হঠাত করেই রাস্তার এক সস্তা নেড়ি কুকুর-এর সাথে (সম্ভবত মেয়েকুকুর) আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেলো । আমি গভীর রাতের পাখি, সপ্তাহে অন্ত:ত তিন দিন আমি অফিস করে বাড়ি ফিরি রাত আড়াইটায় । আমি যে এলাকায় থাকি, সম্ভবত এই এলাকার কুকুর সম্প্রদায়ের মধ্যে “জন্মনিয়ন্ত্রন” বা “পরিবার পরিকল্পনা”-র কোন বালাই নেই । অবাধে কুকুরের চাষ হচ্ছে- যে যার যার মতো করে তার পরিবার বড় করছে । কুকুর সমাজে বর্তমান “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর ধারনা এখনও সম্ভবত সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি । তারা এখনও মধ্যযুগীও কায়দায় “মুখ দিবেন যিনি আহার দিবেন তিনি” –তেই বিশ্বাষ করে তাদের কর্ম (!) চালিয়ে যাচ্ছে । ফলে আমি তার নির্বিচার স্বীকারে পরিনত হচ্ছি বিগত দুই বছর ধরে ।
রাতে অফিসের গাড়ি যেখানে আমাকে নামিয়ে দেয়, সেখান থেকে আমার বাসা তিন মিনিটের হাটা পথ । নিস্তব্ধ এই তিন মিনিটের পথই আমার কাছে অনন্ত যাত্রার মতো দ্বীর্ঘ মনে হয় । মনে হয় পুলসিরাত পার হওয়াও সম্ভবত এর চেয়ে সহজ । কারন সেখানে এমন অবাধে কুকুরের ঘোরাফেরা থাকবে না । থাকলে হুজুরদের বয়ানে তার উল্লেখ থাকতো……!
রাস্তায় পা রাখা মাত্রই দুর থেকে একটা কুকুর চিতকার করে উঠলো । আমি মনে মনে জপতে থাকি “আরে ভয় কিসের, কুকুর তো অনেক দুরে আছে” । বুকচিতিয়ে আরো দু্ই পা সামনে আগাতেই দেখি, যে গলির সামনে দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে দুটা কুকুর অতি সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি হাটার স্পিড বাড়াই, তারাও আমার দিকে একপা-দুপা করে ঘেউ ঘেউ করতে করতে এগিয়ে আসে । যখন আমি মোটামুটি বাসা পৌছার মাঝামাঝি রাস্তায়, আমাকে ঘিরে ১০-১৫ টা কুকুর চক্রাকারে হিংস্র আনন্দে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে । আমি ভাব দেখাই ভয় পাইনি,কিন্তু পিঠ বারাবর শীতল স্রোত বয়ে যায়,কুকুর কে ধমক দিতে চাই, আমার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না ।অবস্থা বেগতিক দেখে একবন্ধুর সরনাপন্ন হলাম-
-বলতো মামা কি করি?
সে এমন ভাবে তুড়ি মারলো যেন কুকুর কেন, “সয়ং ১০-১৫ টা বাঘ এসে আমার পিছে হুংকার করলেও কোন ব্যপারনা” এর চিকিতসা তার জানা আছে ।
-ধুর ব্যটা, কোন ব্যপার না……. ক….তো…. কুকুরের বংষ নির্বংষ করে দিলাম……. তুই একটা মোবাইলের একটা হেডফোন কেন তাহলেই কেল্লাফতে…… আমি ভরসার মতো পেলাম ।
কিন্তু কুকুরের চিকিতসায়, মোবাইলের “হেডফোন” কিনে কিভাবে যে “কেল্লাফতে” করা যায়, তা আমার ঠিক বোধগম্য হল না, আমি কপালে ভাজ ফেলে জানতে চাইলাম “ঝেড়ে কাষ তো মামা”
মামা আমার ঝেড়ে কাষলো……
-শোন, কুকুরে ঘেউ ঘেউ শব্ধ শুনলেই তো তুই ভয় পাস….. আমি বোরটের মতো মাথা দুলিয়ে বললাম “হা”….. যদি তুই শব্দই না শুনতে পাস, তাহলে তো ভয় পাবি না, তাই না ? আবারো বললাম “হা” তাহলে তো সমধানই হয়ে গেল….. অফিসের গাড়ি থেকে নেমে হেডফোনটা কানে লাগিয়ে জোড়ে ভলিউম দিয়ে গান শুনতে শুনতে বীরের মহিমায় পদব্রজে বাড়ি ফিরবি…… আরে হেমন্তের ওই গানটা শুনিসনি “এই রাত তোমার আমার……এই চাঁদ তোমার আমার….. শুধু দুজনে……” ওটা লুপ করে বাজাবি আর মনে মনে ভাবীর মুখ চিন্তা করবি…… বাঘ,কুকুর,হাতি মহিস কেন, ১০-১৫ টা ডাইনোসরও মশার মতো উড়ে পালাবে……..”
