বোরো ধানের মওশুম শেষ হওয়ার পথে। বেশির ভাগ জমির ধান কাটা ও মাড়াই প্রায় শেষ। মাঠের সোনালী ধান কাটার পর কৃষকের গোলা পূর্ণ হওয়ার কথা, উঠান ভরে থাকার কথা খড় দিয়ে। কৃষক-কৃষাণীর শত ব্যস্ততা, ধান মাড়াই, শুকানো, কত কাজ। এ পরিশ্রম তার মুখে হাসি আর মনে আনন্দ আনার কথা। কিন্তু এখন পরিশ্রমের সাথে কৃষকের মনে বিষন্নতা, মাথায় চিন্তার বোঝা। ধান কাটা ফাঁকা মাঠের মতো তার মনটাও ফাঁকা। ধান বিক্রির টাকায় ঋণশোধ, পাওনাদারের দেনা শোধ, সংসারের খরচ, ছেলেমেয়ের বায়না মেটানো তো দূরের কথা উৎপাদন খরচও উঠবে না।
কৃষকের মুখে হাসি না থাকলেও বাম্পার ফলন নিয়ে সরকারের সাফ্যলের কৃতিত্ব ও বাগাড়ম্বের কিন্তু শেষ নেই। অথচ সারা দেশের চিত্র কি? ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা মণ দরে। প্রায় ৪ মাস অক্লান্ত পরিশ্রম, টাকা খরচ করে কৃষক ঘাম ঝরানো ধান বিক্রি করতে এসে চোখের জল ও দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। দোষ দিচ্ছে কপালের। কিন্তু একি শুধু কপালের লিখন নাকি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার।
বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কত?
বাংলাদেশে ধানের মৌসুম তিনটি। আউশ, আমন ও বোরো। খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে ক্রমাগত বোরো ধানের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মোট ধান উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মতে এ বছর বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমি কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো ধান চাষ হয়েছে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উৎপাদন হবে প্রায় ২ কোটি টন।
এই বর্ধিত উৎপাদন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য হিসাব করলে দেখা যাবে কৃষকের জীবন ও জীবিকা কিন্তু অনিশ্চিত হয়ে গেল।
বোরো ধানের উৎপাদন খরচ কত?
বোরো ধান - সেচ, সার ও কীটনাশক নির্ভর ধান। এর জন্য প্রয়োজন নিবিড় পরিচর্যা ও আর্থিক খরচ। এক সাধারণ হিসাবে দেখা যায়, বীজতলা তৈরী, চারা লাগানো, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা মাড়াইসহ ঘরে তোলা পর্যন্ত ১ বিঘা জমিতে কৃষি মজুর লাগে ২৫ জন। বীজের দাম, সারের দাম, তিনবার সেচ দেওয়া, দুইবার কীটনাশক প্রয়োগ করা ও জমির ভাড়াসহ(বা খাজনা) ১ বিঘা জমিতে ধান চাষে খরচ পড়ে প্রায় ১৬,৫০০ টাকা। ১ বিঘা জমিতে গড়ে ফলন হয় ১৮ থেকে ২০ মণ ধান। ফলে কৃষকের নিজের শ্রম হিসেব না ধরলেও প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ৮০০ টাকা। সরকারের পক্ষ থেকেও ধানের সংগ্রহ মূল্য মণ প্রতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮০ টাকা। কৃষক সংগঠনগুলো দাবি করেছে ৪ মাসের বিনিয়োগ, উৎপাদনের সাথে ন্যূন্যতম লাভ হিসেব করলে ধানের দাম হওয়া উচিত ১০০০ টাকা। ১০০০ তো দূরের কথা এখন মণপ্রতি ৫০০ টাকা পাওয়াও কৃষকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
এখন নতুন একটা প্রবণতা তৈরী হয়েছে। আমদানিকৃত গমের ধাম পড়ছে কেজি প্রতি ১৮-২০ টাকা। কিন্তু সরকার গমের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করেছে ২৮ টাকা। এবছর গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সরকারী ক্রয়কেন্দ্রে গম সরবরাহ করার জন্য ক্ষমাতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা, যা কখনও কখনও সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছে। কৃষক মরছে উৎপাদন খরচ না পেয়ে কিন্তু ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো।
