ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে অথচ হেনরি কিসিঞ্জারের (হেঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার) নাম শুনেনি এমন মানুষ দুলর্ভ । তাছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটতে গেলে হেনরি কিসিঞ্জারের নাম অবধারিত ভাবে চলেই আসে । মানুষটাকে যতই অপছন্দ করি না কেন মানতে হবে এই মানুষটার মত কুটনৈতিক ব্রেইন ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নেই । মানুষটি নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা কুটনৈতিকদের মাঝে একজন । যার যার সামান্য কুট বুদ্ধিতে পানির মত রক্তস্রোত বেয়ে গেছে । দুঃখজনক হলেও সত্য যে বেটাটা এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে এবং ২য় স্ত্রী ন্যান্সি ম্যাগিনেস সহ কানেক্টিকাটের কেন্টে এবং নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাস করছে । সাথে সাথে মার্কিনদের অন্যতম গোপন পরামর্শদাতা/উপদেষ্টা হিসেবে এই মানুষটা আজও একটি পদ দখল করে আছেন ।
.
১৯২৩ এ জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই ইহুদী ব্যক্তিটি সম্পর্কে বেশ কিছু দুর্লোভ তথ্য আমার ডাইরীর তথ্য ভান্ডারে আজ অনেক দিন । যা বিভিন্ন রাজনৈতিক বই ও ফেসবুক (যেমন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল অব. শান্তু রহমান) হতে সংগ্রহিত । যার মধ্যে একটি হল বাংলাদেশ সম্পর্কে তার বিখ্যাত মন্তব্য "তলাবিহীন ঝুড়ি" সম্পর্কিত (যা তিনি আদৈতেই করেননি) এবং ২য়টি হল বাংলাদেশের এক সাংবাদিকের সাথে তার তর্কাতর্কি ও ক্ষমা প্রার্থনার কাহিনী ।
.
.
তলাবিহীন ঝুঁড়ি মন্তব্য -
সেদিন ডিসেম্বরের ৬ তারিখ , ১৯৭১ । এ Washington Special Actions Group (WSAG) এর মিটিং এ যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল ও বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের প্রেক্ষিতে আলোচনা হচ্ছিলো। সে মিটিং এই যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে “আকাল/দূর্ভিক্ষ” পরিস্থিতির বর্ননা/আলোচনা এভাবে হচ্ছিল । যেখানে মিঃ জনসনই বাংলাদেশকে international basket case বলে অবহিত করেন ।
.
"Mr. Johnson: They'll be an international basket case.
Dr. Kissinger: But not necessarily our basket case"
.
সুত্র - ( Document 235 in Volume XI of the Foreign Relations of the United States series for 1969-1976 titled "South Asia Crisis, 1971")
.
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই ভুল কে ‘সত্য’ বলে ইতিহাসে স্থান দেয়া হয়েছে । তবে এখানেও একটু বড় মাপের কিন্তু আছে
.
- Basket Case কি ? অবশ্যই এর বাংলা কিন্তু “তলাবিহীন ঝুড়ি” নয়, অর্থাৎ Bottomless Basket নয়। উত্তর আমেরিকার ইংলিশ ভাষার একটি Phrase হচ্ছে Basket Case । ২য় মহাযুদ্ধের পর এর ব্যবহার শুরু হয়। যে সকল সৈনিক যুদ্ধে অংগহানির পর অনেকটা “Vegetative Stage” জীবন যাপন করছিল । (“Vegetative Stage”: A disorder of consciousness, or impaired consciousness, is a state where consciousness is affected by an injury to the brain)
যাদের সরকারি সাহায্য ছাড়া চলার উপায় ছিলনা। তাদের বলা হত বাস্কেট কেইস। হ্যাঁ, যে কোন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশই বাস্কেট-কেইস হয়ে যায়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন আর কি উদ্দেশ্যে এ দেশের সংবাদপত্র বাস্কেট-কেস কে Bottomless Basket বানালো – সে ইতিহাস হয়তো কখনোই জানা হবে না। হয়তো এটা সাংবাদিকের ভুল হয়তো বা না ।
.
