ক্যাথারইজম (Catharism)
....এ সময় এক ক্রুসেডার সেনা পোপের দূতকে প্রশ্ন করেন কী করে তারা ক্যাথার আর অন্যদের পৃথক করবে? পোপের দূত তখন যে উত্তরটি দিয়েছিলেন সেটা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। পোপের দূতের উত্তর ছিল ,“সবাইকে হত্যা কর, ঈশ্বর তাঁর প্রিয়জনকে খুঁজে নেবেন।”(kill them all, God will find his own)| । এ হত্যাকান্ডকে আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসের প্রথম গণহত্যা বলে অভিহিত করা হয়। শুধু ব্যাজিয়েস শহরেই প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়।...১২ শতক নাগাদ ইউরোপের বিভিন্ন অংশে, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে খ্রিস্টধর্মের শুদ্ধিকরণ এবং সংস্কারের আওয়াজ ওঠে। এসব ধর্মীয় আন্দোলনের মধ্যে সব থেকে স্মরণীয় হয়ে আছে ক্যাথরাইজম। ক্যাথার শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ক্যাথারোস থেকে। ক্যাথারোস অর্থ বিশুদ্ধ বা শোধিত। ক্যাথাররা ক্যাথলিক চার্চের মতকে, প্রচলিত মতবাদকে বিরোধিতা করেছিলেন।....সে সময়ে অর্থাৎ ১৩ শতকের শুরুর দিকে ল্যাঙ্গুয়েডক আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের অংশ ছিল না। এ অঞ্চল শাসন করত কিছু অভিজাত পরিবার, যাদের প্রধান ছিলেন কাউন্ট অব তুলুজ। পুরো দুনিয়ায় সে সময়ে বাইজানটিয়ামের বাইরে এই ল্যাঙ্গুয়েডক ছিল খ্রিস্টান সমাজের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং উন্নত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। জ্ঞান চর্চা দারুণভাবে বিকশিত হয়েছিল। দর্শন, কবিতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অন্যান্য কর্মকন্ডের স্ফুরণ ঘটে। গ্রিক, আরবি এবং হিব্রু ভাষার চর্চা হয়। আর এ সময় উত্তর ইউরোপের অভিজাতরা কেবল নিজেদের নাম স্বাক্ষর করতে পারতেন। ইউরোপের অন্যান্য অংশ যখন ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন, তখন এ এলাকায় সভ্য ধর্মীয় সহনশীলতা বজায় ছিল। সামুদ্রিক বাণিজ্যের কেন্দ্র, যেমন মার্সেই বন্দরের মাধ্যমে এখানে আসে ইসলামি ও ইহুদি সভ্যতার নানা চিন্তা। বিপরীতভাবে এ সময়ে রোমান চার্চ ছিল অনেকটা অজনপ্রিয়। ল্যাঙ্গুয়েডকের রোমান চার্চের পাদ্রিরা দুর্নীতিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডের অভিযোগে জনবিছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনও অনেক চার্চ ছিল, যেখানে প্রায় ৩০ বছর ধরে সাধারণ মানুষের কোনো জমায়েত হয়নি। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতেই চার্চের দুর্নীতি আর নেতিবাচকতার প্রতিক্রিয়ায় এ অঞ্চলের বিকশিত জ্ঞানচর্চার জমিতে আত্মশুদ্ধির প্রেরণা থেকে জন্ম নেয় খ্রিস্টিয় হেরেসি বা খ্রিস্টিয় ধর্ম থেকে উদ্ভূত ভিন্নমত ক্যাথরাইজম।....বলা হয়- শয়তান আর ঈশ্বরের মাঝখানে, ক্যাথলিক চার্চের উন্মত্ততা আর ধর্মীয় স্বাধীনতার মাঝখানে রয়ে গেছে ক্যাথাররা....
