কফিহাউজ গানটি নিয়ে মান্না দে সবসময় নিজের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দিয়েছিলেন গীতিকার সুরকারকে - তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র।। আসলেই তো এমন কালজয়ী একটা গান লেখা আর সুর দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। একটা গানে যেন অনেকগুলো মানুষের পুরো একটা জীবনের গল্প বলা আছে।
তার মতে, হেমন্ত গাইলে গানটা সুপারহিট হতো আর শ্যামল মিত্র গাইলে তো হিট। তবে মান্নার কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন গানটির সুরকার সুপর্ণকান্তি।
তবে মান্না দে এ গানটির দ্বিতীয় অংশ হিসেবে ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ শীর্ষক একটি গান প্রথম গানটির ঠিক কুড়ি বছর বাদে গেয়েছিলেন। কিন্তু রহস্যময় কারণে সেটি শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাঙালি।
কফি হাউসের দ্বিতীয় অংশ হিসেবে ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ নামে গানটি একটি নতুন রেকর্ড কোম্পানিই রেকর্ড করিয়েছিল । কিন্তু সুপর্ণকান্তি জানিয়েছেন, সেই গানের অরিজিনাল স্পুলটি পাওয়া যায়নি। ফলে অন্য স্পুল দিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। নিখিলেশ, মইদুলদের নিয়ে দ্বিতীয় গানটি লিখেছিলেন শমীন্দ্র রায় চৌধুরী। প্রথম গানের স্কেলেই গানটা করেছিলেন মান্না দে। দ্বিতীয় গানটি প্রথমটির থেকেও সুরের বৈচিত্রের বিচারে অনেক ভাল হয়েছিল। কিন্তু কোথায় গেল সেই স্বপ্নের কফি হাউস কেউ জানে না। মান্না দেও হতাশ। তিনি শুধু বলেছেন, বাঙালি তো জানতেই পারল না সেই গানের কথাঃ
কফি হাউজ-২
স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই, আজ আর নেই
জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই
নিখিলেশ লিখেছে প্যারিসের বদলে-এখানেই পুজোটা কাটাবে
কী এক জরুরি কাজে ঢাকার অফিস থেকে-মইদুলকেও নাকি পাঠাবে
একটা ফোনেই জানি রাজি হবে সুজাতা-আসবেনা অমল আর রমা রায়
আমাদের ফাঁকি দিয়ে কবেই তো চলে গেছে-ওদের কখনো কি ভোলা যায়?
স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই,আজ আর নেই
জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই,আজ আর নেই
ওরা যেন ভালো থাকে একটু দেখিস তোরা-শেষ অনুরোধ ছিল ডিসুজার
তেরো তলা বাড়িতে সবকিছু আছে তবু-কিসের অভাব যেন সুজাতার
একটাও তার লেখা হয়নি কোথাও ছাপা-অভিমান ছিল খুব অমলের
ভালো লাগে দেখে তাই সেই সব কবিতাই-মুখে মুখে ফেরে আজ সকলের
নাম যশ খ্যাতি আর অনেক পুরস্কার-নিখিলেশ হ্যাপি থেকে গিয়েছে
একটা মেয়ে বলে সুজাতা বিয়েতে তার-দুহাত উজার করে দিয়েছে
সবকিছু অগোছালো ডিসুজার বেলাতে-নিজেদের অপরাধী মনে হয়
পার্ক স্ট্রীটে মাঝরাতে ওর মেয়ে নাচে গায়-ইচ্ছে বা তার কোন শখে নয়
কার দোষে ভাঙলো যে মইদুল বলেনি-জানি ওরা একসাথে থাকেনা
ছেলে নিয়ে মারিয়ম কোথায় হারিয়ে গেছে-কেউ আর কারো খোঁজ রাখেনা
নাটকে যেমন হয় জীবন তেমন নয়-রমা রয় পারেনি তা বুঝতে
পাগলা গারদে তার কেটে গেছে শেষ দিন-হারালো সে চেনা মুখ খুঁজতে
দেওয়ালের রঙ আর আলোচনা পোস্টার-বদলে গিয়েছে সব এখানে
তবুও প্রশ্ন নেই,যে আসে বন্ধু সেই-আড্ডা তর্ক চলে সমানে
