"পিঁপড়াবিদ্যা"র কথা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
সিনেমার নাম- পিঁপড়াবিদ্যা ( Ant Story)
অভাগা যেদিকে তাকায়, সাগর শুকিয়ে যায়- গল্পের প্রধান চরিত্র মিঠু এর ক্ষেত্রে এই কথাটা যায়। লেখাপড়া করা বেকার ছেলে, চাকরি নামক সোনার হরিণটা কিছুতেই তার কাছে ধরা দিচ্ছে না- সবকিছুই অসহ্য লাগে এই সময়টাতে। শিক্ষিত ছেলে বলে তিনি "যেনতেন" কিছু করবেন- এটাও ঠিক না। ভাগ্যদেবী একদিন কিছুটা মুখ তুললেন- লাকি সেভেন নামের এক এমএলএম কোম্পানিতে কাজ পেল মিঠু। কোম্পানিতে যোগদানের পড়ে বসের দেয়া অল্প কিছু টাকা দিয়ে সে একটি মোবাইল ফোন কিনতে যায় । দোকান থেকে মোবাইল কেনার বদলে চুরি হওয়া একটি মোবাইল চোরের কাছ থেকে কম দামে কিনে নেয় সে। মোবাইলটা আসলে ছিল অভিনেত্রী রিমার। মোবাইলে ছিল রিমা আর তার বয়ফ্রেন্ড অয়নের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের একটি ভিডিও। এই ভিডিও দিয়ে মিঠু রিমাকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে। গোবেচারা টাইপ যেই ছেলে প্রায় কথাই বলে না, সে ছেলেটিই একসময় অন্যদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁদের জন্য ফাঁদ তৈরি করে- সাধারণ পিঁপড়ার পাখা মেলতে থাকে আস্তে আস্তে। এই ফাঁদ কি সফল হবে নাকি নিজের তৈরি ফাঁদে মিঠু নিজেই জড়িয়ে যাবে- সেটা জানতে হলে দেখতে হবে পিঁপড়াবিদ্যা।
একেবারেই ডিফারেন্ট স্টোরি( আমাদের দেশের সিনেমার কনটেক্সট এ) কিন্তু তারপরেও খুব চেনা, একদম আমাদের আশেপাশের। এই কাহিনীর এত সুন্দর প্রেজেন্টেশন ছবিকে উপভোগ্য বানিয়ে দিয়েছে। স্ক্রিনপ্লে অ্যান্ড ডিরেকশন- অসাম। ফারুকির কাজের মান তার প্রত্যেক সিনেমার সাথে সাথে একটু একটু করে ভালো হচ্ছে। অভিনয়ে সবাই দারুণ। রিমা চরিত্রে শিনা চৌহান বেশ ভালো। পশ্চিমবঙ্গের একজন অভিনেত্রীকে নিজের প্রথম বাংলাদেশি সিনেমাতে এত সাবলীল বাংলা বলতে দেখে বেশ ভালো লেগেছে। শিনা চৌহানকে কেন নেয়া হল সিনেমাতে- বলে যেই বিতর্কের পাহাড় গড়ে উঠেছিলো, সেই পাহাড় শিনা গুড়িয়ে দিয়েছেন নিজের অভিনয় দিয়ে। তার অভিনয়ে বেশ পরিমিতবোধ আছে। মূল চরিত্রে নূর ইমরান মিঠু- দারুণ! বোঝার উপায় নেই এটি তার প্রথম সিনেমা। এক ক্যারেক্টারের জন্য তিনি ছিলেন পারফেক্ট! তার কমেডি টাইমিং মুগ্ধ করার মতো।মিঠুর মায়ের চরিত্রে অভিনয়কারী বেশ ভালো, রিমার প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয়কারী আরজে ও ডেন্টিস্ট সাব্বির উতরে গেছেন। সিনেমার সংলাপ অসাধারণ, হাস্যরসে ভরপুর, একদম মেদহীন ঝরঝরে। ভাঁড়ামি ছাড়াও শুধু সংলাপ দিয়ে যে দর্শককে হাসানো যেতে পারে- এই সিনেমার সংলাপ তার উদাহরণ। মিঠুর সাথে তার প্রাক্তন প্রেমিকার স্বামী রিদওয়ান এর সাথে মোবাইলে কথোপকথনের দৃশ্যগুলো অনেক বেশি আনন্দ দেয়। স্বামী চরিত্রে এই লোকের অভিনয় বেশ ভালো। "লেজে রাখা পা" গানটার লিরিক, গায়কী এর জন্য চিরকুটকে বিশেষ ধন্যবাদ না দিলেই নয়। দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের জন্য ধন্যবাদ হৃদয় খান, আরমান হক আর চিরকুটকে। সিনেমেটগ্রাফি দারুণ- এই ক্ষেত্রে গোলাম মাওলা নবির কাজের প্রশংসা আলাদা করে না করলেই নয়।
প্রথম অংশ যত দুর্দান্তভাবে আগায়, দ্বিতীয় অংশের শুরুর দিকে সিনেমা একটু ঝুলে যায়- যদিও পরে ট্র্যাক এ চলে আসে। মোবাইল চুরি যাওয়ার পরে এত তাড়াতাড়ি কীভাবে রিমা মিঠুর নাম্বার পেয়ে তাকে ফোন দিয়ে ফেলে বা দ্বিতীয় অংশে যখন মিঠুকে একটি দোকানে থাকতে হয়, সেই দোকানের মালিকের সাথে মিঠুর সম্পর্ক কি, কবে সে এখানে আসলো, কি বলে সে উঠেছে- এগুলো আরও ডিটেল দেখালে মনের মধ্যে খচখচ করত না। কালার গ্রেডিং এ কিছু সমস্যা আছে বলে মনে হয়েছে। এগুলো ছাড়া এই সিনেমার আর কোন নেতিবাচক দিক খুঁজে পাই নি।
