আমার অগ্রজ, প্রিয় কবিদের অন্যতম শুভাশিস সিনহা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। ব্লগের পাঠকদের জন্য প্রিয় শুভাশিস দা'র কবিতা পোস্ট করলাম। সকলের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।
ওহ! মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে, এত গীতলতা এই মানুষটা পেলেন কোথায়! আমি আশ্চর্য হই, ঘোরে আটকে থাকি, বেরুতে পারি না। প্রিয় বন্ধুগণ, আপনাদের সাথে এই অনুভূতিগুলোকে শেয়ার করার জন্যই এই পোস্ট
ভাব
৩.
ডেকেছিলাম- জল, সে যে হাওয়া হয়ে পরি হয়ে উড়ে যাবে কেউ বুঝে নাই, মাটিতে সম্ভ্রান্ত পায়ে আঙুলনিচয় থেকে নখ বলে উঠেছিল, ধিক! ওম্নি কে বুঝেছিল মাটি চিরে মুখ তুলবে পাতালেশ্বরীরা, জলাকার দেহতীর্থ মহাশূন্যে সিঁড়িপথ বানিয়ে এবার আগুন জ্বালিয়ে দেবে পথমানচিত্রে; ডেকেছিলাম গান, সে যে বাক্য আর সুরতাল হারিয়ে মুদ্রায়িত হয়ে উঠবে নন্দনের মঞ্চে, শ্রোতা কিংবা দর্শক কেউ তা ভাবেনি, ভাবার পার্বণ এসে হৃদয়মণ্ডপ জুড়ে নৈবেদ্য সাজালো বেশ, পুরোহিত নিজে হয় যজ্ঞ-উপচার, ফুল-ফল যতেক প্রসাদ সব কেবলই রূপায়িত রঙে, রং থেকে রঙে; ডাকলাম রং, বলামাত্র ধোঁয়া হয়ে চপল আঁধার হয়ে দিগ্বিদিক-- কেউ ভেবেছিল!
ভেদ-অভেদের গান
তাকিয়ে জলের দিকে নিজের মুখের ছবি
চেনা তো হলো না এখনও
ওপারে গাছের পাতা ঝরে তবু স্রোতে ভেসে
পৌঁছেনি এখানে কখনও।
পথে কি নেমেছে ছেলে একা একা ছাতা হাতে
দুর্দিনে বরষা অপার
নদীর পারের জেলে দেখেছে কী বিভ্রমে
জলহীন নদীর দু'ধার।
আকাশে জমেছে মেঘ কালো-লাল-নীল রাঙা
এখানে দেখেছি আমি ধুলোভরা এই ডাঙা।
প্রশ্নে মেলেনি এই ভেদ অভেদের ধাঁধা
দ্বন্দ্বে রেখেছে চরাচর
নিজের মুখের ছায়া অযথাই খুঁজে মরি
কার মুখ জলের ওপর!
বৃষ্টি
আবার বৃষ্টি এসেছে আমার গাঁয়
মাঝদরিয়ায় উঠেছে আবার ঢেউ
আবার বৃষ্টি দরজা-জানলা কাঁপা
সেই কম্পন বুঝতে পারিনি কেউ।
আমরা তো সব বৃষ্টিনিরক্ষর
কণায় কণায় অক্ষরপাঠে ব্যর্থ
তোমার নূপুরে চুলে মুখে দুইচোখে
বৃষ্টির কণা ছড়িয়েছে কোন অর্থ।
অর্থের দায় বন্ধক রেখে রোদ
সূর্য লুকালো মেঘেদের জঙ্ঘায়
কখনো বৃষ্টি মনপ্রাণহীন শুধু
ঝরতেই চায় শরীরের জাংলায়।
তখন লুপ্ত জল-আগুনের ভেদ
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় অপরূপ জাদুকর
নেচে নেচে ওঠে নর্তনভূমিতে
উছলিয়া শিরাধমনিরা থরথর।
থরথর করে কাঁপছে আবার ভূমি
তুমি আর আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে
এবার বৃষ্টি এসেছে উন্মাদিনী
বিদ্যুৎলতা ডাকে হাত বাড়িয়ে।
হওয়া না-হওয়ার গান
১.