সেই স্বপ্নের দিনগুলো বাতাসে উড়িয়ে ধুলো-হয়ত আসছে ফিরে আজ আবার
অমলের ছেলেটার হাতে উঠে এসেছে-ডিসুজার ফেলে যাওয়া সে গীটার
স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই,আজ আর নেই
জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই,আজ আর নেই।।
মান্নাদের মধ্য বয়সের উদাত্ত কন্ঠের এই গানটির প্রথম সুর চিরতরে হারিয়ে গেছে। তবু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্য তার শেষ বয়সের কফি হাউজের সেই আড্ডার মত ভেঙ্গে যাওয়া কন্ঠে এই গানটি শুনে শ্রোতা আপাতত আক্ষেপ মেটাতে পারেন;
সপ্নের কফি হাউজ
***
এবার আসি অন্য একটা প্রসঙ্গেঃ
~ কফি হাউজের সুরকার সুপর্নকান্তি ঘোষ (নচিকেতা ঘোষের ছেলে) ।
এই গানের সুরকার সুপর্নকান্তি ঘোষ একটা কথা বলেছেন; কফি হাউজের সব চরিত্র নাকি কাল্পনিক! আপনার কি মনে হয়? তাহলে ঢাকার সেই মইদুল কোত্থেকে আসল?
~নুর আহমেদ মঈদুল ১৯৩৬ সালের ১৩ জানুয়ারি কলকাতার উত্তর চব্বিশ পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৫ বছর বয়সে মান্না দে'র সঙ্গে পরিচয় হয়। মান্না দে'র গানের আসরে নিয়মিত যোগ দিতেন। কলকাতার ক্রীড়াঙ্গনে খেলোয়াড় হিসেবে সফল মঈদুল ঢাকায় এসে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব এবং ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ব্যাডমিন্টন ও ফুটবল খেলেন। ১৯৬৪ সালেই তিনি পাকিস্তান রেডিওতে ক্রীড়া ধারা ভাষ্যকার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৬৬ সাল থেকে দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, ইনকিলাব, সংবাদ, বাংলার বাণী ও দৈনিক পূর্বদেশে খেলাধুলা নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও পাক্ষিকেও লেখালেখি করে গেছেন তিনি। ~ কফি হাউস গানের সুরকার সুপর্নকান্তি ঘোষ কথা সত্য হলে সারাজীবন মিথ্যে কথা বলে গেছেন মঈদুল। তার কথায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার নিজে কখনো কফি হাউজে আড্ডা দেন নি। সব চরিত্রগুলো তার কল্পনায় আঁকা। হয়তো মান্নাদের পরিচয়ের সুত্র ধরে ঢাকার মঈদুলের সাথে পরিচয় হয়ে এই নামটা তার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
এরপরে আসি সুজাতার কথায়;
কলকাতা আর্ট কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন সুজাতা রানী দাশ। গাইবান্ধা থেকে সত্তরের নির্বাচিত এমপি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ওয়ালিউর রহমান রেজাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন তিনি। যদিও তাঁদের প্রেম হয় ১৯৬২ সালে, তাঁরা বিয়ে করেন ১৯৭২ সালে। সুজাতার বাসস্থান ঢাকার মোহাম্মদপুরে।
সুজাতা এখনো বেঁচে আছেন - আমি তার কোন সাক্ষাতকার পাইনি। কেউ কেউ বলেন তাকে নাকি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ভালবেসেছিলেন।
এটাও একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। সুপর্নকান্তি ঘোষ নিজের মুখে বলেছেন এসব চরিত্র কেউ নেই পৃথিবীতে।
হায় আমরা কত কত ভুল ইতিহাস আর ভুল মানুষকে ভুল জেনেই না বেঁচে আছি ...
*** সুত্রঃ বিভিন্ন অনলাইন নিউজ মিডিয়া***
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১১:৪৬