পেটের গুলিটা পেট ভেদ করে বের হয়ে গেছে! প্রচন্ড রক্তক্ষরন হচ্ছে! গুলি লাগার প্রথম পর্যায়ে প্রচন্ড আতঙ্ক এবং ঝাঁকুনিতে অজ্ঞান হয়ে যায়, কর্ণেল এমদাদ! জ্ঞান ফেরার পর তিনি দেখলেন, কয়েকটি লাশের সঙে দরবার হলে তিনিও পড়ে আছেন! হয়তো বিদ্রোহীরা তাকেও মৃত ভেবে ফেলে রেখে গেছে! ক্রোলিং করে দরবার নিজেকে আলাদা করার চেষ্ঠা করত লাগলেন কর্ণেল এমদাদ! যেন মৃতদের সাথে তাকেও কবর দিয়ে না ফেলে! কর্ণেল এমদাদ ক্রোলিং করতে করতে দরবার হলের একটি বাধরুমে ঢুকে পড়লেন! তিনি যখন বাধরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন তার কিছুক্ষণ পরেই নিকটবর্তি মসজিদ থেকে ভেসে এল যোহরের আযান! কর্ণেল এমদাদ পানি দিয়ে উযু না করে তায়াম্মুম করে নিজেকে নামাযের জন্য প্রস্তুত করলেন! বাধরুমে পানি থাকা স্বত্তেও তিনি পানি ব্যবহার করতে চাইলেন না! পানির শব্দে যদি তার অবস্থান বিদ্রোহীরা জানতে পেরে যায় সেই আশঙ্কায়! এরপর কর্ণেল এমদাদ শুয়ে শুয়ে যোহরের চার রাকাত ফরয নামায আদায় করলেন! এরপর পকেট থেকে মোবাইল টি বের করে ভাবলেন স্ত্রীকে একটা কল করবেন! কিন্তু তার কথা বলার শক্তি ধীরে ধীরে নিঃশ্বেস হয়ে যাচ্ছে! আর কথা বললে ধরা পড়ে যাবারও ভয় থেকে যায়! তিনি তার স্ত্রীকে মেসেজ পাঠালেন! “ আমি দরবার হলের বাধরুমে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছি, আমাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করো ”। কর্ণেল এমদাদ যাদের কাছে সাহায্যের জন্য ম্যাসেজ পাঠালো তারা কোন অবস্থায় আছে তা কর্ণেল এমদাদ কল্পনাও করতে পারেনি! সে আশায় ছিল তার পরিবার তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসবে! তিনি ভাবতে লাগলেন এই বুঝি এ্যাম্বুলেন্স এসে পড়বে! এভাবে প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে এক সময় কর্ণেল এমদাদ বিকাল ৫টায় মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন! এভাবেই সমাপ্ত হল একজন চৌকস সেনা অফিসারের জীবন!
সেদিনের ঘটনার পুঙ্খানুবিরন হয়তো আজীবনেও পাওয়া যাবে না! কিন্তু কিছু সত্য সবসময় আপন গতিতে বেরিয়ে আসে! বিডিআর বিদ্রোহ মামলার আসামী মোট ৬ হাজার ৪৬ জন। এর মধ্যে হত্যার মামলার আসামী ছিল মোট ৮৫০ জন। আর বিস্ফোরক মামলার আসামী করা হয় ৭৮৭ জনকে। ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর এই মামলার রায়ে মোট ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২৬১ জনকে ৩ থেকে ১০ বছর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড এবং ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। বেকসুর খালাস পায় ২৭১ জন। তাদের মধ্য থেকে একজন বন্দির জবানবন্দি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি!
