বাঙালি একটা সময় পেয়েছে সবই, হয়ত বাকিদের তুলনায় কিছু ক্ষেত্রে বেশিই পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল বাঙালি ধরে রাখতে পারেনি তার পাওয়া অমূল্য রতন, বাঙালি হারানোর পরে বুঝতে পারে, কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এই তালিকায় অবশ্যই আসবে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন ওরফে সালমান শাহ্ এর নাম।
সেপ্টেম্বরের ছয় তারিখ আসলেই আমরা ফিরে যাই ১৯৯৬ সালের বিকাল চারটার বিটিভির খবরে, যেখানে খবরের মাঝে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার গান দেখিয়ে বলা হয়- সালমান আর নেই। সেই শুন্যতা আর না থাকাটা আজও পূরণ হয়নি, হবেও না।
প্রতি বছর এই সময়ে সালমানকে নিয়ে টুকটাক লিখলেও আজ লিখব সালমানের এক "মৃত্যুকঠিন" বা ডাইহার্ড ফ্যান বা ভক্তকে নিয়ে।
সালমান যখন মারা যান, তখন চাঁদপুরের বাসিন্দা এই ফ্যান মাত্র ক্লাস এইটে পড়েন। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, বিশ্বাস হওয়ার মত কথাও না এটা। তাও আবার আত্মহত্যা- অসম্ভব! কিসের অভাব ছিল সালমানের যে তাকে আত্মহত্যা করতে হবে? ঢাকা থেকে আসা যেকোনো মানুষকে পেলেই জানতে চান সালমানের সম্পর্কে। একটা সময় অতি কষ্টে মেনে নেন যে সালমান আর নেই।ছোট মানুষ তখন তিনি, কিন্তু সালমানের প্রতি তার ভালোবাসার উচ্চতা ছোট ছিল না মোটেও। নিজের গ্রামে গড়ে তুললেন সালমান শাহ্ ফ্যান ক্লাব। সালমানের ভিউ কার্ড, পোস্টার দিয়ে ভরিয়ে ফেললেন পুরো ফ্যান ক্লাব। সালমান শাহ্ ইন্ডাস্ট্রিতে আসার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে নিয়ে যত আর্টিকেল বাংলাদেশের যত পত্রিকায় ছাপা হইসিল, সব, একদম সব তার সংগ্রহে ছিল! "ছিল" কেন বলছি?
কারণ তার বাবা একদিন "ছেলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এগুলো করে" মনে করে ওই ক্লাবের সমস্ত পোস্টার আর ভিউ কার্ড অর্ধেক পুড়িয়ে ফেললেন আর বাকি অর্ধেক পানিতে ফেলে দিলেন। তার মা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন, নিজের বাবার এই কাণ্ড দেখে রাগে হতবুদ্ধি হয়ে তিনি পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ঢাকায় চলে আসেন। আজ পর্যন্ত তিনি তার বাবার সাথে এই ঘটনার কারণে কথা বলেন না।
সালমানের প্রতি তার এরকম অদ্ভুত ভালোবাসার একটা কারণ আছে। তিনি সেরকম ভাগ্যবান মানুষদের মাঝে একজন যিনি সালমান শাহ্ এর সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন তাও সেই ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে। তার এক মামা জাদুঘরের কিউরেটর হিসেবে ছিলেন, সেখানের এক প্রোগ্রামে সালমান আসেন। তার মামা তাকে কাছে ডেকে বলেন- দেখ তো চিনিস কিনা।
মাথায় হ্যাট পড়া, চোখে সানগ্লাস, ডান হাতে ঘড়ি আর ব্রেসলেট, পায়ে জিন্স আর কেডস পড়া সেই যুবককে ক্লাস এইটে সদ্য ওঠা বালক চিনতে পারল না , যদিও সে তার সেই লেভেলের ফ্যান! তখন তার মামা তাকে বললেন- আরেহ! এই তো সালমান, ওই যে, কেয়ামত থেকে কেয়ামতের!
দেবতাকে চোখের সামনে দেখলে পূজারীর যেই অবস্থা হয়, তার অবস্থা হল অনেকটা সেরকম। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকলেন। সালমান তাকে কাছে টেনে নিলেন আর জিজ্ঞেস করলেন- কোন ক্লাসে পড়? "ক্লাস এইট"- ছোটো কিন্তু স্পষ্ট জবাব। "ঠিক আছে, ভালমতো পড়াশুনা কইর কিন্তু" এটা বলে সালমান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর কাঁধে হাত রাখলেন। এরপর চলে গেলেন। কিন্তু ক্লাস এইটের সেই ছোটো ফ্যানের ভিতরে যেই ভালোবাসা ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন, সেটা দিনে দিনে বাড়তেই লাগলো।
ঢাকায় আসার পর তিনি নিজের উপার্জনের জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করলেন। থাকা খাওয়া বাদে যা টাকা থাকত- সব সালমানের পোস্টার আর ভিউকার্ড সংগ্রহের জন্য ঢেলে দিতেন কোন কার্পণ্য ছাড়াই। এমনও হয়েছে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে কোন সেলুনের বাইরে সালমান শাহ্ এর ছোটো একটা পোস্টার দেখেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেটা তিনি কিনে নিয়েছেন, যত টাকাই লাগুক না কেন। এবার আর আগের মত ভুল করলেন না, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিলেন, সব ছবি ল্যাপটপে সুরক্ষিতভাবে রাখতে শুরু করলেন নতুন করে। কিন্তু বিধিবাম! তার অফিসের নানান জিনিসপত্রের সাথে আর সেই ল্যাপটপ চুরি গেল!
আবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি, এখনও চলছে সংগ্রহ। ফেসবুকে আসেন একটা কারণেই- সালমানকে নিয়ে কিছু পোস্ট করার জন্য। ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছেন, তিনিও সালমান শাহ্ বলতে পাগল- সেই সূত্রেই প্রেম ও বিয়ে। ঢাকায় নিজের ছোটো ঘরের দেয়াল ভরিয়ে ফেলেছেন সালমানের পোস্টে। সালমান শাহ্ মারা যাওয়ার পর থেকে আজ ১৯ বছর পর্যন্ত তিনি এফডিসি, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে যত জায়গায় লেখা যায়, সব জায়গায় সালমান শাহ্ স্মরণে একটি সড়ক আর এফডিসিতে একটি ভবনের নামকরণ সালমানের নামে করার জন্য চিঠি লিখেই যাচ্ছেন, লিখেই যাচ্ছেন। সবাই তাকে আশা দেয়, ভরসা দেয়- কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেও তাকে কিছুই দেয় না।
পত্র পত্রিকায় তিনি বহু লেখালেখি করেছেন সালমানের মৃত্যু বিষয়ে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন সালমানকে হত্যা করা হয়েছে। তার বক্তব্যের পক্ষে তার কাছে বেশ শক্তিশালী যুক্তিও রয়েছে। দেখতে ছোটখাটো আর অসম্ভব বিনয়ী এই মানুষটার নাম মাসুদ রানা নকিব (Masud Rana Noqib)
আমি তার প্রথম খোঁজ পাই আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে কালের কণ্ঠের এক রিপোর্টে। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এই লেভেলের কোন ফ্যান থাকতে পারে। অনেক কষ্টে তাকে ফেসবুকে খুঁজে পাই। অবশেষে গত পরশু আমার রেডিওর সিনেমার শোতে তাকে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি অসুস্থ ছিলেন, এরপরেও শুধু "সালমানের" উপরে একটা শো হবে বলামাত্রই তিনি চলে আসেন, তাও নির্ধারিত সময়ের তিন মিনিট আগে।
এরকম একজন মানুষের সাথে দেখা করাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে হয়। মনে হয় যেন তার মাঝেই সালমানকে দেখতে পাচ্ছি। আমার জন্য এর চেয়েও বড় এক সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল, নকিব ভাই আমার জন্য সাংবাদিক সুপন রায়ের সেই সময়ে লেখা বই "সালমান শাহ্র অজানা কথা" (মাওলা ব্রাদার্স, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭, বেশ রেয়ার একটা বই, বইমেলাতে খুঁজে পাই নাই) নিয়ে এসেছেন। বাসায় এসে বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়া শেষ করলাম। শেষ যখন হল তখন বাজে রাত চারটা।
এই বইটা সবাই যদি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে সালমানকে নিয়ে কত নোংরা রাজনীতি করা হয়েছিল। কীভাবে কিছু মানুষ তার কাছ থেকে ফায়দা করত। কীভাবে তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করত। সালমানের বউয়ের ভাষ্যমতে সালমান আত্মহত্যা করেছিলেন আর তার মা নীলা চৌধুরীর ভাষ্যমতে সালমান কে মেরেছেন সামিরা।
কিন্তু যেই মানুষটা খ্যাতির এত শীর্ষে, মারা যাওয়ার আগের দিনও যিনি এফডিসি গিয়েছেন, সন্ধ্যায় সাংবাদিকের সাথে কথা বলেছেন (এই সুপন রায়), রাতে ডাবিং করে বাসায় ফিরেছেন, ১৫ আর ১৭ সেপ্টেম্বর কোথায় শুটিং করবেন সেটা নিয়ে আলোচনা করেছেন, নতুন কি কি সিনেমা করবেন সেগুল নিয়ে আলোচনা করেছেন- তিনি কি আসলেই আত্মহত্যা করতে পারেন? মৃত্যুর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেও তিনি চলাফেরা করেছেন আর বলেছেন তাকে ডিস্টার্ব না করতে। ঘুম থেকে উঠে কি কেও আত্মহত্যা করে? সাইকোলজি কিন্তু সেটা বলে না।
ফরেনসিক রিপোর্টে প্রথমবার আসে সালমান আত্মহত্যা করেছেন। তার বাবা মা আরেকবার আবেদন করলে কবর থেকে আরেকবার লাশ উঠিয়ে পরীক্ষা করান হয়, কিন্তু সেই পরীক্ষার রেজাল্ট আর বলা হয়নি- এর রহস্য কি?
