বাংলাদেশের ওষুধশিল্পঃ রয়েছে এক অপার সম্ভাবনা!
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
যে কাউকে আমাদের দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্পখাতগুলো নিয়ে বলতে বললে শুরুর দিকেই থাকবে ওষুধ শিল্প। আমরা সবাই জানি যে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল, আমাদের ঔষধও আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু এটাকি জানি যে পৃথিবীর এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি) বা অনুন্নত ৪৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে সবচেয়ে এগিয়ে আছে? এটা কিন্তু আমাদের দেশের জন্য একটা বিশাল অর্জন!
বাংলাদেশের আছে ওষুধশিল্পে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, শুরুটা হয়েছিলো সেই ১৯৫০ এর দশকে। বর্তমানে আমাদের দেশীও চাহিদার প্রায় ৯৭ শতাংশ পূরণ হয় দেশে তৈরি ওষুধে, এছাড়া আমরা রপ্তানি করছি ৮০ টিরও বেশী দেশে! গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প প্রভূত উন্নতিসাধন করেছে, আর গত পাঁচ বছরের বাজার প্রবৃদ্ধি তো এক কথায় অসাধারণ। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে আমাদের ড্রাগ পলিসি, আর অনুন্নত দেশ হিসেবে আমাদের পাওয়া TRIPS (Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights) রিলাক্সেশন।
১৯৮০ সালে আমাদের ওষুধশিল্প ছিল মাত্র ১০০ কোটি টাকার, সেটা ২০০৩ এ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২৫০০ কোটিতে আর ২০১২ সালে প্রায় ৯০০০ কোটি টাকায়!
নিচে আমি গত পাঁচ বছরের বাজার কে দেখাচ্ছি-
বাংলাদেশের গত পাঁচ বছরের ওষুধ বাজার (কোটি টাকা)
বাজার প্রবৃদ্ধি (%)
যদিও আমাদের ওষুধশিল্প অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, তবে এখনও আমরা ৭০% এরও বেশী কাঁচামাল বাইরে থেকে আমদানি করি। সুখের কথা হচ্ছে আমাদের দেশীও কয়েকটি কোম্পানি ইতোমধ্যেই API (Active Pharmaceutical Ingredient) উৎপাদন শুরু করেছে, এছাড়া খুব শিগগিরিই একটি API Park তৈরির তোড়জোড় চলছে।
আমাদের ওষুধশিল্প একই সাথে দেশীও বাজার এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খুব ভালোভাবেই প্রসারিত হচ্ছে এবং আমরা বিভিন্ন উন্নত দেশেও ওষুধ রপ্তানি করছি। ওষুধের আন্তর্জাতিক বাজার মূলত দু ধরনের- রেগুলেটেড এবং আন-রেগুলেটেড। আফ্রিকা বা এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলোই হচ্ছে আন-রেগুলেটেড বাজার। এসব দেশে রপ্তানি করা তুলনামুলকভাবে সহজ, কারন এসব দেশের ওষুধশিল্প এখনও তেমনভাবে বিকশিত হয়নি; সরকারও তেমনভাবে প্রতি পদে পদে খবরদারি করে না। কিন্তু রেগুলেটেড মার্কেটে ওষুধ রপ্তানি করা তুলনামুলকভাবে অনেক বেশী কঠিন। এগুলো হচ্ছে ইউরোপ এবং আমেরিকার মত উন্নত দেশ সমুহ। এসব দেশে খুব ভালো মেডিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে, রেগুলেটরি অথরিটি যথেষ্ট কড়া। একেবারে ১০০% মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত কড়া না গেলে ওইসব দেশে ঢোকার কোন উপায়ই নেই!
আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওষুধের বাজার হচ্ছে আমেরিকা, কিন্তু এরপর? জানি বেশিরভাগই বলবেন চীন, কিন্তু আসলে সেটা ভুল। ওষুধের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হচ্ছে জাপান । আসলে বাজার জনসংখ্যার উপর যতটা নির্ভর করে তারচেয়ে বেশী করে সেদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর। তো এসব দেশে কোন ওষুধ রপ্তানি করতে গেলে কিছু জিনিশ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হয়। যেমন-
১. কারখানার আন্তর্জাতিক মান
২. আন্তর্জাতিক মানের কাঁচামাল (API এবং Excipient দুটোর জন্যই)
৩. cGMP (Current Good Manufacturing Practice) মেনে চলা
৪. আন্তর্জাতিক মানের মেশিনারি
৫. দক্ষ কর্মচারী বৃন্দ ইত্যাদি।
কারখানার আন্তর্জাতিক মান বলতে আমরা আসলে কি বুঝি? সেটা কীভাবে প্রমাণ করা যাবে? আসলে কারখানার মান নিশ্চিত করার জন্য কিছু রেগুলাটরি বডি আছে, যারা কারখানা পরিদর্শন করে সেটার মান সন্তোষজনক হলে সার্টিফিকেট প্রদান করে। এমন কিছু রেগুলাটরি বডির মধ্যে আছে USFDA (United States Food and Drug Administration), UK MHRA (UK Medicine and Healthcare Regulatory Authority), Australian TG (Therapeutic Goods) ইত্যাদি। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই কয়েকটি কোম্পানি UK MHRA এর সার্টিফিকেট পেয়েছে, কয়েকটি কোম্পানি পেয়েছে Australian TG এর সার্টিফিকেট, তবে এখন পর্যন্ত কেউই USFDA এর সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারে নি।
তো ভালো একটা কারখানা থাকলেই কি হল? না, ভালো ওষুধ তৈরি করতে হলে অবশ্যই ভালোমানের কাঁচামাল লাগবে। সেটাকে হতে হবে Pharmacopoeia Grade- যেমন COS (Certificate of Suitability) grade API. ইউরোপের মার্কেটে রপ্তানি করতে হলে এই COS গ্রেডের কাঁচামাল একদম Basic Need.
ভালো কারখানা আর ভালো কাঁচামাল তো নিশ্চিত হল, কিন্তু এতেই কি শেষ? না, আমাদের মেনে চলতে হবে WHO (World Health Organization) এর cGMP (Current Good Manufacturing Practice), এটি নিশ্চিত করবে ওষুধের গুনগত মান। কোনভাবেই এর ব্যত্যয় হওয়া চলবে না, কারন এছাড়া আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করা আসলেই অসম্ভব।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কোন মেশিনারি ব্যাবহার করে ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে, ভালমানের ওষুধ তৈরি করতে গেলে অবশ্যই প্রয়োজন ভালমানের মেশিন। বর্তমানে ভারত এবং চীন প্রায় সবধরনের মেশিনই তৈরি করছে, তবে এখনও আমেরিকা বা ইউরোপে তৈরি মেশিনই সবচেয়ে ভালো মানের। রপ্তানির ক্ষেত্রে সবসময়ই ইউরোপিয়ান মেশিনারি ব্যাবহার করা উত্তম!
আর এত সবকিছুর পড়ে আসে একদল দক্ষ কর্মচারী, যারা cGMP এর সমস্ত নিয়ম মেনে সতর্কতার সাথে সম্ভাব্য সেরা মানের ওষুধ তৈরি করবে। বাংলাদেশের কর্মচারীরা কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে, আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত!
বর্তমানে বাংলাদেশে ২৫০ টিরও বেশী ওষুধ কোম্পানি আছে, এগুলোর মধ্যে অবশ্য বেশীরভাগই অন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করে না। তবে বড় বেশ কয়েকটি কোম্পানি কিন্তু এখনই অত্যন্ত উন্নতমানের ওষুধ তৈরি করছে। আমাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে আমরা তুলনামুলকভাবে অনেক কম খরচে ভালমানের ওষুধ তৈরি করতে পারি, এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে আমরা একদিন বিশ্ব বাজারে মাথা তুলে দাঁড়াবো...সে স্বপ্নই দেখি। বাংলাদেশের একটি কোম্পানির নাম উচ্চারিত হবে Pfizer এর সাথে...স্বপ্নটা কি খুব বেশী বড় হয়ে গেলো? আশাবাদি হতে দোষ কোথায়?
৩১টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন