এক সময় ভারত বর্ষের মুসলিমরা গান যেকোন ধরনের গান শোনাকে হারাম মনে করত। কোথাও গান হচ্ছে আর সেই সাউন্ড মুসলিমদের গান পর্যন্ত পৌছালেই তারা কান চেপে ধরত। সেই অবস্থায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং শিল্পী আব্বাসউদ্দিন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তারা মুসলিমদেরকে গান শোনানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। আর সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক কবি নজরুল ইসলামী গান রচনা করলেন আর সেই সুরলা কন্ঠে মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন শিল্পী আব্বাস উদ্দিন। সেইসব গান গুলোর মধ্যে ছিল মুখে বল রে বল রে আল্লাহ রাসূল সবে বল । তার বিখ্যাত গান ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ এই গানটিও সেইসময় কবি নজরুল রচনা করেছিলেন। সেই গান আজও তেমনি জনপ্রিয় রয়েছে। কবির ইসলামী কবিতা ‘শোনেন সবে নবীজীর ঐ হকিকত/ কেয়সা ছিল বেলালেরই মহব্বত; উড়িয়া যায়রে জোড় কবুতর মা ফাতেমা কান্দ্যা কয়/ আজ বুঝি কারবালার আগুন লেগেছে মোর কলিজায়’ কিংবা ‘এবারের মতন ফিরে যাও আজরাইল মিনতি করিয়া কই তোমারে/ আসমান জমিন চেহারা তোমার আজাবের ডা-া হাতেতে তোমার’ । আর এভাবেই ইসলামী গান, ইসলামী কবিতা, হামদ-নাত সাধারণ মানুষের মাঝে পৌছে দিয়েছিলেন জাতীয় কবি।
তাঁর সেই কাজকে আঞ্জাম দিয়েছিলেন, মরমী কবি মতিউর রহমান মল্লিক। আমি তাঁকে প্রথম দেখি আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগে। আমাদের বাসার নিকটবর্তি একটি কলেজে ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আর সেই অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সে অনুষ্ঠানে তিনি খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেও সেই বক্তব্যে ছিল চিন্তার খোরাক। সেই অনুষ্ঠানে তিনি তাৎক্ষনিক একটি গান শুনিয়েছিলেন। সেই গানটি ছিল, টিক টিক যে ঘড়িটা বাজে ঠিক ঠিক বাজে, কেউ কি জানে সেই ঘড়িটা লাগবে কয়দিন কাজে। এমন অসাধারণ শব্দমালা দিয়ে তিনি মুসলিম মনে ঈমান জাগানোর চেষ্ঠা করে গেছেন। এই মরমী কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সম্রাট ও অলিয়ে কামেল হযরত খানজাহান আলীর স্মৃতিবিজড়িত বাগেরহাটে।
এ জেলারই বারুইপাড়া গ্রামে ১৯৫৬ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। সংস্কৃতিবান পরিবারে অন্যতম কৃতী পুরুষ কবি মুন্সি কায়েম উদ্দিন মল্লিক তাঁর পিতা। মা আছিয়া খাতুনও মুখে মুখে ছড়াকাটা মহীয়সী মহিলা ছিলেন। কবি মল্লিকের বড় ভাই আহমেদ আলী মল্লিকও একজন বড় কবি। সবুজে ঢাকা মায়াময় পরিবেশে বেড়ে ওঠা মল্লিক নিজেকেও সবুজের সাথে মানানসই করেই গড়ে তুলেছিলেন। সাহাবী-কবি আবদুল্লাহ বিন রাওহা রা. এবং সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠকবি আল্লামা ইকবালের কাব্যদর্শনকে বুকে ধারণ করেই বেড়ে ওঠেন তিনি। মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষাজীবন। মুহাক্কিক আলিমগণও যেমন তার উস্তাদ তেমনি আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো সব্যসাচী সাহিত্য ব্যক্তিত্বেরও প্রিয়ছাত্র হতে পেরেছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও সে প্রভাব পুরোপুরি চোখে পড়েছে।
কবি মতিউর রহমান একাধারে কবি ছিলেন, ছিলেন শিল্পী, সুরকার এবং গীতিকার। তাঁর রচিত ইসলামী গান গুলোর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ঈমান জাগানিয়া গান
ঈমানের দাবি যদি কুরবানী হয় / সে দাবি পূরণে আমি তৈরি থাকি যেন
ওগো দয়াময় আমার প্রভু দয়াময়
ঈমানের উপমা যে অগ্নিশিখা / কাজ হলো শুধু তার জ্বলতে থাকা
তেমনি করে ওগো নিঃশেষে আমি / জ্বলে পুড়ে জীবনের দাম যেন খুঁজে পাই
ওগো দয়াময় আমার প্রভু দয়াময়।
তিনি আল্লাহপাকের সৃষ্টির প্রশংসা করেছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে। যেখানে ফুটে ওঠেছে কবির অসাধারণ চিন্তাশক্তির। তোমার সৃষ্টি যদি হয় এতো সুন্দর / না জানি তাহলে তুমি কতো সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন / ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর
না জানি তাহলে তুমি কতো সুন্দর।
কখনওবা অসহায় মুমলিমদের মনে সাহস যোগাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ভেঙে যায় সবকিছু ভাঙে না তো মুমিনের মন
দীন কায়েমের কাজে কাটে তার সকল সময় কাটে তার প্রতিটি ক্ষণ।
চলো চলো চলো মুজাহিদ পথ যে এখনো বাকি
ভোল ভোল ব্যথা ভোল মুছে ফেলো ঐ আঁখি।
আসুক ক্লান্তি শত বেদনা শপথ তোমার কভু ভুল না
সময় হলে দিও আজান তাওহিদের হে প্রিয় সাকি।
একজন মুজাহিদ কখনো বসে থাকে না / যতই আসুক বাধা যতই আসুক বিপদ / ভেঙে পড়ে না
কবি নিজ কন্ঠে গেয়ে গেছেন অসংখ্য গান। যা আজও সুধী মহলে ব্যাপক সমাদৃত হচ্ছে। কবির নিজকন্ঠে গাওয়া কিছু গানের ভিডিও লিংকঃ
মরমী কবির জন্মমাসে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর গান কবিতা এবং সুরকরা হাজারো গানের মাঝে। বাংলাদেশের ইসলামী সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। আল্লাহপাক তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:৪৭