“কেল্লাফতে”র এতো সুন্দর সহজ সমাধান থাকতে আমি ভয়ে মরছি….! নিজেকে গাধা টাইপের নিম্ন শ্রেনীর প্রানী হিসেবে মনে হতে লাগলো……. নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে হেডফোনের দোকনে গিয়ে ৪৫০ টাকা খরচ করে হেড ফোন কিনলাম…… এবার শালা কুকুরে দল দেখবো কিভাবে ভয় দেখাও……!!!
পরদিন । আনন্দের সাথে অফিসের গাড়ি থেকে নামলাম । কানে হেডফোন… শরীরে গানের দুলানী নিয়ে এগুচ্ছি….. তাই তো ! ভয় লাগছে না….. আমিও মাথা দুলাচ্ছি…… ১০-১৫ টা কুকুরে আমাকে আগের কায়দায় চেপে ধরলো কিন্তু কেন যেন আরাম পাচ্ছেনা….. উল্টা আমি ওদের হাত পা দুলিয়ে নাচ দেখাচ্ছি…..
আমার নাচের মুদ্রা দেখেই হোক অথবা হঠাত এমন বীরত্বের আচরনেই হোক কুকুর গুলো যেন গোল হয়ে কিছু একটা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো….. ওদের মধ্যে থেকে একটা কুকুর আমার সামনে এগিয়ে এসে, আমার চারদিকে চক্রাকারে ঘুরতে থাকলো আর গলা টান করে লেজ নাড়তে লাগতো….. মনে হলো ও কিছু একটা বলতে চায়…… বুঝলাম ওকে গলায় হাত বুলিয়ে দিতে বলছে….. দিলাম হাত বুলিয়ে….. বুঝলাম ও আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে……. “ওকে” হল বন্ধুত্ব….. কোন ব্যপার না….. বাড়ি ফিরে বিথীকে সদ্যকাঁচা ঘুম থেকে টেনে তুলে, আমার কুকুর সম্প্রদায় জয়ের কাহিনী শোনালাম…… এমনিতেই সে কুকুর খুব ভয় পায়, আমি তার সবচেয়ে ভয়ের বস্তু জয় করেছি শুনে, চোখগোল করে হতবাক চোখে আমার তাকিয়ে রইল….. বারবার বলতে লাগলো “বলো কি….!!! কুকুরের গায়ে হাত দিলে,কুকুর কামড় দিলো না……!!!” আমি সম্ভবত ডায়নোসর শিকার করে আসলেও বীথি এতো অবাক হতো না….. হাই তুলতে তুলতে বলতো “কি যে কাজকারবার করো না…. খামখা সময় নষ্ট….. খাবার ঢাকা আছে, খেয়ে ঘুমাও…..কাল অফিস আছে, যত্তসব !!! ”
আমি বীথির এতো উচ্ছাস দেখে মনে মনে গোপন অহংকারে ফুলে উঠলাম, আর মনে মনে “রিমন (মামা)”-কে ধন্যবাদ দিতে দিতে শুয়ে পরলাম ।
রাতে বোধ হয় কুকুর সম্প্রদায় নিয়ে একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম । পরদিন সকালে কুকুর সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক আরো মজবুত করতে ঘুম থেকে উঠেই ছুটে গেলাম নিচে…… দেখি মেয়ে কুকুরটা বাসার পাশেই ময়লা খাচ্ছে, আমাকে দেখেই ছুটে এসে আমার চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে আর লেজ নাড়ছে…..ছোট্ট করে “ঘেউ”করে ডাক দিল(মানে হল “গুড মরনিং”,মনে হল ওর ভাষা আমি বুঝতে শুরু করেছি, যাকে বলে পশু প্রেমে অস্থির !) ……”আদরের ঘেউ” ভয় পাওয়ার কিছু নাই…..