সিনেমার এন্ডিং নিয়ে অনেকে অভিযোগ করেছেন, অনেকের কাছেই পছন্দ হয়নি, ফারুকি যেন হঠাৎ করে শেষ করে দিলেন সিনেমা। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এই ফিনিশিং ই কেন জানি অনেক বেশি ভালো লেগেছে। নিজে ঠিক না করে দিয়ে, দর্শকের হাতে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেয়া, নিজে শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়ার কারণে ফারুকিকে ধন্যবাদ। বিবাহপূর্ব শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে ফারুকির কোন ধরনের লেকচার দেয়ার চেষ্টা ছিল না- এটা বেশ ভালো লেগেছে।
পিঁপড়াবিদ্যা কেমন? অবশ্যই ভালো, বেশ ভালো। অনেক উপভোগ্য সিনেমা। প্রাণখুলে হাসার সিনেমা। একই সাথে বেদনার সিনেমা, চিন্তার উদ্রেককারী সিনেমা, বাস্তবতার দিকে আঙ্গুল তাক করা সিনেমা। আমাদের দেশের শিক্ষাজীবন শেষ করে বেকার ছেলেগুলোর জীবনের হতাশা, দুঃখ, কামনা, ঠাট্টা, স্বপ্ন- সবই পাবেন পিঁপড়াবিদ্যাতে। এমএলএম ব্যবসা এবং পরে এই ব্যবসার উপরে সরকারের নিষেধাজ্ঞা- কত তরুনের জন্য, কত মানুষের জন্য যে কি পরিমাণ অভিশাপ বয়ে এনেছে, তা এই সিনেমাতে পাওয়া যায়। তাঁদের কষ্টটা বোঝা যায়। সবার জন্য মাস্ট ওয়াচ, বেকার ভাইদের জন্য অবশ্যই। তবে সিনেমা দেখার মতো "বিলাসিতা" বেকার ভাইরা করেন কিনা বা করবেন কিনা- সেটাও একটি প্রশ্ন। তবে করলে মনে হয়না ভুল করবেন, অন্তত এই সিনেমার ক্ষেত্রে। পুরো সিনেমাতে কোন কাজ না করে একদম শেষের দৃশ্যে মিঠুর বোন চরিত্রে অভিনয়কারী মেয়েটি যখন বলে "ভাইয়া, তুই কি আসলেই নাকি...?" - তখন বাস্তবতার নির্মম চিত্র আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়।
দেখে আসুন পিঁপড়াবিদ্যা- দলে- বলে- হলে। হ্যাপি ওয়াচিং
পুনশ্চ- পিঁপড়াবিদ্যা সিনেমা নিয়ে অনেক বলেছি, একটা মজার জিনিস শেয়ার না করে পারছি না...
হলে বসে দেখছিলাম সিনেমা, আমার পিছনে একজন রিকশাওয়ালা শ্রেণীর ব্যক্তি বসেছেন (তার কথা শুনেই বুঝেছিলাম, রিকশা করে কত আয় করেছেন আজকে সেটা নিয়ে কারো সাথে কথা বলছিলেন)। যাই হোক, সিনেমা চলার সময় তিনি কিছুক্ষণ পড় পড় প্রতিটা দৃশ্য সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করছিলেন- কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলাম, আবার খুশিও লাগছিল যে যিনি একেবারেই আলাদা ধরনের সিনেমা দেখে অভ্যস্ত, তিনি এই সিনেমা বেশ উপভোগ করছেন আর তার মত দিয়ে যাচ্ছেন। তবে সিনেমা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে তিনি যেই মত দিলেন, সেটি শুনে আমি হতবাক না, পুরো "নিহতবাক" হয়ে গেছিলাম। তিনি বললেন-
"ভালা সিনেমা বানাইসে রে! এমএলএম কোম্ফানিরা (?!) ভালা সিনেমা বানাইসে, হেই কমফানির ব্যাটাদের বহুত কষ্ট হইছে টেকা পয়সার লাইগা, হেল্লেইগাই এই সিনেমা বানাইয়া হ্যাগোর কষ্ট বুঝাইসে, ভালা বানাইসে!"
সিনেমা শেষে আমি তাকে বললাম বুঝিয়ে যে এটা কোন কোম্পানি না, ফারুকি নামের একজন মানুষ- একজন পরিচালক বানিয়েছেন। তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন আমি কোন সন্ত্রাসী! "হ ভাই ! কইছে আপনেরে! এইটা ঐ কমফানি ছাড়া আর কেও বানাইতে পারতো ন! আর আপনে যেই ব্যাটার কথা কইলেন, ঐ ব্যাটা তো ৪২০ নামে একটা নাটক বানাইসিল, টিভি তে বউরে নিয়া দেখসিলাম , ভালা বানাইসিল, হেরফরে ঐ ব্যাটারে আর কিছু বানাইতে দেখলাম না!"
থাক ব্যাপার না, বুঝাতে ব্যর্থ হলেও সেই রিকশাওয়ালা বিনোদন পেতে ব্যর্থ হয় নাই। তার কষ্টের টাকায় কেনা টিকেটের দাম তার উশুল হইসে, বিনোদন সে ঠিকমতো পেয়েছে- স্বয়ং ফারুকির কাছেও বোধয় এটাই কাম্য। আর মনিষীরা তো বলেই গেছেন "নামে নয়, কর্মে পরিচয়!"
২৬টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন