চমস্কি মনে করেন মানুষ সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে সক্ষম। এখান থেকেই একটা কথা বলতে চাই, কি নামে বা কি প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থা এখানে প্রকাশ করা হল কারণটা সেটা নয়, কারণটা আপনারা যারা নারী ইস্যু নিয়ে নারীকে ফেলে দেন দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের কাতারে তারাও না (মানে তার নিজের কথা বলতে না দেওয়া), কারণটা হল আপনাদের মনস্তত্ত্বে এই বিষয়গুলোর বিরোধিতার ব্যাপারটি ঢুকেছে অনেক আগে থেকেই মানে বিরোধিতাকারীর ছোট বয়স থেকেই মানে তার ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক পর্ব থেকে। তাই লিখাটি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও মেনে নিতে চাই না আপনার মনস্তত্ত্ব। কারণ এই মনস্তত্বই হল পুরুষ, এটাই হল পুরুষতান্ত্রিকভাবে পুরুষের নির্মাণ প্রক্রিয়া। আপনার চিন্তা আর ভাষার মাঝেই সে বেঁচে থাকে আর প্রকাশ হয় আপনার আচরনে। এটাই হল পুরুষতান্ত্রিক ভাষার রাজনীতি। আপনি বুঝবেন কিন্তু আপনি এর স্বপক্ষে চিন্তা করতে নিজের জন্য যথেষ্ট যুক্তি পাবেন না। আপনাকে ক্ষমতা প্রদান করে বা ক্ষমতাবান ভাবিয়ে আপনার মাঝেই ঐ তন্ত্র বেঁচে থাকে। কিন্তু আপনি সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারেন বলে ধর্ষণকে ভাল বলতে পারেন না। কিন্তু এই নিয়ে আপনি অর্থাৎ যে চিন্তা (পুরুষতান্ত্রিক) দ্বারা ধর্ষণ হয় সেটা বিপক্ষে চিন্তাও করতে পারেন না। এটাই হল ক্ষমতার রাজনীতি বা খেলা বা ধাঁধা যেটাকে আপনারা বলেন হিজিমনি।
আবার ঐ পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা “সতী- অসতী” ধারণা তৈরি করেছে। কিন্তু এই সতীত্ব নারীর নিজের কাছে না, সতীত্ব বন্ধি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার কাছে। জোর করে কাউকে ধর্ষণ করবে আর নাম দিবে অসতী। আর নারীকেই গ্রহণ করতে হবে সেই উপাধি। সামাজিক কাঠামোর মাঝে আপনারা যে জেন্ডার ভিত্তিক রাজনীতি শুরু করেছেন অনেক আগে থেকেই তার ছোট ছোট প্রকাশ এগুলো। এই রাজনীতির চর্চা আমাদের পরিবারে,সমাজে, রাষ্ট্রে। আর তাই আপনি ভাবতে থাকেন আপনার মা আপনার বাবার সম্পদ, আপনার বোন আপনার সম্পদ, আপনার বউ আপনার সম্পদ। শুধু সম্পদই না, ব্যক্তিগত সম্পদ। ব্যবহার করেনও সেইভাবে। আপনাদের আছে পূর্বপুরুষ। অথচ পূর্ব কিছু থেকে থাকলে সেটা থাকার কথা ছিল নারীর। কারণ শিশুর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সাথে প্রথম অনুভূতি বিনিময় হয় একজন নারীর সাথে। অথচ সেই শিশুর পূর্বপুরুষ আছে, নেই কোন পূর্বনারী। আমি বলছি না এটা থাকা দরকার, আমি বলতে চাই এটা হল অনেক ছোট থেকে আপনার ভাষার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা কিভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে। আর সেই চিন্তা এখন আপনি নিজের বলে দাবী করেন। অথচ আপনি সৃষ্টিশীল চিন্তক হয়ে সেটা মেনেও নিতে পারেন না। আর আপনি সেটা বুঝতেও পারেন না। এটাই হল ঐ চিন্তার হিজিমনি। এই রকম আরও অনেক