রিপোর্টিং টাইম এর মাত্র ৫ মিনিট বাকি , এই সময় এমন একটা রিকোয়েস্ট করা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতে জাম্পিং ইন্সট্রাকটর লার্কম্যান কে খুজে বের করলাম । ব্রিটিশ সিটিজেন যেহেতু ক্রিকেট এর সাথে পরিচয় থাকবে ধরে নিয়ে তার কাছে গেলাম । গিয়ে বললাম, তুমি হয়ত জান বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা চলছে , আজকে আমার দেশের খেলা আছে, আমি চাচ্ছি দেশের ফ্লাগের সাথে মিল রেখে একটা টিশার্ট পরে জাম্প দিতে, এখন কি ড্রেস চেঞ্জ করা যাবে কস্ট করে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লার্কম্যান রাজি হয়ে গেল, বলল জলদি চলো। আবারও একই রকম যত্ন করে সে প্রস্তুতি সম্পন্ন করল, সব কিছু ভালভাবে চেক করে নিল , আমার শার্ট বদলের পর । এর পরপরই এলার্ম বাজল, আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম প্লেনে উঠার জন্য ।
স্কাইডাইভ পরিকল্পনার শুরু থেকে যারা আমার সাথে ছিল, ঘটনার দিন সকাল থেকে আমাকে আকাশে তুলে একে একে সবাই কেটে পরল । কি আর করা- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে গুনগুন করতে করতে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম । জানিয়া বুঝিয়া সজ্ঞানে আমি ঝাপ দিতে চলিলাম, অন্যথা হইলে কারো কোন দায় নাই লিখা ডিজিটাল ফর্ম এ ডিজিটাল সাইন করে শুরু হল অপেক্ষার পালা । বিগত একমাস ধরে নানাজনের ঝাপ দেয়ার কাহিনি পড়ে পড়ে এখন সে মহেন্দ্রক্ষনের অপেক্ষা । ওয়েটিং ডেকে বসে বসে কফি খেতে খেতে লোকজনের আকাশ থেকে নেমে আসা দেখতে লাগলাম। শুরুতে যারা সলো জাম্প দিচ্ছে তারা একে একে নেমে আসছে, দেখে ভাবছি একদিন ইনশাআল্লাহ আমিও একা একা লাফ দিব
হাতে থাকা এলার্ম বেজে উঠার পর চলে এলাম সমাবেশ স্থলে আমার নাম লেখা বোর্ডের পাশে । লার্কম্যান এসে পরিচিত হল। জানাল এটা তার ৭০০০ তম জাম্প হবে । আমার প্রথম জাম্প শুনে বলল ভয় পাবার কিছু নেই, আমি যখন যা বলব শুধু সেটা ফলো করবা । তারে কেমনে বলি, জাম্প তো দিবা আমারে নিয়া তুমি, টেনশন করলে তুমি করো, আমার অত ভেবে কাজ নেই । কথার মাঝে ইভান এসে হাজির হলো , সে ও আমাদের সাথে যাবে ক্যামেরা নিয়ে । কিছু ছবি তুলল, ভিডিও করলো। আবার অপেক্ষার পালা ।
প্লেনে উঠে বসলাম, লাফ দেয়ার ৪ জন, ইন্সট্রাকটর ৪ জন, ক্যামেরাম্যান ৪ জন । ভয় না লাগলেও কেমন জানি একটা ফিলিং হচ্ছিল যে ব্যাপারটা আসলে কি , কি করতে যাচ্ছি, কেমন হবে । এমনকি ভিডিও কিংবা ছবি ঠিকমত উঠবে কিনা সেটাও ভাবছিলাম, টাকাত আর কম দেই নাই !!! ২০ মিনিটের মত উড়ান শেষে প্লেন প্রায় ১৩০০০ ফিট উচ্চতায় চলে আসল । ডাইভাররা পুরোটা সময় হই হুল্লোড় আড্ডা দিয়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেছিল যে এটা কোন ব্যাপারইনা । এমন সময় গ্রীন লাইট জ্বলে উঠল আর দরজা খুলে গেল । বিপুল পরিমান ঠান্ডা বাতাস একসাথে প্লেনে ঢুকে পড়ায় কেমন জানি লাগছিল । সবাই প্রস্তুত ।
মজার ব্যাপার হলো, লাফ দেয়ার আগে ওরা একজন আরেকজনের সাথে এমন ভাবে উইশ আর বিদায় দিচ্ছিল মনে হবে এটাই বুঝি জীবনের শেষ জাম্প। সবার শেষে আমি ।
লার্কম্যান সব ফাইনাল চেক করে নিল, ইভান আর আমার সাথে হাই ফাইভ করল । ইভান আগে আর আমরা তার পরে । ভেতরে বরফশীতল বাতাস । প্লেনের দরজায় আসতে প্রচন্ড বাতাসে মুখ কুচকে যাবার যোগাড়, লার্কম্যান এর হেলমেট থাকলেও গেস্ট কে সেটা দেয়া হয়না , আমি জানতে চেয়েছিলাম দিলে সমস্যা কি । রিসেপশনের মেয়েটা বলেছিল, তাহলেত তুমি পুরো মজা পাবেনা । প্রচন্ড হীমশীতল বাতাসের অনুভূতি কেমন সেটা টের পাবা !
