মূল : আনাতোলি কারলিন
ভাষান্তর : শানজিদ অর্ণব
স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ ২০১৫ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু আমি এ লেখিকা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমি এ অজ্ঞতার জন্য বিস্মিত হইনি। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আমার পরিচিত অনেক রাশানও স্ভেতলানা সম্পর্কে অজ্ঞ। আমার পরিচিত রাশানরা যে সাহিত্য সম্পর্কে জানাশোনাহীন তা কিন্তু নয়। একজন পশ্চিমা সাংবাদিকও নিশ্চিত করেছেন যে, স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ নামটি রাশানদের কাছে প্রায় অপরিচিত। স্ভেতলানার ট্র্যাজেডি হচ্ছে তার কিছু বই যখন জনপ্রিয়, বিশেষত ওয়ার'স আনওমেনলি ফেস যখন ২০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে, তখন নিজের মাতৃভূমিতেই তিনি প্রায় অপরিচিত। রাশিয়াস অ্যানসার টু অ্যামাজন ডট কম কিংবা ওজোন আরইউতে তার সম্পর্কে তেমন কোনো মন্তব্য বা ভোট চোখে পড়েনি। তার বেশিরভাগ বই এমনকি তাদের স্টকে নেই। রুশ ভাষায় এর আগে যে পাঁচজন সাহিত্যিক নোবেল পেয়েছেন তারা সবাই এখনও রাশিয়ার ঘরে ঘরে পরিচিত।
স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচকে নিয়ে অনলাইনে যে পরিমাণ কথাবার্তা হয়েছে তার সঙ্গে আমি রুশ ভাষার আরও কয়েকজন বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লেখককে নিয়ে মানুষের কথাবার্তার একটি তুলনা করেছি গুগল ট্রেন্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। আমি ২০০৪ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করেছি যাতে স্ভেতলানার নোবেল জয়ের খবরের পরবর্তী প্রভাব এখানে না উঠে আসে। দিমিত্রি বাইকভ একজন কবি এবং প্রবন্ধকার। ভিক্টর পেলেভিন একজন পোস্টমডার্নিস্ট এবং এ বিষয়ে তার সিরিয়াস কাজ আছে। বরিস আকুনিনের ঐতিহাসিক গোয়েন্দা কাহিনী বেস্টসেলার। এ তিনজনই পুতিনবিরোধী। সার্গেই লুকিয়ানেনকোর শহুরে জীবনের কাহিনী তাকে আধুনিক রাশিয়ার সবচেয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে কোনো মাসেই এ চার লেখকের নাম অনলাইনে স্ভেতলানার চেয়ে কম উচ্চারিত হয়নি। এ চারজনের কেউই হয়তো নোবেলের জন্য অযোগ্য নন। ফলে জনপ্রিয়তার জন্য স্ভেতলানা নোবেল পাননি এটা বলা যায়।
তাহলে কী সুইডিশ নোবেল কমিটির রুশ সাহিত্যের ওপর অগাধ জানাশোনার কারণে স্ভেতলানা নোবেল পেলেন? তিনি কী আবর্জনার মধ্যে থাকা হীরা, যার সন্ধান এখনও কেউ পায়নি?
সৌভাগ্যজনকভাবে ল্যাজি গ্লাসোফিলিয়াক নাম্নী আমার পরিচিত এক ব্লগার প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটু অনুসন্ধান করেছেন, যা অনেক সাংবাদিকই করেননি। দ্য চেরনোবিল প্রেয়ার : ক্রনিকেলস অব দ্য ফিউচার বইটির প্রতি তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ল্যাজি গ্লাসোফিলিয়াক সাহিত্যিক নন; কিন্তু তার দৃষ্টিতেও বইটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর সাহিত্য। বইটিতে তথ্য উপস্থাপনে স্ভেতলানার উদাসীন্য প্রকাশ পেয়েছে। এ বইতে লেখিকা অনেক তথ্য উপস্থাপন করেছেন, যেগুলো হয় প্রমাণিত নয়, নয়তো পরিসংখ্যানগতভাবে মিথ্যা। কিছু আছে ছোট ভুল। যেমন তিনি লিখেছেন, বেলারুশ একটি গ্রামীণ জনপদ; কিন্তু ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ের পর এ কথাটি আর সত্য নয়। কিছু ভুল একেবারে মৌলিক। যেমন তিনি দাবি করেছেন যে, চেরনোবিলের বিকিরণ বেলারুশের ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের বা জনসংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এটি প্রধান তো নয়ই বরং দশম কারণও নয়। বেলারুশ, রাশিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত মৃত্যুহার কম ছিল। (উল্লেখ্য, চেরনোবিল দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে)। মৃত্যুহার কমার কারণ ছিল গর্বাচেভের অ্যালকোহলবিরোধী প্রচারণা। বেলারুশ, রাশিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে অ্যালকোহলের ব্যবহার আবার বৃদ্ধি পায় ১৯৯১ সালের পর অর্থাৎ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পরে। কারণ ছিল অর্থনৈতিক ধস এবং ভদকা উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হারানো।
