শীত শেষ শেষ, গরম আসি আসি। উত্তরবঙ্গের একদম উত্তরে হিমালয়ের প্রায় কাছাকাছি একটা ছোট্ট না গ্রাম না শহর মতো জায়গায় থাকি। মাঝে মাঝেই একটা দমকা বাতাস বয়। খাঁ খাঁ করা বাতাস। অনেক পাতা ওড়ায়। এক পশলা দমকা বাতাস বয়ে গেলেই সবাই বলে ঝায়েল আসছে। সে ঝড় বা বাতাসের নাম ঝায়েল। এরকম ঝায়েলের মৌসুমে কোন একদিন দোকানদার চাচার বাসায় দাওয়াত থাকতো। হালখাতার দাওয়াত। আব্বার হাতের আঙুল ধরে ছোট্ট আমি হালখাতায় যেতাম। ‘ তোলা’ জামা গায়ে কপালে টিপ। তখনও দিন তারিখের হিসাব শেখা হয়নি। মাস বলতে শুধু একটাই জানুয়ারি মাসের নাম জানি। এরপর কবে কবে যেন হাশেম খানের ছবি ধরে ধরে শিখে ফেলা ষঢ়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ্য এই দুইমাস গ্রীষ্মকাল। ছোটবেলা থেকে আরো একটা জিনিস দেখতাম বাসায়। সেটা হলো কিছুদিন পর পর ঘরবাড়ি পরিস্কার করার একটা পর্ব আসতো এবং বলা হতো সামনে ওমুক দিন তার আগে আশপাশ সব পরিস্কার করতে হবে। তো যথারীতি বছর শেষ হচ্ছে, নতুন বছরের আগে সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা চাই। মোটামুটি আমরা উৎসবের মতো করে উঠোন, আঙিনা, সামনের ছোট বাগান পরিস্কারে নেমে যেতাম। সেটাই আনন্দের উপলক্ষ্য। আর বাড়ির পাশে যাদের দিদি বা বৌদি বলে ডাকতাম। পুরো একমাস তাদের তুলসি মঞ্চের উপর ছিদ্রওয়ালা ঘট ঝুলতে দেখতাম। যে ঘট কিনা মাস শেষে ঘটা করে নামানো হতো। জানতাম আজকে চৈত্র সংক্রান্তি। পরের দিন সবাই পরিস্কার বাড়ি ঘরে পরিস্কার জামা কাপড় পড়তাম। এক ধরণের ফুরফুরে ভাব। এটা মোটামুটি আমার ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ঢাকার বাইরের ছোট শহরবাসের অভিজ্ঞতা। তখনই গল্পের বই বা উপন্যাসে পড়ে জেনেছি গ্রাম বাংলার আবহমান বৈশাখী আড়ং এর গল্প, দেখা হয়নি।
এরপর ঢাকা বাস। এবং পহেলা বৈশাখের হৈ চৈ, আওয়াজ, আয়োজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। বলা হয় পহেলা বৈশাখ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। কিন্তু এতগুলো বছরেও ঠিক প্রাণটা কোথায়, খুঁজে পাইনা। শহর জুড়ে অসহ্য যানযট, রুদ্ধশ্বাসে টিএসসি মুখী জন¯্রােত। এই গনগনে গরমে নতুন শাড়ি পাঞ্জাবী গায়ে, ফুল মেকআপে মানুষ হাঁটছে, ধাক্কা খাচ্ছে। চেনা অচেনা নানারকম মানুষ। ঘাম, ধাক্কাধাক্কি। আর তার আগে প্রায় ১ মাস ধরে শপিং করা। ষোল হাজার টাকায় ইলিশ মাছ কেনা। এই পুরো আয়োজনে প্রাণ কই? প্রাণ তো পাওয়া যায় তখন, যখন প্রাণের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, পাশাপাশি বসা হয় কিছুটা সময়। একটা উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষ। উৎসব মানে তো মাত্রা ছাড়া শপিং, অপ্রাসঙ্গিক খাওয়া দাওয়া আর উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাহাঁটি বা ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকা নয়। আমাদের আদিবাসীরা বৈসাবি বলে যেটা করে, সেটা উৎসব। অনেকগুলো পর্ব দিয়ে সাজানো তিন দিনের মূল পর্বসহ প্রায় ৭ দিন ব্যাপি চলে বৈসাবি উৎসব। পরিবার পরিজন, বন্ধু, প্রতিবেশিরা মিলে প্রকৃতির সেবা করে। এ ঘর ও ঘর বেড়ানো, শুভ উদ্দেশ্যে, শুভ কামনায়। সেটাই উৎসব। পাড়া প্রতিবেশি তরুন তরুনীরা পানি খেলে, এটা উৎসব। এই উৎসবের প্রতিটি পর্বের রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম, নির্দিষ্ট আচার আনুষ্ঠানিকতা। শত শত বছর ধরে যা মেনে আসছে পাহাড়ের আদিবাসীরা। এ উৎসব শুধু একটি দিন কেন্দ্রিক নয়, উৎসব হয় জুম চাষের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। এসময় জুম ক্ষেতে কাজ থাকেনা, ঘরে ফসল থাকে। আগুন দিয়ে জমি পোড়ানো হয়, তৈরি করা হয় পরের সিজনের জন্য। এর বাইরে আর বেশি কাজ নেই। সুতরাং উৎসব হয়। উৎসব হয় পরবর্তী ফসলের মঙ্গলের জন্য। বর্ষায় জুম চাষ শুরু হলে কেউ কেউ চলে যাবে জুম ঘরে। অনেক দিনের বিচ্ছেদ। অতএব তার আগে একসঙ্গে নাচগান, খাওয়া দাওয়া।
হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ট্রেন্ড কিন্তু উৎসব নয়। উৎসবের থাকে কার্যকারন। একসময় যেমন এদেশে ঘটা করে বর্ষাকালে গাজীর গান, ঘেটু গানের উৎসব হতো। তার একটা কারণ আছে। ভরা বর্ষায় মানুষের কাজ থাকেনা। মাঠে বা বাহিরে কাজ না থাকায় মানুষ থাকে ঘরবন্দী। ঘরে বসে হাতের কাজ সারে। কাঁথা সেলাই করে, জাল বোনে। এই অখন্ড অবসরে তখন মানুষের বিনোদনের সঙ্গী হয় গাজীর গান, পালা গান। এমনকি দূর্গা পূজা কেন বসন্ত থেকে শরতে শিফট করলো। এরও কিন্তু অকাল বোধন কেন্দ্রীক ধর্মীয় ব্যাখ্যা ছাড়াও প্রাকৃতিক কিছু কারণও রয়েছে। অপেক্ষাকৃত নিরামিষভোজী হিন্দু সম্প্রদায় দূর্গা পূজায় বলির উছিলায় মাংস খায়। এবং হিন্দু ধর্ম যেহেতু পুরোপুরি প্রকৃতি থেকে উৎসারিত একটি ধর্ম। সেই বাল্মিকির যুগেই তারা মনে করেছিল, বছরের অন্য সময়ের চেয়ে শরৎকালে মাংস ভক্ষণ শরীরের জন্য সহনীয়। আর ভাদ্রের শেষ এবং আশ্বিনের শুরুতে ফসল রোপন শেষ হয়। সুতরাং এসময় কৃষি নির্ভর ভূ ভারতের মানুষের কিছুটা অবসর। এই অবসরেই উৎসব। অথচ কিভাবে কিভাবে পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ খাওয়া একটা নিয়মে পরিনত হলো আমাদের দেশে, মূলতঃ ঢাকা শহরে। এর কিন্তু কোন কার্যকারণ নাই। যে ঋতুর উৎসব, সেই ঋতুতে প্রাপ্য বা সম্পৃক্ত উপকরণেই উৎসব পালিত হবে। অগ্রহায়নে নবান্ন হয়। আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতি। নতুন ফসল ওঠা উপলক্ষ্যে এ উৎসব। স্বরস্বতি পূজায় গাদা ফুল বা কুল বড়ই লাগে কারণ এগুলো সেসময়ই পাওয়া যায়। তেমনি বর্ষার শেষে শরতে পদ্ম আর শিউলি ফোটে বলে দূর্গা পূজার মূল উপকরণ শিউলি আর পদ্ম। অথচ ইলিশ মাছের মৌসুম বর্ষা । আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে কুবেরদের ব্যস্ত রাত কাটে ইলিশের সন্ধানে। তার আগে বৈশাখ থেকে জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি ইলিশের প্রজননের কাল। এমসয় ইলিশ ধরাই নিষিদ্ধ। অথচ কি এক আজগুবি কারণে আমাদের ট্রেন্ড চালু হয়েছে পয়লা বৈশাখে ইলিশ খেতেই হবে। তার দাম ষোল বা বিশ যত হাজার টাকাই হোক না কেন।
উৎসব যদি সবার জন্য করা হয়, তাইলে তার মধ্যেও কেন বৈষম্য? গত কয়েক বছরে একটা শ্রেণীর হাতে বেসুমার টাকা হয়েছে, সবাই জানি। ষোল হাজার টাকার ইলিশ মাছ তাদের কাছে ‘নট এ বিগ ডিল’। কিন্তু আরেকটা শ্রেণী যারা দেখছে, জানছে সব, শামিলও হতে চাচ্ছে উৎসবে। কিন্তু উৎসবের নামে যে স্টান্ডার্ড আমরা সেট করে ফেলেছি, তা ধরতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের কথা না ভেবেই পয়লা বৈশাখ আমাদের সার্বজনীন প্রাণের উৎসব বলে গাল ভরা গল্প করছি। বেশ কয়েক বছর আগে আমার বাসায় কাজে সাহায্য করতো এক ভদ্রমহিলা। পাঁচ থেকে তের বছর বয়সী চার কন্যার মা তিনি। একবার পয়লা বৈশাখের আগে হঠাৎ দেখি বেশ বিষন্ন সে। কি হয়েছে প্রশ্ন করায় জানতে পারি। চার মেয়েরই আব্দার লাল শাদা শাড়ি লাগবে। এক সঙ্গে চারটা নতুন শাড়ি মানে তার এক মাসের আয়ের চেয়েও বেশি টাকা। এই নিয়ে পরিবারে অশান্তি। উৎসব করি শুভ উদ্দেশ্যে, মঙ্গল কামনায়। এই সুযোগে বানিজ্য করে নেয় বনিক শ্রেণী। আর খাদিজা, ময়ুরীদের মায়ের সংসারে চলে মাসব্যাপি অশান্তি, নতুন শাড়ি কিনে ফেলার পর ভাতও হয়না ঠিক মতো। বাঙ্গালী মুসলমানের কোন শেকড়ে কবে লেখা ছিল পয়লা বৈশাখ মানে নতুন লাল পাড় শাদা শাড়ি?
উৎসব পালনের চরিত্র দেখে মনে হয়, আমাদের প্রধান উদ্দেশ্যই কেনাকাটা। পয়লা ফাল্গুনে হলুদ পোশাক কেনো, পরেরদিন ভ্যালেন্টাইনস ডে তার জন্য লাল পোষাক। কেনাকাটাতেই আনন্দ আর আনন্দ ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস বা টি এস সি র দিকে দৌড়ে যাওয়া। রাষ্ট্রীয় দিবস হোক বা এইসব পয়লা তারিখ কেন্দ্রিক উৎসব বা হালের ভ্যালেন্টাইনস ডে। মানুষ উদ্দেশ্যহীন ভাবে শুধু ঘোরে আর টি এস সি যায়। সব উৎসবের এক গন্তব্য। ফলাফল ঢাকা শহরে সেদিন মাত্রাতিরিক্ত জ্যাম। মনে পড়ে একবার পয়লা বৈশাখের ছুটির দিনে প্লান ছিল, নাটক দেখবো, রক্ত করবী। খিলগাঁর বাসা থেকে শান্তি নগর মোড়ে গিয়ে জ্যামে আটকা ছিলাম ৪ ঘন্টা। বিকেল ৫ টায় বাসা থেকে বেড়িয়ে রাত ১০ টায় ঘরে ফিরেছিলাম নাটক না দেখেই, শুধু জ্যামের কারণে। আরেকবার রাতে দাওয়াত ছিল প্রিয় এক বন্ধুস্থানীয় বড় ভাইয়ের