ঢাকা ভার্সিটিতে ক্যামিস্ট্রি পেয়েও পড়ল না সে। ভর্তি হলো চারুকলায়। ওর বাবা তো রেগে অস্থির। হেঁড়ে গলার চিৎকারে মাথায় তুলল বাড়ি। মানুষটা ছুতো পেলেই এমন তুলকালাম শুরু করে যে আমারই রাগ লাগে।
আমি কাঁধে আলতো হাত ছুঁইয়ে বললাম, আহা থামো তো, ছেলেটার ছোটবেলা থেকেই তো আঁকাআঁকির দিকে ঝোক। ওকে ওর উপরই ছেড়ে দাও।
বলতেই আমার উপর হুমড়ি খেলো সে।
— তুমি চুপ করো। আস্কারা দিয়ে দিয়ে তুমিই নষ্ট করেছো ওকে।
— তোমাকে কে বলল ও নষ্ট হয়েছে?
— হয়নি তো কী? সারাদিন এতো ঘোরাঘুরি কিসের? বাইরে কোথায় কী করে না-করে তার খোঁজ রাখো?
— তাই বলে সারাক্ষণ পুলিশের মত লেগে থাকতে হবে পিছে? তোমার এই পুলিশি স্বভাব যাবে না আর। সব কিছুতেই সন্দেহ!
চার বছর হল মানুষটা পুলিশের ইউনিফর্ম ছেড়েছে। কিন্তু অভ্যাস ছাড়েনি তাকে। এখনো যাকে-তাকে আসামীর মত সন্দেহ, জেরা…। প্রশাসন বিভাগে চাকুরিজীবীদের এই এক প্রোব্লেম। প্রফেশন লাইফ আর পারসোনাল লাইফ গুলিয়ে ফেলে সব।
ছেলেকে আমি আদর করে ‘বাবুই’ বলে ডাকি। দিনরাত আমার ভাবনার ভেতরে ‘বাবুইটা’ টইটই করে উড়ে বেড়ায়। আমি স্বপ্ন দেখি, দেশের বড় বড় আর্টিস্টদের মত বাবুইয়ের মাথায়ও ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশ। মেদুর মেঘগুলো পেজা তুলোর মত জড়িয়ে যাচ্ছে ঝাকড়া চুলে। মানুষ মাথা উঁচু করে তাকাচ্ছে ওর মুখে। গ্যালারি ঘুরে দেখছে ওর আঁকা সারি সারি রঙ-বেরঙের ছবি। ওর তুলির ছোঁয়া নিয়ে বইমেলায় প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে রকমারি সব প্রচ্ছদ… আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি এসব। দেখতে দেখতে এক সময় স্বপ্নের মধ্যেই মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ি।
আর্মি স্টেডিয়ামে চলছে আজ চতুর্থ দিনের উচ্চাঙ্গ লহরী। মৃদঙ্গ-ঘটমের তালে মিশে যাচ্ছে বেহালা বিহাগ। নৃত্যশৈলীতে দুলছে কুয়াশার মিহিন পর্দা, সুরের উৎসব।
আমার খুব ইচ্ছে দর্শক গ্যালারির একদম সামনের সারিতে বসে উচ্চাঙ্গ শুনি। মানুষটাকে এতো আহ্লাদ করে বললাম নিয়ে যেতে, নিল না। একদম কাঠখোট্টা। হাত ভরে ঘুষ নিতে নিতে বৌয়ের হাত ধরাও ভুলে গেছে।
রাতের চ্যানেলগুলো ঘুরছে মন খারাপে। ভারতীয় সিরিয়াল দেখার বাজে অভ্যাস আমার নেই। বাংলাদেশের সব চ্যানেলেই কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ দেখাচ্ছে। আমি স্থির চোখে দেখছি। আহা, জীবন এঁকে এঁকে আজ তুলিতে তুলে নিলেন মৃত্যুর রঙ…শেষ কথাটি কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি?
নিশুতি রাত চেপে বসেছে জানালায়। মানুষটা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে পাশেই। আমার ঘুম এক্কাদোক্কা। বাবুইয়ের রুমে এখনো আলো। ছেলেটা এতো রাতেও কি ছবি আঁকছে? নিজের রুমটাকেই আর্টের হোমগ্যালারি বানিয়ে নিয়েছে সে। সারাদিন ওখানেই রঙ নিয়ে খেলা। আমি পায়ে পায়ে ওর রুমের দরজায় এলাম। ঘর ভর্তি ছোট বড় ছবি সাজানো। টেবিলের উপরে ছড়ানো তুলি। সব কিছুতেই মন খারাপের রঙ।
প্যাস্টেলওয়েলে একটা অর্ধেক আঁকা মুখের ক্যানভাসের সামনে হাটু মুড়ে বসে এক মনে তুলির আঁচড় টানছে বাবুই। এতোটা মনযোগী যে আমার উপস্থিতিও টের পেল না।
আমি দাঁড়িয়ে দেখছি, তুলির ছোঁয়ায় একটু একটু করে জীবিতদের মত জেগে উঠছে তৈলচিত্রের মুখ। খুব চেনা। আত্মার মত আপন। হঠাৎ মনে হল, এটাই তো আমার বাবুই! না না… মুখটা হাসছে। কী সুন্দর করে হাসছেন কাইয়ুম চৌধুরী!
(উৎসর্গ: শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। গতকাল ছিল তার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে থাকুন তিনি। হাজারও কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম হোক এই বাংলায়।)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৫২