এ ধরনের ভুল হয়তো একজন মৌলিক সাহিত্যিকের জন্য ক্ষমার যোগ্য; কিন্তু মনে রাখতে হবে স্ভেতলানা একজন নন-ফিকশন লেখিকা। ১৯৫৩ সালে উইনস্টন চার্চিল সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার পর এ প্রথম একজন নন-ফিকশন লেখক সাহিত্যে নোবেল পেলেন। চার্চিল ইতিহাস এবং আত্মজীবনীমূলক কিছু দারুণ কাজ করেছিলেন। আমি চার্চিল পড়িনি; কিন্তু অনুমান করতে পারি যে, তিনি ঐতিহাসিক তথ্যগুলো সঠিকভাবেই উপস্থাপন করেছিলেন।
ল্যাজি গ্লাসোফিলিয়াক চেরনোবিল নিয়ে স্ভেতলানার লেখা সম্পর্কে বিশ্লেষণে লিখেছেন-
"'ভয়াবহ যুদ্ধ এবং বিল্পব ঘটলেও ২০ শতকের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে চেরনোবিল দুর্ঘটনা।' এটা হচ্ছে এ বছরের নোবেল জয়ী স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচের কথা। আমি তার কথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। নোবেল জয়ী এ লেখিকার কথাবার্তা একেবারেই বাগাড়ম্বরপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, 'চোরনোবিল একটি রহস্য যার অনেক কিছু এখনও উন্মোচনের বাকি আছে। এটা এখনও সামধান হয়নি এমন এক রহস্য। সম্ভবত ২১ শতকের জন্য এটা এক রহস্য। এটার সমাধান জরুরি।' তিনি পুরো বিষয়টিতে কোথাও কোনো প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে কথা বলেননি, যা বলেছেন তা স্রেফ ফাঁপা শব্দের বয়ান। তিনি আরও বলেছেন, 'শুধু তথ্যই এখানে শেষ কথা নয়। এখানে সবাইকে তথ্যের পেছনে তাকাতে হবে। বুঝতে হবে আসলে কী ঘটেছে।' ওহ তাই? বইয়ের শুরুতেই তিনি 'তথ্য' সম্পর্কে উদাসীনতা দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন চেরনোবিলের দুর্ঘটনার ভয়াবহতা সবাইকে দিশেহারা করে দিয়েছে, কারণ এ পর্যন্ত মানুষ ভয়াবহতার পরিমাপ করত যুদ্ধের মানদন্ডে। তিনি লিখেছেন, 'আমরা এখন এক নতুন ইতিহাসে, যেখানে মহাবিপর্যয় শুরু হয়েছে।' ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে আসলে তার কোনো ধারণাই নেই। দুনিয়ায় যেন কখনও বন্যা, ভূমিকম্প, হ্যারিকেন, মহামারী দেখা যায়নি। তিনি শুধু অদৃশ্য বিকিরণ নিয়ে লাইনের পর লাইন লিখে গেছেন; কিন্তু মনে রাখা দরকার ভাইরাসও অদৃশ্য এবং তারা আরও ভয়ঙ্কর।
স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ কোনো ব্রডস্কি, পাস্তরনায়েক বা সলঝেনিস্টাইন নন। এরা সোভিয়েতবিরোধী ছিলেন; কিন্তু তারা যা বলেছেন তা যথার্থ। আর তারা সত্যিকার মাস্টারপিস সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন।"
অরেকটা বিষয় হচ্ছে, স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ তার 'দ্য চেরনোবিল প্রেয়ার : ক্রনিকেলস অব দ্য ফিউচার' বইয়ে কতবার শব্দ লোপ বা এলিপস (...) ব্যবহার করেছেন? ৭৮ হাজার শব্দে তিনি ৪১৯৬ বার শব্দ লোপ বা এলিপস (...) ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ প্রায় প্রতি ২০ শব্দে স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ একবার শব্দ লোপ বা এলিপস (...) ব্যবহার করেছেন! এত এলিপস ব্যবহারকে আমি লেখার অসংলগ্নতা এবং দুর্বলতা ঢাকার কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করব।