দোকানে ছুটে গেলাম….. দোকানে এক ইয়া মোটা মহিলা বসা, তাকে ৫০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে একটা পাউরুটি দিতে বললাম…… তিনি ৫ টাকার পাউরুটি আর ৫০০ টাকার নোট বিষয়টা ঠিক মিলাতে পারলেন না…… প্রথমে একটু ইতস্তত করে আমার দিকে তাকালেন, আমার শুকনা মুখ দেখে মায়ায় পরেই বোধ হয় দোকান ফেলে বাড়ির ভেতরে গেলেন ভাংতি আনতে…… মহিলার চোখের মায়ায় স্পষ্ট হলো, তিনি ধারনা করেছেন আমি নিজে খাবার জন্য পাউরুটি কিনছি….. মহিলা বাড়িতে ভাংতি আনতে গেলেন, ইতিমধ্যে কুকুরকে আমি পাউরুটি খাওয়াচ্ছি….. কুকুরও যারপর নাই আনন্দের সাথে লুটোপুটি খেয়ে রুটি খাচ্ছে….. মহিলা ফিরে এসে অবস্থা দেখে আমার চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়লেন
“পশু ফেরেমিক আয়া ফরছে রে…. কুত্তারে রুডি খিলায়…. মানুষ না খাইয়া মাইরা যাইতাছে……”
কুকুরের জন্য তার এতো কষ্ট,তিনি ব্যপার টা বেশ শক্ত অপমানের সাথেই নিয়েছেন । মনে মনে সম্ভবত অভিষাপও দিলেন । কিন্তু আমাকে তখন আর পায় কে, কুকুরের প্রেমে আমি পুরোপুরি নিমজ্জিত…. মহিলার কথাও আমার কাছে মধুর মতো মনে হতে লাগলো…… প্রথমত আমি তোমাকে চাই….. দ্বীতিয়তও আমি তোমাকে চাই অবস্থা……।
বীথি জানেনা….! বেশ কিছু দিন আমাদের গোপন এই সখ্যতা বজায় রইলো । আমি আর নেড়ি, নেড়ি আর আমি…. আমি গভীর রাতে বাড়ি ফিরি, নেড়ি বসে থাকে পথের ধারে । আমার সাখে সাথে বাড়ি ফেরে… আমাকে নিজ দায়িত্বে্ বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়…. পাড়ার কুকুর সম্প্রদায়ও বোধহয় আমাদের সখ্যতা মেনে নিয়েছে । তারাও এখন আর বিরক্ত করেনা । আমরা সুখ-দু:খের ছোট-খাটো দু-একটা কথাও বলি…. ওর ঘেউ ঘেউ আমি স্পস্ট বুঝতে পারি…. ওর খুব খাবার-দাবার কষ্ট…… ওর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু স্বামী ভালো না…. অন্য কুকুরে প্রতি আসক্ত….. আগের ঘরের একটা বাচ্চা ছিল, গাড়ি চাপায় মারা পরেছে….. এখন সে একা…. এই হিংস্র কুকুর সমাজে সে একাই সংগ্রাম করে টিকে আছে…. এই সব প্রাত্যাহিক জীবন আলাপ…… চলছিল ভালই….. হঠাত বিপত্তি দেখা দিল একদিন (সম্ভবত দোকানী মহিলার অভিসাপের ফল)
একদিন বীথিকে নিয়ে নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম, বাড়ি ফিরছি । হঠাত কোথা থেকে যেন কুকুড়টা ঘেউ ঘেউ করতে করতে এগিয়ে এলো । আমি ওর ঘেউ ঘেউ চিনি। আচরন পুরাই উল্টা । সে প্রচন্ড জোড়ে ঘেউ ঘেউ করছে…. যেন আমি বিশাল কোন অন্যায় করছি….। কুকুরটা আমার পায়ের কাছে এসে ঘুরপাক খায় আর ঘেউ ঘেউ করে বীথিকে কামড়াতে চায় । আমি পরলাম মহা ফাফরে, এখন কি করি ! আমি ভদ্রতাশোচিত ভাবে বীথিকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলাম “বীথি তুমি ভয় পেয়ো না….. ওর কথাই বলেছিলাম….. এই যে তোমাকে বলেছিলাম না ! ওই যে আমাকে এই কুকুড় এগিয়ে দেয় সমীহ করে…. সেই কুকুর টা…… ।
কিসের কি পরিচয়, বীথি পারলে লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে বসে ।
-ধুর….. সরাও তো কুকুর….. কামড় দেবে তো….. উফ…..