সরকার ধান ক্রয়ের জন্য প্রতি কেজির মূল্য নির্ধারণ করেছে ২২ টাকা বা মণপ্রতি ৮৮০ টাকা। সরকার কাগজে কলমে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ১ লাখ টন ধান ও ১০ লাখ টন চাল সংগ্রহ করবে। এবছর ক্রয় কেন্দ্রগুলো এখনও ধান ক্রয় শুরু করেনি। কিন্তু বিগত দিনে সরকারী ক্রয় কেন্দ্রগুলো খোদ কৃষকের কাছ থেকে না কিনে দালাল-ফড়িয়াদের কাছ থেকে ধান কিনেছে। তাই কৃষক কমদামে দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী পাইকার, ফড়িয়া এবং দলীয় লোকদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হতো। কেউ কেউ বলেন কৃষক মওশুমে ধান বিক্রি না করলেই পারে। পরে যখন দাম ভালো পাওয়া যাবে তখন বিক্রি করলে পারে। না, কৃষক তা পারে না। কারণ ধান বিক্রি করেই তাকে সেচের টাকা, সারের টাকা পরিশোধ করতে হয়; কৃষি শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে হয়। ধান কেটে জমি ফেলে রাখা যায় না, নতুন করে চাষাবাদ শুরু করতে হয়। নতুন চাষাবাদের জন্যও টাকা লাগে। তাই সে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
আমাদের কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির একটা বড় কারণ সেচ ব্যয়। দেশের ৬৫-৭০ ভাগ সেচ ব্যবস্থাই এখনও ডিজেল চালিত সেচযন্ত্র নির্ভর। সেচ কাজে ব্যবহৃত ডিজেলে বিশেষ ভর্তুকি না থাকায় এই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশে এই খাতে ব্যয় সর্বাধিক। আমাদের দেশে সেচ ব্যয় ধান উৎপাদনের মোট ব্যয়ের ২৮%। যা ভিয়েতনামে ৬%, থাইল্যান্ডে ৮% ও ভারতের মরু প্রবণ পাঞ্জাবে ১৩%। সরকার নিজেকে কৃষকবান্ধব দাবি করলেও ভর্তুকি প্রদান করার ক্ষেত্রে কৃপণ। অথচ কুইক রেন্টাল পাওয়ার এর জন্য ভর্তুকি দিতে টাকার অভাব হয় না।
দেশে ১৮ হাজার চালকলের মধ্যে ১৫ হাজারই এখন বন্ধ রয়েছে। এই চাতালের মালিকরা ধান কিনলে ধানের চাহিদা বাড়তো কিন্তু তারাও ধান কিনছে না। কারণ তারা ধান থেকে যে চাল তৈরী করে, সে চাল বিক্রি করতে পারছে না। কারণ বাজারে এখন প্রচুর পরিমাণ ভারতীয় চাল। শূন্য শুল্কে চাল আমদানির সুবিধা থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা প্রচুর চাল আমদানি করছে। ভারতীয় চাল প্রতি কেজির আমদানি মূল্য ২৫ থেকে ৩০ টাকা পড়ছে। আর সরকার নির্ধারিত দরে চাল কিনে চালকলে ভাঙলে প্রতি কেজি চালের দর পড়ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা আমদানির দিকে বেশী মনোযোগ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ৩০ শতাংশ কমায় এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ধানের উৎপাদন বেড়েছে। ফলে গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমেছে ১৫০ থেকে ২৫০ ডলার। এ পরিস্থিতিতে কৃষককে রক্ষা করতে প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার সরকার আমদানির উপর শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের সরকার এখন পর্যন্ত কৃষক রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে বেসরকারীভাবে ১৩ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ১৪ লাখ ৮ হাজার টন। এবছর মার্চ পর্যন্ত ১০৫ কোটি ডলার বা ৮ হাজার কোটি টাকার চাল আমদানি হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৭৭ কোটি ডলার। যদিও মাত্র ৫০ হাজার টন চাল শ্রীলংকায় রপ্তানি করা হবে বলে মন্ত্রীরা ব্যাপক প্রচার করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন কৃষক বাঁচবে কী করে? সেখানে সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজূর ও কৃষক ফ্রন্ট ও অপরাপর কৃষক সংগঠনগুলো দাবি করেছে ধানের মূল্য মণপ্রতি ১০০০ টাকা নির্ধারণ করা। মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে প্রত্যেক হাটে সরকারী ক্রয়কেন্দ্র খুলে ধানসহ কৃষি ফসল উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদন খরচের সাথে ৩০ ভাগ যুক্ত করে মূল্য সহায়তা দিয়ে সরকারীভাবে ফসল ক্রয় করা। ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ডে চাল-গম বিতরণ করা। উন্নয়ন বাজেটের ৪০% কৃষি খাতে বরাদ্দ করা। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, কৃষি উপকরণ (সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ, কৃষিযন্ত্র, কীটনাশক, বীজ) সরবরাহে সরকারী ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং কৃষকদের ক্ষতিপূরণসহ কৃষি ঋণ মওকুফ। ক্ষেতমজূরসহ গ্রামীণ মজুরদের জন্য পল্লী রেশনিং চালু করা। টিআর, জিআর, কাবিখা, কাবিটা, ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক ভাতা, দুঃস্থ ভাতা, প্রসূতি ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন গ্রামীণ কর্মসূচি ও প্রকল্প বরাদ্দে দুর্নীতি-লুটপাট-দলীয়করণ বন্ধ করতে হবে। সারা বছর কাজ ও খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
দেশের প্রধান খাদ্য ফসল ধানের আবাদ কৃষকের জন্য ক্রমাগত লোকসানের ঝুঁকিবৃদ্ধির ফলে আগামীতে এক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ কতটুকু ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় ফলন ভালো হলে যেমন কৃষকের স্বপ্ন মারখায় আবার ফলন কম হলেও তার স্বপ্ন মার খায়। শাঁখের করাতের মতো সে দুদিকেই কাটা পড়ে।
সরকার কেন ধানের দাম বা চালের দাম কম রাখতে চায়? একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে লুটপাট-দুর্নীতির ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে যেমন বিপুল সম্পদ জমা হয় অন্যদিকে শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। শাসকশ্রেণী মনে করে অন্ততঃ খাবার ব্যবস্থা থাকলে জনগণকে কোনোভাবে শান্ত রাখা যাবে। তাই তারা জনগণকে বিভক্ত রাখার জন্যও এই অপকৌশল গ্রহণ করে। শ্রমজীবী মানুষ মনে করে দ্রব্যমূল্য যতই বাড়ুক চালের দাম তো কম আছে? এর ফলে শ্রমিকদের কম বেতনে কাজ করানো সম্ভব হয়। শহরকেন্দ্রিক বিক্ষোভকে প্রশমিত রাখা যায়। খাদ্য বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের লাভকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করা যায়।
এ বছর বোরো ধান ২ কোটি টন ফলন হয়েছে। এর অর্ধেক পরিমাণ ধান যদি বাজারে বিক্রি হয় বাকি অর্ধেক যদি কৃষক নিজে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করে তা হলে ১ কোটি টন ধানের বাণিজ্যে কৃষকের লোকসান ১০ হাজার কোটি টাকা। কৃষকের লোকসান অর্থাৎ খাদ্য ব্যবসায়ীর লাভ। একদিকে খাদ্য আমদানির মাধ্যমে লাভ অন্যদিকে কৃষক ঠকিয়ে লাভ। ব্যবসায়ীদের এরকম সুবিধা দেয়ার কারণেই সরকারকে বলা হয় ব্যবসাবান্ধব সরকার। অসংগঠিত কৃষক বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চাষবাস করে। সে ধান ফলিয়ে লোকসান করে, সবজি চাষ করে পোষানোর চেষ্টা করে কিন্তু সেখানেও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে দাম পায় না। ফলে বাধ্য হয় ঋণ করতে। সেখানে ওৎপেতে আছে মহাজন, ঋণদানকারী এনজিও। এদের ঋণের জালে একবার আটকা পড়লে আর রেহাই নাই। জায়গা-জমি বিক্রি করে শেষ প্রর্যন্ত ঠাঁই-ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ছিন্নমূল হিসেবে। অথবা দুঃস্থভাতার জন্য হাত বাড়াতে বাধ্য হয়।