চিন্তার রাজনীতিই আপনার মাঝে আছে তা আপনি একটু নিজের মাঝে তাকালেই বুঝতে পারবেন। আপনি বুঝেন কি জানি না, এই পূর্বপুরুষ আমাদের অস্বীকার প্রক্রিয়ার একটা নাম। অনেকটা অবদমনের মতো। নারীর উপর পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার যে আধিপত্য এই পূর্বপুরুষ তারই নিখুঁত নির্মাণ। পুরুষের আইডেন্টিটি টিকিয়ে রাখতেই এই রাজনীতি। এই পুরুষ সেই পুরুষ না, এই পুরুষ আমার মাঝেও থাকতে পারে, আপনার মাঝেও থাকতে পারে, নারীর মাঝেও থাকতে পারে। মাঝে মাঝে মাথা তুলে উঠতে পারে আবার সকল সময় মাথা তুলে থাকতে পারে। আপনার ভাষা আর চিন্তার জগতে কতোটা পুরুষ আধিপত্যশীল ধারণা আছে তা আপনি নিজের মাঝে দেখলেই বুঝবেন। আর সেই ভাষা আর চিন্তার জগত শুধু আপনারই তৈরি তা নয়, এটা আপনার মাঝে ঢুকানো আপনার ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক পর্ব থেকে। আর সেখান থেকেই বাকিটা আপনি জুড়াতালি দিয়ে তৈরি করেছেন নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। আর আপনার এই কাজে আপনার চারপাশ খুব খুশি। কারণ সেই চারপাশও তৈরি ঐ পুরুষতান্ত্রিক ধারণার রাজনীতি থেকে। আর এই চারপাশের মধ্যে পড়ে আপনার শরীর, আপনার চিন্তা, আপনার পরিবার, আপনার পাড়া, মহল্লা, আপনার সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্প, রাষ্ট্র। এখন একজন পুরুষের ধারক হিসাবে আপনি ভাবুন তো আপনি কতোটা নিজের? পুরুষের এই ধারক হতে পারে একজন নারী, একজন পুরুষ, একজন মা, একজন ছেলে, একজন মেয়ে, একজন প্রেমিক, একজন প্রেমিকা, একজন বউ, একজন স্বামী, একজন নেতা, একজন পিতা, একজন শিক্ষক, এমন করে যে কেউ হতে পারে। আপনি হতেও পারেন আবার নাও হতে পারেন, মাঝে মাঝে হতে পারেন, সকল সময় হতে পারেন। পুরুষের ধারক পুরুষতান্ত্রিক সমাজই তৈরি করে। এই তৈরির জন্য সে যেসব ইন্সটিটিউট, স্পেস, মডেল কাজে লাগাই বা তৈরির কারখানা হিসাবে রেখেছে সেগুলোও আপনার হাত দিয়েই বেঁচে আছে। আর পুরুষ তৈরির কারখানাগুলো হল- এমন একটা সমাজ সেখানে যে কেউ যে কারো বাসের মাঝে ধর্ষণ করেতে পারে, ভীরের মাঝে শাড়ি ধরে তান দিতে পারে এমন একটা সমাজ। এই ঘটনা মাঝে মাঝে দেখা দিতে পারে আবার অনেক বেশিও দেখা দিতে পারে এমন সমাজ। দেখা দিলে সেটা নিয়ে আপনারা অনেক প্রতিবাদও করতে পারেন। পুলিশে অপরাধীদের ধরতেও পারে। তবে এই রকম সমাজ মানেই পুরুষ তৈরির কারখানা। পুরুষ তৈরির আর একটা কারখানা হল- আপনার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই সব থেকে বেশি পুরুষ তৈরির কাজ চলে। মানে আপনি যদি নারী হন বা পুরুষ হন, ছোট হন বা বড় হন, ধনী হন বা গরিব হন আপনাকে এখানে এমন ভাবে তৈরি করা হবে যে আপনি চিন্তাগতভাবে পুরুষ হয়ে উঠবেনই। ঠিক এই রকমই এক শিক্ষা ব্যাবস্থা আপনার চারপাশে আছে। আপনি না চাইলেও আপনাকে যে হয়ে উঠতে হবেই। আপনার পূর্বপুরুষ আপনার জন্য রেখে গেছে। আপনিও আপনার পরবর্তী পুরুষের জন্য এমনই ব্যাবস্থা রেখে যাচ্ছেন। কারণ আপনি এখন ঐ সব কারখানা থেকে পুরুষ হয়ে উঠেছেন। সিমন দ্য বুবেহার যেমন বলেছিলেন- নারী হয়ে কেউ জন্মাই না, নারী হয়ে ওঠে। মানে ঐ সব কারখানাই একজনকে নারী করে তোলে। মানে সে কিভাবে চিন্তা করবে, সে কিভাবে খাবে, কতোটা খাবে এই সব আর কি। ঠিক এইভাবেই একজন মানুষ পুরুষ হয়ে জন্মাই না, সে পুরুষ হয়ে ওঠে। মানে ঐ সব কারখানা থেকে বছরের পর বছর পুরুষ তৈরি করা হয়।