সালমানকে নাকি তার রুমে সিলিং এর সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। অথচ তার দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় কোন প্রতিবেশী, সালমানের বাবা মা কিংবা পুলিশকে দেখান হয়নি। দড়িতে ঝুলার পরেও তার জিব্বা বের হয়নি। দড়ি কেটে তাকে নামানোর পরেও তার শরীর কিছুটা গরম ছিল এবং বাসার কাজের লোকেরা তার শরীরে তেল মালিশ শুরু করে। শরীর গরম মানে শরীরে প্রাণ ছিল- কিন্তু দড়িতে ঝোলার পরেও এতক্ষন কীভাবে প্রাণ থাকে? থাকলে ডাক্তার না ডেকে তেল মালিশের মানে কি? মৃত্যুর দিন সকালে সালমানের বাবা সেই বাসায় গিয়েছিলেন, কিন্তু ইন্টারকমে তাকে ঢুকতে বাধা দেয়া হয় যেটা এর আগে কখনো ঘটেনি। সালমানের রুমের ফোনের সাথে যেই আন্সারি মেশিনটি ছিল, সেটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সালমানের লাকেজে ভেজা কাপড়চোপড় সহ JASOCANE- A 20mg চেতনানাশক ক্যাপস্যুল কীভাবে এসেছিল তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
আর আত্মহত্যার পক্ষে বললে- একজন মানুষ এমনি এমনি আত্মহত্যা করবেন না। তার আশেপাশের মানুষ অনেকাংশে দায়ী ছিলেন তার জীবনকে বিষিয়ে তোলার জন্য, আত্মহত্যা করলে সেখানে তাদের দায়ভারও বর্তায়। "আমার মৃত্যুর জন্য কেও দায়ী নয়"- এরক্ম একটা চিরকুট পাওয়া যায় সালমানের মৃতদেহের পাশে। সালমানের বাবা মা বলেছিলেন- এই হাতের লেখা সালমানের নয়, যদিও সেই অভিযোগ যাচাই করে দেখা হয়নি।
যারা বলেন- সালমান আগে স্টার ছিল, মরার পরে সুপারস্টার হয়েছে, তাদের কথা বেশ অদ্ভুত লাগে। সালমানের আগেও অনেকে মারা গিয়েছেন এই দেশে, জাফর ইকবাল তার মাঝে অন্যতম, তিনিও কম স্টাইলিশ ছিলেন না। কিন্তু সালমান কে নিয়ে যেই ধরনের পাগলামি দেখা যায়, সেটা এখনও আর কাওকে নিয়ে দেখা যায়নি, দেখা যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। সালমানই একমাত্র বাংলাদেশী নায়ক যার মৃত্যুতে চারজন মেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি একমাত্র শিল্পী যিনি সেই আমলে লাগেজ নিয়ে এফডিসিতে শুটিং এ আসতেন, আর সেই লাকেজে কি ধরনের স্টাইলিশ জিনিসপত্র ছিল সেটা আমরা সবাই দেখেছি। বিদেশে তিনি জেতেন একটা বা দুইটা লাগেজ নিয়ে আর ফেরত আসতেন সাতটা বা আটটা নিয়ে।
তিনিই একমাত্র নায়ক, যাকে নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২৩ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন করে।
যাই হোক না কেন, বইটা সবাই পড়ার চেষ্টা করবেন, মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করবেন। আশা করি সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই।
মাসুদ রানা রকিবের এখন ইচ্ছা হল সালমান শাহ্ এর নামে একটি ওয়েব পোর্টাল করা যেখানে সালমানের সব কিছু থাকবে, যেখান থেকে তরুণ প্রজন্ম জানবে- শুধু হলি বা বলিতে না, তাদের নিজের দেশেও ছিল এমন একজন মানুষ যে সেই সময়ে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিল। আর একটা ইচ্ছা তার, সালমানের নামে একটি পাঠাগার করবেন। সালমানের মৃত্যু নিয়ে লেখার কারণে বেশ কয়েকবার হুমকি পেয়েছেন তিনি, কিন্তু এরকম ভক্তের কাছে এইসব হুমকির কি কোন বেইল থাকে?
শুভ কামনা মাসুদ রানা নকিবের জন্য। একটা জিনিস খেয়াল করেছেন ছবিতে? এই মানুষটা ডানহাতে ঘড়ি পড়েন, যেমন পড়তেন আমাদের নায়ক সালমান শাহ্- এই না হলে ভক্ত?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৪