ইভান লাফ দেয়ার ১ সেকেন্ড পর লার্কম্যান লাফ দিল। প্রথমে সে একটা ডামি লাফ দেয়ার ভান করায়, আমার ভয়টা শুরুতেই কেটে গিয়েছিল । শুরু হল ফ্রী ফল, তীব্র বাতাস আর ঠান্ডা ।
১ম সেকেন্ড নিচে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠেছিল, এ আমি কি করলাম টাইপ ভাবনা । নিচে আরব সাগরের নীল জল দেখা যাচ্ছে কেবল, সত্যিবলতে পরক্ষনেই ভয় কেটে গিয়েছিল, ইন্সট্রাকশন ফলো করতে গিয়ে । নিচে ইভান কে দেখে মনে হল, এতগুলা টাকা দিয়া লাফ দিচ্ছি ছবি ভাল না হলেত হবেনা
লার্কম্যান তার কসরত দেখিয়ে যাচ্ছে ফ্রী ফল এর সময় ১২০ মাইল বেগে নামার সময়, ঘুরে, চিত কাত হয়ে নানা ভংগিতে আর ইভান আমাদের চারপাশে ঘুরে চলেছে তার বিল্টইন ক্যামেরা সহ হেলমেট নিয়ে । এইসময় আসলে ভয় পাওয়া কিংবা ভাবনার তেমন অবকাশ নেই। এত দূরন্ত গতিতে ফ্রী ফল হয় যে মন মস্তিস্ক সব কিছু সেটাতেই নিমগ্ন হয় । এই অনুভূতি আসলে লিখে বোঝানো যাবেনা । যেকোন ঝড় ই এক সময় থামবে, এই স্বতঃসিদ্ধ নিয়মে ফ্রী ফল ঝড়ও থামল মিনিট খানেক পর, যখন লার্কম্যান প্যারাসুট খুলে দিল, এক ঝটকায় আমরা আবার অনেক উপরে উঠে গেলাম , এই সময় প্রচন্ড একটা ঝাকি খাওয়ার অনুভূতি হয়, চমকে না উঠে উপায় নেই তখন। ইভান ও যেন কই হারিয়ে গেল। প্যারাসুট থিতু হবার পর ব্যাপারটা এত নরমাল লাগবে যে বলার বাইরে, নিজেকে পাখির মতন মনে হবে । মোটিভেশনাল স্পিকার এর মতন বলা যায়, ঝুলে থাকুন, লেগে থাকুন, ধৈর্য ধরুন, জীবনের যে কোন ঝড় ই এক সময় থেমে যাবে, তারপর সব কিছু শান্ত সুন্দর
পুরো দুবাই এর স্কাইলাইন চোখের সামনে চলে আসে । সাগর পাড় থেকে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি , অসাধারন ভিউ । উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানো, এক্সাইটমেন্ট বাড়ানোর জন্য লার্কম্যান প্যারাসুট নিয়ে যে ডিগবাজি টা দিয়েছিল সেটা জাস্ট ওয়াও । আস্তে আস্তে পুরো পাম জুমেইরা চোখের সামনে চলে আসল। এটার পাশ দিয়ে আমরা উড়ে চলেছি, দূরে দেখা যায় ওয়াল্ড আইল্যান্ড । নিচের বাড়ি ঘর গাড়ি সবই ক্লিয়ার হতে থাকে নিচে নামতে নামতে । লার্কম্যান জানতে চাইল কেমন লাগছে, এই কাজ আবার করব কিনা । তাকে বললাম অবশ্যই, ইনশাআল্লাহ বউ বাচ্চা সহ এই কাজ আবার করতে হবে, এই এক্সাইটমেন্ট তারা সহ করলে ব্যাপারটা অসাধারন হবে !
“What is the craziest thing you have ever done?”
এই প্রশ্নের উত্তরে এখন থেকে বলা যাবে, প্রথমটা হচ্ছে বিবাহ করা !!!! কেন যে আমি বিয়ে করলাম এই কথা ভাবেনা এমন পুরুষ কিংবা মহিলা নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবেনা
দ্বিতীয়ত, একটা ভাল সচল প্লেন থেকে আরেকজনের উপর ভর করে লাফ দেয়া ।
------------------------------------------------------------------------
১৮ বছর ধরে কানেক্টেড থাকা আসলেই একটা বিশাল কিছু ! সবাইকে শুভেচ্ছা, পথ চলা হউক নিরন্তর ! শুভকামনা । ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ২:১৭