কিন্তু দেশের সুষম অর্থনীতির বিকাশ করতে হলে কৃষকের কৃষি উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকের হাতে টাকা থাকলেই তো সে অন্যান্য পণ্য কিনবে।
দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান এ সব চিন্তা করলে কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরী। আর যদি কৃষক লোকসানের কারণে কৃষি উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এর ফলাফল হবে ভয়াবহ। এখন যে সস্তায় বিনাশুল্কে চাল আমদানি হচ্ছে তখন আন্তর্জাতিক খাদ্য ব্যবসায়ীরা খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে এমন অবস্থা করবে যে টাকা দিয়েও খাদ্য পাওয়া যাবে না। ইন্টারনেট-ফেসবুক ছাড়াও বাঁচা যায় কিন্তু খাদ্য ছাড়া বাঁচার কথা কি কেউ চিন্তা করতে পারেন?
তাই জনগণের সামগ্রিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে কৃষকের এই সর্বনাশ বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষকের পাশে সাধারণ মানুষেরও এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি উপকরণের দাম কমানো, ধান-সবজিসহ কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, খাদ্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বন্ধ করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বোরো ধানের মওশুম শেষ হওয়ার পথে। বেশির ভাগ জমির ধান কাটা ও মাড়াই প্রায় শেষ। মাঠের সোনালী ধান কাটার পর কৃষকের গোলা পূর্ণ হওয়ার কথা, উঠান ভরে থাকার কথা খড় দিয়ে। কৃষক-কৃষাণীর শত ব্যস্ততা, ধান মাড়াই, শুকানো, কত কাজ। এ পরিশ্রম তার মুখে হাসি আর মনে আনন্দ আনার কথা। কিন্তু এখন পরিশ্রমের সাথে কৃষকের মনে বিষন্নতা, মাথায় চিন্তার বোঝা। ধান কাটা ফাঁকা মাঠের মতো তার মনটাও ফাঁকা। ধান বিক্রির টাকায় ঋণশোধ, পাওনাদারের দেনা শোধ, সংসারের খরচ, ছেলেমেয়ের বায়না মেটানো তো দূরের কথা উৎপাদন খরচও উঠবে না।
কৃষকের মুখে হাসি না থাকলেও বাম্পার ফলন নিয়ে সরকারের সাফ্যলের কৃতিত্ব ও বাগাড়ম্বের কিন্তু শেষ নেই। অথচ সারা দেশের চিত্র কি? ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা মণ দরে। প্রায় ৪ মাস অক্লান্ত পরিশ্রম, টাকা খরচ করে কৃষক ঘাম ঝরানো ধান বিক্রি করতে এসে চোখের জল ও দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। দোষ দিচ্ছে কপালের। কিন্তু একি শুধু কপালের লিখন নাকি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার।
বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কত?
বাংলাদেশে ধানের মৌসুম তিনটি। আউশ, আমন ও বোরো। খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে ক্রমাগত বোরো ধানের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মোট ধান উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মতে এ বছর বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমি কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো ধান চাষ হয়েছে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উৎপাদন হবে প্রায় ২ কোটি টন।
এই বর্ধিত উৎপাদন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য হিসাব করলে দেখা যাবে কৃষকের জীবন ও জীবিকা কিন্তু অনিশ্চিত হয়ে গেল।
বোরো ধানের উৎপাদন খরচ কত?