পুরুষ তৈরির আর একটা কারখানা হল আপনার চারপাশে যেসব ধর্ম দেখছেন সেগুলো। আপনি চাইলেই এইসব কারখানা থেকে বের হতে পারবেন না। আপনার অনেক ছোট বয়স থেকে আপনাকে এই সব কারখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটি করে আবার আপনার মতোই আপনার পূর্বপুরুষ। এখন আপনই বলেন আপনই কতোটা আপনার? আপনি তো একজন পুরুষ। আবার মাঝে মাঝে হতে পারেন পুরুষ। এই যে পুরুষ তৈরির কারখান হল ধর্ম সেটা আপনি সকল ধর্মকে একটু ভালকরে দেখলেই বুঝবেন। পুরুষ তৈরির কারখানা হিসাবে ধর্ম কিভাবে কাজ করে সেই আলোচনার স্পেস এই লিখা নয়। এখানে শুধু দেখানো হচ্ছে যে আপনি একজন পুরুষ হিসাবে কোন কোন কারখানার প্রোডাক্ট। আপনার রাষ্ট্রের যে প্রচলিত কাঠামো আছে সেটাও পুরুষ তৈরির একটা বিশাল কারখানা। আপনার মাঝে যে সকল ইতিহাস ঐতিহ্য ঢুকানো হয়েছে সেটাও একটা পুরুষ তৈরির কারখানা। পুরুষ তৈরির আর একটা ভাল কারখানা হল আপনার মিথ, রূপকথা, উপকথা। যেমন ধরেন, আপনি রাজকুমার। তাহলে, রাজকুমারীর শরীর দেখে, রূপ দেখে রাক্ষস তাকে ধরে নিয়ে গেছে। রাজকুমারি যে অসহায়। সে তো ফুল বাগানে খেলছিল মাত্র। ওমনি রাক্ষস তাকে ধরে নিয়ে গেল। আর ঘুম পাড়িয়ে রাখলো। আর আপনি তো রাজকুমার। আপনি শক্তিধর। রাজকুমারীর মতো অসহায়কে তো আপনি উদ্ধার করবেন। ক্ষমতা তো আপনারই। একটু ভেবে দেখেন কিভাবে একটা পুরুষ এই সব কারখানায় তৈরি করা হয়। আপনার যেসব শিল্প আছে, যেসব সাহিত্য আছে সেগুলোও পুরুষ তৈরির কারখানা। ভাল করে দেখেন বুঝতে পারবেন। আপনাকে যেসব নীতি কথা, উপদেশ কথা শিখানো হয়েছে সেগুলোও পুরুষ তৈরির কারখানা। একজন পুরুষ হিসাবে আপনি কত জটিল যন্ত্রের প্রোডাক্ট। এই সব যন্ত্রগুলো এক ধরণের ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা হল পুরুষ। এই রকম শত শত পুরুষ তৈরির কারখানা আপনার চারপাশে। আপনাকে তাই দোষ পুরটাই দেওয়া যায় না। তবে আপনি সম্পূর্ণভাবেই আপনার না। আপনি হলেন আপনাদের তত্ত্বের ভাষায় একটা এজেন্ট, একটা মিডিয়া, একটা প্রোডাক্ট। আর এটাই হল পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহাসিক হিজিমনি। আপনি আছেন কিন্তু আপনি বুঝেন না। আপনি বুঝেন কিন্তু আপনি মানতে পারেন না। আপনি চাইলেই আপনার হতে পারেন না।
পুরুষ তৈরির কারখানার কথা বাদ দিয়ে এখন আসি অন্য ব্যাপারে। তবে একটা কথা বলে রাখি যে প্রোডাক্ট হিসাবে পুরুষ কিন্তু খুবই জটিল, জটিল ক্ষমতার যন্ত্র, ক্ষমতা প্রয়োগের জটিল এজেন্ট। সহজে ধরা যায় না। আপনার মাঝে আছে কিন্তু আপনি ধরতে পারবেন না। মজার ব্যাপার হল এই পুরুষ হতে পারে আপনার বিজ্ঞান, আপনার দর্শন, আপনার তত্ত্ব, আপনার জ্ঞান। সেখানে কিন্তু আপনি নারীকে পাবেন না। যতটা পুরুষ পাবেন ততটা নারীর পাবেন