আমি চমকে বাম পাশের সিটে বসা ছেলেটার দিকে তাকালাম । মুহুর্তের মধ্যে আমার চোখ মুখ কুচকে গেল । চোখ সরু করে তার কথার ওজন মাপার চেষ্টা করতে লাগলাম । সে আবার বলল-
-"বড় ভাই কি আমাকে একটা কিডনি দিতে পারবেন ?"
আমার মেজাজ পুরা মাত্রায় খারাপ হয়ে গেল, হারামজাদা বলে কি ! এমন অবলীলায় কিডনি চাইছে যেন আমি আমার সারা গায়ে কিডনি ঝুলিয়ে রেখে হকারি করছি,....আই কিডনি লাগে.... কিডনি.... । আর ও বাসা থেকে আসার সময় মানি ব্যাগ ফেলে এসেছে, কিনে নিতে পারছে না তাই চাইছে,বিরাট লজ্জার মধ্যে পরে গেছে । একটা কিডনিই তো ! খুব মামুলি ব্যপার ।
হাজামজাদাকে থাবরায়ে মাটিতে শোয়ায়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল । মেজাজ যখন এহেনো পর্যায়ের খারাপ, তখন হঠাত আবিষ্কার করলাম কোথা থেকে যেন পেশাব এর পিন পিন গন্ধ আসছে । আমি মহাবিরক্ত । একে তো বিথীকে দেখি না ৭-৮ দিন ধরে,মাথা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে তার মধ্যে এই কিডনি বিষয়ক জটিলতা । কষে একটা ধমক মারার প্রস্তুতি নিচ্ছি এই পর্যায়ে ডান পাশের ছিটে বসা ছেলেটার মা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
- বাবারে আমার ছেলের কথায় কিছু মনে করবেন না... ও খুব অসুস্থ্য.... ওকে ঢাকায় কিডনি ফাউন্ডেসনে চিকিতসার জন্য নিয়ে যাচ্ছি..... অবস্থা খুব একটা ভাল না .....
ভদ্র মহিলা মুখে আচল চাপা দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন । মায়ের ডান পাশে বসা ছেলেটার খালাও একই কায়দায় মুখে আচল চাপা দিলেন । আমি ইমোশানে গলে পানি হয়ে গেলাম, সম্ভবত আমার কাপড়ে আচল থাকলে আমিও মুখে আচল চাপা দিতাম..... কিন্তু সম্ভব হল না......
কথা বলে জানতে পারলাম ছেলেটার নাম সোহেল,বয়স ১৮ কি ১৯ । মাথা ন্যড়া । শীতকাল হবার কারনে, গায়ে দুটা মোটা জ্যকেট এক সাথে চাপিয়েছে বলে শরীরের গড়ন বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত কিডনি রোগে ভোগার কারনে গায়ের শীতটা একটু বেশি অনুভত হচ্ছে । কি এক অদ্ভুত কারনে যেন সে সুস্থির হয়ে বসতে পারছেনা । কেমন যেন উটবিষ উটবিষ করছে । তার ডান পাশে আমি বসে এবং আমার ডানে বাসের আইল যেখান দিয়ে মানুষ যাওয়া আসা করে তার পাশের দুই সিটে তার মা ও খালা । গাড়ি হু হু করে যশোর রোড ধরে ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে । রাত আনুমানিক দুটার মতো বাজে,আমি মাত্রই তন্দ্রার মতো এসেছি । হঠাত বুঝতে পারলাম ছেলেটার মা আমাকে টোকা দিচ্ছেন ।
-বাবারে...
