(ইহা একটি অতি সস্তা লেখা, যারা সহ্য করতে পারবেন না তাঁদের জন্য নয়)
বলাকায় ঢুকতে যাওয়ার আগেই একজন লোক হঠাৎ করে পথ আটকে বলে-
-মামা লাগবে নাকি?
-কি?
-মামা সব আছে- বলিউড, তামিল,হলিউড- সব।
-না মামা, লাগবে না!
-মামা বাংলাও আছে, লাগবে? সেই জিনিস মামা, নিয়া যান।
"স্বদেশী পণ্য , কিনে কি হব আমি ধন্য?" টাইপ চিন্তাকে অনেক কষ্টে মাথা থেকে সরিয়ে বললাম
- না মামা, আমার লাগবে না, আমি সিডি দেখি না, আমার ব্রডব্যান্ড নেট আছে
ঈদের দুই সপ্তাহের বেশি পার হয়ে গেছে, অথচ জলিল সাহেবের প্রতি মানুষের ভালবাসা কোথাও পাড় হয়নি- শপিং মলে ঈদের কেনাকাটা "টাইপ" ভিড় এখনও বলাকাতে! সেলফি, উইলফি, কুলফি- টাইপ যত ধরনের ছবি তোলা যায়- সব ধরনের ছবি সবাই তুলতেই আছে হলের ভিতর সিনেমা শুরু হওয়ার আগে। পকেটের মানিব্যাগ ঠিক আছে কিনা, এতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে কেনা অমূল্য টিকেট কেনা ঠিক আছে কিনা- সেটা "চেক" করতে ভুলে গেলেও "ওয়াচিং স্যার জলিল'স সিনেমা, ইটস মাস্তিটাইম দুধস থুক্কু ডুডস" লিখে "চেক ইন" দিতে কেও ভুলে নাই- ইহা দেখিয়া দুই চোখ সার্থক হইল।
সিনেমা শুরু হইল। বাংলাদেশের বিখ্যাত(?) সায়েন্টিস্ট হাসান মইন ( সোহেল রানা) ক্যান্সারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন- এই খবর আল জাজিরা , বিবিসি থেকে শুরু করে দেশের যমুনা টিভিতে প্রচার হচ্ছে- সমস্যা একটাই- সংবাদ পাঠকেরা এই খবর পড়ছেন, কিন্তু তাঁদের ঠোঁট দেখে বুঝা যাচ্ছে আসলে তারা অন্য খবর পড়ছিলেন, জাস্ট ফুটেজ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু লিপসিং চেঞ্জ করতে ভুলে গেছেন পরিচালক। ছোটবেলায় পড়েছিলাম "হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না"- এই ধরনের খবর দেখে প্রবাদ চেঞ্জ করার সময় এসেছে বলে মনে হল- "ঠোঁটে নড়ে তো খবর নড়ে না"। সূর্য পূর্ব দিকে উঠে- এইরকম চিরন্তন সত্যের মতো সোহেল রানার চুল ও গোঁফ ধবধবে সাদা- যেহেতু তিনি বিজ্ঞানী। তবে সাদার চেয়েও সাদা গোঁফের নিচে তার ব্রাউন কালার এর আসল গোঁফ দেখা যাচ্ছিলো যেটা দেখে বুঝলাম শাক দিয়ে মাছ ঢাকা গেলেও ব্রাউন গোঁফকে সাদা গোঁফ দিয়ে ঢাকা যায়না। ক্যান্সারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ভিলেন নিনোর এক স্পাই এসে গোপন ক্যামেরায় ( যেটা তার শার্টের বোতামে লাগানো, যেটা থেকে আবার নীল রঙের কুদরতি আলোও বের হয়!) সব কিছু ধারণ করে, যেটা দেখে নিনো তার সাঙ্গপাঙ্গদের পাঠান এই ভ্যাকসিন আর বিজ্ঞানীকে নিয়ে যেতে- এটা দিয়া তিনি কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করতে পারবেন তাইলে। নিনো কিছু বলার আগেই মুহূর্তের মাঝে তার চ্যালারা সেখানে পোঁছে গেলেন ২০-২৫টা গাড়ি নিয়ে, ঢোকার মুখে পাহারারত পুলিশকে তারা মেরে ফেললেন, অথচ সেখান দিয়েই বেশ কিছু লোক আর মহিলা এমন "দুলতে দুলতে" হেঁটে যাচ্ছিলেন যেন সকাল বেলা পার্কে শরীরচর্চার জন্য হাঁটছেন! এর মাঝেই কোত্থেকে কাচ ভেঙ্গে স্যার জলিলের আগমন- পাবলিকের তালি আর চিৎকার থামেই না! লাফ দিয়ে তিনি যেই গাড়িতে পড়লেন- সেই গাড়ি অক্ষত থাকলেও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি "মাসুম বাচ্চা" লেভেলের গাড়ি কোন কারণ ছাড়াই কেন উল্টায় গেল সেটা কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলাম না!
