গুমনামী বাবা: ~ এই সাধু কি আসলেই 'নেতাজী' সুভাষ চন্দ্র বোস ছিলেন? পর্ব~১
নেতাজি ও গুমনামী বাবা
গুমনামী বাবার কাহিনি আরও নেতাজিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। কয়েকজন মুষ্টিমেয় মানুষ যারা ওই সাধুবাবার জীবদ্দশায় তাকে দেখতে পেয়েছেন, তারা সকলেই বলেছেন, গুমনামি বাবার সঙ্গে নেতাজির চেহারা এবং মুখের নাকি অদ্ভুত মিল রয়েছে। এমনকি তার অভ্যাস, তার কথা বলার ধরণ, তার খাদ্য রসিকতা সবকিছুই একেবারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আদলেই। গুমনামি বাবা কে? তা জানতে নেতাজির ভাইজি ললিতা বসু ১৯৮৬ এর ফেব্রুয়ারি মাসে এবং বিজেপি নেতা শক্তি সিংহ ২০১০ সালে আদালতের কাছে দুটি পিটিশন দাখিল করেন। এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই বিষয়ে মামলাও করা হয়। তাদের বক্তব্য ছিল, "গুমনামি বাবার পরিচয় জানতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক।"
২০১৬ সালে ২৬ জুন, উত্তরপ্রদেশ সরকার এলাহাবাদ হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বিষ্ণু সহায়ের নেতৃত্বে গঠন করে একটি তদন্ত কমিশন। তদন্তের পর, সেই তদন্ত কমিটি কমিশনে রিপোর্ট পেশ করে, "অধিকাংশ সাক্ষী জানিয়েছেন গুমনামি বাবাই ছিলেন নেতাজি। জনাকয়েক অবশ্য বলেছেন তিনি নেতাজি ছিলেন না।"
তবে সহায় কমিশনের বিপরীত মতামত ছিল এর আগে গঠিত মুখার্জি কমিশনের। তাদের তদন্তে উঠে এসেছিল, গুমনামি বাবা ছিলেন নেতাজির একজন ভক্ত, তিনি আদতে নেতাজি ছিলেন না।
সাংবাদিক বীরেন্দ্র কুমার মিশ্রাও পুলিশের কাছে একটি রিপোর্ট দায়ের করেছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন ১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গুমনামি বাবা মারা যান। এবং তার দুদিন পরে অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর তার সমাধি স্থাপন করা হয়। যদি ১৯৪৫ সালের বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি না মারা গিয়ে থাকেন, এবং এই গুমনামি বাবাই নেতাজি হন তাহলে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হবার কথা ৮৮ বছর। তবে খুব অদ্ভুত ভাবে, সেই বিশেষ দিনে কোন মৃত্যুর হদিশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। না রয়েছে কোনো মৃত্যুর প্রমাণপত্র, না রয়েছে মৃতদেহের কোন ছবি অথবা শেষকৃত্যের কোন ছবি। স্থানীয় সংবাদপত্র 'জনমোর্চা' দাবি করেছিল, 'গুমনামি বাবা নেতাজি নন'। ওই সংবাদপত্রের তৎকালীন সম্পাদক শীতলা সিং নেতাজির এককালীন সহায়ক পবিত্র মোহন রায়ের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন কলকাতায় এসে।
রায় তাকে জানান, 'পশ্চিমবঙ্গের শৌলমারী থেকে শুরু করে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা এমনকি পাঞ্জাব পর্যন্ত আমরা প্রত্যেক সাধুবাবার খোঁজ করেছি নেতাজির ব্যাপারে জানার জন্য। একই ভাবে বাস্তি, ফৈজাবাদ এবং অযোধ্যার মত জায়গাতেও আমরা খোঁজ চালিয়েছি। আমি হলফ করে বলতে পারি, গুমনামি বাবা নেতাজি নন।' উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফ থেকেও নেতাজির গুমনামি বাবা হওয়ার দাবি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া হয়।