বাসায়। সন্ধ্যা ৬ টায় বেড়িয়ে তার বাসায় যখন পৌঁছাই তখন রাত সাড়ে বারোটা! আর গত বার ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় বন্যা আপার গান শুনবো বলে ঠিক করলাম। এমন দূরত্বে অনুষ্ঠান, বাসা থেকে হেঁটে গেলেও আধা ঘন্টা লাগে। অথচ দেড় ঘন্টা জ্যামে বসে থেকে এ গলি ও গলি করে ফিরে আসলাম, কারণ হেঁটে যাওয়ার মতো অবস্থাও ছিলনা রাস্তায়। বাঙালীর উৎসব মানে যেন তাই বিড়ম্বনাও।
অথচ উৎসব মানে হওয়া দরকার সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, রুচির প্রতিফলন। উৎসব সবাই মিলে উপভোগের, সবার মঙ্গল কামনার। উৎসব মানে বিড়ম্বনা নয়, আদিখ্যেতা নয়। আমাদের দূর্ভাগ্য, আমাদের মাত্রা জ্ঞানের অভাব প্রতিফলিত হয় আমাদের উৎসব উৎযাপনেও। প্রসঙ্গক্রমেই এসে যায় তুলনা। কলকাতার সঙ্গে ঢাকার উৎসব আনুষ্ঠানিকতার। সুযোগ পেলেই আমরা কলকাতার বাঙালীদের সমালোচনা করি। তাদের আচরণ, কৃপনতা নিয়ে আমরা ঠাট্টা মশকরা করি। এর হয়তো কিছুটা সত্য হলেও হতে পারে। কিন্তু যে কোন উৎসব পালনের যে ঐতিহ্য ওরা পালন করে, তার ধরণ দেখেই বোঝা যায়, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তাদের রুচিবোধ কত উন্নত। বাহুল্যতা বর্জিত এই সব উৎসব সত্যিই আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। বইমেলা মানে ওদের কাছে অযথা ঘোরাঘুরি নয়, বইমেলা মানে বই কেনা। বই কেনা লোক দেখানো বা ফেসবুক স্টাটাস দেয়ার জন্য নয়। বই কেনা মানে বই পড়া। গত বছর ফেব্রুয়ারির প্রায় পুরোটা কলকাতায় কাটিয়ে দেখেছি পয়লা ফাল্গুন মানে লোক দেখানো হলুদ পোশাকের আনুষ্ঠানিকতা নয়। বরং তার কয়েকদিন আগে হয়ে যাওয়া স্বরস্বতি পূজাই বসন্ত বরনের উৎসব। প্রেমে বা বন্ধুতে ওরা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকলেও ১৪ ফেব্রুয়ারি পুরো কলকাতা শহরে সেভাবে চোখে পড়েনি জুটি বেঁধে লাল পোশাকে ঘোরাঘুরি। এর মানে এই না যে সেটাই আমাদের অনুসরন করতে হবে, এটাই স্টান্ডার্ড হওয়া দরকার। তুলনা আসলো এটা বোঝাতে যে বাহুল্য ছাড়া, লোক দেখানো প্রতিযোগীতা ছাড়াও উৎসব হয়, সেটা বোঝাতে। বসন্তে কলকাতার মানুষ সাজেনা অথচ শহরটা পুরোই বাসন্তী রূপ নেয়। অসংখ্য পলাশের সারি, মূল রাস্তার ধার দিয়ে। কাকের চেয়ে কোকিলের সংখ্যা বেশি। তার মানে প্রকৃতিই বসন্তের আবাহন করে। অথচ আমাদের বৃক্ষ বিহীন, পাখী বিহীন ঢাকা শহরকে আমরা আরো প্রকৃতি বিমুখ করি। প্রকৃতিকে সাজতে না দিয়ে নিজেরা সেজে পালন করি বসন্ত উৎসব!
ভুলে গেলে চলবেনা আগে প্রকৃতি, তারপর মানুষ। প্রকৃতিকে ধরে না রাখলে, প্রকৃতি মেনে উৎসব না করলে সেটা আদিখ্যেতা হয়, উৎসব নয়।
সবাইকে শুভ নববর্ষ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৬