(লেখার বিষয়বস্তু ও কিছু শব্দ অশ্লীল মনে হতে পারে -তবে কোনক্রমেই শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নয়।)
দ্বীতিয় ও শেষ পর্ব;
ওই দ্যাখ কমলা নটী যায়-
বালক বয়সে বাবার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে বসে চকিতে মুখ তুলে চেয়ে দেখতাম রাস্তা দিয়ে অবনত মুখে একটু ভিন্ন সাজ সজ্জায় কোমড় দুলিয়ে খালি পায়ে হেটে যাচ্ছে কোন রমণী।
শাড়িটা গোড়ালীর একটু উপড়ে তোলা তার নীচ দিয়ে ঝকঝকে রঙ্গীন কুচি দেয়া সায়াটা বেরিয়ে আছে আঙ্গুল চারেক। মাথার চুলগুলো চুঁড়ো করে বাঁধা-আর ঘোমটাখানা কোন মতে আটকে আছে ওখানটায়। মনে হত এই বুঝি ঝুপ করে খসে পড়বে।
চলন বলন চাহনী সব কিছুই ভিন্ন ধারার। পরিচিত কারো সাথেই মেলে না। তবে ওদেরকে কখনো উগ্র প্রসাধণীতে বাইরে যেতে দেখিনি।
পল্লী ছেড়ে এমনিতেই ওরা বাইরে বেরুত খুব কমই। মাঝে মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে রিকসা ডেকে হুড তুলে সামনে পর্দা দিয়ে যেত- হেটে যেত কদাচিৎ।
ওদের পল্লীর বাইরে সেন্ডেল পড়া নিষিদ্ধ ছিল- যাতে সবাই বুঝতে পারে ওরা খারাপ মেয়ে মানুষ! কি অদ্ভুদ!!
ওখানকার মুল খদ্দের ছিল ট্রাক ড্রাইভার হেল্পার পুলিশ ঘাটের ব্যাবসায়ী দালাল দুর-দুরান্ত থেকে আগত ব্যাবসায়ী আর ভবঘুরেরা। কারো কারো বাধা নারী ছিল- তারা ওখানটায় ঘর সংসার পেতে থাকত, কিন্তু দেহ দান করত না অন্য কাউকে।
ওদের সন্তানদের স্কুল মাদ্রাসায় পড়া নিষেধ ছিল। হিন্দু মুসলমান কাউকেই ধর্মমতে ক্রিয়াকর্ম করা হত না। হোগলায় বা পাটিতে মুড়ে রাতের আধারে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দিত ওদের নশ্বর অচ্ছুৎ দেহ!
নটি বা নটী এই দুটো ইংরেজী ও বাংলা শব্দের সাথে আমরা কমবেশী পরিচিত।
তবু কেন ওদের নটি বা নটী নামে ডাকা হয়!
এটাকি ভুল? নাকি অভিজাতদের পতিতা বা খানকি,মাগী এসব বলতে মুখে বাধত বলে একটু সভ্য করে নটী বলত!
মাঝে মধ্যেই কানে যেত, 'অমুক নাকি নটী পাড়ায় যায়!-হায় হায় ঘরে এত সুন্দর বউ রাইখ্যা ক্যামনে যায়! নটী মাগী ওরে তাবিজ কইরছে!
কখনো শোনা যেত,ও গ্রামের অমুকে নটীরে বিয়া কইরা ঘরে তুলছে!’
সেই নিয়ে চলত হেভ্বী তুলকালাম আর সরস আলোচনা সারা থানা জুড়ে। তবে ওই পল্লী থেকে এসে এইসব সংসারে টিকেছে খুব কম মেয়েই। ঘরের লোক আর প্রতিবেশীদের অত্যাচার সইতে না পেরে দুদিন পরেই ভেগে যেত বেশীর ভাগ।
আবার মদের নেশার ঘোর কাটলে কর্তা স্বয়ং কখনো লাঠি পেটা করে তাকে তাড়িয়ে দিতে দ্বীধা করত না। কত মেয়েকে দেখছি শরিরে দগদগে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাচ্ছে তার পুরোনো ডেরায়!
