নাগরিক সভ্যতা আর জীবন জীবিকার টানা পোড়নে আমার থেকে আমার বাবার দূরত্ব যোজন যোজন দূর। আমার মতো যারা বাবার থেকে অনেক দূরে যান্ত্রিক এই শহরে ইট-পাথরে ঘেরা চার দিয়ালের মাঝে বসে বাবাকে মিস করতেছে,তাদের স্মরণে আর পৃথিবীর সকল বাবাদের প্রতি বিন্ম্র স্রধা জানিয়ে আমার এই লেখা তাদের পদতলে সমর্পণ করলাম। পৃথিবীর প্রায় সব ছেলে মেয়েরা তাদের জন্মের পর প্রথম যে সুপার হিরোকে তাদের অন্তরের রাজত্ব দেয় সে তার বাবা। কিন্তু আমাদের মতো নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা যাকে দেখে জীবন সংগ্রামে নামে , সে পাশের বাড়ির মেধাবী ছেলে বা মেয়েটা (ব্যাক্তিগত মতামত)। তাই আমার বাবার সাথে সম্পর্কটা যে কতোটুকু কাছের বা দূরের তাহা পরিমাপ করে বলতে পারবো না। ছেলে বেলার সবকিছু ঠিক মনে নেই,তবে যাহা মনে আছে তাতে বলতে পারি আমার বাবা-মা আমাকে ঐটুকু বয়সে যে রেসে নামিয়ে দিয়েছিলো তাতে আমার প্রতিপক্ষ ছিল আমার কাজিন। ছোটবেলা থেকে তাদের একটাই কথা ক্লাসে ফাস্ট হতে হবে,ধার্মিক হতে হবে,খেলা করা যাবে না। ছোটবেলা থেকে ভাবতাম ভালো ছেলেরা বুঝি খেলা করে না। সত্যই কি তাই??? জীবনের এই রেসে ছোট্ট কিছু অর্জনের পিছনে ছুটতে যেয়ে যাকে হারিয়ে ফেলেছি সে আমার বাবা। শেষ বার বাবাকে হারিয়েছি ২০০৯ সালের ১২ই জুলাইতে। বাবা আমাকে ঢাকাতে ভার্সিটি কোচিং করার জন্য ফার্মগেটের একটা হোস্টেলে রাখতে এসেছিলো। আমাকে রেখে যাবার সময় বাবা আমার হাতে ১৩০০ টাকা দিয়ে বলেছিল এটা রাখো আর লাগলে পরে নিও। প্রথমবার নিজের হাত খরচের জন্য এত টাকা যা আগে কখনো পাই নি। কিন্তু কেন যেন খুশি হতে পারিনি সেদিন!! রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম বাবা খুব জোরে পায়ে হেঁটে আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে,শুধু একবার পকেট থেকে রোমালটা বের করলো। রুমে এসে বাথরুমে ঢুকে পানির ট্যাব ছেড়ে অঝরে চোখের পানি ছেড়েছিলাম। পরের দিন হোস্টেলের খালার (পরিচিকা) কাছ থেকে শুনলাম যাবার সময় বাবা নাকি খালার কাছে কান্নাকাটি করে বলেছিল “আমার ছেলেকে দেইখেন,আমি জীবনে কখনো ওকে দিয়ে এক গ্লাস পানি আনাইনি,আমার একমাত্র ছেলে, ও সব খাবার খেতে পারে না, আপনি একটু দেখেইন”। খালাকে দুইশত টাকা দিয়ে গিয়েছিলো যাতে সে আমার প্রতি একটু বেশি খেয়াল করে। জীবনের এই মর্মান্তিক রেসে অনেক কিছুই পেয়েছি হয়তোবা,কিন্তু তুমি যে আমার থেকে আজ অনেক দূরে। বাসায় গেলে মনে হয় একই ছাদের তলায় থেকেও বাবা তুমি আমার থেকে অনেক দূরে। তা নাহলে তোমাকে দেখে এতো লুকোচুরি খেলি কেন আমি?? বাবা এই রেসে নেমে আমি তুমার আদর্শ হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই,বাবা ক্ষমা করো আমায়। বাবা আর একটা সুযোগ দেবে আমায় তুমার হাতটা ধরে কিছুটা পথ পায়ে হাঁটার। বাবা তুমার বুকে মাথা রেখে আর একবার উচ্চস্বরে বলতে চাই “বাবা ভালোবাসি তোমাকে, আমি গর্বিত তুমি আমার বাবা”।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:৫২