ডাক দিয়ে গেলে
তবু একবার ফিরে চাই
থমকে যাওয়া শ্বাস থেকে ভূত নেচে ওঠে
শাবলখানিও তুলে নিতে হয়
যারা আকাশের বুক প্রায় ছুঁয়ে
মেঘ হয়ে গিয়ে ভাবে আর কিছু নাই
এ জনম নোনাজল, আছে দাগ আছে পোড়া ছাপ
মুঠো মুঠো ছাই নিয়ে উড়ায়ে দিয়েছে ছায়াবালকের দল
কারা তবে অন্ধ হবে বা কারা হবে না (জানি না জানি না)
তবু ডাক দিয়ে গেলে আড়মোড়া ভেঙে
একটিবার উঠে বসতে হয়
সাধের বারান্দা থেকে উঠানের দিকে
উঠানের শ্যাওলাধরা পথ থেকে পুবের রাস্তায়...
সর্পিনীরা নিয়ে যাবে আয়ুর গহন পথ বেয়ে
কিছু তুমি বুঝবে না, তবু
দাও, ডাক দাও
২.
বাতাস সর্পিল, আমি তার পিঠে চড়ে
জগৎ ভ্রমিতে গিয়ে বারবার পিছলে পড়ে যাই
পায়ে লাগে কাদা, ফের মাটি ফের ধুলো
অথচ যাবার দিন চোখ মুছে তাহাদের কাছে
কাঁসার থালার মতো পড়ে আছে বিদায় লগন
তখন বাতাস ডেকেছিল
মেঘ কিংবা শূন্য শূন্য আকাশের পূর্ণভানদেহ
ভেবেছি যাব না আর রক্তমাখা পোশাকের কাছে
কয়েকটি বোতাম না লাগিয়েই তাড়াহুড়ো ভরে
সেঁদিয়ে যাব না তার ভেতরে অথবা
যাব না গোল্লাছুটের মাঠে
যে আঙুল ছেড়ে দিয়ে কষ্টসহা মুঠোর ভিতরে
আয়ুপুঞ্জ পেয়ে পেয়ে আসা
কোথায় তাহারা সবে, ভ্রম, চিত্র, রূপক, ম্যাজিক...
বাতাস সর্পিল, আমি তার পিঠে চড়ে
বারবার পিছলে পড়ে যাই
স্থির আগুনের মুখে, দারণ জিহ্বায়।
৩.
কে আর আসিবে এই মরা ঘাটে, আসিবে না
পুষ্পরেণু কথা বলে, ঝরা পাতা হাস্য করে
ধুলো-ওড়া তিথিগুলো শ্লেষ ভরে
হৃদয়ের লাফালাফি দেখে করে হা হা
জল আমাকে টেনে নিল মধ্য দুপুরের দীঘিকোলে
দুরের পাহাড়ে কারা ওই যে দাঁড়িয়ে আছে
কে যেন, একটি চিহ্ন, একটি রেখার মতো
বনবালা, ও সায়াহ্ন, আমার বন্ধুরা
মরে মরে গাছ হয়ে প্রেতিনীর সাথে একা
জেগে থাকে, আশেপাশে তাহাদের নীরবকীর্তন
ও মৌনতা, আমি তোর পূর্বধ্বনি,
এইমাত্র উচ্চারিত হয়ে ফের তোর গ্রাসে ঢুকে গেছি
কে আর হাসিবে এই শোকরাতে
আমার বাপেরা গেছে, মায়েরা, বোনেরা, ভাইয়েরা...
আমি সেই বীজ শুধু বীজ
এইমাত্র অঙ্কুর বা অনেক অনেক আগে
আসো, তবু মৃত্যু করে গান
এসে তার সাথে তাল মারো
বাজাও একটিবার তুড়ি
লগ্ন চলে যায়...
