বিবাহিত পুরুষের বেশীরভাগই বেশীরভাগ সময় বন্ধু বেঈমান । ব্যাচেলর লাইফে যারা ছিল ব্যাকপেকার এখন তারা নিজের ব্যাগটাও গোছাতে পারেনা, ফলস্বরুপ পরিকল্পনা করলেও ট্যুর খালি পেছাতে থাকে। গতবছরের পরিকল্পনা ছিল যাব সেটাত হয়ই নাই, এইবছরও সিজন প্রায়ই শেষ । যে করেই হউক এবার যাব। শুরুতে দশ বার জনকে জানানোর পর মোটামুটি দেখা যাচ্ছে সবাই রাজি । মনে মনে ভাবছি দারুন একটা ট্যুর হবে, এতগুলা বন্ধু একসাথে যাচ্ছি । সময়মত ব্যাগ গোছাতে না পারায় যাবার দিন বার জনের দল হয়ে গেল অর্ধেক !!! লক্ষ্য পেয়ারার ভাসমান বাজার আর বাগান ঘুরে দেখা ।
যারা থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেট দেখে ভাবেন ইশ নদী মাতৃক বাংলাদেশে কেন এমনটি নেই। তারা অনেকেই হয়ত জানেন না বর্যায় বাংলাদেশেও এমন একটি মার্কেট বসে যেটি রুপে গুনে পুরোপুরি প্রাকৃতিক। পিরোজপুর জেলার স্বরুপ কাঠি উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা বাজার । পেয়ারার জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চল। কয়েক মাইল এলাকা জুড়ে এখানে পেয়ারা চাষ হয়, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় বলে দুপাশের মাটি তুলে মোটা আইল বানানো হয় যেখানে পেয়ারা গাছ লাগানো হয়েছে । যার ফলে পেয়ারা গাছের সাড়ির দুপাশে তৈরি হয়েছে নালার মত যেটাতে ডিঙ্গী নৌকা চলে। বর্যা হচ্ছে পেয়ারার মৌসুম। নৌকা করে গিয়ে পাকা পেয়ারা সংগ্রহ করা হয় ।
আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নেই হয় পেয়ারার মূল বিকিকিনি। বাগান মালিকরা নৌকায় করে পেয়ারা নিয়ে আসেন । ভীমরুলি, আটঘর আর কুড়িয়ানা - তিনটি স্হানে বসে ভাসমান পেয়ারার বাজার। পাইকারি ক্রেতারা বড় ইঞ্জিন বোট নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে পেয়ারা কিনেন। নৌকা হিসেবে কিংবা মন হিসেবে চলে বেঁচাকেনা। এই হাটগুলো ভ্রমনের সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে পেয়ারার ভরা মৌসুম জুলাই থেকে আগষ্টের শুরু পর্যন্ত । পেয়ারার পাশাপাশি এই এলাকা আমড়ার জন্যও বিখ্যাত ।
স্বরুপকাঠির কুড়িয়ানা যাবার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় আছে। যারা জলপথে যেতে সাহস পাননা তারা গাবতলী থেকে সাকুরা পরিবহনের বাসে করে পিরোজপুর হয়ে যেতে পারেন। তবে যাত্রা পথের মজা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে লঞ্চে । সদরঘাট থেকে হুলারহাটের লঞ্চ ছাড়ে, আপনাকে নেমে যেতে হবে বানারিপাড়ায়। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এটাতেই যাবার। কিন্তু সবার আগে সদরঘাট পৌঁছে বন্ধু বেনজীর এই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিল। বরিশালগামী লঞ্চের পাশে এইগুলাকে ছোট মনে হওয়ায় সে বরিশালগামী লঞ্চের কেবিনের টিকেট কেটে ফেললো । একে একে আমরা সবাই চেপে বসলাম এম ভি টিপু-৭ এ।