সোহেল রানার নাতনী হলেন আমাদের সবার পিয়ো (জলিল ভাইয়ের উচ্চারণ অনুসারে) গ্রামার গাল থুক্কু গ্লামার গার্ল বর্ষা- এটা মেনে নিলাম। -বর্ষার মা হলেন হলেন চম্পা দাঁতে দাঁত চেপে এটাও মেনে নিলাম অনেক কষ্টে- কিন্তু সোহেল রানার মেয়ে হলেন চম্পা- সিরিয়াসলি?! সোহেল রানা একজন প্রতিবন্ধী নাতিও আছেন- বিলটু নামে- সম্ভবত অটিজমে আক্রান্ত। কিন্তু অটিজম কি এটা না বুঝেই এই চরিত্রে অভিনয় করলে যা হয় আরকি, সেটাই হইলে- এমন পরিমাণে মাথা ঝাঁকাইসে এই পোলা- রক ব্যান্ডের গায়ক এমনকি আমাদের গুরু জেমস ও জীবনে গান করতে গিয়ে এত মাথা ঝাঁকাইসেন কিনা আলাহ মালুম। আরে বাপ, এমনে ঝাঁকি দিলে তো তোর সব নাটবল্টু খুলে পড়ে যাবে! এবার জলিল ভাইয়ের পরিবারে আসি- এখানে বর্ষার পরিবারের চেয়েও বড় টুইস্ট আমার জন্য অপেক্ষা করছিল- তা দুঃস্বপ্নেও ভাবি নাই- দিতি হলেন জলিল ভাইয়ের মা! হোয়াট দ্যা...?! জলিল ভাইয়ের ছোট বোন চরিত্রে আছেন অগ্নি সিনেমাতে মাহিয়া মাহির ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয়কারী পূজা নামের মেয়েটি। আমি লিখে দিতে পারি- ভালো পরিচালক পেলে এই মেয়ে একদিন কাঁপায় দিবে তার অভিনয় দ্বারা, খুবই ন্যাচারাল।
ছবির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে সিনেমার গ্রাফিক্স বা VFX। কসম লাগে, ছোটবেলার আলিফ লায়লার গ্রাফিক্স এর চেয়ে হাজারগুণ ভালো ছিল! গানগুলো বিদেশী লোকেশনে নাই বললেই চলে, সব ক্রোমা দিয়ে করে দিয়েছেন আর সে কি জঘন্য ক্রোমার ব্যবহার! এভারেস্ট এর হিমশীতল পরিবেশে জলিল ভাই একটা পাঞ্জাবী আর ভাবি বর্ষা শাড়ি পড়ে এমনভাবে নাচ গান করছেন- এভারেস্ট আসলেই ঠাণ্ডা জায়গা কিনা সেটা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়লাম! পিস্তল থেকে গুলি যেগুলো বের হচ্ছে- সেগুলো হোমিওপ্যাথিক এর ছোট বোতলের সাইজ- নস্টালজিক হয়ে গেলাম দেখে, আহারে! কতদিন হোমিও ওষুধ খাইনা! মিসাইল বের হলে সেগুলো গ্রাফিক্স এর কল্যাণে(!?) হয়ে যায় দেশি লাউ এর সাইজের! বুঝলাম যে দেশ কৃষিতে বেশ উন্নতি করেছে-ভাবতেই ভাল্লাগে- শত