সিপাহী সেলিম রেজার জবানবন্দীঃ
সিপাহী সেলিম রেজা। বয়স ২৮। তার নং ৬৩৯০৭। ২০০৯ সালের ৯ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হওয়া এক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম রেজা জানায়, শেখ সেলিম এবং তাপস এর সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। নির্বাচনের দুই দিন আগে ২৭ ডিসেম্বর বিডিআর পিলখানা মাঠে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সিপাহী কাজল, জাকির, ২ জন সিআইডি, সিপাহী মইন, তালেব বৈঠকে অংশ নেয়। এরা সবাই ছিলো ১৩ ব্যাটালিয়নের সদস্য। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোন ভাবেই হোক তাপসকে এমপি হিসেবে জয়ী করতে হবে। তাহলেই তাদের দাবী দাওয়া আদায় সম্ভব। তাপসকে এমপি নির্বাচিত করার জন্য বিডিআর সদস্যরা কয়েকটা টীম গঠন করে। ২৯ তারিখে নির্বাচনের দিন সিপাহী জাকির এবং সিপাহী সেকান্দার ব্যারিস্টার তাপসের সঙ্গে কথা বলে। নির্বাচনে শেখ সেলিম এবং তাপস বিজয়ী হওয়ার পর তাদের সাহস বেড়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম রেজা জানায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের ৭/৮ দিন পর ডিএডি জামিল, মইন, কাজল, হাবিলদার মনির তাপসের সাথে একই দিনে তিনবার মিটিং করে, ওইসব মিটিংয়ে তাপস তাদেরকে সাহস দেয়। তাপস তাদেরকে সাহসী হতে বলে। তাপস তাদেরকে অভয় দিয়ে বলে, এদেরকে (সেনা কর্মকর্তা) মেরে ফেললেও কোন সমস্যা নেই। সেলিম জানায় তাদেরকে সেনা কর্মকর্তা হত্যার সাহস দেয়া তাপসের ওই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ঝিগাতলা চেম্বারে। ওই বৈঠকে মূলতঃ ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়ন এবং ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের বিডিআর সদস্যরা অংশ নেয়। ২০০৯ সালের ৯ মার্চের জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম জানায়, ৩৫ জন বিডিআর সদস্য কোরআন ছুঁয়ে শপথ করে বলেছে তারা পরিকল্পনা মতো কাজ করবে। শেখ সেলিম এবং ব্যারিস্টার তাপস ওই শপথ গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন। তারা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিডিআর সদস্যদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, তাদের রক্ষার দায়িত্ব শেখ হাসিনা নেবেন। ওই ৩৫ জন সিপাহীদের কয়েকজন হলেন সিপাহী হাবিব, সেলিম, কাজল, হাবিবুল, মিজান এবং মাইন। এদের অধিকাংশই ৪৪ নম্বর এবং ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নের। বিদ্রোহের ঘটনাকে যৌক্তিকতা দিতে শেখ সেলিম, ব্যারিস্টার তাপস এবং মহিউদ্দিন খান আলমগীরের পরামর্শে ২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারী কয়েকজন সিপাহী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বাসায় যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে না পেয়ে তারা দাবী দাওয়া সংক্রান্ত একটি এ্যাপ্লিকেশন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস এর কাছে রেখে আসে। ২৪ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারী কথিত বিডিআর বিদ্রোহের আগের রাতে সিপাহী জিয়া, সিপাহী ইব্রাহীম, সিপাহী আজহার, সিপাহী মনির এবং অজ্ঞাতনামা আরো একজন শেখ সেলিমের বাসায় ছিলো।
২০০৯ সালের ১১ মার্চের জিজ্ঞাসাবাদে সিপাহী সেলিম রেজা জানান, নির্বাচনের ৩/৪ দিন পর ব্যারিস্টার তাপসের নির্বাচনী অফিস স্কাই স্টার এ যান তিনি। সেই সময় তার সঙ্গে সিপাহী কাজল এবং মনির ও উপস্থিত ছিলেন। তাপস এমপি সবাইকে বের করে দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে। সে জানায়, এখন তিনি এমপি হয়েছেন। এখন তিনি সবকিছু করতে পারবেন। তাপস জানায়, বিডিআর এর সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। এখন পরিকল্পনা মতো এগিয়ে যাওয়ার সময়। বিডিআর এর দাবী দাওয়া সম্পর্কে লিফলেট সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:২৭