় লেখা)-
সংগ্রহীত(Mohib Nirob০)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৭