এমনকী নেতাজি কন্যা অনিতাও এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলেই মনে করেন। তাঁর কথায়, "অর্থহীন তত্ত্ব নিয়ে কখনোই এগোনো উচিত নয়। অনেকে বলে থাকেন তিনি নাকি এখনও জীবিত। এটা সবথেকে ভালো বলতে পারবে একমাত্র ঈশ্বর। আর যদি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ওই বিমান দুর্ঘটনায় না মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে উনি গুমনামি বাবা সাজতে যাবেন কেন? যে দেশের স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগ করলেন, সেই দেশে নিজের নামে ফিরলেন না কেন? পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন না কেন? এটা কি আদৌ হতে পারে? এই সমস্ত অর্থহীন বিতর্ক নিয়ে আমি অত্যন্ত বিরক্ত।"
~ অনিতা বসু। সুভাষ চন্দ্র বসুর কন্যা।
তবে উত্তরপ্রদেশের সাধারণ মানুষের কাছে গুমনামি বাবা-ই ছিলেন নেতাজি। ফৈজাবাদ অঞ্চলের এক বাসিন্দা রাম কুমার বলছেন, "আমার বাবা বিশ্বাস করতেন, গুমনামি বাবা আসলে নেতাজি। উনি গুমনামি বাবার সমস্ত ইচ্ছা সম্মান করতেন, এবং কখনও তিনি তার সঙ্গে জোর করে দেখা করতে যাননি। সরকার এই সত্যিটাকে স্বীকার না করলেও গুমনামি বাবা আসলেই ছিলেন।"
গুমনামি বাবার মৃত্যু রহস্য ও কিছু উত্তর না জানা প্রশ্ন
৩৮ বছর হয়ে গেলেও গুমনামি বাবার মৃত্যুর রহস্য নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। এই মৃত্যু রহস্য আমাদের সামনে খাড়া করে দেয় একাধিক প্রশ্ন। কেন গুমনামি বাবা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবারের সদস্যদের ছবি এত যত্ন করে রেখেছেন? তার কাছে আজাদ হিন্দ ফৌজের এত গোপনীয় তথ্য এলই বা কোথা থেকে?
গুমনামি বাবার দাঁতের ডিএনএ এবং বসু পরিবারের কিছু সদস্যের রক্তের ডিএনএ পরীক্ষা করা হলেও তেমন কোনো মিল পাওয়া যায়নি। মুখার্জি কমিশন এর এই ডিএনএ রিপোর্ট পরবর্তীতে এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি খারিজ কেন করে দিয়েছিলেন?
নেতাজির অন্তর্ধানের চার বছর পর কলকাতার গোয়েন্দা অফিসার অনিল ভট্টাচার্য একটি সিক্রেট নোটে একজন সাধুর উল্লেখ করেছিলেন, এই সাধুই কি তাহলে গুমনামি বাবা? গুমনামি বাবার হস্তাক্ষরের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতের লেখার এত মিল কেন? একজন অজ্ঞাত বোনের কাছ থেকে তিনি নাকি একাধিক বই উপহার পেয়েছিলেন গুমনামি বাবা, কে এই 'বোন'? একজন ভারতীয় সাধু হওয়া সত্বেও তিনি মাংস খেতেন কেন?
মুখার্জি কমিশনের প্রধান জাস্টিস মুখার্জি, অফ ক্যামেরা কেন বলেছিলেন, 'তিনি ১০০ শতাংশ শিওর, গুমনামি বাবাই নেতাজি?'
কোনো ভক্ত ছিল না তার, কিন্তু তবুও গুমনামি বাবা অর্থসাহায্য পেতেন কার থেকে? আর তার থেকেও বড়ো কথা যদি তিনি নেতাজিই হন তাহলে গুমনামি বাবার ভেকই বা ধরেছিলেন কেন? তিনি কি সমসাময়িক রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাননি? তিনি যদি ফিরে আসতেন, তাহলে তাকে ভারতের সর্বময় কর্তা করার দাবি উঠতোই। তিনি কি এই সমস্ত থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলেন?
জনমোর্চা সংবাদপত্রের বর্তমান সম্পাদক ডক্টর সুমন গুপ্ত বলেন, 'উত্তরপ্রদেশে এখনো সমসাময়িক বহু মানুষ রয়েছেন যারা এই গুমনামি বাবা মানুষটিকে একবারের জন্যও না দেখলেও কিংবা তার সঙ্গে কথা না বললেও, গুমনামি বাবার উপরে বিশ্বাস রাখতেন। সরকার কোন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করল তাতে তাদের খুব একটা যায় আসে না। মৃত্যুর ৩৭ বছর পরেও উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে এখনো অনেকের মনেই জীবিত রয়েছেন নেতাজি ওরফে 'গুমনামি বাবা'!"
***
নেতাজীর মৃত্যু রহস্য!
নেতাজীর মৃত্যু সর্বদাই একটা বিতর্ক। তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে কয়েকটি প্রচলিত মত আছে। প্রথমটি সবচেয়ে প্রচলিত। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট মঞ্চুরিয়া যাওয়ার পথে তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছিল বলে সরকারি দলিল-দস্তাবেজে বলা আছে। যদিও এর যথেষ্ট বিরোধিতাও আছে। রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজীর চিতাভষ্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে, ওই চিতাভস্ম নাকি নেতাজীর নয়।
বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষের মৃত্যুর সত্যতা যাচাই করতে একাধিক তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে। যার মধ্যে শাহনওয়াজ কমিশন, খোসলা কমিশন এবং মুখার্জি কমিশন উল্লেখযোগ্য। প্রথম দুটি কমিশন ওই দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পক্ষেই মতামত দিয়েছে। কিন্তু হাস্যকরভাবে উক্ত কমিশনের কেউই তদন্ত করতে দুর্ঘটনাস্থলে যায়নি।
বিচারপতি মনোজ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন কমিশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তাইহোকু বিমানবন্দরের সব নথি খতিয়ে দেখে তারা মতামত দেয় যে ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট সেখানে কোনও বিমান দুর্ঘটনাই ঘটে নি। যদিও, কোনো কারণ না দেখিয়েই এই তদন্ত রিপোর্ট বাতিল করে দেয় সরকার।
একমাত্র মুখার্জী কমিশন বলেছিল, নেতাজীর মৃত্যুর প্রমাণস্বরূপ কোন ডেথ সার্টিফিকেট নেই। এমনকি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হননি বলে জানিয়েছেন নেতাজীর গাড়িচালকও।
হাবিবুর রহমান ছিলেন একমাত্র ভারতীয়, যিনি সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গী ছিলেন এবং তাই ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর সময় একমাত্র ভারতীয় সাক্ষী। রহমানকে মিত্রবাহিনী বন্দী করে এবং অবশেষে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন।
তিনি, তথাকথিতভাবে বিমান দুর্ঘটনার সাক্ষী ছিলেন কিন্তু সেদিনের দুর্ঘটনায় কোনো গুরুতর আঘাত পাননি। নেতাজীর সারা দেহ "গুরুতরভেবে পুড়ে যবার জন্য তিনি মারা যান এবং বলা হয় হাবিবুর নিজেই বোসকে তার শেষ মুহূর্তে সাহায্য করেছিলেন। যদি তাই বিশ্বাস করা হয়, তবে হাবিবুর রহমানের দেহে কোনো পোড়া আঘাতের ক্ষত কিভাবে হলো না?
