শেষ পর্ব রিপোস্ট
চারিদিকে সবকিছু নিরব নিথর হয়ে যাবার পর-নিজের রুমে ফিরে দেখি যেন ভীষন টর্নেডো এসে লন্ড ভন্ড করে দিয়ছে রুমখানা! সারা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে আছে ওসমানের সেই প্রিয় রিরিয়ানি। কার্পেট ভিজে জব জব করছে। পায়া ভাঙ্গা চেয়ার, মেঝের উপর পড়ে থাকা ছেড়া রক্তাক্ত র্অন্তবাস দেখে সবাই আরেকবার শিউড়ে উঠলাম। সারাক্ষন দেখা ওসমানের সেই ফুলহাতা সাদা শার্ট আর নেভি ব্লু জিন্সখানা শতছিন্ন হয়ে পড়ে আছে রুমের এককোনে- ওদিকে হাট করে খোলা ওয়ার ড্রব থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্পোর্টস ওয়্যারখানা উধাও। ওকে মনে হয় ওইটে পরিয়েই নিয়ে গেছে।
রুমের ডান দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে বিমুঢ়।বিশাল জানালার কাচ ভেঙ্গে ছড়িয়ে আছে ওদিকটার মেঝেতে। শীতের দেশে ঘরের তাপ যাতে দ্রুত বাইরে বেরুতে না পারে সেজন্য ভেতরে ও বাইরের দেয়াল ঘেষে ৪/৫ ইঞ্চি ফাকে দুটো জানালা থাকে। দুটোরই কাচ ভাঙ্গা!
সেখান দিয়ে হুড়মুড়িয়ে কনকনে ঠান্ডা বাতাস এসে ততক্ষনে রুমকে যেন ডিপ ফ্রিজ করে ফেলেছে।
বন্ধু মামুনের কথা:
সে নাকি রুমে বসে ওসমানের সাথে একাই গল্প করছিল-বাদবাকি যারা ছিল তারা ভাষাগত দুর্বলতার জন্য ওসমানের সাথে তাল মিলাতে না পেরে এদিক ওদিক সটকে পরেছে। আগেতো বলেইছি সেদিন ওসমান বেশ জোশে ছিল-আর জোশে থাকলে আজারবাইজানিদের মুখে আদি রসের খই ফোটে। সেদিন তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মামুন আবার এসব ব্যাপারে এককাঠি সরেস।সুযোগ বুঝে সে আরো বেশী উস্কে দিচ্ছিল ওসমানকে। ও বসে ছিল খাটে আর ওসমানতার উল্টোদিকের চেয়ারে। রুমের একমাত্র দরজাটা ওসমানের ঠিক পেছনে-যে কেউ ঢুকতে কিংবা বেরুতে গেলে মামুনের নজরে পড়বে-ওসমানকে দেখতে গেলে স্বভাবতই ঘাড় ঘোড়াতে হবে। আড্ডায় ওরা মশগুল ছিল-আচমচা বলা নেই কওয়া নেই দরজা ঠেলে প্রবেশ করল দুই বিশাল দৈত্যাকৃতির রুশ যুবক। ওরা যে সাধারন কেউ নয় সেটা মামুন চোখের নিমেষেই বুঝে ফেলল। ও ওসমানকে ইশারায় কিছু বলার আগেই একজন ঠোটের সামনে আঙ্গুল উচিয়ে চুপ থাকতে বলল। ওসমান তখনো টের পায়নি রুমে তার যমের আবির্ভাব!
দুই রুশ দৈত্যেও একজন তার পিছনে পজিশন নিয়ে দাড়াল- অন্যজন ঘুরে ওসমানের সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল; তুমি ওসমান না?