হলেও দেশের জিনিস। বিদেশী কাটপিস দিয়ে সিনেমা ভর্তি। চিকেন তান্দুরি গান কলকাতা থেকে মেরে দেয়া, আর সেইগানে জলিলের যা নাচ দেখলাম রে মাইরি! ঋত্বিক রোশনের শেখার আছে নাচের ব্যাপারে জলিলের কাছ থেকে অনেক কিছু। ক্যান্সার ছড়ানোর ভিডিওটা পুরোটা আরেক সিনেমা থেকে মেরে দেয়া- সেই ভিডিও দেখে চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে নতুন জ্ঞান লাভ করলাম- নীল রঙের জুসের কালারের ক্যান্সারের জীবাণু কুকুরকে খাওয়ায় দিয়া মানুষের দেহে সংক্রমন করানো যায়! ক্যান্সার ছোঁয়াচে রোগ ...ক্যান্সার নাকি হাচি কাশি সর্দির মাধ্যমে ছড়ায়। ক্যান্সারের রোগীগুলার কারো মিনিটের মাঝে গাল পুড়ে যাচ্ছে, ভিসুভিয়াস এর লাভা নির্গমনের মতো তারা ভেদবমি করতেই আছে, সেই বমি আর থামেনা- ঢাকা মেডিক্যালে সে এক ভয়াবহ অবস্থা! এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে বর্ষা আর জলিল কোন মাস্ক ছাড়াই যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- যেন কেনাকাটা করতে এসেছেন! আর ডাক্তাররা এক কাঠি সরেস- যেই মাস্ক তারা পড়েছেন- সেটা গার্মেন্টস এ আগুন লাগলে ফায়ার বিগ্রেড এর সদস্যরা পড়েন! মারামারির দৃশ্য শুরু হওয়ার এক সেকেন্ডের মাঝে জলিল ভাই উড়তে শুরু করেন মাটিতে তার পাই পড়ে না, হলি বলিতেও এই উড়াউরি দেখি নাই। দুই গজ সামনে পেয়েও কেও জলিল ভাইরে একটা সিঙ্গেল গুলি লাগাইতে পারেন না- কি করিস ভিলেনের বাচ্চারা? হরলিক্স খা বেশি করে! জলিল ভাই কর্ড ছাড়া ইলেকট্রিক গীটার বাজাইতেই আছেন গানের মাঝে, গীটার নিজেও মনে হয় বিরক্ত হয়ে গেছে একসময়! লিপস্টিক এর ব্যবহারে কে বেশি পারদর্শী সেটা নির্ধারণ করতে বেশ কষ্ট হইসে- জলিল ভাই না বর্ষা ভাবি? চাকরি হারিয়ে জলিল ভাই একাকি নিজের রুমে বসে কলের গান(এত টেকাপয়সা থাকতেও ঘরে একটা মিউজিক সিস্টেম নাই?!) শুনছেন, যে সে গান নয়, রবিঠাকুরের গান- যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে তবে একলা চল রে...! ভাগ্য ভালো রবিবাবু বেঁচে নাই, থাকলে সব ছেড়েছুঁড়ে একলাই চলে যেতেন ফাঁসি দিতে!