৪.
পাহাড়ের উপরে উঠিয়ে
বাতাস আমাকে শেষে নিচে ঠেলে দেবে
কে জেনেছে আগে
ভেবে তো ছিলাম যাব মেঘের জংলায়
কণা কণা বাঁধিব জমাট
শ্রাবণঝঞ্জার তোড়ে গলে গলে নেমে আসব
খা খা মাঠে, শুকনো কাঠে
দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে
যেন আরও এক ইঞ্চি খাড়া হলে মেঘে গিয়ে
তুলকালাম কিছু
সন্ধ্যায়, গল্পের সব আয়োজন প্রায় শেষ, আগে
মাত্র জমে উঠেছে আসর
রূপকথা-লোককথা-ব্যঙ্গ-হাস্য-যৌন-ঢলাঢলি...
নিজের ওজন-ভার বানিয়ে বিমূর্ত হাহাকার
আমি শূন্যে তাকিয়েছিলাম
বাতাস আমাকে নিল, পাহাড়ে ওঠালো
ভেবে তো ছিলাম যাব তীর্থআঙিনায়
কে জেনেছে অবশেষে গভীর খাদই জিতে যাবে !
৫.
এখন পুষ্পের হাসি মেঘের শিকল-চেরা
অশ্বতীর, অশ্রু-কুড়ানোর খেলা
ধুলির বিপন্ন পথে, এখন দীঘল ডাক, কন্ঠের চড়–ই
সম্মুখে আঙুলফুল, রেখায় রেখায় ডুবসাঁতার
এখন কেবলি জল, কেবলি আগুন
দীর্ঘ নিশিগুলো মেয়ে উঁকুনের মতো বেছে
ফেলে দ্যেছে প্রারম্ভডোবায়
বিধি-রীতি-কর্কশ-ধমক সবি হাস্যমালা
কেন না হে পরাণ তুমি তো জানো
এ জগতে একটি জোয়ার কতকাল পরে পরে আসে
কতকাল পরে মানুষের সর্বনাশ
চরম পরম
এখন সর্বনাশের স্তন চুষে দুগ্ধ হয়ে যাই...
হে শুরু হে বিদায় !
যে গৃহে চণ্ডাল থাকে
১.
প্রায় একসাথে
আমাদের মৃত্যু হবে, প্রায়
এক মুহূর্তেই আমাদের
শেষ নিঃশ্বাসটি উড়ে যাবে বিলয়পুরের পানে
রক্তের আগুন, নীল শিরার বিদ্যুৎ
চোখের চাবুক
পিঠের ঝাঁঝালো ক্ষত
ধোঁয়া পরধোঁয়া, সব, ঘুরবে অবিরত
এক অন্তিমেই শুরুকালের বচন
হারাবে শ্র“তির ভূমি, ধ্বনির চাদর
ছিঁড়ে খুরে খেয়ে যাবে অন্ধ খা খা
দৃশ্যের শকুন
এক ছুরিতে, একটি ডগায়
জ্বলে উঠছে একলক্ষ খুন।
২.
এখনো বসন্তকাল, এখনো ফাল্গুন
কাঁচা মেহেদীর মতো হলুদ শরীর
সুরের পাখির ঠোঁটে রক্তনুন
ভালবাসিবার
গহনপিঞ্জর জুড়ে বজ্রঝড়, মেঘের জিকির
পেশীতে পেশীতে মহাকম্পন, নীলাভ হাহাকার
তবু
এখনো বসন্তকাল, এখনো তো না-রোদ না-ছায়া
এখনো পরশানন্দ, গভীর মধুরতর ঘুম, মায়া,
আলিঙ্গন, চুম্বন, এবং
যতেক রঙঢঙ
এখনো বসন্তকাল, এখনো সমীর
সন্ধ্যারাগে ফিরিবার নীড়
কাঁচা মেহেদীর মতো হলুদ শরীর...
৩.