আমার বাড়ির অনতি দুরেই এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক দ্বীতিয় বউ করে যাকে এনে ঘরে তুলল তিনি ছিলেন সেই পল্লীর। আমার জন্মের আগের কথা। স্বভাবতই সেই নিয়ে তুমুল হুলস্থুল হয়েছিল বলে আমার বিশ্বাস।
শত প্রতিকুলতার মধ্যেও তিনি তাকে ছাড়েননি। মহিলাও মাটি আকড়ে পড়েছিলেন তার সংসারে।
এইতো কয়েক বছর আগে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অন্তত তার চরিত্র নিয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। নিজের কোন সন্তান সন্তদি ছিলনা তার তাই প্রান দিয়ে ভাল বাসতেন সতিনের সন্তানদের।
বলতে দ্বীধা নেই খুব ছোট বেলায় আমি তার কোলেই মানুষ হয়েছি। এত বেশী স্নেহ করতেন যে আমি তাকে ছোট মা বলে ডাকতাম। আমার আপন মা কোনদিনও এই নিয়ে কোনরুপ বিরুপ মন্তব্য করেননি। তিনি আমাকে কখনোই নিষেধ করেননি তার কাছে যেতে।
স্বর্গ-নরক বলে যদি কিছু থাকে তবে সৃস্টিকর্তা যেন উনাকে বেহেশতে নসিব করেন।
৮০র গোড়ার দিকে সু-গভীর খরস্রোতা সু-প্রশস্ত যমুনা নদীর ওপার বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য দানবাকৃতির পোল গাথার প্রয়োজন হলে ইন্জিনিয়ার আর কারিগরেরা আসল কোরিয়া থেকে।
তারা কয়েক বছর ডেরা বেধে ছিল আরিচায়। বিদেশ বিঁভুইয়ে সেই আদম সন্তানদের শরিরের চাহিদা মেটানোর জন্য মেয়ে সাপ্লাই দেয়া হত এই পল্লি থেকে।
কেউ কেউ দেহের জ্বালা সইতে না পেরে সরাসরি এসে হানা দিত এদের ডেরায়। কুকুরখেকো সেই কোরিয়ানদের(ওরা কুকুরের মাংস খেত বলে সবাই খুব ঘৃনার চোখে দেখত ওদের-বলত তাদের কুত্তাখোর।) ভদ্র কেউ কাছে ঘেষত না।
তাই নিয়ে কত মিথ আর অশ্লীল আলোচনা ;‘কুত্তা খাইয়া ওরা কুত্তার মত … চায় এই কুত্তি মাগীরাই পারে ওগেরে সামলাইতে!
সেই শ্রমিকেরা অবশ্য অর্থ বিলাত দু হাতে। মানুষ যে কতভাবে প্রতারনা করত তাদের! শুনতাম রাস্তা থেকে এক নেড়ি কুত্তা মেরে পুড়িয়ে খেয়েছে। আর তাই নিয়ে কয়কজন গেছে নিজেদের পালা কুত্তা বলে টাকা দাবি করতে। দু-পাঁচশ থেকে হাজার টাকাতেও ওরা শান্ত হত না।
গ্রামে মফস্বলে ফর্সাদেরকেই মুলত সুদর্শন বা সুন্দরী বলে। এমন দুধে আলতা রমনদের দেখে সেই নারীরা আর লোভ সামলাতে পারেনি। পরবর্তী প্রজন্মের এমন গায়ের রঙ্গের আশায় খায়েশ হয়েছিল ওদের গর্ভ ধারনের। দু-য়েক জনের সেই ইচ্ছা অবশ্য পূর্নও হয়েছিল। তবে কয়েক বছর বাদে সেইসব শিশুরা কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ আর জানেনা।
‘নটী’গ্যার নিয়্যাই ভাইববার সুময় নাই ওগোরে পুলাপান নিয়া কিডা ভাববে’।
সেই সময়ে সেই নটী পাড়া বা পতিতা পল্লীতে বেশ আলোড়ন সৃস্টিকারি একটা ঘটনা ঘটে গেল। আমার পাশের জমিদার টাইপের গেরস্ত বাড়ির সবচে বড় বদমাইশ এলাকার ত্রাস সেঝ সন্তান এক সুন্দরী নটী’কে এসিড মেরে ফেরার হল।
এইটে আবার আমার বড় ভাই তখন এক দৈনিকের সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে ফলাও করে প্রচার করল। সেই ঘটনা নিয়ে এত বেশী আলোচনা হয়েছিল চারপাশে যে আজও আমার বিলক্ষন মনে আছে।