স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ তার জনপ্রিয়তা বা লেখার স্টাইলের জন্য নোবেল পাননি। পেয়েছেন কোনো মতাদর্শ দিয়ে প্রভাবিত না হয়ে সত্য বলার জন্য। স্ভেতলানার অনুবাদক কেইথ জেসেন বলেছেন, অনেক সময় তার লেখা আবেগ এবং নিরপেক্ষ সাক্ষ্যের দ্বারা আলোড়িত হলেও সেগুলো নির্দিষ্ট কাউকে আক্রমণ বা অ্যাক্টিভিস্ট এজেন্ডা মুক্ত। এ মত প্রতিধ্বনিত হয়েছে নোবেল কমিটির কথায়ও। সাহিত্যে পলিফোনি বা বহুস্বর বা এজেন্ডামুক্তভাবে লেখার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন মিখাইল বাখতিন। বাখতিনের মতে, পলিফোনি হচ্ছে সেই লেখা যেখানে লেখক কোনো মতাদর্শ বা ধারণার অধীন হয়ে লেখেন না। বাখতিনের এ সংজ্ঞার প্রাথমিক একজন লেখক হচ্ছেন দস্তয়ভস্কি। কিন্তু স্ভেতলানার লেখা তো এমনটা নয়। বরং দ্য চেরনোবিল প্রেয়ার : ক্রনিকেলস অব দ্য ফিউচার বইটির শুরুর দিকে তিনি লিখেছেন-
'১ কোটি মানুষের ছোট বেলারুশের জন্য চেরনোবিল ছিল একটি জাতীয় দুর্যোগ। যদিও বেলারুশের নিজের একটি পারমাণবিক প্লান্টও ছিল না। দেশটি এখনও কৃষিনির্ভর, বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ফ্যাসিস্টরা অধিবাসীদেরসহ বেলারুশের ৬১৯টি গ্রাম ধ্বংস করে। আর চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর বেলারুশ ৪৮৫টি গ্রাম এবং তার বসতি হারায়।... যুদ্ধে বেলারুশের প্রতি চারজন নাগরিকের একজন নিহত হয়েছিলেন আর চেরনোবিল বিপর্যয়ের পর প্রতি পাঁচজনের একজন বেলারুশীয় কলুষিত ভূমিতে বাস করে।'
খেয়াল করলে দেখা যাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নাৎসিদের তুলনাহীন নৃশংসতার সঙ্গে সোভিয়েতের বহু ঘটনাকে দুর্বল যুক্তি-তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তুলনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচের সাক্ষাৎকার এবং বক্তব্যের অ্যাক্টিভিস্ট এজেন্ডাই হচ্ছে তার নোবেল জয়ের প্রধান কারণ। বহুস্বরের প্রতিনিধিত্বকারী সাহিত্যের পরিবর্তে স্ভেতলানা আসলে ১৯৭০-১৯৮০ দশকের সোভিয়েতবিরোধী বক্রোক্তিগুলোকেই পুনরুৎপাদন করেছেন।
আমার ভাবতে অবাক লাগে, কেন রাশিয়া এবং বেলারুশের মানুষ স্ভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচের বই কিনতে ছোটে না! কারণ তার সব লেখাতেই তো একটু হলেও পুতিনবিরোধিতা থাকে। তিনি লেখেন, 'রুশ টিভি আপনাকে ভুল বোঝায়। এজন্য তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। ইউরোপ, ইউক্রেন নিয়ে এসব মিডিয়া যা বলে তা সঠিক নয়। সমস্যা হলো রাশিয়ার মানুষ আসলে এসব কথাই শুনতে চায়। তাই মিডিয়া এসব ভুল মতামত প্রচার করে। এখন আমরা দেখি প্রতিটি রাশানের মনেই একজন পুতিন বাস করে। লাল সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়েছে; কিন্তু তার মানুষেরা রয়ে গেছে।' স্ভেতলানার জন্ম ইউক্রেনে, তিনি বেলারুশের নাগরিক এবং লেখেন রুশ ভাষায়। তার লেখা রাজনৈতিক এজেন্ডায় পূর্ণ। রাশান দুনিয়ায় পশ্চিমা মত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি এক আদর্শ অস্ত্র। বেলারুশে স্ভেতলানার নোবেলপ্রাপ্তির ঘোষণা আসার কিছুদিন পরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এখন গায়ে নোবেল পদক ঝুলিয়ে সাবেক এই দ্বিতীয় শ্রেণীর সাংবাদিক নিরপেক্ষতার চাদর গায়ে দিয়ে তার এজেন্ডা নিয়ে প্রচার চালাতে পারবেন।
নোবেল নিয়ে আসলে কিছু করার নেই। কারণ রাশিয়া কিংবা অন্য কোনো পশ্চিমা শক্তি নোবেলের কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প তৈরি করতে পারেনি। এটা নিশ্চিত যে, শান্তির পাশাপাশি সাহিত্যেও নোবেল পশ্চিমা রাজনৈতিক প্রভাবের অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:০৪