আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, অথবা করতেও পারেন, আমার প্রথম স্ত্রীর নাম তামান্না মাহবুবা। হ্যা, ঠিকই ধরেছেন, এই সময়ের জনপ্রিয় লেখিকা তামান্না মাহবুবার কথাই বলছি। নইলে আমার প্রথম স্ত্রীর নাম আপনাকে জানানোর কী এমন প্রয়োজন, তাছাড়া অন্যের স্ত্রীর নাম জেনে আপনারই বা কী কাজ!
তামান্না আমার প্রথম স্ত্রী। 'প্রথম স্ত্রী' শব্দবন্ধের ভেতরেই কেমন যেন সাবেকী গন্ধ পাওয়া যায়, তাই না? আর প্রথম বললেই, বিশেষত প্রেম বা দাম্পত্য সম্পর্কিত বিষয়ে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় সংখ্যাটাও প্রশ্নাত্মক হয়ে চলে আসে। সে ক্ষেত্রে আপনারও মনে হতে পারে, তবে কি আমার দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় কোন স্ত্রী আছে? অবশ্য আমার দ্বিতীয় তৃতীয় কিংবা ধর্মমতে চতুর্থ স্ত্রী আছে কি নেই সেটা আপনার মাথাব্যথার কারণ নয়। কিন্তু যেহেতু আপনার প্রিয় লেখিকার এক সময়ের স্বামী আমি, তাই বিষয়টা সামান্য গুরুত্ববহ বটে। গুরুত্ববহ একারণে যে, আমাদের দাম্পত্য বিষয়ক কোন জটিলতার সাথে তার মৃত্যুর কোন সম্পর্ক আছে কিনা, তা জানতে আপনারা, মানে তার সিরিয়াস পাঠকেরা, প্রচন্ড কৌতুহলী।
প্রথমত, তামান্নার সাথে আমার ডিভোর্সের পর আমি আর কোন বিবাহ করিনি। দ্বিতীয়ত, ডিভোর্সের পরও তার সাথে আমার নিত্য যোগাযোগ ছিল। নিয়মিত ফোন করত। চিঠি লিখত। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে নিজের সব কথা জানাতো আমাকে। সেলফোন, ইমেইল থাকা সত্বেও চিঠি লেখা ছিল তার প্রিয় অভ্যাস। প্রেমিক কিংবা বন্ধুর কাছে যতটা যত্ন নিয়ে চিঠি লেখা যায়, ঠিক ততটাই বা তার চেয়েও অধিক যত্নের ছোঁয়া পেতাম তার চিঠিতে।
একবার লিখেছিল, রূপম, যার জন্য তোমাকে ছেড়ে এলাম, সেই দুঃস্বপ্ন আমার পিছু ছাড়েনি আজও। নাছোড় প্রেমিকের মত প্রতিরাতেই সে ফিরে আসে। ঘুমের ভেতরে উৎপাত করে। আমি ঘুমাতে পারি না। এর হাত থেকে আমার হয়তো মুক্তি নেই। নিষ্কৃতি নেই। ধীরে ধীরে ইনসোমনিয়া চেপে বসেছে আমার চোখের নিচে। এখনকার এই আমাকে দেখে, তোমার সেই প্রিয় চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে, তুমি হয়তো আহত হবে। রূপম, এই দুঃস্বপ্নের জুজু যে বা যারা আমার দিকে লেলিয়ে দিয়েছে, তুমি চেনো তাদের?