মৃত সাগরের এসেনাসদের ধর্ম (Religion of Essenes of Dead Sea)
...সাধারণভাবে সেকেন্ড টেম্পল জুডাইজম বলতে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ অব্দ থেকে ৭০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে বিবেচনা করা হয়।
সেকেন্ড টেম্পল যুগে ইহুদিদের অনেক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় গড়ে ওঠে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তিনটি- ফারিসিজ, সাডুসিজ এবং এসেনাস।...ডেড সী’র স্ক্রল কুমারন স্ক্রল নামেও পরিচিত। কারণ, এ পান্ডুলিপির স্রষ্টা ছিলেন এসেনাসরা এবং এই এসেনাসরা বাস করতেন খিরবেত কুমারনে। তবে এসেনাসরা কুমারনেই বাস করতেন কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। তবে কুমারন-এসেনাস মতটিই এখনও সর্বজনগ্রাহ্য। জেরিকো শহরের আট মাইল দক্ষিণে ডেড সীর (মৃত সাগরের) পশ্চিম তীরে পাহাড়ের গুহায় এসেনাসরা নিজেদের পান্ডুলিপিগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন। তারপর কেটে গেছে ২ হাজার বছর। অবশেষে ১৯৪৭ সালে দুজন আরব মেষপালক জুডিয়া মরুভূমির গুহা থেকে এ পান্ডুলিপিগুলো আবিষ্কার করেন। গবেষকরা মনে করেন, এ পান্ডুলিপিগুলো খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে প্রথম খ্রিস্টীয় শতক সময়কালে লেখা হয়েছিল।...এসেনাসদের বিশ্বাসমতে, ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের ‘নতুন চুক্তি’ অনুসারে কেবল তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যরাই হচ্ছেন ঈশ্বরের নির্বাচিত মানুষ। আর নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যকেও আলাদাভাবে নির্বাচিত করা হতো। অর্থাৎ একজন সাধারণ ইহুদির সন্তান জন্মসূত্রে এবং খৎনা করার মাধ্যমে একজন নির্বাচিত ইহুদি হতে পারেন, কিন্তু এসেনাসদের বিষয়টি তেমন নয়। নিজেদের সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া সন্তানকেও তার গুণ এবং ধর্মনিষ্ঠা দ্বারা নির্বাচিত সদস্য হতে হতো। এসেনাসদের নির্দিষ্ট ধর্মীয় স্কুলে পড়াশোনার পর কারও বয়স বিশ বছর পূর্ণ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ব্রত গ্রহণের মাধ্যমে সম্প্রদায়ের চুক্তিতে প্রবেশ করতে হতো। এসেনাসদের বিশ্বাসমতে, ঈশ্বরের নির্বাচিত মানুষদের পথ দেখায় সত্য এবং আলোর আত্মা। আর সাধারণরা অন্ধকারের পথে হারিয়ে যায়। এসেনাসদের সম্প্রদায়ের আইনবিষয়ক স্ক্রলে এ বিষয়ে পরিষ্কার উল্লেখ আছে- The Master shall instruct all the sons of light and shall teach them the nature of all the children of men according to the kind of spirit which they possess...
From the God of knowledge comes all that is and shall be, before ever they existed He established their whole design, and when, as ordained for them, they come into being, it is in accord with His glorious design that they accomplish their task without change...
He has created man to govern the world, and has appointed for him two spirits in which to walk until the time of His visitation : the spirits of truth and injustice spring from a source of darkness. All the children of righteousness are ruled by the Prince of Light and walk in the ways of light, but all the children of injustice are ruled by the Angel of Darkness leads all the children of righteousness astray, and until his end, all their sins, iniquities, wickedness, and all their unlawful deeds are caused by his dominion in accordance with the mysteries of God...
But the God of Israel and His Angel of truth will succour all the sons of light. For it is He who created the spirits of Light and Darkness and founded every action upon them and established every deed [upon] their [ways]. And He loves the one everlastingly and delights in its works for ever; but the counsel of the other He loathes and for ever hates its ways.
এসেনাসদের খুব অদ্ভুত একটি বিশ্বাস ছিল এই আলো-অন্ধকারের আত্মা নিয়ে। কোন মানুষের মধ্যে কোন ধরনের আত্মা রয়েছে তা তারা মানুষটির শারীরিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে নির্ধারণ করতেন। খারাপ আত্মার মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এসেনাসদের স্ক্রলে উল্লেখ আছে- ...and his thighs are long and lean, and his toes are thin and long. He is of the second Column. His spirit consists of six (parts) in the House of Light and three in the Pit of Darkness. And this is his birthday on which he (is to be/was?) born : in the foot of the Bull. He will be meek. And his animal is the bull
... and his head... [and his cheeks are] fat. His teeth are of uneven length (?). His fingers are thick, and his thighs are thick and very hairy, each one. His toes are thick and short. His spirit consists of eight (parts) in the House of Darkness and one from the House of Light...