-জী খালাম্মা বলেন ।
-এই ডিমটা আমার ছেলেরে দেন ।
আমি দিলাম । সোহেল যন্ত্রের মতো ডিম মুখে পুড়ে সাবার করে দিল । তার মা পানি এগিয়ে দিল আমিও কোন বাক্য ব্যয় না করে সোহেলের কাছে পানি পৌছে দিলাম । সে পানি খেয়ে বোতল সামনের জালিতে ভরে রাখলো । এরপর শুরু হল আমার সার্ভিস দেবার পালা । যেই ঘুমের মতো আসছি, খালাম্মা আমাকে জাষ্ট টোকা দিচ্ছেন । এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন আমিও কোন বাক্য ব্যয় না করেই সোহেলকে সার্ভিস দিয়ে চলেছি । অবস্থা এমন যে, মাঝে আমি আছি এটা কোন ব্যপারই না,খালাম্মা চোখের ইশারায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন,আমিও যথাবিহীত সম্মান প্রদর্শন পুর্বক তার অজ্ঞা বহন করে যাচ্ছি । একবার বাসের সেই আলো আধারির মধ্যেই তিনি আমার হাতে একটা কাঠির মতো বস্তু ধরিয়ে দিলেন ।হাতরে হাতরে মোবাইলের আলো জ্বেলে বুঝতে পারলাম সেটা একটা থার্মোমিটার । সোহেলের মুখে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দিয়ে খালাম্মাকে তার বাধ্য সন্তানের মতো রিডিং জানিয়ে দিলাম ।
-খালাম্মা একশ দুই…
খালাম্মা বিজ্ঞ জনের মতো মাথা ঝাকাতে লাগলেন যার অর্থ হল “হু… আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম” খালাম্মা মুখে কোন আওয়াজ দিচ্ছেন না ।
গাড়ি চলছিল ভালই । হঠাত গাড়িতে কিভাবে যেন আতংক ছড়িয়ে পরলো । গাড়ি যে গতিতে যাচ্ছিল তার চেয়ে ডাবল গতিতে ছোটা শুরু করলো । চিকন টাই পরা হেল্পারের আতঙ্ক আলাপে বুঝতে পারলাম সম্ভবত একদল ডাকাতের গাড়ি আমাদের গাড়িকে ফলো করছে । ফাকা রাস্তায় আমাদের আগে যেতে পারলেই কেল্লা ফতে করে দেবে । হেল্পার সাহেব সরু গলায় আমাদের সবার উদ্দেশ্যে আয়তাল কুর্সি পরার জন্য পরামর্শ দিলেন । আমি আয়তাল কুর্সি জানিনা । দোয়া ইউনুস জানি । ছোট দোয়া কিন্তু বিরাট কাজের জিনিস । দোয়া ইউনুস পরে আল্লাকে বলতে লাগলাম 'হে আল্লাহ মাছের পেট থেকে দরকার নাই আপাতত ডাকাত ভাইদের হাত থেকে এবারের মতো আমাদের বাচাও ।'
একেতো ডাকাতের ভয়, অন্যদিকে গাড়ি যে গতিতে চলছে তাতে স্বর্গে পৌছে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছিল না।
দোয়া ইউনুস্ এর একপর্যায়ে অবাক হয়ে একসময় লক্ষ করলাম, খালাম্মা বা তার বোন বা সোহেলের এতে তেমন কোন ভ্রক্ষেপ নেই । তারা খুব আরাম পাচ্ছে বলে মনে হল,যাকে বলে আরাম ঘুম । বাসের লাইট জ্বলে উঠেছে । সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে । সবার চোখে মুখে ভরসা হারা দৃষ্টি । আমি খালাম্মার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি ও তার বোন একে অন্যের কাধে মাথা রেখে আরামে ঘুমাচ্ছেন, যেন “এবাধন যাবে না ছিড়ে” । সম্ভবত এদের কথা চিন্তা করেই মান্নাদে গেয়ে উঠেছিলেন “সে আমার ছোট বোন বড় আদরের ছোট বোন”….
প্রায় হঠাত করেই বাস জোড়ে ঝাকুনি খেলো । সোহেল সাহেবের ঘুম ভাংলো । ঘুম থেকে উঠেই তার যেন কি হল, সে মাজা চেপে ধরে,মুখ খিচিয়ে ওরে বাবারে ওরেমারে বলে বিকট চিতকার করতে লাগলো…
-সোহেল কি হয়েছে…
-ভাই গাড়ি থামাইতে কন পিশাব করবো…আমার কিডনিতে সমস্যা পিশাব না করলে কিডনিতে খুব যন্ত্রনা হয় । ভাই আল্লার দোহাই লাগে আপনে গাড়ি থামাতে বলেন ।
-তুমি কি পাগল হয়ে গেছো.. পেছনে ডাকাতের গাড়ি তারা করছে আর তুমি এ অবস্থায় গাড়ি থামাতে বলো, মানে কি !
সোহেল চিতকার দিয়ে হেল্পার কে গাড়ি থামাতে বললো । আর কই যায়, বাসের সবাই আতঙ্ককে প্রায় ডুকরে কেদে উঠলো । সবাই ভাবলো ডাকাতের একটা দল গাড়িতেই আছে এখনই ডাকাতি হবে!
-ভাই গাড়ি থামান পিশাব করবো ।
গাড়ির সবাই চিতকার দিলো
-ওই শালা ড্রাইভার ডাকাত গাড়িতে তুলে আনছস । খবরদার গাড়ি থামাবি না । জোড়ে টানদে… খবরদার গতিকমাবি না….(অমুকের পোলা..... )
-ভাই গাড়ি থামান পিশাব করবো... আল্লার কসম লাগে ভাই গাড়ি থামান....
