জয়দীপ দে শাপলুর "ভাল হইছে কয়টা ইহুদী মরবো" পোষ্টে কমেন্ট করেছিলাম। বলেছিলাম, প্রকৃতপক্ষে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ইসলাম কারো প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন সমর্থন করে না। সত্যান্বেষী আমাকে প্রশ্ন করেছিল আমি কোরআনের সুরা আনফালের ১২ নম্বর আয়াত পড়ে একথাটি বলেছি কিনা। আয়াতটি হচ্ছে এরকম:
"স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ফিরিশতাগণের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন, 'আমি তোমাদের সহিত আছি, সুতরাং মু'মিনগণকে অবিচলিত রাখ'। যারা কুফরী করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব; সুতরাং তোমরা আঘাত কর তাদের স্কন্ধে ও প্রত্যেক আঙ্গুলের অগ্রভাগে।" (৮:১২)
প্রশ্নটি আমার কাছে গুরুতর মনে হল, ইসলাম কি অন্য ধর্ম বর্ণের মানুষের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের কথা বলে নাকি অন্য ধর্ম বর্ণে মানুষকে ঘৃণা করতে নিষেধ করে? আর তাই সত্যান্বেষীকে জবাব দিতে গিয়ে দেখি লেখাটি বড় হয়ে গেল। সেজন্যই সেটিকে একটি আলাদা পোস্ট হিসেবে দিলাম, অনেকের কাছে পঠনযোগ্য মনে হলেও হতে পারে।
@সত্যান্বেষী, ভাই আপনার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি: ইসলাম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কোন মানুষের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনকে সমর্থণ করে না। আমি একথাটি আপনার উল্লিখিত সূরা আনফালের (৮ নম্বর সুরা) আয়াত পড়েই বলেছি। কোরআনের আয়াতগুলো তার কনটেক্সট অনুযায়ী বুঝতে হবে, না হলে শুধু এ ক্ষেত্রে নয়, প্রতি ক্ষেত্রে ভুল বোঝা বা অপব্যাক্ষার অবকাশ রয়েছে। কিছু কিছু আয়াত যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রযোজ্য। সূরা আনফাল বদর যুদ্ধের পর পরই নাযিল হয়েছিল এবং সুরাটির বেশীরভাগ জুড়েই বদর যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এ সুরার আয়াতগুলো সে প্রেক্ষাপটেই বুঝতে হবে। আনফাল শব্দের অর্থই হচ্ছে 'যুদ্ধলব্ধ সম্পদ'। এখন যুদ্ধাবস্থার আয়াত যদি শান্তিবস্থায় প্রয়োগ যোগ্য বলে মনে করেন তাহলে একটি বড় ভুল হবে। আবার একটি বিষয়ে কোরআনের একটি আয়াত পড়ে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে চলবেনা। ঐ বিষয়টির ব্যাপারে সব আয়াত মিলিয়ে দেখে তার সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এখন বিবেচ্য শান্তির ধর্ম ইসলামে তাহলে যুদ্ধ কেন বা কোন ক্ষেত্রে পার্মিসিবল। কোরআন অনুযায়ী কেউ যুদ্ধ করলে বা আক্রমণ করলেই কেবল আত্মরক্ষার্থে এটি প্রযোজ্য হতে পারে। কোরআন বলছে,
"যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; সীমা লংঘন করোনা। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের পছন্দ করেনা।"(২:১৯০)
এখানে লক্ষণীয় যুদ্ধের অনুমতি দিয়েও দারুণভাবে সতর্ক করে দেয়া হচেছ যাতে সীমালংঘন না হয় কোনভাবেই। আর একটু আগালেই দেখতে পাই আল্লাহ বলছেন, "... যদি তারা বিরত হয় তবে যালিমদিগকে ব্যতীত আর কাউকেও আক্রমণ করা চলবেনা। "
তারমানে যুদ্ধ শেষ হলে আর আক্রমণ করা চলবেনা। শান্তি অবস্থায় অর্থাৎ সাধারণ অবস্থায় কি করতে হবে তা পরিষ্কার হয় কোরআনের অন্য একটি আয়াত থেকে, "দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করে নি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেননা। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন।"
(৬০ নং সুরা মুমতাহিনা , আয়াত ৮)