তামান্নার সাথে আমার কেবল ফোনে বা চিঠিতেই কথা হতো। বিবাহ বিচ্ছেদের পর আমাদের কখনও দেখা হয়নি। এমন কি, এই শহরেই সে কোথায় কীভাবে থাকে, সে ঠিকানাও আমার জানা ছিল না। আপনারাও হয়তো জানেন, শেষ কয়েকটা বছর, না কোন মিডিয়া, না কোন সাহিত্য জলসা, না কোন বন্ধু-পাঠক-শুভাকাঙ্ক্ষী—কারো সম্মুখেই সে আসত না।
শেষ দিকে, আমার সাথে ফোনালাপও বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু চিঠি লিখত। সপ্তাহে কমপক্ষে তিনটা চিঠি আমার বাসার ডাকবাক্সে এসে চুপচাপ বসে থাকত। ইনভেলাপের গায়ে কোন সীল-সাক্ষর না থাকায় বুঝতাম, অপেশাদার কোন এক পিয়ন রেখে গেছে চিঠি। কিন্তু কে আসত, কখন রেখে যেত, আমি তা কোনদিন জানতে পারিনি।
শেষ দিকে একবার চিঠি এল—রূপম, কোন প্রকার কথা না বলেও যে একটা জীবন পার করা যায়, তা হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এই গভীর সত্যকে আমার মত আর কে জানে! এখন কেবলই মনে হয়, মানুষ অযথাই কথা বলে। কথা বলে বলে জীবনের সময়গুলো নিছক নষ্ট করে ফেলে। যে কথা বলা প্রয়োজন, ক'জন তা বলতে পারে? আমিও কি পেরেছি? জানো রূপম, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি হয়তো এ জীবনে একটা কথাও বলিনি। হ্যা, আমার এই উপলব্ধি মিথ্যে নয়। আমি কখনও কথা বলিনি। কারো সাথেই না। তোমার সাথেও না। যা কিছু আমাকে বলতে দেখেছো, তা কেবলই শব্দের পিঠে সাজানো শব্দ মাত্র। কথা নয়। বলার জন্য আমার যত কথা ছিল, তা বলতে পারিনি। একটা অদৃশ্য হাত আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরে রাখে। ওরা আমাকে কোন কথাই বলতে দেবে না রূপম।
সারাটা জীবন ধরে তামান্না কী বলতে চেয়েছিল, আমি হয়তো জানতাম। হয়তো ওর নীরবতাও কিছুটা বুঝতাম। কিংবা হতে পারে, একদমই বুঝতাম না।
একদিন সন্ধ্যায়, শপিংমল থেকে বের হয়ে আমরা রিকশা না পেয়ে কিছুদূর হেঁটে এলাম, মালিবাগ মোড়ে। মোড়ের কাছেই, রাস্তার ওপাশে দেখলাম জটলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। দুটো মটরবাইক সাঁই করে একজন তরণীর সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটাও হয়তো রিকশা খুঁজছিল। কয়েকটা যুবক বাইক থেকে নেমে মেয়েটার হাত থেকে ব্যাগটা টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর কিছুক্ষণ হাতাহাতি। নোংরা খিস্তি। শেষে মেয়েটা মাটিতে পড়ে গেলে ওরা বাইক নিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেল। চোখের সামনেই ঘটে গেল সব।
তামান্না বলল—দেখেছো, মানুষগুলো কেমন হা করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। কেউ কিচ্ছু বলল না। এগিয়েও এল না।
আমি বললাম—ওদিকে দেখো, দুইজন পুলিশ ডিউটিতে আছে। তাদের সামনেই ঘটল সব। অথচ তারাও এক পা এগোল না।
তামান্না গলায় খেদ নিয়ে বলল—তাদের হয়তো ওখানেই ডিউটি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার দুইগজের বাইরে কিছু ঘটলে সে দায় তারা নেবে কেন?
আমরা রাস্তা পার হয়ে জটলার কাছে এসে জানলাম, বাইকের ছেলেগুলো প্রথমে মেয়েটাকে বাজে কথা বলেছিল। মেয়েটাও তার প্রতিউত্তর করেছিল। যে অপরাধে বাইক ঘুরিয়ে এসে তার শাস্তিটা ওরা বুঝিয়ে দিল।
তামান্না বলল—এই একই ঘটনা যদি আমার সাথে ঘটত, তখন তুমি কী করতে রূপম?
আমি হঠাৎ চমকে উঠে ওর দিকে তাকালাম। কিছুই বলতে পারলাম না। আসলেই তো, কী করতাম আমি? ওই মানুষগুলোর মত আমিও কি জড়মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম? আমি কি ওদের চেয়ে আলাদা কেউ?
সে রাতে বাসায় ফিরে তামান্না কিছুই খেল না। আমার সাথে তেমন কথাও বলল না। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কিছুক্ষণ লিখতে লিখতে আবার উঠে পড়ল। খুব অস্থির দেখাচ্ছিল ওকে। রাতে ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে জেগে উঠল।
বললাম—কী হলো, কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছো?