সবাই আতংকে আমাদের সিটের দিকে তাকাচ্ছে । জীবনে ফাপর কাহাকে বলে, কত প্রকার, আর কি কি সব টের পেলাম । যদি একবার পাবলিক মাইর শুরু করে তাহলে শুধু হাড্ডি নিয়ে বাড়িতে পৌছাতে হবে,চামড়া এরা খুলে রাখবে । তার চেয়েও বড় ভয়, বিথিকে কি জবাব দেবো… বাড়ি পৌছামাত্র বিথি খুব স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইবে
-কি ব্যপার তোমার চামড়া-মাংস এসব কোথায় রেখে এসেছো ! তোমাকে তো এ অবস্থায় ইন্ডিয়া পাঠাইনি !
-গাড়িতে ডাকাত সন্দেহে মার খেয়েছি । গাড়ির মানুষেরা চামড়া মাংস সব খুলে রেখেছে ।
বিথি “ও… তাই …. ঠিক আছে” বলে বাবার বাড়ি চলে যাবে ইহো জনমের মনে । আমার কি হবে ! তখন রাস্তায় রাস্তায় বৌরাগী হয়ে গান গাইতে হবে...
“নিম তিতা, নিসিন্দা তিতা, তিতা পানের খর তার চেয়ে আরো তিতা,চেয়ে আরো তিতা বউ ছাড়া ঘর রে বউ ছাড়া ঘর…” এটা আমার পক্ষে সম্ভব না ।
আমি সোহেল কে কসে এক ধমক দিলাম ।
-ওই হারামজাদা…চুপ কর… পাবলিকের মাইর খাওয়াতে চাস ? চু্প ।
-ভাই পেশাব করবো…. ওরে বাবারে মরে গেলাম রে….
আমি উপায় অন্ত না দেখে বললাম
-এখানেই করে দে যা হবার হবে,পরে দেখবো,তবুও আল্লার ওয়াস্তে চুপ কর ।
-ভাই আপনার পানির বোতলে করি, বোতল টা দেন …
আমি বোতল এগিয়ে দিলাম, সে জানালা দিয়ে আমার দুই লিটার মাম পানির বোতল খালি করে দিলো… তার পর সেখানে তার কর্ম সেড়ে সদ্য ধোয়া ওঠা বোতলটা রাস্তায় ফেলে দিল । খালাম্মা তখনও ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে সুখো নিদ্রা দিচ্ছেন ।
সকাল বেলা যখন গাবতলীতে পৌছালাম খালাম্মা অনেক গুলো উপদেশ দিয়ে গেলেন । আমি খুব মনযোগ দিয়ে শুনলাম
-বাবারে… মানবতা বলে তো একটা কথা আছে নাকি । পাশে অসুস্থ্য মানুষ থাকলে একটু দেখভাল করতে হয়না ! খালি ঘুমালে চলে ! আজ যদি সোহেল তোমার আপন ছোট ভাই হতো তাহলে তুমি সারা রাত ঘুমাতে পারতে ! আর নাইট কোচে ঘুমাবা না, কথন কোন বিপদ হয় বলা যায়… আজ যে কিছু হয় নাই, সহি সালামতে এসেছি এটা নেহায়েত আল্লার ইচ্ছা । ঠিক কিনা কও'….আমি উত্তর দিলাম ‘জ্বী খালাম্মা ঠিক,সবই আল্লার ইচ্ছা’ । 'আর মা খালাদের সম্মান করবা কেমন,জীবনে অনেক দুর যেতে পারবা,ঠিক আছে আসি'
আমি খালাম্মার কথায় যন্ত্রের মতো মাথা নাড়লাম যেন সব বুঝেছি,আপনার কথা মনে রাখবো।
সোহেল চলে যাবার সময় বললো
-বড় ভাই আসি । কিডনিতে বড় জ্বালা বড় ভাই । আমার জন্য দোয়া রাখবেন । যেন একটা কিডনি জোগার হয় । আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করে দিলাম ।
সকল ঝক্কি ঝামেলা শেষে দোকানে এসে একটা পানির বোতল চাইলাম । দোকানদার একটা মাম পানির বোতল দিল । চুমুক দিতেই কেন যেন সোহেলের হাতের ধরা ধোয়া ওঠা রাতের বোতলটার কথা মনে হতে লাগলো… ওয়াক থু করে ফেলে দিলাম ।
ধোয়া তোলা পানির বোতল আমার মাথায় ভরে দিয়ে সোহেল চলে গেলো । এরপর থেকে দুর পাল্লার বাসে উঠলেই পাশে বসা মানুষটার সাথে গল্পের ছলে একটা প্রশ্ন করি, ‘ভাই আপনার কিডনি ঠিক আছে তো?’ সে অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে ‘এতো রেখে আপনি কিডনির খোজ নিচ্ছেন কেন,উদ্দেশ্য কি ?’ আমি এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনা । আসলেই কি কোন উত্তর আমার জানা আছে ? শোভন ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৫৮