প্রাচীন মিশরের ধর্ম
....চতুর্থ আমেনহোটেপ চার বছর শাসন করার পর আমানের পরিবর্তে আটেনকে মিশরের প্রধান দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং নতুন এক ধর্মীয় ব্যাখ্যা হাজির করেন। এটি ছিল মিশরের ধর্মীয় ইতিহাসের এক যুগ-সন্ধিক্ষণ। একে অনেকে ধর্মীয় বিপ্লব বা বিবর্তন বলে অভিহিত করেন। স্যার ফ্লাইন্ডার্স পেট্রির মতে, এর চেয়ে মহান কোনো ধর্মনীতি পৃথিবীতে ইতিপূর্বে কখনো উদ্ভূত হয়নি এবং এই ধর্ম পরবর্তী সকল একেশ্বরবাদী ধর্মের অগ্রদূত। আটেন ছিলেন একজন সামান্য দেবতা, সূর্যের চাকতি বা থালা ছিল তার প্রতীক। চতুর্থ আমেনহোটেপ-এর দাদা চতুর্থ থুতমোসের আমলে পৃথক সূর্য দেবতা হিসেবে একটু একটু করে গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল আটেনের। তৃতীয় আমেনহোটেপের আমলে আটেনের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। তবে তিনি আটেনকে, ‘আমান-রা’-এর চেয়ে বেশি ক্ষমতা এবং গুরুত্ব দয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু তার পুত্র চতুর্থ আমেনহোটেপ আটেনকে মিশরের সবচেয়ে ক্ষমতাবান দেবতার আসনে বসান। চতুর্থ আমেনহোটেপ ২২ বছর বয়সে যে ধর্মমত প্রচার করেন তা ছিল প্রাচীন দুনিয়ার সবচেয়ে আলোকপ্রাপ্ত ধর্মতত্ত¡।.... এই তরুণ ফেরো হয়তো পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ঈশ্বরকে কোনো আকারহীন অস্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করেন। ....আমেনহোটেপ সৃষ্টিকর্তা দেবতার আরাধনায় বাহুল্য পরিত্যাগ করার কথা বলেন। দেবতার মূর্তি নির্মাণও তিনি নিষেধ করেন । কারণ তার মতে, ঈশ্বরের কোনো আকার নেই। ইতিহাসে নিরাকার ঈশ্বরের কল্পনা সম্ভবত এটাই প্রথম।...একেশ্বরবাদের ধারণা ছিল আটেনিজমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈপ্লবিক চিন্তা। ইতিপূর্বে আমানের ক্ষেত্রে একেশ্বরবাদী চিন্তা দানা বাঁধলেও সেখানে আরও অনেক দেবতার অস্তিত্ব ছিল। এ ধরনের বিশ্বাসকে বলা হয় হেনোথেইজম। কিন্তু আটেনের ক্ষেত্রে এই হেনোথেইজম রূপান্তরিত হয় একেশ্বরবাদ বা মনোথেইজমে। আটেনিজমে পবিত্র প্রাণী, দেবতার মূর্তির মতো বিষয়গুলো রহিত করা হয়। ঈশ্বর আটেনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠেন রাজা। একে অনেকটা আব্রাহামিক ধর্মগুলোর ঈশ্বর প্রেরিত মহামানবদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আখেনাটেন প্রথমদিকে আটেনের সঙ্গে রা, শু, হারাখটে নামের দেবতাদেরও পূজা চালু করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি আটেন বাদে আর সব দেবতাকে সরিয়ে দেন। আখেনাটেন সমাধিস্তম্ভ সংক্রান্ত দেবতাদেরও অগ্রাহ্য করেন। এটা ছিল সেদিনের মিশরের জন্য এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। আখেনাটেনের এই বৈপ্লবিক ধর্মীয় চিন্তা অবশ্য খুব বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। আখেনাটেনের মৃত্যুর পরে তার এই একেশ্বরবাদী ধর্মচর্চা বিলুপ্ত হয়। আখেনাটেনের কোনো পুত্র ছিল না যে তার পিতার ধর্ম চিন্তাকে বজায় রাখতে পারত। অন্যদিকে আখেনাটেনের একেশ্বরবাদী ধর্ম রাজ পরিবার এবং সমাজের ক্ষমতাশালীদের যেভাবে আকৃষ্ট করেছিল তা সাধারণ মানুষকে করতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তাদের হাজার বছরের বহু দেবতার উপাসনারই মানসিকতা ধারণ করতেন। আখেনাটেনের মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে হেরেসি (heresy) বা বৈধর্ম্যরে অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন স্থাপনা থেকে তার নাম মুছে ফেলা হয়। থীবিস এবং আমারানায় তার স্থাপিত ভবন ধ্বংস করে ফেলা হয়। ....
সূত্র: (ধর্মকোষ : পৃথিবীর ধর্মসমূহের ইতিবৃত্ত)
পৃথিবীর ধর্মসমূহের বিবরণ নিয়ে এ বই- ধর্মকোষ : পৃথিবীর ধর্মসমূহের ইতিবৃত্ত। বেশ কয়েক বছরের অনুসন্ধান, অধ্যয়নের ফসল এই বই। পৃথিবীর প্রধান ধর্মসমূহের পাশাপাশি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ধর্ম, আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশের স্থানীয় ধর্ম, ভারতীয় ধর্ম, বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা অনেক ধর্মের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে এ বইয়ে। দুনিয়ার বহু বিশিষ্ট ধর্ম বিশারদ এবং ইতিহাসবিদের বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তথ্যের উৎসের মান সম্পর্কে ধারণা পেতে বইয়ের শেষে 'গ্রন্থপঞ্জী'তে একবার চোখ বোলালেই হবে।
ধর্মকোষ : পৃথিবীর ধর্মসমূহের ইতিবৃত্ত
শানজিদ অর্ণব
প্রকাশক : দিব্যপ্রকাশ
বইমেলায় স্টল নং-২৫৯, ২৬০,২৬১
মূল্য : ৪১০ টাকা (গায়ের দাম-৫৫০ টাকা)