ও বলল—পানি দাও প্লিজ।
আমি পানি দিলাম। গ্লাস শেষ করে টেবিলে রেখে আমার বুকের কাছে ঘন হয়ে শুয়ে পড়ল আবার। কেমন যেন তিরতির করে কাঁপছিল।
বললাম—শরীর খারাপ লাগছে?
বলল—আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকো রূপম। শক্ত করে ধরে রেখো। ছেড়ো না প্লিজ।
বললাম—কী হয়েছে তোমার তানু?
ও জড়সড় হয়ে আমার ভেতরে আরো সরে এল। বলল—দুঃস্বপ্নের ভেতরেও ওরা আমাকে তাড়া করছে রূপম। সেই নয় বছরের ছোট্ট আমাকে ওরা আবার রেইপ করতে আসছে। ওদেরকে মেরে ফেল। প্লিজ, কিল দেম!
এই দুঃস্বপ্ন শৈশব থেকেই তামান্নাকে তাড়া করছে। ও ছিল প্রচণ্ড চঞ্চল এবং আনন্দ মুখর এক কিশোরী। এ পাড়ায় ও পাড়ায় নেচে বেড়াত ঘাসফড়িংয়ের মত। পড়াশোনায় বিশেষ মন ছিল না। তাই বাবা তাকে পড়ানোর জন্য জয়নাল মাস্টারকে ঠিক করে দিলেন। জয়নাল মাস্টার বাজারের উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ান। তামান্নার বাবাকে তিনি বিশেষ সম্মান করেন এবং তামান্নাকেও স্নেহ করেন বলেই দুপুরের পর তার নিজের বাড়িতে এসে পড়ে যাবে এই শর্তে পড়াতে রাজি হলেন।
কয়েকদিন দুপুরে পড়তে যাবার পর মাস্টার একদিন বললেন— আজ দুপুরে ফিরতে দেরি হবে। তুমি সন্ধ্যার পর এসো।
সেদিন সন্ধ্যায় তার স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। হারিকেনের আলোয় পড়তে পড়তে তামান্না টের পেল, একটা লোমশ পশুর হাত তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলার ভেতরে আটকে গেল সব চিৎকার।
সেদিন বাসায় ফিরে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। কাঁদতে থাকল। কিন্তু তার কান্নার কারণ কাউকে বলতে পারল না। মায়ের কাছেও না। বাবার কাছেও না। ডানা ভাঙা একটা ফড়িং সেদিন থেকেই চুপসে গেল, খুব নীরবে।
এই ঘটনা বিয়ের আগেই জেনেছিলাম। তামান্নাই বলেছিল। ভেবেছিলাম বিয়ের পর ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ওকে মানসিকভাবে সাহস জোগাতাম। বলতাম—দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। যারা মানুষকে দুই খন্ড করে পুরুষ এবং নারীতে বিভক্ত করে রাখে, নারীকে ভাবে ভোগ্য বস্তু। পৃথিবীটা তাদের জন্য নয়। এই সমাজ একদিন ওদের ঘৃণা করতে শিখবে।
ও তখন বলত—পৃথিবীর সব পুরুষ যদি তোমার মত ভাবত! জানো রূপম, খবরে পত্রিকায় যখনই কোন ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের সংবাদ পড়ি, তখন মনে হয় ওর নাম তামান্না। ওটা আমিই। ওরা যেন আমার শরীরেই আঘাত করছে। আমাকেই খুন করছে।
একদিন রাতে টিভি চ্যানেলে একটা টকশো দেখছিলাম। গেস্ট ছিলেন বাংলাদেশের একজন নাম করা শিল্পপতি। নাম বললে আপনিও হয়তো চিনবেন। কিন্তু নামটা কেন গোপন রাখছি, একটু পরই তা আঁচ করতে পারবেন। তামান্না শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে টাওয়েলে চুল শুকাচ্ছিল। টিভির স্ক্রিনে চোখ পড়তেই প্রায় চিৎকার করে উঠল। বলল—চ্যানেলটা চেঞ্জ করো প্লিজ!
আমি বললাম—আরেকটু শুনি না! টপিকটা ভালো তো।
তামান্না হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে উঠল। ছুটে এসে রিমোট কেড়ে নিয়ে নিজেই টিভি অফ করে দিল। বলল—ভালো টপিক নিয়ে কথা বললেই কেউ ভালো প্রমানিত হয় না।
আমি বললাম—লোকটার প্রতি তোমার বেশ রাগ দেখছি। তুমি চেনো তাকে?