এর চেয়ে স্পষ্ট ভাষ্য আর কি হতে পারে? এটিই এ বিষয়ে কোরআনের চূড়ান্ত অবস্থান। আয়াতের শেষের ইঙ্গিত থেকে বোঝা যাচ্ছে আসলে শান্তি অবস্থায় আল্লাহ সকলের প্রতি (অবশ্যই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার, জাত, পাত নির্বিশেষে সকলের প্রতি, কারণ এখানে মুসলমানদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের কথা বলা হয়নি, অন্য ধর্মের লোকদের সাথে মুসলমানদের কেমন ব্যবহার করা উচিৎ সে সম্পর্কেই বলা হয়েছে) "মহানুভবতা" ও "ন্যায়বিচার" প্রদর্শনকেই ভালবাসেন। সুতরাং এখানেই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে আল্লাহ কি চান, ইসলাম কি চায়। এখন কোন ব্যক্তি বা সমষ্টি যদি এটি কমপ্লাই করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই ব্যর্থতার দায় তাদের।
ইসলাম যে কারো প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন পছন্দ করে না তার আরো প্রমাণ হচ্ছে, সুরা নিসার প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলছেন:
"হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদিগকে এক ব্যাক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুজন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন।" (৪:১)
অর্থাৎ ইসলাম অনুযায়ী আমরা বিশ্বাস করি সব মানুষ আদম থেকে এসেছে, তার ধর্ম যাই হোক না কেন। এদিক থেকে ইসলাম ইউনিভার্সেল ব্রাদারহুডে বিশ্বাসী। ইসলাম মর্যাদার দিক থেকে সকল মানুষকে সমান মনে করে - তার ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার, সম্পদ-স্বচ্ছলতা যাই হোক না কেন। "হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি কর্রেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার।... "
(৪৯:১৩)। এ আয়াতে স্পষ্ট হচ্ছে, স-অ-ব মানুষের উৎস এক বলে ইসলাম মনে করে। আর তাদের যে বিভক্তি তা খুবই সুপারফিশিয়াল এবং ইনসিগনিফিক্যান্ট।
যে আমাদের ব্রাদার, মানুষ হিসেবে মর্যাদার দিক থেকে সমান, তার সাথে মতদ্বৈততা থাকতে পারে, চিন্তা চেতনায় অমিল থাকতে পারে, কিন্তু তাকে ঘৃণা কিভাবে করা যেতে পারে? একজন প্রকৃত মুসলিম তাকে ভালবাসার সাথে উত্তমভাবে দাওয়াত দিতে পারে শুধু। কিন্তু কোন জবরদস্তি নেই (২:২৫৬) এবং তারা তাদের ধর্ম পালনের ব্যাপারে স্বাধীন (১০৯: ৬)।
রাসূল সা. -এর সারাজীবনের আমলও আমাদের সেই শিক্ষা দেয়। কিন্তু এ বিশ্বাসের উপর আমাদের আমল কম। ব্লগে দেখছি একজনের সাথে আর একজনের মতদ্বৈততা হলে গালি দিয়ে বসছে, স্যান্ডেলাইজ করতে চাচ্ছে। এসব নৈতিকতা এবং ইসলাম বিরোধী। ধৈর্য, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ এসবই হল বড় কথা। এগুলো অর্জন করতে না পারলে ধর্মের প্রশ্ন অর্থহীন হয়ে পড়ে। গাছের শেকড় না থাকলে, ডালপালা দিয়ে লাভ কি? ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য। গরু ছাগলের জন্য তো নয়। মানুষই না হলে তার জন্য ধর্ম দিয়ে লাভ কি? ইসলামকে বুঝতে হলে আমাদের সবার খোলা মন নিয়ে কোরআন এবং রাসূলের জীবনী ভালভাবে পড়ে নিতে হবে। বর্তমান সময়ের ভাল স্কলারদের বই পড়তে হবে। তবে তার আগে মনটাকে সাফ করে মানুষ হয়ে নিতে হবে।
সত্যান্বেষী ভাই, আপনার সাথে হয়ত আমার সামান্য দ্বিমত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাই বলেই আমাদেরকে যে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা তৈরী করত হবে, গালিগালাজ করতে হবে, তার কোন মানে নেই। যদি আমার ভুল থাকে আপনার কথা খোলা মনে বোঝার চেষ্টা করলে আমার ভুল দূর হয়ে যেতে পারে। আবার একইভাবে যদি আপনার ভুল থাকে সেটিও সহনশীল আলোচনার মাধ্যমে দূর হতে পারে। আমার এই যে ইউনিভার্সেল ঘৃণা না করার দৃষ্টি ভঙ্গি তা আমি ইসলাম থেকেই পেয়েছি। এটাকেও আমি "ইসলাম যে কাউকে ঘৃণা করার শিক্ষা দেয় না "- তার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই। তবে আপনাকে যে আমার কথার সাথে এক্ষুনি একমত হতে হবে তার কোন মানে নেই। তবে আপনি চিন্তা করুন, আপনার যেকোন দ্বিমত আমি সাদরে এবং সহনশীলতার সাথেই গ্রহন করব।
মানবতাবাদ জিন্দাবাদ। গালিগালাজ আর ঘৃণার রাজ মুর্দাবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৪:১০