না। বলে রাখি এই পুরুষ কিন্তু আপনার যা যা দেখা যায় সেটা নয়, এই পুরুষ হল আপনার চিন্তা,ভাষা, আচরণ, প্রবণতা, প্রতিক্রিয়ার ধরণ। মানে যেই চিন্তা আপনাকে আর একজনের শাড়ি ধরে টান দিতে প্রলুব্ধ করে, আপনাকে বলে যে আপনিই উত্তম। তবে খুব সাধারণভাবে বা স্থুলভাবে আমি আর একটা কারখানার কথা বলতে চাই যারা যুগের পর যুগ সম্প্রদায় ভিত্তিক পুরুষ তৈরি করে যাচ্ছে। সেটা হল আপনার পূর্বপুরুষের জ্ঞানতত্ব। এখানে আমি আপনাকে দেখাতে চাই যে, আপনার যে বাউলতত্ত্ব আছে সেটাও একটা পুরুষ তৈরির কারখানা। বাউলতত্ত্বের মতো আর যেসব জ্ঞানতত্ত্ব আছে সেগুলো সবই পুরুষ তৈরির কারখানা। তবে ঐতত্বগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য আপনার আমার মতো পুরুষ তৈরি নয়। তাদের উদ্দেশ্য পরমকে পাওয়া। তবে এই পাবার জন্য তারা পুরুষ হয়ে ওঠে। তবে তাদের মরমী আচরনের উদ্দেশ্য থাকে নারীর হয়ে ওঠা। বাউলতত্ব নারীর অনেক স্বাধীনতা দেয় তবে তা তাদের তত্ত্বের অনুগামী পথ হিসাবে। এখানে আমি বাউলতত্ত্বের সমালোচনা করছি না। সেটা ভিন্ন ব্যাপার। এখন যে কথা বলবো যে, বাউলতত্ত্বের নারীরকে দেখা হয় একটা পথ হিসাবে। নারীর হল সাধুর সাধনার পথ। এই পথ বেয়ে সে পরমকে উপলব্ধি করে। মানে নারীর তার সাধনার পথ মাত্র। সেখানে যান আপনাকে পুরুষ বানিয়ে ছাড়া হবে। আর একটু খুলে বলি বাকিটা আপনি ওখানে গিয়ে পুরুষ হলেই বুঝবেন। বাউল ঊর্ধ্বরসের সাধনার জন্য রাতের পর রাত নারীর শরীর নিয়ে পড়ে থাকে। নারীর আবেগ, শরীর আর অনুভূতি নিয়ে যে সাধনার খেলায় মত্ত হয়। নারীর শরীরের জ্ঞানতাত্ত্বিক গুরুত্ব বাউলের কাছে থাকতে পারে কিন্তু নারীর জায়গা থেকে দেখলে তার অর্থ হয়ে যায় ভিন্ন। এই রকম নানা ধরণের পুরুষ তৈরির কারখানা আপনার চারপাশে আছে। সেগুলো ব্যক্তি ভেদে ভিন্নও হয় তাই চিনে নিতে হবে ব্যক্তিকেই কারখানাগুলোকে।
আপনার চিন্তার গড়নটা পুরুষতান্ত্রিক, পুঁজি প্রেষিত পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞান ক্ষমতা সম্পর্কের কারনে। ঐসব কারখানা থেকে একটা ভাল প্রোডাক্ট হিসাবে আপনি প্রায় পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে তাদের জেন্ডারগত পরিচয়ের কারনে আপনি তাদের মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চান। আপনি সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারেন কিন্তু আপনি আমার এই লিখার প্রতিটা লাইনের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন কারণ আপনি পুরুষ। আপনি চাইলেও আপনি এই লিখাটি মেনে নিতে পারবেন না কারণ আপনার মাঝে আপনার থেকেও বড় হয়ে উঠেছে অন্য একজন যাকে আমরা পুরুষ বলছি।
আপনার চারপাশে এতো যে পুরুষ নারী তৈরির কারখানা তাপরেও আমি মনে করি মানুষ হিসাবে প্রত্যেকের আইডেন্টিটি তার স্থান থেকে দেখার একটা সাইন দেখা যেতে পারে। আমি মনে করি না নৃবিজ্ঞানে মাতৃতান্ত্রিকতার উৎস খুঁজার যে চেষ্টা চলছে তা সম্পূর্ণ সঠিক।