কিছু সিন যেগুলো দেখে হাসতে হাসতে চাপা ব্যথা হয়ে গেছে- জঙ্গলে জলিলের বুকে হাত দিয়া বর্ষা ঘনিষ্ঠ হইতে চাইলে জলিল বলেন , “এ কি করছ”- আমি মনে মনে কই, আগে করতে দে! তাইলে না বুঝবি কি করতেসে! গহীন বনে হারায় যাওয়ার পড়েও তিনি বর্ষাকে বলেন- চল তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি- আরে ব্যাটা রে! বাসায় কি করবি? সারাজীবন তো বাসায়ই থাকলি- জঙ্গলের সৌন্দর্য দেখ কিছু! সিনেমার সবচেয়ে বেস্ট সিন হল জলিল ভাই যখন মিশা সওদাগরকে মারার জন্য খালি গায়ে ছুড়ি নিয়ে দাঁড়ান- আহ! জলিল ভাইয়ের প্রশস্ত বুক আর সিক্স প্যাক দেখে আমার জীবন আর যৌবন- দুইটাই সার্থক হয়ে গেছে- তালির আর চিৎকারের চোটে কান ঝালাপালা হয়ে গেছিল হলে এই সিনে! যদিও এই সিক্স প্যাক ও গ্রাফিক্স করে বসিয়ে দেয়া, গলার নিচেই ভুঁড়ির জায়গায় এই সিক্স প্যাক দেখে সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিও মনে হয় বেঁচে থাকার ইচ্ছা ত্যাগ করবে! আর মিশাকে মেরে ফেলার পড়ে ছুড়ি হাতে নিয়ে জলিল প্রায় ত্রিশ সেকেন্ডের মতো লিবার্টি অফ স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন- আমি প্রথমে ভাবসিলাম মিরগি (মৃগী) রোগে ধরল কিনা আমাদের জলিল ভাইরে! হোয়াট অ্যা সিন!
জলিল ভাইয়ের অভিনয় আর উচ্চারণ আগের চেয়ে ভালো হইসে একটু হলেও, তবে পোতিশোদ না , প্রতিশোধ। বিকলংগ না, বিকলাঙ্গ। ইউ ইউল ফিনিশ না । ইউ উইল বি ফিনিশড। তবে পাল্লা দিয়ে বর্ষার অভিনয় দিনের পড় দিন খারাপ হইতেই আছে! সিনেমাতে হুদাই মারামারি খালি। বর্ষাকে ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে ওঠানোর পড়ের সিনেই অনন্তকে দেখলাম বান্দরবানে চলে এসেছেন! আলোর গতিও এত হবে কিনা কে জানে যেই গতিতে জলিল ভাই ঢাকা থেকে বান্দরবানে চলে এলেন! যেই ক্যান্সারের ফর্মুলা নিয়া এত মারামারি, কাটাকাটি- সিনেমার শেষে সেই ফর্মুলা নিয়া কারো কোন খবরই নাই! উল্টা জলিল ভাই বর্ষা ভাবির সাথে গলফ ক্লাবে শুয়ে শুয়ে প্রেম করছেন!
এত টাকা পানিতে ফেলে এইসব জিনিস বানানোর কোনই মানে নাই আসলে, এগুলোকে "আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা" বলে বরং জলিল সাহেব নিজেকেই অপমান করছেন- তবে জানিনা সেই সেন্স তার আছে কিনা। বাংলাদেশে মেধাবীরা টাকার অভাবে একটা ছোট্ট শর্টফিল্ম বানাতে পারেন না, আর অন্যদিকে আরেকজন টাকা পয়সা দেদারসে খরচ করে এইসব অদ্ভুত জিনিস বানাতেই আছেন! এখন কেউ কেউ বলতে পারেন , আপনি ফিল্ম বানাইয়া দেখান মিয়া ,খালি মানুষের সমালোচনা করেন! এই প্রসঙ্গে প্রিয় ব্লগার দুর্যোধন লিখেছেন,“ সানি লিওনের অভিনয় খারাপ কইতে হইলে আমারও কি সানি হইয়া দেখাইতে হইবো ?”
এতকিছুর পড়েও এই জিনিস "চেখে" দেখার ইচ্ছা থাকলে নিজ দায়িত্বে দেখবেন, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে যাতে পুরো সিনেমা দেখে শেষ করে আসার মতো ধৈর্য(আমার মতো) দান করুন- এই কামনাই করি