বোরো ধান - সেচ, সার ও কীটনাশক নির্ভর ধান। এর জন্য প্রয়োজন নিবিড় পরিচর্যা ও আর্থিক খরচ। এক সাধারণ হিসাবে দেখা যায়, বীজতলা তৈরী, চারা লাগানো, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা মাড়াইসহ ঘরে তোলা পর্যন্ত ১ বিঘা জমিতে কৃষি মজুর লাগে ২৫ জন। বীজের দাম, সারের দাম, তিনবার সেচ দেওয়া, দুইবার কীটনাশক প্রয়োগ করা ও জমির ভাড়াসহ(বা খাজনা) ১ বিঘা জমিতে ধান চাষে খরচ পড়ে প্রায় ১৬,৫০০ টাকা। ১ বিঘা জমিতে গড়ে ফলন হয় ১৮ থেকে ২০ মণ ধান। ফলে কৃষকের নিজের শ্রম হিসেব না ধরলেও প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ৮০০ টাকা। সরকারের পক্ষ থেকেও ধানের সংগ্রহ মূল্য মণ প্রতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮০ টাকা। কৃষক সংগঠনগুলো দাবি করেছে ৪ মাসের বিনিয়োগ, উৎপাদনের সাথে ন্যূন্যতম লাভ হিসেব করলে ধানের দাম হওয়া উচিত ১০০০ টাকা। ১০০০ তো দূরের কথা এখন মণপ্রতি ৫০০ টাকা পাওয়াও কৃষকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
এখন নতুন একটা প্রবণতা তৈরী হয়েছে। আমদানিকৃত গমের ধাম পড়ছে কেজি প্রতি ১৮-২০ টাকা। কিন্তু সরকার গমের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করেছে ২৮ টাকা। এবছর গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সরকারী ক্রয়কেন্দ্রে গম সরবরাহ করার জন্য ক্ষমাতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা, যা কখনও কখনও সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছে। কৃষক মরছে উৎপাদন খরচ না পেয়ে কিন্তু ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো।
সরকার ধান ক্রয়ের জন্য প্রতি কেজির মূল্য নির্ধারণ করেছে ২২ টাকা বা মণপ্রতি ৮৮০ টাকা। সরকার কাগজে কলমে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ১ লাখ টন ধান ও ১০ লাখ টন চাল সংগ্রহ করবে। এবছর ক্রয় কেন্দ্রগুলো এখনও ধান ক্রয় শুরু করেনি। কিন্তু বিগত দিনে সরকারী ক্রয় কেন্দ্রগুলো খোদ কৃষকের কাছ থেকে না কিনে দালাল-ফড়িয়াদের কাছ থেকে ধান কিনেছে। তাই কৃষক কমদামে দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী পাইকার, ফড়িয়া এবং দলীয় লোকদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হতো। কেউ কেউ বলেন কৃষক মওশুমে ধান বিক্রি না করলেই পারে। পরে যখন দাম ভালো পাওয়া যাবে তখন বিক্রি করলে পারে। না, কৃষক তা পারে না। কারণ ধান বিক্রি করেই তাকে সেচের টাকা, সারের টাকা পরিশোধ করতে হয়; কৃষি শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে হয়। ধান কেটে জমি ফেলে রাখা যায় না, নতুন করে চাষাবাদ শুরু করতে হয়। নতুন চাষাবাদের জন্যও টাকা লাগে। তাই সে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
আমাদের কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির একটা বড় কারণ সেচ ব্যয়। দেশের ৬৫-৭০ ভাগ সেচ ব্যবস্থাই এখনও ডিজেল চালিত সেচযন্ত্র নির্ভর। সেচ কাজে ব্যবহৃত ডিজেলে বিশেষ ভর্তুকি না থাকায় এই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশে এই খাতে ব্যয় সর্বাধিক। আমাদের দেশে সেচ ব্যয় ধান উৎপাদনের মোট ব্যয়ের ২৮%। যা ভিয়েতনামে ৬%, থাইল্যান্ডে ৮% ও ভারতের মরু প্রবণ পাঞ্জাবে ১৩%। সরকার নিজেকে কৃষকবান্ধব দাবি করলেও ভর্তুকি প্রদান করার ক্ষেত্রে কৃপণ। অথচ কুইক রেন্টাল পাওয়ার এর জন্য ভর্তুকি দিতে টাকার অভাব হয় না।