আমাদের কর্পোরেট মিডিয়া পুরুষ তৈরির এক নয়া কারখানা। আপনি যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক কারখানায় তৈরি একটা পুরুষ এজেন্ট, আর এই রাষ্ট্র যেহেতু পুরুষের তৈরি তাই আপনি এই রাষ্ট্র,সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য সকল কিছুর মালিক। এই পৃথিবীটাই আপনার। এটা হল পুরুষ পৃথিবী। তবে আপনি কিন্তু আপনার না, আপনি বহুকালের ধারাবাহিকতায় আপনার পূর্বপুরুষের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার এজেন্ট মাত্র। তবে আপনি চাইলেই আপনার হয়ে উঠতে পারেন, মানে আপনার পাশে যে মানুষটা আছে মানে যাকে আপনি আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ ভাবেন মানে নারী তাকে মানুষ ভাবতে শেখেন।
মাঝে মাঝে আমার এক বন্ধু পুরুষের তৈরি নারীর মুখের একটা গান করে- “আমি হলাম গরম চা, আমারে ফু দিইয়া খা...” এ গান আপনার গান, আপনার চা তো চারপাশে যাদের আপনি নারী বলেন। আপনি চাইলেই খেতে পারেন। একজন নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলেও সে আপনার কাছে একটা গরম চা। এবার নববর্ষের অনুষ্ঠানে একটা গান শুনলাম একটা পুরুষ প্রোডাক্ট এ মানে টিভিতে। গানটা এমন- “যতই ঘুড়ি উড়াও রাধে, নাটাই তো আমার হাতে...”। নারী যাই করুক না কেন আপনি একজন পুরুষ হিসাবে ভাবেন সে আপনার হাতে বন্ধি নারী। আপনি মানুষ হিসাবে সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারেন তারপরেও আপনি এমন করে ভাবেন। নারী শিক্ষিত হোক, নারী অধ্যাপক হোক, নারী বড় লেখক হোক, নারী খেলোয়াড় হোক, নারী বিজ্ঞানী হোক, নারী গবেষক হোক, দার্শনিক হোক তারপরেও আপনি ভাবেন যে নারী আপনার হাতে বন্ধি। কারণ আপনি মনে করেন যে ক্ষমতা আপনার, কারণ এই পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিনিধি আপনি, আপনাকে সে তৈরি করেছে বছরের পর বছর ধরে, আপনি তো এমনটাই ভাববেন। তবে পুরুষ হিসাবে আপনি জেনে রেখেন, আপনি যতটা নিজেকে নিজের ভাবছেন আপনি কিন্তু ততটা নিজের না।
একটা মোটরসাইকেলও ক্ষমতার প্রতীক মানে পুরুষের প্রতীক আপনার কাছে। টিভি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়। একজন কি একটা মোটরসাইকেল চালায় আর দলে দলে মেয়েরা সব তার দিকে ছুতে আসতে থাকে। একটা মেয়ে নয়, দুইটা মেয়ে নয় সাত আটাটা মেয়ে। তিব্র পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব কাজ করেছে এই বিজ্ঞাপন নির্মাণে। কারণ এভাবেই তো আপনি নারীকে দেখেন। আপনি বিজ্ঞাপনগুলোকে একটু ভাল করে দেখেন ওখানে মানুষ হিসাবে নারীর কোন স্বকীয় সত্তা নেই, আছে শুধু শরীর, আছে শুধু আপনি তাকে যেভাবে দেখতে চান সেটা, আছে শুধু যৌনতার বস্তু হিসাবে নারী। আর বিজ্ঞাপনে আপনি আছেন রাজার মতো, পুরুষ হিসাবে, ক্ষমতা হিসাবে, কতৃপক্ষ হিসাবে। আপনি একটু বিজ্ঞাপনগুলো ভাল করে দেখন। ওখানেও আপনার মতো পুরুষ পাবেন। ঐ জগতও আপনার একান্ত দখলে। আমি এখানে সাইলকের বাণিজ্য বিস্তারের মতো করে- আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, অনুভূতি, প্রেম, ভালবাসা, আবেগ, হাসি, কান্না সব কিছু বাজারে বিক্রি হয়। এটাই হল বর্তমান পুঁজির বাজার। এখানে সব কিছু পুঁজি। নারীকে নিয়েও আপনার পুঁজির ব্যবসা চলে। তবে আপনার সব থেকে বড় পুঁজি আপনার ভিতরের পুরুষ। আপনি নিজেও পুঁজি এখানে। কিন্তু সেটা আপনি বুঝেন না। এটাই হিজিমনি। এখানে আপনি একজন পুরুষ হিসাবে নারীর স্বপন বিক্রি করেন। অন্য পুরুষ সেই স্বপনের গ্রাহক আবার। খেলা তো করেন আপনারা পুরুষে পুরুষে। পুরুষ হিসাবে আপনি বাজার থেকে নারীর শরীর ও অনুভূতি কিনে আনেন অনেক দামাদামি করে। আপনি সুগন্ধি কিনেন নাকি ঐ সুগন্ধির কৌটাই যে আধানগ্ন নারীর ছবি আছে সেটা কেনেন তা আপনিই ভাল জানেন। আপনি যে গাড়ি কিনেন আপনি কি শুধু সেই গাড়িটাই কিনেন নাকি গাড়ির পাশে যে নারীকে দাড় করিয়ে রাখা হয় তাকেও কিছুটা কিনেন? এইভাবে হাজার হাজার নারীকে আপনি কিনেন প্রতিদিন। আপনি কিন্তু বাজার থেকে হতাশাও কিনে আনেন। আপনি কিন্তু বাজার থেকে আধুনিকতাও কিনে আনেন যেমন- জিন্স, টি শার্ট, শর্টস। আপনি যৌনতাও কিনে আনেন বাজার থেকে যেমন সিনেমা, ব্লু ফিল্ম। নারীর ও পুরুষ হিসাবে আপনি আপনার সবটাই বাজারে রেখে এসেছেন। তারপরেও আমি বলি আপনি তো সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারেন, তাহলে আপনি নিজেকে একবার দেখেন ভাল করে। আপনার চোখ থ্রী এক্স দেখে, আপনার হাত অকারণে ক্ষমতার চর্চা করে। আপনি চাইলে আপনার চোখে আরও অনেক কিছু দেখতে পারে, একজন নারীকে মানুষ হিসাবে দেখতে পারে। কিন্তু আপনি তা পারবেন না। কারণ আপনার বলে আর কিছুই নেই। এমন কি আপনার হাতটা পর্যন্ত উপরে তুলার ক্ষমতা নেই যদি আপনি রেক্সোনা না ব্যবহার করেন। আপনার ইচ্ছে আর স্বাধীনতাও বিক্রি হয় বাজারে। বাংলালিংক একটেল বিক্রি করে তাদের মতো করে আপনার স্বাধীনতা। আর ইচ্ছে তৈরি করে মিডিয়া, ইচ্ছে তৈরি করে বাজার। বাজার হল আপনার থেকেও বড় পুরুষ। আপনার কারখানা পুরুষ। সে অনেকটা আপনার ঈশ্বরের মতো। মিডিয়া নির্ধারণ করে দিবে আপনার ইচ্ছে মানে আপনি কি খাবেন, কেমন করে ঘুমাবেন, কি পরবেন এমন কি কেমন নারীকে নিয়ে বিছানাতে যাবেন। আপনি মনে করছেন পুরুষ হিসাবে আপনি স্বাধীন। কিন্তু না। আপনাকেও আসলে কামলার মতো খাটিয়ে নেয়া হচ্ছে। আসলে পুরুষতন্ত্র হল এখানে একটা প্রক্রিয়া। ব্রিটিশ, পাকিস্থান থেকে আপনি মুক্ত হয়েছেন কিন্তু বাংলালিংক গ্রামীণ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে আপনি আবার বন্ধি। আপনি পুরুষ তাই এগুলোতে আপনার সমস্যা হবার কথা নয় কারণ এগুলোই আপনি।
কিন্তু পুরুষ বাদে আপনি একজন প্রেমিক হতে পারেন। আপনি সত্যিকারভাবে ভালবাসতে পারেন মানুষকে। আপনি সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারেন। বাজারের বাইরেও ভালবাসা আছে, প্রেম আছে, বন্ধুত্ব আছে। ভালবেসে আপনি কারো হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে পারেন, দুপুরের খাবার একসাথে সস্তা হোটেলে বসে দুজন খেতে পারেন ভাগাভাগি করে। আপনি যখন নিজেকে পুরুষ ভাবেন, তখন আপনি আপনার পাশের মানুষকে মানে নারীকে একজন নিম্নবর্গ ভাবেন। কিন্তু আপনি তো সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৫৭