ওসমানের ধারনার মধ্যেই ছিল না এমন একটা ভয়াবহ ঘটনা অপেক্ষা করছে তার জন্য। সে কোন কিছু না ভেবে হ্যা আমি ওসমান’ বলেই ঠা ঠা করে বেকুবের মত হেসে হাত মেলানোর জন্য উঠে দাড়াতে গেল - ঠিক তখুনি পিছনের জন তার সবল বাহু দিয়ে ওর দু কাধ চেপে বসিয়ে দিল। পরমুহুর্তেই প্রথমজন টেবিলের উপরে রাখা পানি ভরা পাচ লিটারের জারটা উপুড় করে পুরো পানিটা ওসমানের মাথায় ঢেকে দিল।
তারপরেই শুরু হলো কিল ঘুষি! বিস্ময়ে বিমুঢ় হতবিহ্বল বিশাল দেহী বোকা ওসমান শুধু দুহাত তুলে আত্মরক্ষার ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
ঠিক এর মাঝে মামুনকে কে কখন যেন বিড়াল ছানার মত তুলে ধরে সেই রুমে পাচার করেছে সে বুঝেও উঠতে পারেনি।..
এঘটনার পরে আজো অব্দি ওসমানের কোন খবর পাইনি। সেদিন নাকি সেই নারকীয় অত্যাচার সইতে না পেরে ওসমান আমার রুমের জানালা ভেঙ্গে লাফ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। আমি থাকতাম আটতলায়। ধারনা যদি সত্যি হয় তবে,সেখান থেকে একজন মানুষ কোন অবস্থায় ঝাপ দিতে চায় তা সহজেই অনুমেয়।
কেউ বলে ওরা নাকি ‘আমন’ (রাশিয়ার স্পেশাল পুলিশ ফোর্স)ছিল, যার আদলে আমাদের যেমন RAB। সামরিক আধা সামরিক বাহিনী থেকে বাছাই করা সব লম্বু তাগড়া চতুর নিঃশ্বংস জোয়ানদের নিয়ে তৈরি এই স্পেশাল ফোর্স।বেশীর ভাগ অপারেশনে ওরা নেকাব পরে যায়। ওদের নাম শুনে ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের ঠ্যাং কাঁপে, শুধু অপরাধী নয় সব রাশিয়ানের কাছেই এরা মুর্তিমান আতঙ্ক! ওদের দেখা পাওয়াটা নেহায়েৎ দুর্ভার্গের ব্যপার!
আবার কেউ বলে শওকতের সেই বড় ভাইয়ের ভাড়াটে মাফিয়ারা এই কাজ করেছে। ওকে নাকি নুলা ল্যাংড়া করে পাঠিয়ে দিয়েছে সাইবেরিয়াতে চিরদিনের জন্য নির্বাসনে! কিংবা…
কাজটা যেই করুকনা কেন একদল হল রাস্ট্র নিয়ন্ত্রিত লাইসেন্স ধারী বৈধ সন্ত্রাসী অন্যদল আইনের চোখে অবৈধ! ওরা নির্বিশেষে সবাই নিষ্ঠুর নিঃশ্বংস!
খুব কষ্ট লাগে যখন ভাবি বিশালদেহী হাবাগোবা তেজী-গোয়াড় সদ্য হাসিখুশী বন্ধু বৎসল অমায়িক সেই ওসমানের কথা। যদি ধরে নিই তাকে মেরে ফেলা হয়েছে( সম্ভবনা খুববেশী) তবে কি অকারনেই না তার প্রানটা গেল!
এজন্য দায়ী কে? কয়েকজন অর্থলোভী গো-মুর্খ বাঙ্গালী নয়তো কি?
সবকিছু ছাপিয়ে আজো কানে বাজে ওসমানের সেই বিকৃত সুরে ও বচনে আউড়ে যাওয়া ‘শওকত ভাই, টাকা চাই’ ছড়াটা। মানসপটে দেখি আরিওখাবা হোস্টেলেরর সেই ৮০২ নম্বর রুমের সামনে হাত-পা ছড়িয়ে আজ প্রায় দেড় যুগ ধরে সে যেন বসে আসে তার পাওনাদারের অপেক্ষায়।…শেষ
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:৩৪