দেশে ১৮ হাজার চালকলের মধ্যে ১৫ হাজারই এখন বন্ধ রয়েছে। এই চাতালের মালিকরা ধান কিনলে ধানের চাহিদা বাড়তো কিন্তু তারাও ধান কিনছে না। কারণ তারা ধান থেকে যে চাল তৈরী করে, সে চাল বিক্রি করতে পারছে না। কারণ বাজারে এখন প্রচুর পরিমাণ ভারতীয় চাল। শূন্য শুল্কে চাল আমদানির সুবিধা থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা প্রচুর চাল আমদানি করছে। ভারতীয় চাল প্রতি কেজির আমদানি মূল্য ২৫ থেকে ৩০ টাকা পড়ছে। আর সরকার নির্ধারিত দরে চাল কিনে চালকলে ভাঙলে প্রতি কেজি চালের দর পড়ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা আমদানির দিকে বেশী মনোযোগ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ৩০ শতাংশ কমায় এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ধানের উৎপাদন বেড়েছে। ফলে গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমেছে ১৫০ থেকে ২৫০ ডলার। এ পরিস্থিতিতে কৃষককে রক্ষা করতে প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার সরকার আমদানির উপর শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের সরকার এখন পর্যন্ত কৃষক রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে বেসরকারীভাবে ১৩ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ১৪ লাখ ৮ হাজার টন। এবছর মার্চ পর্যন্ত ১০৫ কোটি ডলার বা ৮ হাজার কোটি টাকার চাল আমদানি হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৭৭ কোটি ডলার। যদিও মাত্র ৫০ হাজার টন চাল শ্রীলংকায় রপ্তানি করা হবে বলে মন্ত্রীরা ব্যাপক প্রচার করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন কৃষক বাঁচবে কী করে? সেখানে সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজূর ও কৃষক ফ্রন্ট ও অপরাপর কৃষক সংগঠনগুলো দাবি করেছে ধানের মূল্য মণপ্রতি ১০০০ টাকা নির্ধারণ করা। মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে প্রত্যেক হাটে সরকারী ক্রয়কেন্দ্র খুলে ধানসহ কৃষি ফসল উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদন খরচের সাথে ৩০ ভাগ যুক্ত করে মূল্য সহায়তা দিয়ে সরকারীভাবে ফসল ক্রয় করা। ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ডে চাল-গম বিতরণ করা। উন্নয়ন বাজেটের ৪০% কৃষি খাতে বরাদ্দ করা। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, কৃষি উপকরণ (সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ, কৃষিযন্ত্র, কীটনাশক, বীজ) সরবরাহে সরকারী ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং কৃষকদের ক্ষতিপূরণসহ কৃষি ঋণ মওকুফ। ক্ষেতমজূরসহ গ্রামীণ মজুরদের জন্য পল্লী রেশনিং চালু করা। টিআর, জিআর, কাবিখা, কাবিটা, ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক ভাতা, দুঃস্থ ভাতা, প্রসূতি ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন গ্রামীণ কর্মসূচি ও প্রকল্প বরাদ্দে দুর্নীতি-লুটপাট-দলীয়করণ বন্ধ করতে হবে। সারা বছর কাজ ও খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
দেশের প্রধান খাদ্য ফসল ধানের আবাদ কৃষকের জন্য ক্রমাগত লোকসানের ঝুঁকিবৃদ্ধির ফলে আগামীতে এক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ কতটুকু ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় ফলন ভালো হলে যেমন কৃষকের স্বপ্ন মারখায় আবার ফলন কম হলেও তার স্বপ্ন মার খায়। শাঁখের করাতের মতো সে দুদিকেই কাটা পড়ে।