আশে পাশের মানুষজন ওদেরকে এমনিতেই ঘৃনা করত। এই ঘটনায় যেন এসটা বেড়ে গেল কয়েকগুন। কিন্তু ওদের দেখেছি ভাবলেশহীন-যেন কিছুই হয়নি। হাসি খুশি গল্প খেলা ঠিকই চলছে। ছেলে হল ফেরার- পুলিশেও ধরল। বিচার শুরু হলে মেয়ে গিয়ে কাঠগড়ায় সাক্ষী দিয়েছিল। সেই প্রথম মনে হয় কোন নটি ওখানকার আদালতে ঢুকবার অনুমতি পেয়েছিল।
আমি তখনো বেশ ছোট। চলতি পথে আচমকা মুখোমুখি পড়েছিলাম সেই মেয়েটার। আচল দিয়ে এক পাশের মুখটা ঢাকা-সে পাশটা নাকি পুরোপুরি ঝলসে গেছে-যারা দেখেছে তারা বর্ননা করতে গিয়ে আতকে উঠত। আমার নজরে এসেছিল অন্য পাশটা। নিটোল কমনীয় সেই মুখের আভিব্যাক্তি আর একখানা সজল চোখের মায়াবী দৃষ্টি ভুলতে সময় লেগেছিল।
সেই ছেলে হাজার বিশেক টাকা মেয়েটাকে ক্ষতি পুরন আর থোক টাকা পুলিশ আর গন্য মান্য ব্যক্তিদের উৎকোচ দিয়ে তখনকার মত পার পেয়েছিল আর আমরা হয়েছিলাম চিরশত্রু। কিন্তু বলে না,’ভাগ্য বিধাতা তখন অলক্ষ্যে হেসেছিল।‘
বহু বছর বাদে তার এক ভাইপো সম্পদ নিয়ে গন্ডগোলের মুহুর্তে চাপাতি দিয়ে মোক্ষম একটা কোপ বসিয়েছিল তার মুখে! এখন সেও মুখ ঢেকে রাস্তা দিয়ে হাটে।
অগ্নিতে ঘৃতাহতি কে দিয়েছিল জানিনা তবে আচমকাই একটা রব উঠল। এই শহর আর এই জাতিকে বাঁচাতে হলে নটি পাড়া উচ্ছেদ করতে হবে। প্রথমে দুয়েকজন বিচ্ছিন্ন ভাবে কদিন বাদে সেটা রুপ নিল গন দাবিতে। পুলিশ জমিদার( যে সেই জমির মালিক) আরো কিছু জনপ্রতিনিধি আর প্রসাসনিক কর্ম কর্তারা প্রতি মাসে মোটা দাগের বখরা পায় ওদের কাছ থেকে। তারা এই দাবিতে পিছু না হটে উল্টো প্রটেকশন দিল ওদের।
আমার তখন পক্ষ-বিপক্ষের বয়স হয়নি। যেদিকে হাওয়া সেদিকেই পাল ঘোরাই। পরাশুনার অবসরে বাবার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে তার কাছটাতেই থাকতাম বেশী।
পরিস্থিতি থমথমে –যে কোন সময় একটা বড়সড় অঘটন ঘটে যেতে পারে। ঘটলও তেমনি। চৈত্র মাসের এক শুস্ক দিনে কে যেন আগুন দিল সেই নটী পাড়ায়। মাত্র মিনিট বিশেকের ব্যাপার ছিল জেলা শহর থেকে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি আসতে, কিন্তু সেদিন লেগেছিল তিন ঘন্টা!
আজ এতগুলো বছর বাদেও আজও বেশ মনে আছে আমার সেই দিনটার কথা। দখিনা বাতাস বইছে ভীষন জোরে। আগুনের লেলিহান শিখা যেন আকাশ স্পর্শ করছে।চারিদিকে ভীষন হৈ চৈ! তবে এ এক অন্য রকম দৃশ্য সবাই উৎফুল্ল হাসি মুখে দৌড়াচ্ছে সবাই। আগুন নেভানোর দায় ঠেকেছে কার! ওরা যাচ্ছে মজা দেখতে।
...পুড়ছে এককালের বিখ্যাত রেল স্টেশন ও স্টিমার ঘাট গোয়ালন্দের কুখ্যাত নটীপাড়া! পুড়ে যাক সব নস্টামি গ্লানি কালিমা। এইবার এই শহরটা জাতে উঠবে। পুলাপানরা সব ক্বারি সুফি হবে।
পুড়ছে ভাগ্য কয়েকশ রমনীর যাদের কোন ঠিকানা নেই। একজন কুষ্ঠু রোগীরও ঠাই মেলে কোন দয়াবানের উঠোন কোনে- কিন্তু এদের ঠাই মিলবেনা কোথাও। এরা নস্ট হয়ে গেছে, পচে গলে অচ্ছুৎ হয়েছে! ওদের ধরা যাবে ছোঁয়া যাবে ওদেরকে খাবলে খুবলে ছেড়া যাবে শকুনের মত। পেষা যাবে শরিরের সমস্ত শক্তি দিয়ে! নিজের ঘরের স্ত্রী যে কাজে পারঙ্গম নয় সেই বিকৃত কর্ম ওদের দিয়ে অনায়াসে করানো যাবে। শরির নিংড়ে বেরিয়ে আসা তপ্ত বীর্য ঢালা যাবে ওদের যোনী মুখে। কিন্তু আশ্রয় না না এটা কি করে সম্ভব!