~ হাবিবুর রহমান
তার দাবী যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী নিহত হয়েছেন বলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত, সে ঘটনার চার মাস পর তিনি নেতাজীকে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন সদস্য বলে দাবি করেছেন।
নেতাজী যদি জীবিত থাকেন, তাহলে কোথায় গিয়েছিলেন তিনি? অনেকে বলেন, নেতাজী সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। রাশিয়াতে যাওয়ার পর তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল সে ব্যাপারে তারা আবার ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন।
কারো কারো দাবি, সুভাষ গিয়েছিলেন রাশিয়াতে। রাশিয়ান সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করে এবং সেখানকার কারাগারে তিনি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কেউ বলেন তাঁর মৃত্যু হয় সার্বিয়াতে।
বোস: দ্য ইন্ডিয়ান সামুরাই- নেতাজী ও আইএনএ সামরিক পরিসংখ্যান - বইটিতেও নেতাজীর রাশিয়ায় যাওয়ার উল্লেখ আছে। এই বইটি ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জি. ডি. বকশি বইয়ে সাফ বলে দিয়েছিলেন, বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়নি। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তত্ত্বটি জাপানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির দ্বারা ছড়িয়ে পড়েছিল যাতে নেতাজী পালিয়ে যেতে পারেন। টোকিওতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় বোস এই পরিকল্পনাটি করেছিলেন। যখন বসু জাপান থেকে পালিয়ে যান, তখন তিনি সার্বিয়া থেকে তিনটি রেডিও সিরিয়াল সম্প্রচার করেন। সেই সময়ে ব্রিটিশরা জানত যে বসু জীবিত ছিলেন। তার বেঁচে থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে, ব্রিটিশ সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারের কাছে সুভাষকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ জানায়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় বসুকে এতটাই নির্যাতন করা হয় যে তিনি মারা যান। যদিও, এই বক্তব্যকে অনেকেই প্রত্যাখ্যান করেন।
(ভারতীয় সরকারের তরফ থেকে গঠন কতা খোসলা কমিশন ধৈর্য সহকারে বোসের নতুন 'দেখা' রেকর্ড করেছে - ১৯৪৬ সালে মার্সেইল বিমানবন্দরে তার সাথে একজন এমপির সাক্ষাৎ-এর সুযোগ হয়েছিল (জেকেসিআই রিপোর্টের অনুচ্ছেদ ৭.৩, ৭.৪); যিনি ছিলেন বোসের একজন চরম ভক্ত। একজন সোভিয়েত সেনা কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন যে " সুবেশী বোসকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৬ তারিখে উচ্চ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে ক্রেমলিনে প্রকাশ্যে যেতে দেখেছিলেন" এবং অন্য একজন এমপি দাবি করেছেন "বোসকে সাইবেরিয়ার একটি কারাগারে ৪৫ নং কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল "। তখনও অন্যকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাক্ষী দিয়েছিলেন যে, বোসকে ১৯৫২ সালে মঙ্গোলিয়ান ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সাথে পিকিং সফরে দেখা গিয়েছিল এবং একই বছরে, রেঙ্গুনের ইনয়া লেকেও তাঁকে দেখা গেছে। একজন বার্মিজ সন্ন্যাসীর পোশাকে নেতাজির সাথে সমাজতান্ত্রিক পার্টির সদস্যের সাথে দেখা হয়েছিল।)
ফুটনোটঃ মেজর জেনারেল (ড.) গগনদীপ বক্সী (সেনা পদক, বিশেষ সেবা পদক) একজন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা এবং লেখক। তিনি 'জি ডি বক্সি' নামে বিখ্যাত। তিনি জম্মু ও কাশ্মীর রাইফেলসে ছিলেন। কার্গিল যুদ্ধে একটি ব্যাটালিয়ন কমান্ড করার জন্য তিনি বিশিষ্ট সেবা পদক লাভ করেন।
তিনি ইংরেজি ভাষায় Bose: An Indian Samurai A Military Assessment Netaji and the INA (BOSE: AN INDIAN SAMURAI (A Military Assessment of Netaji and the INA)
তবে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক আছে যে, বিতর্ক বেশ কয়েকবার ভুয়া খবর প্রচার করেছে।
***
১৯৬৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী উজবেকিস্তানের তাসখন্দে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সাথে তাসখন্দ চুক্তি করার পরই রহস্যজনক ভাবে তার মৃত্যু হয়। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।অথচ তাঁর চিকিত্সক আর. এন. চুং দাবি করেন, ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী একদম ফিট ছিলেন। ওই বৈঠকের কিছু ছবিতে এমন এক ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যার চেহারা অবিকল সুভাষচন্দ্রের সাথে মিলে যায়। অনেক ফরেনসিক এক্সপার্টরাও ওই ব্যক্তিকে সুভাষ বলে দাবি করেছিলেন।
সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যুর ব্যাপারে তৃতীয় মতটি হল ফয়জাবাদের 'ভগবানজি' ওরফে গুমনামি বাবাই হলেন নেতাজী। ১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। চেহারায় কিছুটা মিল আছে বটে, তবে এমন দাবীর পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মুল রিপোর্টঃ
১৯৬৬-র ইন্দো-পাক শান্তি বৈঠকে যোগ দিতে তাসখন্দ গিয়েছিলেন সেই সময় প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। সেই সফরে লাল বাহাদুরের একটি ছবির পেছন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। নেতাজির ছবির সঙ্গে ওই ব্যক্তির মুখে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে বলে তাঁর ৬২ পাতার রিপোর্টে বলেছেন ফেস ম্যাপিং এক্সপার্ট নেইল মিলার। মুখের ধরণ, কান, চোখ, কপাল, নাক, ঠোঁট এবং চিবুক সর্বত্রই দুটি মুখের মধ্যে মিল যথেষ্ট বেশি।
~ এখানে মিলটা বেশ ভালই বোঝা যায় না কি বলেন?