ও বলল—চিনি। ভালোভাবেই চিনি। আমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না। আমি অবাক হলাম।
বললাম—উনার সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে?
তামান্না কিছু বলল না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ওই মুহূর্তে আমারও আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না।
দু'বছর আগে বইমেলায় তামান্নার যে নতুন বইটি বেরিয়েছিল, কাগজের ঈশ্বরী, যার জন্য গত বছর 'মানিক বন্দোপাধ্যায়' পুরস্কারও পেলো—ওটা পড়েছেন নিশ্চয়ই। উপন্যাসটি মূলত তামান্নার আত্মজীবনী মূলক। উপন্যাসের 'তনু' চরিত্রটি সে নিজেই। যদি পড়ে থাকেন, তবু কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি।
“আমি যখন মেডিকেলে ভর্তি হলাম, তখন ঢাকা শহরে আমার পরিচিত কেউ ছিল না। বাবা তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখে আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। বাবার দেয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখলাম রাজপ্রসাদের মত বিরাট বাড়ি। বাড়িতে তেমন কেউ থাকে না। বাবার বন্ধুর একমাত্র ছেলে আর স্ত্রী থাকে শুধু। ভদ্রলোকের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম।
তিনি একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বললেন—আজ থেকে এখানেই থাকবে তুমি, যতদিন ইচ্ছে। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তার স্ত্রীও আমাকে স্নেহের চোখে দেখলেন। ভদ্রলোক বাবাকে চিঠিতে জানালেন, তোমার মেয়ে তো আমার মেয়ের মতই। আমার বাসাতেই থাকবে সে। বন্ধু হয়ে তোমার এইটুকু উপকার তো করতেই পারি। তুমি নিশ্চিন্তে থেকো।
বাবা নিশ্চিন্ত হলেন। আমিও ঠিকঠাক কলেজে যাওয়া আরম্ভ করলাম। ভদ্রলোক নিয়মিত আমার খোঁজ-খবর নিতেন। কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, জানতে চাইতেন। তার পিতৃসুলভ আচরণে আমি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়লাম।
তিন মাস পর, ছেলেকে নিয়ে একদিন তার স্ত্রী বেড়াতে গেলেন ব্যাংকক। বিজনেসের কাজের চাপে তিনি গেলেন না। সে রাতেই, আমি তখন পড়ছিলাম, তিনি আমার রুমে এসে খোঁজ খবর নিলেন। তারপর হাসতে হাসতেই বললেন—পড়তে পড়তে তো মাথাটা নষ্ট করে ফেলবে। চলো আজ একটু রিল্যাক্স করা যাক।
আমি ঠিক বুঝলাম না তিনি কী বলতে চাইছেন। ফ্রিজ থেকে একটা বোতল বের করে ড্রইং রুমে এলেন।
আমি বললাম—আংকেল কী ওটা?
তিনি আবারও হেসে উঠলেন—অমিয়। খেয়ে দেখো ফ্রেশ লাগবে। মাথাটা হালকা হবে।
আমি বললাম—আমার অভ্যাস নেই।
তিনি বললেন—একদিন খাওয়ার জন্য অভ্যাসের দরকার হয় না। এসো, কিচ্ছু হবে না। তোমার আন্টি বাসায় নেই, এমন সুযোগ আর পাবে না। এসো তো, নাও গ্লাসটা ধরো।
আমার আড়ষ্টতা তবু গেলো না। কী বলব, এই অবস্থায় কী বলা উচিত, কিছুই মাথায় এলো না। ভাবলাম, হাই সোসাইটিতে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। নাকচ করাটা হয়তো অভদ্রতা।
সে রাতেই আমি দেখলাম, বাবার মত যাকে সম্মান করেছি, তার ভেতরেও কতটা পশুত্ব ঘাপটি মেরে ছিল। দ্বিতীয়বারের মত সেই পশুত্বের শিকার হতে হলো আমাকে। সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত পুরো একটা বছর, যেদিনই বাসায় তার স্ত্রী-পুত্র কেউ থাকত না, আমার উপর নেমে আসত সেই অসুর যন্ত্রণা।”
উপন্যাসের এই অংশটি পড়ার পর তামান্নাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—তোমার বাবার সেই বন্ধুটি কে?