আমার ধারনা আগুন দিয়েছে তারাই যারা ওদেরকে এসিড মারে ঘরের বধু করে এনে দুদিন বাদে লাঠি পেটা করে খেদিয়ে দেয় তাদের মতই সজ্জনরা।
যাদের দেখেছি উল্লসিত হয়ে এতদিন বাদে একটা সৎ কর্ম করা গেছে বলে দৌড়ে যেতে। তাদের অনেককেই পরবর্তী সময়ে সেই কুকর্মের দায়ে দায়ী হতে দেখেছি।
মেয়েগুলো শাপ শাপান্ত করে আলুথালু বেশে দুয়েকটা ঘটি বাটি টিনের তোরঙ্গ কাপড়ের পুটলি নিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে দৌড়াচ্ছে! আর দুরে দাড়িয়ে একপাল শুয়োরের দল ওদের দিকে আঙ্গুল তুলে নাম তুলে বলছে ওই দেখ কল্পনা নটী, আর দ্যাখ ওই যে সপ্না মাগী। যা দেমাগ ছিল মাগীর। সবাইরে ঘরে নিতনা। দ্যাখ এহন ক্যামন লাগে?এই বলে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
ওরা গালি দেবে কাকে মানুষকে না ঈশ্বরকে? সে কি বুক ফাটানো আর্তনাদ! একদিন এই পল্লীতে এসে যারা বাইরের পৃথিবী দেখার বাসনায় জীবন বিসর্জন দিতে রাজী ছিল আজ তারাই প্রানপনে ফিরে চাইছে তাদের সেই এক চিলতে নোংড়া কুটির খানা।
আগুন পুরো নিষিদ্ধ পল্লী গ্রাস করে দখিনা বাতাসে ভর করে ধেয়ে এল বাজার অভিমুখে। তখন আবার উল্টো চিত্র! হাসি উবে গেল সবার মুখের।
এবার আর যাবি কই-নিজেদের ঘর বাঁচানোর তাগিদে সবাই ঝাপিয়ে পড়ল আগুন নেভাতে। কিন্তু ভীষন দুর্নিবার বেয়াড়া আগুন তার খেলা দেখাচ্ছে। কোন কিছুতেই সে বশ মানবেনা।
সেই পল্লী থেকে আমাদের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান শ’দুয়েক মিটার দুরে। আগুন ধেয়ে আসছে এদিক পানেই। আমি আর আমার বাবা বেরিয়ে এলাম বাইরে। আর মাত্র কয়েকটা ঘর বাদেই আমাদের ঘরখানা পুড়ে যাবে। আমি একবার তাকাচ্ছি আগুনের দিকে একবার আব্বার মুখের পানে। আমাদের এই ঘরখানা পুড়ে গেলে আমরা ভীষন বিপদে পড়ব। নতুন করে আবার এই ব্যাবসা চালু করার সাধ্য হয়তো আমার বাবার নেই। কিন্তু কি আশ্চর্য তার মুখের রেখায় নেই কোন উদ্বগের চিহ্ন!
আমি ভীষন আতঙ্ক নিয়ে বললাম’ -আব্বা আমাদের ঘর পুড়ে গেলে কি হবে?
আব্বা হাসলেন-বললেন, কি আর হবে। ঘরতো আমার আর একার পুড়ছেনা। সবার যা হয় তাই হবে!
সেই সময়টাতেই দেখেছি। ভয়ঙ্কর হুল স্থুলের আর হুড়োহুড়ির মাঝে অল্প সংখ্যক কিছু নিষিদ্ধ পল্লীর নারী মন্থর পদক্ষেপে ভাবলেশহীন মুখে হেটে যাচ্ছে। এতবড় একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তাদের সেই নিয়ে কোন বিকার নেই!
মনে হল ঠিক আমার বাবার মনের কথাগুলো যেন ওদেরও। কি আর হবে? সবারইতো ঘর পুড়েছে। সবার যা হয় আমারও তাই হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২৩ সকাল ৮:৩৭