ছেঁড়াফাড়া এ বাগানে পুষ্প আজ ফোটার মৌসুম
ধুলোঝাড়া শালিখের গায়ে গায়ে গন্ধমাখা হাওয়া
কোকিলের কন্ঠমধু লেগে গেল গাছের জঙ্ঘায়
এ বাগানে নিত্য কত জলের সিঞ্চন
কত মালী প্রেমরাগে বাঁধে কান্না, বনমালী,
আহা বনমালী !
কুঠারে কুঠারে পাশে চেরা হলো সাধের সেতার
যতিচ্ছেদে ভরে যায় পৃষ্ঠাহাহাকার
পোড়া ভেজা এ বাগানে পুষ্প আজ ফোটার মৌসুম
বসেছে ষাঁড়ের শিঙে রঙ্গপ্রজাপতি
মহিষের প্রাণে ছোটে সহজিয়া হরিণসুন্দর
এ বাগানে তীর্থ জাগে, রক্তকাদাস্নানপরে
নরক ঘুমিয়ে যায় শুচিশুভ্র ঘরে।
৪.
সহসা আমার দিদিমারা
সারি সারি গাছ হয়ে যায়
তাদের শাখায় লাগে ফেরার বাতাস
সহসা পথের পরে ঝরে গেল চোখের জলের
ফুল, পানের পিকের রঙ
শাদা হয়ে যাওয়া দেহ, ধোঁয়া হওয়া প্রাণ
ভাসালো শোণিতস্রোতে কী প্রাচীন গান
সহসা আমার দিদিমারা
রাশি রাশি পাতা
খসে পড়ে ধূলায় ধূসর
কত ভাঁজ পাতায় পাতায়
কত রেখা, কত কোণ, সবুজে সবুজে ভরে যায়...
৫.
ধানেরা বলেছে কথা অসম্ভব রাতে
শীষে আর শিসে
এ খবর পৌঁছে গেল চন্ডালের ঘরে
আলোজ্বালা রঙীন কব্বরে
ধানেরা করেছে নাচ,
লাস্যে ও তান্ডবে
ক্ষেতে ক্ষেতে ছিন্ন আল, সীমার বন্ধন
ঝনন ঝনন
চন্ডাল খবর পায়, এবং সে বর্শা এক
অন্ধ কোনো স্বপ্নমুখে ছোড়ে
সেই বর্শা পাওয়া যায়
রক্তধান বিকশিত ভোরে...
৬.
একেলা বিপন্ন পথে সহসার ঝড়ে
ভিজে যেতে যেতে পাওয়া একটি চালার ঘর
গাদাগাদি বসিবার দাওয়া...
আমাদের ভালবাসা এইভাবে পাওয়া
বৃষ্টির ধোঁয়ায় সাদা, অবসন্ন পলি-কাদা
ওৎ পাতা মাগুড়ের শিং
সাঁড়াশি কাঁকড়ার...
এইসবে ভরে আছে এই ভালবাসার ভাঁড়ার
সুদীর্ঘ কান্নার শেষে ভেঙে যাওয়া স্বরের যাতনা
চোখে জ্বালা, বুকে বিষপিঁপড়ের কামড়
নিদারুণ নগ্ন অবসাদ...
এখানে ঝরিবে প্রিয় এই ভালবাসার প্রপাত...
৭.
আকাশে তাকালে নীলে এখনো কবিতা পাই
এখনো সে নীলে মাখা আমাদের পুরনো বেদনা
মেঘে মেঘে দেখি আজো স্বপ্নের নিরর্থ নবায়ন
শাদা মেঘে কালো চিহ্ন... এখন কেঁদো না।
প্রতীকে প্রতীকে ভরে আছে ভূমন্ডল
কলমের নিবে তীব্র ছুরিধার সেধে
কখন ছুড়িব তীর, মাঠে
জল ভরে এল, বানে ভেসে গেল স্বপ্নশিশুদল
ডুবিল আকাক্সক্ষাপিতামাতা
ভগ্নি আর ভ্রাতা
এ অনাথ জগতের মধ্যে দেখি আকাশের নীল
প্রস্থানবিন্দুর সাথে কী অবাক দিগন্তের মিল।
বেলা দ্বিপ্রহর
১.