-আরে কামড়াবেনা……
-শোন কুকুর যদি কামড় দেয় তুমি কিন্তু লক্ষিনদরের বাক্সে ঢুকলেও আমার হাত থেকে বাচতে পারবে না…….
জীবনের উপর হুমকি ! আমি কুকুড়ের দিকে তাকিয়ে ধমক দিলাম “এ্যই যাহ…” । সে খুব আহত হল মনে হয় । “ঘেউ” করে দু:খচিত একটা আওয়াজ করলো যার মানে দাঁড়ায় “হায় শেষ পযর্ন্ত তুমিও !!!” এবার সে বীথিকে তার জীবনের শ্রেষ্ট শত্রু মনে করে প্রায় তাড়া করলো, আমি কোন ভাবেই আর ঠেকাতে পারিনা…… একপ্রকার বাধ্য হয়েই পথের পাশ থেকে আদলা ইট তুলে ছুঁড়ে মারলাম ওর দিকে । ওর পিঠে দুম করে দিয়ে পরলো……
হঠাতই সে আর কোন চিতকার করলো না । একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষনের জন্য । আমার দিকে ফ্যল-ফ্যল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। কি যেন বলতে চায়, কোথায় যেন বাধা। তারপর মাথা নিচু করে ধিরে ধিরে চলে গেল, একবারও পেছনে ফিরে তাকালো না । এর পর থেকে কুকুরটাকে আমি আর দেখিনি । গাড়ি থেকে নেমে মাঝে মাঝে এগলি-ওগলি উঁকি দিতাম কিন্তু নেড়ির দেখা নেই । ভাবলাম হয়তো কাল দেখা হবে...... হলোনা.....
এর পরের পার্ট টুকু খুবই সহজ । আমি জীবনের চাপে ভুলেই গেলাম কোন একসময় আমার এক পথের কুকুরের সাথে পরিচয় ছিল । আমি আর বীথি সুখে-দু:খে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি । হঠাত কাল কুকুরটার সাথে আবার দেখা । সাথে একটা বড় শক্ত সামর্থ কুকুর আর তার সাথে ছোট ছোট দুটা ছানা…… । আমাকে দেখে এগিয়ে এসে আদুরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো । ওর ঘেউ ঘেউ শুনে আমার স্পস্ট মনে হতে লাগলো ও জীবনান্দের কবিতা আবৃত্তি করছে……
"কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার……”
মজার ব্যপার হচ্ছে, আমাদের মধ্যে যারা সম্পর্ক গুলোকে খুব অবহেলে,নগ্নভাবে হত্যা করে
তাদেরকেই আমরা বেশি ভালবাসি,তাদের জন্যই আমরা পুড়ে মরি…..
সেই সুদুর অতীত থেকে উঠে এসে, দেখে আসতে চাই, আমাদের প্রিয় মানুষটি কোথায় আছে,কেমন আছে,জীবনের চাপে ভুলে যাওয়া প্রিয় মুখগুলো বড় যন্ত্রনা দেয় হঠাত একদিন, গভীর কোন এক এককি রাতে । সম্ভবত প্রানীকুলেও একই ঘটনা ঘটে । প্রকৃতির কি এক অদ্ভুত নিয়ম ! শোভন ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৮:৪৮