সদরঘাটের কালো পানি পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি, সাথে ডেকে বসে তুমুল আড্ডা , মনে হতেই পারে কেবিন নেয়ার কি দরকার ছিল। ওরে নীল দরিয়া- গানটা গাওয়া শুরু করলে বন্ধু জামিলকে বললাম দোস্ত লঞ্চের ক্যাপ্টেন মাইর দিতে পারে, নিশ্চিত জীবনে সে কোনদিন নীল দরিয়া দেখে নাই, ঘোলা পানি ছাড়া !! এর মাঝে কেবিন বয় এসে জানতে চাইল আমরা কি খাব, তাকে বললাম কি খাওয়াইতে পারবা। সে পাল্টা বলে কি খাইতে চান- রূপচাঁদা, আইড়, কোরাল, বাইলা, চিংড়ী,মুরগী । । আইড় মাছের অর্ডার দিয়ে বললাম সবার শেষে আমাদেরকে খাওয়া দিবা ।
জলপথে ভ্রমনের সবচেয়ে বড়মজা হচ্ছে টেরই পাওয়া যায়না যে আমরা ছুটে চলেছি , তুমুল আড্ডায় দেশ জাতি ভবিষ্যত নিয়ে নানা ভাবনা তো আছেই । এর আগে দুবার বরিশাল গিয়েছি, লঞ্চ পৌঁছেছিল সকাল ছয়টার দিকে, আমাদের কেবিন বয় জানাল ৪টায় পৌঁছে যাবে !!! ঘটনা আসলেই সত্য । ২০ মিনিট দেরী হয়েছিল কারন মাঝপথে চরমোনাই পীরের বাড়ির ঘাটে অনির্ধারিত যাত্রা বিরতী, পীর সাহেবের বাড়ীর জন্য ঢাকা থেকে থাইএলুমিনিয়াম নেয়া হইছে, সেটা নামাতে হবে । ।
চারটা বিশে লঞ্চ বরিশাল ঘাটে, আমরা তখন ঘুমাতে গেলাম, একটু ঘুমিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ও নেই, এই মাঝ রাতে কোথাও যাবার উপায় নেই । সাতটার দিকে ধীরে সুস্হে লঞ্চ থেকে নেমে আমরা একটা অটো ভাড়া করলাম বানারিপাড়া যাবার জন্য । পথে ভরপেট নাস্তা সেরে বরিশাল শহর পাড়ি দিয়ে আমরা চলে আসলাম কুড়িয়ানা বাজার। আমাদের অটো চালক অতিবুদ্ধীমানের পরিচয় দিয়ে বানারিপাড়া না নিয়ে সোজা আমাদেরকে গন্তব্যস্হলেই পৌঁছে দিল। পরিকল্পনা ছিল আমরা বানারিপাড়া যাব, সেখান থেকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে ঘুরে বেড়াব।
কুড়িয়ানা বাজার, আটঘর আর ভীমরুলি বাজারে বসে পেয়ারার হাট। চাষীরা বাগান থেকে পেয়ারা সরাসরি ছোট ছোট নৌকায় করে এসব হাঁটে নিয়ে আসে, পাইকাররা এখান থেকে সংগ্রহ করে পৌঁছে দেয় সারা বাংলাদেশে। বানারিপাড়া না গিয়ে কুড়িয়ানা পৌঁছার ফলে আমরা নৌকার সংকটে পড়ে গেলাম, সেখানে বড় কোন নৌকা পাওয়া যাচ্ছেনা যেটা দিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াতে পারি। এদিক ওদিক ঘুরে পরে এক নৌকা মালিক কে পাওয়া গেল যার নৌকা আসলে মালামাল বহনের জন্য ব্যবহার করা হয়। তাকে রাজি করিয়ে আমরা সেটা নিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম।
বাজার বসতে বসতে মোটামুটি দশটা বেজে যায়। আমাদের হাতে আরো এক ঘন্টা সময় আছে। আমরা শুরুতে বাগান ঘুরে দেখার জন্য আগালাম। ছোট খালের মাঝ দিয়ে নৌকা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, দুপাশে পেয়ারার বাগান। সিজন প্রায় শেষ বলে পেয়ারার রমরমা উপস্হিতি নেই, শেষ সময়ের ফলন কালেকশন হচ্ছে । ছোট ছোট নৌকা করে চাষীরা পেয়ারা বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করেন। দুইসারি গাছের মাঝখানে ছোট একটা নৌকা চলতে পারে এমন নালা বানানো আছে। পেয়ারা গাছের ফাঁকে ফাঁকে আছে আমড়ার গাছও, বরিশালার আমড়াও কিন্তু দেশ বিখ্যাত ।
আমরা যখন ঘুরছি তখন চাষীরা আস্তে আস্তে তাদের ছোট নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বাজারের দিকে। পথে নৌকা থামিয়ে একজন থেকে আমরা কিছু পেয়ারাও কিনে নিলাম, নৌকায় বসে চলল পেয়ার ভক্ষন। এখানে পেয়ারার বকিকিনি হয় নৌকা হিসেবে কিংবা মণ হিসেবে । বহন করার কস্টের কথা চিন্তা করে আমরা পেয়ারা কেনার পরিকল্পনা শুরুতেই বাদ দিয়ে দিয়েছি........। ঘুরে ঘুরে আমরা পৌঁছালাম ভীমরুলি বাজার । এটাই পেয়ারার সবচেয়ে বড় হাট। এই বাজারের পাশেই রয়েছে শতবর্ষী ভীমরুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে থেকে নৌকা নিয়ে আমরা চলে এলাম আটঘর।
আটঘর বাজারে পেয়ারার পাশাপশি নৌকা বিক্রীর হাট ও বসে ।সেখান থেকে কুড়িয়ানা । কুড়িয়ানা বাজারে তখন পেয়ারা ভর্তি নৌকার আগমন শুরু হয়েছে, ঘাটে চলছে বেচাকেনাও ।মোটামুটি এই হচ্ছে আমাদের পেয়ারা বাগান দেখার মিশন। সবুজ বাগানের মাঝখান দিয়ে নৌকা করে ঘুড়ে বেড়ানোটাই রোমাঞ্চকর ।
বেলা তখন একটা, কি করা যায় এই নিয়ে ভাবাভাবির এক পর্যায়ে ঠিক হল সবাই মিলে দূর্গা সাগরে view this link গিয়ে গোসল করব। কিছুক্ষন ডুবাডুবির পর আমরা ঠিক করলাম রাতে লঞ্চে ফেরার বদলে এখনি ফিরে গেলে মন্দ হয়না বরং রাতের ঘুমটা তাহলে বাসায় গিয়েই দেয়া যাবে। বাঁধ সাধল বিআরটিসির এসি বাস, তাদের বাস নস্ট হওয়ায় আজকে আর কোন ট্রিপ নেই। অগত্যা উপায় না পেয়ে একটা মাইক্রোবাসে উঠে পড়লাম, যার ড্রাইভার মোটামুটি চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোতেই বেশী অভ্যস্ত মনে হল । মাওয়া কেওরাকান্দি ঘাটে এসে ফেরীত যাব না লঞ্ছে যাব এই ভাবনা বাদ ডিয়ে একজন প্রস্তাবদিল স্পীড বোটে করে ২৫ মিনিটে পাড় হয়ে গেলে বরং সময় বাঁচবে। হালকা ভয়ে ভয়ে উঠে পড়লাম স্পীড বোটে, কপাল ভাল উত্তাল পদ্মার মুখোমুখি হতে হয়নি আমাদের। শান্ত জলরাশির পদ্মা পাড় হয়ে এপাড়ে আসতেই ইলিশ মাছের হাকডাক শুনে দুপুরে যে খাওয়া হয়নি সেকথা মনে পড়ে গেল। মামা ইলিশ ভাজতে থাকেন, সাথে ডাল ভাত................