অনেক মৃত্যুর কথা আঁচলে এনেছো বেঁধে
অন্ধকার, পাড়াভরে পাহারায় রয়েছে জোনাকি
দুটো হাত জড়ো করে আকাশের দিকে দৃষ্টিতীর
ছুড়ে গেয়ে যাচ্ছি একে একে
প্রার্থণাসঙ্গীতমালা, তখনই আঙিনা
ছায়ার ভেতরে ছায়া খুঁজে পেল
টের পেল, এখন নিশ্চয়
একসঙ্গে কথা বলবে চাঁপা গাছ, পেয়ারার ডাল
গোয়ালঘরের দড়িখানা, কুঠারের ভাঙা দাঁত
চালের ওপরে ঠিকরানো
এলোকেশী জোছনা রাক্ষসী
সবাই বলবে কথা, তোড়জোর শুরু হবে
এসো ভাত খাও, এসো আজ
বিছায়েছি শয়ন তোমার
এনেছো মৃত্যুর কথা, এখন সকলে উঠবে বেঁচে।
২.
দিনভর ভালমানুষির শেষে
শেষরাতে একটু খারাপ হতে সাধ করে
গায়ের পোশাক খুলে উদোম দাঁড়িয়ে পড়ি
আয়নায় চেয়ে চেয়ে হাসি
পায়চারি করি
সাধের দরোজা খুলে উঠানে পা রাখি
কোন সে শরৎ কতকাল পরে আসবে হয়ত
তার প্রেমে কাতর শিউলী-
গাছ, একেবারে বুকের ভেতরে ঢুকে পিনপিন কাঁদে
তাকে গলা টিপে মারি
আর তার লাশ বয়ে নিয়ে
ভাসাই জোছনাস্রোতে, ধানক্ষেতে, সুবোধ বাতাসে।
৩.
রাস্তার ওপরে একটা শাল থাকে--একটা চাদর
বাকলের মতো
অনেক অনেক ছাপ খেয়ে খসে পড়ে
অনেক অনেক রেখাচিত্র, তাই লোকে ফিরে এসে
নিজের নিজের পদছাপ খুঁজে হাতাহাতি করে
কারণ সে শাল ঘন ঘন খুলে যায়
রাস্তা নিজে বদলে ফেলে তাকে
এটা কোনো খোলসের মতো, সাপ যেভাবে পাল্টায়
কিছুই থাকে না, তবু মানুষের দারুণ পছন্দ
ছাপ আর ছাপ তার বুকে রেখে যেতে।
৪.
এত চুপ হয়ে আছে সকালের রোদ যেন এইমাত্র বাপের হাতে চড় খেয়েছে, মুখপোড়া, তোকে কতদিন বলেছি, আমরা যখন ঘুম ছেড়ে নামব, তুই তখন গলা ওঠাবি সপ্তমে, অশিক্ষিত জানি, তবু স্বজ্ঞা আর প্রেম দিয়ে ভরিয়ে তুলবি আমাদের সুসভ্য শ্রবণ, কেন এত ভিজে ভিজে রয়েছে সকাল, সূর্যের শ্লেষের পথে সে যেন থ-মারা নীরব ক্রন্দন, আমাদেরও ক্রন্দসী আছেন, তাদের অশ্র“পিছল পথে এখনো স্বপ্নের ঘোরে প্রেমনটবর এক হাতে একগোছা চাবি দোলাতে দোলাতে মস্ত জমিদার সেজে বৃক্ষাড়ালে ওৎ পেতে থাকে, মশার কামড় খায়, তোকে তো বলেছি রে হতচ্ছাড়া, তোরও মধ্যকপালে এরকম অজস্র হুল ফুটে আছে, তবু তুই ওষ্ঠভরে সাজাবি চুমুস্মিতহাস, ভালবাস্ ভালবাস্ বলে পাড়ার প্রতিটি অন্ধকার গোয়ালঘরে দলিতা ওলান থেকে শাদা শাদা আলোচ্ছটা ঝরে পড়বে, সব তো জানেই, তবু কেন এত চুপ মেরে সকালের রোদ!