.
সাংবাদিক কর্তৃক অপমানিত হবার ঘটনা-
.
সচরাচর বাংলাদেশী সংবাদিকরা হেনরি কিসিঞ্জারকে নাগাল পান না কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক বাংলাদেশী সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হক জাপানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তার নাগাল পেয়ে যান । এবং চোখের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধীতাকারী সেই দাম্ভিক ও প্রচন্ড ক্ষমতাবান বাক্তিকে দেখে নিজের অজ্ঞাতেই কঠিন সুরে প্রশ্নটি করে ফেলেন
.
-"১৯৭১ সালে আপনি তো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন"
.
সামলে নিলেন তিনি, রাগ চেপে অহেতুক বিনয় করেই দ্রুতার সাথে জবাব দিলেন -
"বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, ভারতীয় অগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পলিসি ছিল, যাতে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে না পড়ে । জেন্টেলম্যান, সত্যটা জানবার চেষ্টা করুন"
.
-"আমাদের ইতিহাস কিন্তু আপনাকে সেভাবেই জানে এবং গণহত্যাকারী পাকিস্তানিদের আমেরিকান সমরাস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে এবং কথাটাও মিথ্যাও নয়"
.
উনি বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রসঙ্গটি এভয়েট করে গেলেন ।
কিন্তু সাংবাদিক সাহেব নাছোড়বান্দ -"এছাড়াও স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারকে আপনি "বটমলেস বাস্কেট "বলেছিলেন"
-"ও ভাবে বলেছি কিনা মনে নেই"
.
.
সেইদিন সাংবাদিক সম্মেলনে নির্ধারিত ২৫ মিনিটের মাঝে ১৫ মিনিটই বাংলাদেশ নিয়ে তার সাথে তর্ক বিতর্ক হয়ে গেলো । সেখানে যাতে তাকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হল যে , আমাদের দেশের মানুষ আজো তাকে ঘৃণার চোখে দেখে । ব্যাপারটা উপলদ্ধি করতে পেরে , লাঞ্চের সময় হেনরী কিসিঞ্জার সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হক কে ডাকেন । উনি কাছাকাছি হতেই ঘাড়ে হাত রেখে ক্লান্ত সুরে বলেন,
-" তোমার দেশবাসীকে জানিও, আমি তাদের বিরুদ্ধে ছিলাম না, আমার কাছে সে সময়ের সব ডকুমেন্ট আছে, আমার জীবিতাবস্থায় তোমাদের সরকারের উচিত তা সংগ্রহ করে সে সময়ের প্রকৃত অবস্থা জানার ।"
.
তার শেষ বাক্যটায় বোধ হয় কিছুটা দুঃখবোধ ছিল । একসময়ের কৃতকর্মের জন্য আফসোস আর অজ্ঞাতেই ক্ষমা প্রার্থনার আর্তিটাও ছিল । কিন্তু সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হকের কাছে তার এই করুণ সুর পাত্তা পায়নি । কারণ মায়ের অপমানকারীকে কেউ কখনো মাপ করতে পারে না । উনি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হেনরি কিসিঞ্জার হতে বিদায় নেন । বিদায়ের সময় ইনসানুল চাইলে আমাদের পক্ষ হতে সরাসরি একটি কথা বলেও আসতে পারতেন
-"স্যার বাংলা ভাষায় কিসিঞ্জার বলে একটি গালি আছে , আপনি সৌভাগ্যবান এই গালির জনক কিন্তু আপনিই"
.
এছাড়াও সত্য কথা বলতে কি, আমরা তাকে মাপ করে দিলেও কি বা না দিলেও কি । এই মানুষটাকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না ইন্দোচীন, বাংলাদেশ, চিলি, সাইপ্রাসএবং পূর্ব তিমুরের ৩০ মিলিয়ন মুক্তিকামী জনতা, বিপ্লবীদেরকে হত্যা অপহরণ অত্যাচারের কলকাটি নাড়াবার জন্য । ইতিহাস তাকে চিরকালই এক পাপিষ্ট খলনায়ক হিসেবে মনে রাখবে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৭