ও বলেছিল—নামকরা এক শিল্পপতি।
বিশ্বাস করুন, আমার মাথায় তখন রক্ত চেপে বসেছিল। আমি সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমি তাকে খুন করব। সে যত বড় শিল্পপতিই হোক আর যত কঠিন দূর্ভেদ্য দূর্গেই থাকুক না কেন, আমার হাতেই তাকে মরতে হবে।
কিন্তু তার আগে খুঁজে বের করতে হবে জয়নাল মাস্টারকে। প্রতিশোধের নেশায় আমি হন্যে হয়ে উঠলাম। আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে, যেখানে বিয়ের পর কখনও যাওয়া হয়নি একারণে যে আমাদের নিজেদের পছন্দমত বিয়ে তারা মেনে নেয়নি, আমি নিজে সেই গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে জয়নালকে খুঁজে বের করলাম। সে কখন কোথায় যায় কী করে সব তথ্য জোগাড় করলাম। এরপর একদিন সে কোচিংয়ে পড়িয়ে সন্ধ্যার পর যখন গ্রামের পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল, আমি তার পিছু নিলাম। রাস্তাটা মাঠের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। ফাঁকা একটা পুলের কাছে আসতেই খুব সতর্কভাবে তাকে পেছন থেকে আক্রমন করলাম। আমার একটুও হাত কাঁপল না। তারপর পুলের নিচে, কাদার ভেতরে, লাশটা ফেলে দিয়েই ভাড়া করা মটরবাইক হাকিয়ে পালিয়ে এলাম। এবং সে রাতেই ফিরে এলাম ঢাকায়।
তামান্নার কাছে এই ঘটনা দীর্ঘদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু একদিন সে কীভাবে যেন বুঝতে পারল। আর তারপর যা ঘটল তার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।
আমাকে বলল—রূপম, ইচ্ছে করলে শাস্তিটা আমি নিজেই দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তা চাইনি। আমি চেয়েছি এ দেশের আইন-আদালতই এর বিচার করা শিখুক।
আমি বললাম—এ দেশের আদালত এসব বিচার কোনদিন করবে না সে তুমিও জানো।
সে বলল—হ্যা, এখন হয়তো করছে না। কিন্তু একদিন করবে। একদিন এই সমাজের এই রাষ্ট্রের মগজ চেঞ্জ হবেই। সে আশা কেন ছাড়ব? আমি অপেক্ষা করে আছি।
আমি বললাম—তাহলে আমি কি অপরাধ করেছি? সে বলল—তুমি খুন করেছো। অর্থাৎ তুমি খুনী। আর একজন খুনীর সাথে আমি থাকতে পারি না রূপম।
তামান্নার সাথে আমার ডিভোর্সের মূল কারণই ছিল ওই খুন। সেদিন বুঝলাম, খারাপ মানুষ মরার পরও ক্ষতি করতে ছাড়ে না। তামান্না আমাকে ছেড়ে গেলো। আলাদা বাসা নিলো। কিন্তু যোগাযোগ ছাড়ল না। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে আমাকে চিঠি লিখেছিল। হয়তো আগের মত ভালোও বাসত।
শেষ চিঠিতে লিখেছিল—আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি রূপম। ভেবেছিলাম, একা থাকলে হয়তো নিজের মত গুছিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু দিন দিন সবকিছু অবনতির দিকে যাচ্ছে। রাতে ঘুম হয় না আমার। এতোগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েও কেমন দিব্যি জেগে থাকি। অনেক দিন ধরে কিছু লিখতেও পারছি না। নতুন পাণ্ডুলিপিটা গোছানো দরকার, কিন্তু এ অবস্থায় তা কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। আমি যদি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাই, আমাকে এসে খুন করে যেও। পারবে তো?
হ্যা, আপনি বিশ্বাস করুন অথবা নাও করতে পারেন, কিন্তু আরেকটা খুন আমি করবই। আমি তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। খুনটা করার পর সেদিন আর চেপে রাখব না। প্রকাশ্যেই স্বীকারোক্তি দেব। কেননা, ওই খুনটার পর আমার সব কাজ শেষ। তারপর রাষ্ট্র আমার জন্য যে শাস্তিই দিক না কেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি তা মাথা পেতে নেব। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:০৪