সরকার কেন ধানের দাম বা চালের দাম কম রাখতে চায়? একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে লুটপাট-দুর্নীতির ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে যেমন বিপুল সম্পদ জমা হয় অন্যদিকে শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। শাসকশ্রেণী মনে করে অন্ততঃ খাবার ব্যবস্থা থাকলে জনগণকে কোনোভাবে শান্ত রাখা যাবে। তাই তারা জনগণকে বিভক্ত রাখার জন্যও এই অপকৌশল গ্রহণ করে। শ্রমজীবী মানুষ মনে করে দ্রব্যমূল্য যতই বাড়ুক চালের দাম তো কম আছে? এর ফলে শ্রমিকদের কম বেতনে কাজ করানো সম্ভব হয়। শহরকেন্দ্রিক বিক্ষোভকে প্রশমিত রাখা যায়। খাদ্য বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের লাভকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করা যায়।
এ বছর বোরো ধান ২ কোটি টন ফলন হয়েছে। এর অর্ধেক পরিমাণ ধান যদি বাজারে বিক্রি হয় বাকি অর্ধেক যদি কৃষক নিজে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করে তা হলে ১ কোটি টন ধানের বাণিজ্যে কৃষকের লোকসান ১০ হাজার কোটি টাকা। কৃষকের লোকসান অর্থাৎ খাদ্য ব্যবসায়ীর লাভ। একদিকে খাদ্য আমদানির মাধ্যমে লাভ অন্যদিকে কৃষক ঠকিয়ে লাভ। ব্যবসায়ীদের এরকম সুবিধা দেয়ার কারণেই সরকারকে বলা হয় ব্যবসাবান্ধব সরকার। অসংগঠিত কৃষক বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চাষবাস করে। সে ধান ফলিয়ে লোকসান করে, সবজি চাষ করে পোষানোর চেষ্টা করে কিন্তু সেখানেও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে দাম পায় না। ফলে বাধ্য হয় ঋণ করতে। সেখানে ওৎপেতে আছে মহাজন, ঋণদানকারী এনজিও। এদের ঋণের জালে একবার আটকা পড়লে আর রেহাই নাই। জায়গা-জমি বিক্রি করে শেষ প্রর্যন্ত ঠাঁই-ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ছিন্নমূল হিসেবে। অথবা দুঃস্থভাতার জন্য হাত বাড়াতে বাধ্য হয়।
কিন্তু দেশের সুষম অর্থনীতির বিকাশ করতে হলে কৃষকের কৃষি উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকের হাতে টাকা থাকলেই তো সে অন্যান্য পণ্য কিনবে।
দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান এ সব চিন্তা করলে কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরী। আর যদি কৃষক লোকসানের কারণে কৃষি উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এর ফলাফল হবে ভয়াবহ। এখন যে সস্তায় বিনাশুল্কে চাল আমদানি হচ্ছে তখন আন্তর্জাতিক খাদ্য ব্যবসায়ীরা খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে এমন অবস্থা করবে যে টাকা দিয়েও খাদ্য পাওয়া যাবে না। ইন্টারনেট-ফেসবুক ছাড়াও বাঁচা যায় কিন্তু খাদ্য ছাড়া বাঁচার কথা কি কেউ চিন্তা করতে পারেন?
তাই জনগণের সামগ্রিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে কৃষকের এই সর্বনাশ বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষকের পাশে সাধারণ মানুষেরও এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি উপকরণের দাম কমানো, ধান-সবজিসহ কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, খাদ্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বন্ধ করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:২৭