৫.
পাকিব পাকিব বলে শরমসোনায় গলে
কী করেছো হে ধানবালিকা
চারিদিক বিহোবল ছড়ায়েছে উতরোল
কবে ক্ষত দেবে পাদটীকা?
টীকার চরণে বসে সুরধ্বনিবাকরসে
ভিজে সারা বিদায়ী আগন
উদরে আগুনজ্বালা ফুরাবে সে গীতিপালা
গরম শিশিরে পোড়ে বন।
বনের মাঝারে প্রাণ পোড়াফুলে খোঁজে ঘ্রাণ
খোঁজে প্রেম, আদর, মমতা
পাকিব পাকিব গানে তবুও পুরনো ভানে
ধানবালিকার নীরবতা!
নীরবতা জেনো তার স্বরছলনাপাথার
ডুবে যাবে দাঁড়ানো সমাজ
সেধে সেধে কেঁদে কেঁদে নবভাতগীতি বেঁধে
পায়ে ধরে বেহায়া নিলাজ।
লাজের দোহাই, ধান-- বালিকা হে সমাধান
এই বেলা বাতাসে নাচাও
কার ঘরে যাবে শেষে কী শোণিতে আশা মেশে
কে মরেছে, কাহারে বাঁচাও!
৬.
কুঞ্জে আমি পুষ্পরাশি
ছড়িয়ে দিয়ে, ফিরে
এসেছিলাম দুঃখনদীতীরে।
রঙ্গধনু হাসতেছিল
মাঝআকাশে ভাসতেছিল
একটি মাথা কাশের বনে
আরেক মাথা আখে
তখন নদী নরম জিভে
রক্তজবা চাখে।
চাখ রে নদী স্রোতের জোরে
আমরা গতিহারা
কুঞ্জবনে মাল্যগলে
ব্যর্থ, পতিহারা।
তবুও দিনরাত্রি ভরে
পুষ্পরাশি ঢেলে
এসেছিলাম কামান্ধারে
দুঃখশিখা জ্বেলে।
জ্বল রে শিখা, দেখুক নদী
সন্ধিমূলে ওড়ায় যদি
ঝঞ্ঝানটী পাল
আমরা এবে ফেলব তবে
মৎস্যহৃদিরই উৎসবে
চতুর্তটী জাল।
৭.
জানি পৃথিবীতে কেউ না কেউ আমাকে পিঞ্জর বলে ডাকে
আর ভাবে আমার ভেতর বসে আছে পোষমানা অনেক পাখি
তারা কখনো ডানা ঝাপ্টায়, কখনো ঠোঁট বাঁকিয়ে
নৈঃশব্দ্যের শ্লেষ তৈরী করে
জানি পৃথিবীতে কেউ না কেউ আমাকে পিঞ্জর বলে ডাকে
মনে মনে, আমাকে শুনিয়ে বা না শুনিয়ে
কেউ কেউ চাবি হাতে ঘুরঘুর করে
অদৃশ্য তালার কাছে ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকে
পাখির গান শুনতে শুনতে দাঁড়িয়েই ঘুমায়
আর আমি ভাবি
আমার পাঁজর ভেঙে রক্তের স্রোত
কোথাও বয়ে যেতে চেষ্টা করছে
অধিকাল ধরে...
৮.
বাবা আমাদের গাইয়ের দুধ দোহন করত
আমি পেছনে দাঁড়িয়ে মশা তাড়াতাম
দেখেছি
দুধ থাকলেই দোহনওয়ালা আসে
তার পিছে পিছে মশা
আর একজন কারও না কারও পক্ষে দাঁড়াবেই।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
ডেকেছিলাম জল
শুভাশিস সিনহা
প্রকাশক: মোঃ আরিফুর রহমান নাইম
ঐতিহ্য
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৬
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ২:১১