নেইল মিলার এই সামঞ্জস্য থেকে দু-জন একই ব্যক্তি, এই সিদ্ধান্তে আসা যায় বলে জানিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ হাইকোর্ট ও আন্তর্জাতিক আদালতে বিভিন্ন মামলায় একাধিকবার বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়া মিলার এক বছর এই ছবিটি নিয়ে কাজ করেছেন। তবে চুল উঠে মাথার সামনেটা ফাঁকা হয়ে যাওয়া নেতাজির যে ছবি দেখে আমরা অভ্যস্ত, তার সঙ্গে কিছুটা অমিল রয়েছে চুলে ঢাকা এই ব্যক্তির। তবে ছদ্মবেশ ধারণের জন্য তা পরচুল হতেই পারে বলে জানানো হয়েছে।
মিশন নেতাজির প্রাক্তন সদস্য ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডাচ নাগরিক সিদ্ধার্থ -এর নির্দেশেই এই ফেস ম্যাপিং-এর কাজ করা হয়। ৩৬ বছরের এই সফটওয়্যার প্রফেশনালকে আরও কয়েকজন নেতাজি গবেষক ও কলকাতায় নেতাজি অনুগামীরা মিলারের পারিশ্রমিকের অর্থ চাঁদা করে তুলে দেন। প্রথমে একজন ভারতীয় বিশেষজ্ঞকে দিয়েই এই কাজ করানো হবে বলে ঠিক করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য কোনও ভারতীয় ফেস ম্যাপিং বিশেষজ্ঞ এই কাজে রাজি হন না। শেষে ইংল্যান্ডের নেইল মিলারকেই এই কাজের ভার দেওয়া হয়। নেইল মিলারের রিপোর্ট কোনওরকম রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায়, সেই রিপোর্ট আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে আশা করেন নেতাজি গবেষকরা।
*****
আমার কথাঃ
"নেতাজী বিমান দুর্ঘটনায় (দুপুর ২টায় জাপানের নিয়ন্ত্রিত তাইওয়ানের তাইহোকু এয়ারপোর্টে) মারাত্মক আহত হওয়ার পরে 'নানমোন' হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যে ডাক্তার তাঁকে প্রথম চিকিৎসা দেন (তায়োশি সুরুতা), তিনি সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে মারা যান।
তাঁর 'থার্ড ডিগ্রি' বার্ন হয়েছিল—যে নার্স তাঁর পোড়া ক্ষতে অলিভ অয়েল লাগিয়েছিলেন তিনি বলেছেন, বোসের শরীরের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ দগ্ধ হয়েছিল। পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ায় তাঁর চেহারা চেনা সম্ভব ছিল না। তিনি বলেছেন; বোস রাত ১১টার দিকে মারা যান।
বোসকে সনাক্ত করেন একজন জাপানিজ দোভাষী, তা-ও শুধু তাঁর কণ্ঠ শুনে। আহত বোসের ভাষা বোঝার জন্য একজন দোভাষীকে আনা হয়, সেই ভদ্রলোক বলেন তিনি এর আগেও বোসের দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারেন ইনি বোস।
এর মাঝে একজন লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার অফিসার এসে ডাক্তার তায়োশিকে বলেছিলেন, 'ইনি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মানুষ—ইনাকে যে কোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে।'
এই হল বোসের পরিচয়!!!
তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য, হাতঘড়ি চশমা থেকে শুরু করে কিছুই সংরক্ষণ করা হয়নি। ডিএনএ টেস্টের জন্য দেহের কোনো টিস্যু এমনকি দাঁত পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়নি। তিনি মারা যাওয়ার পরে তাড়াহুড়া করে তাঁকে দাহ করা হয় (কোন ধর্মমতে সেটা নিশ্চিত নয়)। তাঁর দেহভস্ম টোকিওতে নিয়ে যাওয়ার পরে মুখার্জী কমিশনের আগে কেউ কোনোদিনও সেটা ফরেনসিক টেস্টের জন্য আবেদন করেনি। জানা যায় যে সৈনিক নেতাজীর তথাকথিত দেহভস্ম নিয়ে টোকিও যাচ্ছিল সে কোনোদিন আর টোকিওতে পৌঁছায়নি।
ভারত সরকার ১৯৫৬ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যতগুলো কমিশন গঠন করেছিল, তাঁর মধ্যে একমাত্র শেষের মুখার্জী কমিশন কি রিপোর্ট দিয়েছিল দেখুন।"
Mukherjee Commission 2005
Findings:
This commission said that Bose’s death could not be proved. It also said that the ashes which are claimed to be Bose’s belong to another Japanese soldier. This report was submitted to the Parliament in 2006. It was rejected by the government.
• মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, রেনকোজি মন্দিরের ছাই তার নয়। তাইপে সরকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট কোনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি।
*আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রধান কর্মকর্তা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে ১৯৯৯ সালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল কেন? যদি তিনি ১৯৪৫ সালে মারা যেতেন তাহলে ১৯৯৯ সালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিশ্বাস করা একটা সন্দেহ সৃষ্টি করে।
**১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার চুক্তি এবং গোপন নথি ইনা নং পৃষ্ঠা নং ১০। এই পৃষ্ঠা ২৭৯-এর গবেষণা দেখায় যে ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি।
***নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর কথিত মৃত্যুর ঘোষণা পরে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধী ১৯৫৬ সালে শাহ নেওয়াজ কমিটি এবং ১৯৭০ সালে খোসলা কমিশন তদন্ত করেছিলেন। তারা দুইটি প্রতিবেদনে বসুকে মৃত ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু ১৯৭৮ সালে মোরারজি দেশাই এই প্রতিবেদনগুলো বাতিল করেন। এনডিএ সরকার মুখার্জী কমিশন গঠন করে পুনরায় তদন্তের চেষ্টা করে। কিন্তু মুখার্জী কমিশন রিপোর্ট বর্তমান কংগ্রেস সরকার স্বীকার করেনি। জাপান সরকার তদন্তে জানিয়েছে ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ থেকে শুরু করে বিমান দুর্ঘটনা সত্য নয়, যা সন্দেহ সৃষ্টি করে যে নেতাজী ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট মারা যাননি।
****১৯৪৮ সালে, বিজয় লক্ষ্মী রাশিয়া থেকে ফিরে এসে মুম্বাই অ্যাম্বাসেডর শাঁটক্রুজ বিমানবন্দরে নামার পর সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন, 'আমি ভারতবাসীকে এমন একটি সুসংবাদ দিতে চাই যা ভারতের স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হবে, কিন্তু নেহেরু জি জনসাধারণ এবং সংবাদ মাধ্যমকে সেই খবর দিতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ তিনি সন্দেহ করেছিলেন নেতাজী রাশিয়ায় ছিলেন।
*****ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৭ সালের ৪ আগস্ট রায় দিয়েছে যে 'নেতাজীর নাম মরণোত্তর বাতিল করা হয়েছে।' এটি প্রমাণ করে না যে নেতাজীর মৃত্যু হয়েছিল।
******২৮ মে ১৯৬৪ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর সময় প্রকাশিত একটি দস্তাবেজমন্ত্রে ফিল্ম 'লাস্ট চ্যাপ্টার' ফিল্ম নং ৮১৬ বি তে নেতাজীকে সন্ন্যাসী বেশে দেখা গেছে।
***
এই পোস্ট নিয়ে গঠনমূলক যে কোন আলোচনা সমালোচনা গ্রহণযোগ্য হবে। যেহেতু এটা একটা স্পর্শ কাতর ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয় সেহেতু্ তথ্যগত যেকোন ত্রুটি বিচ্যুতি নজরে আসলে অবশ্যই জানানোর সবিশেষ অনুরোধ রইল।
২য় পর্ব শেষ।।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২