কয়েকদিন আগে একটি ব্যক্তিগত কাজে উত্তরবঙের অন্যতম জেলা লালমনিরহাটে গিয়েছিলাম। এই শহরের বুক চিরে এক বেঁকে বয়ে গেছে তিস্তা নদী! ট্রেনে করে যখন তিস্তা ব্রীজ পার হচ্ছিলাম তখন দেখলাম, নদীর বুকে ধান চাষ করা হয়েছে! মানুষ পায়ে হেটে নদী পার হচ্ছে! ঠিক যেন সেই ছোট্টবেলায়য় পড়া কবিতার মত, “ আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে”। কিন্তু তিস্তা নদীতে এখন সারা বছরই হাটু জল থাকে! উত্তরবঙ বরাবরই মঙা পিড়ীত এলাকা। বিশেষ করে লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলাটি সবচেয়ে মঙা কবলিত এলাকা। এই এলাকায় গরীব খেটে খাওয়া মাুনুষদের আবাস সবচেয়ে বেশি। এইখানকার মানুষদের চাষাবাদ করার জন্য এই তিস্তার পানির পানেই চেয়ে থাকতে হয়! কবে আমাদের বন্ধু রাষ্ট ভারত তিস্তার উজানের পানি ছেড়ে দিবে আর সেই পানি দিয়ে তিস্তার পাড়ের মানুষরা চাষাবাদ করবে। কিন্তু তিস্তার পাড়ের মানুষদের তো এমন দয়ায় বেঁচে থাকার কথা নয়! তাদের রয়েছে অধিকার। যে অধিকার ফারাক্কা চুক্তিতে নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অধিকার কি শুধুই ফাইলে বন্দি থাকার জন্য সাক্ষরিত হয়েছিল?
ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে এ দেশের সবাই আশায় বুক বেঁধেছিলো। সবাই ভেবেছিল এবার বুঝি আমাদের তিস্তার পানি নিয়ে দুঃখ মিটলো! ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত প্রস্তুতিসহ যৌথ নদী কমিশনের তৎপর ভূমিকায় চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টিকে সবাই শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার মনে করেছিল। গণমাধ্যমও বিষয়টিকে নিয়ে অন্যরকম একটি উচ্চাশা তৈরি করেছিলো দেশের অভ্যন্তরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিস্তা পানি বন্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোন চুক্তি সম্পাদিত হলোনা। এরপর থেকে কারণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেতিবাচক অবস্থানকেই সবাই চিহ্নিত করে আসছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের রাজনৈতিক জোটের (ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) টিকে থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন অপরিহার্য, তাই মনমোহন সিং ও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দড়ি টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত বলির পাঁঠা হয়েছিলো, এই তিস্তা চুক্তি।
সেসময় পশ্চিমবঙের মুখ্যমন্ত্রীর ভেটোর কারণে তস্তিা চুক্তি সাক্ষরিত না হলেও এইতো কিছুদিন আগেই মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। কিন্তু তখনও শুধু আশ্বাসের উপর দিয়েই বৈঠক শেষ হয়েছে কোন চুক্তি সাক্ষরিত হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আশাবাদের কথা শুনিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চুক্তিটি সইয়ের জন্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই পক্ষের মানুষের স্বার্থ সুরক্ষার স্বার্থে কারিগরি সমস্যা মেটানোর কথা বলেছেন। কারিগরি সমস্যার সমাধান করা এবং দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষার উল্লেখ করায় চুক্তিটি সইয়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আদৌও চুক্তি হবে তো? আর চুক্তি হলেও তিস্তাপাড়ের মানুষরা পানি পাবে তো?
এ আশংকা কোন অমূলক কিছু নয়! কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিস্তা চুক্তি সইয়ে ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখার আশ্বাস দিলেও কোনো সময়সীমার উল্লেখ করেননি মমতা। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সুরক্ষা করে যে তিনি চুক্তিটি সই করতে চান, সেটি স্পষ্ট করেই বলেছেন। এতে স্পষ্ট যে, পানির এখানকার প্রবাহ হিসাব-নিকাশ করেই তিনি চুক্তিটি করবেন। আর ‘কারিগরি সমস্যা’ মেটানোর কথা বলেও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, সাড়ে তিন বছর আগে তিস্তা নিয়ে আলোচনা যে থমকে গিয়েছিল, সেটি আবার শুরু হবে।
তিস্তা নদী আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে একটি আন্তর্জাতিক নদী। কেননা এটি শুধু সিকিম রাজ্যে উৎসারিত হয়ে ভারতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাংলাদেশের উপর দিয়েও প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়েছে। এ ধরণের আন্তর্জাতিক নদীতে কোনো দেশের একচ্ছত্র আইনগত আধিপত্য নেই। এ নদীগুলোর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উজান ও ভাটির দেশগুলোর একইরকম অধিকার।
১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নিয়মাবলী অনুযায়ী ইচ্ছা করলেই উজানের দেশ, এ ধরণের নদীর উপর ভাটির দেশের জন্য ক্ষতিকর এরকম কোন কিছু নির্মাণ করতে পারেনা। তবে ভারতের সংবিধান আন্তর্জাতিক নদীকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। সংবিধানে নদী বলতে “আন্তঃরাজ্য নদী”-কেই (Inter-State Rivers) বুঝিয়েছে। এক্ষেত্রে এই নদীগুলো আন্তর্জাতিক না আন্তঃরাজ্য কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীন নদী, সেই ব্যাপারে ভারতের সংবিধান কোন দিক নির্দেশনা দেয়নি। ভারতের সংবিধানের ক্ষমতা তালিকার ৫৬নং সন্নিবেশকে নদীসমূহের (Inter-State Rivers) ব্যবস্থাপণা ও উন্নয়নের দায়িত্ব শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, নদীকে ঘিরে রাজ্য সরকার দায়িত্ব বন্টনের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের এখতিয়ার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে পানি সরবরাহ, সেচ, খাল খনন, হ্রদ, নালা ও বাঁধ নির্মাণ, সংরক্ষণ এবং জলশক্তি ব্যবহার। সংবিধানানুযায়ী এগুলো নিশ্চিত করা হয়েছে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা তালিকার ১৭নং সন্নিবেশকে। অবশ্য এই দায়িত্বগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা তালিকার ৫৬নং সন্নিবেশের সাথে যেন সাংঘর্ষিক না হয়।
ভারতের সংবিধানের রাজ্য ক্ষমতার তালিকার ১৭নং সন্নিবেশকের ক্ষমতা বলেই ভারতীয় রাজ্য সরকার এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করেছে পানি সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি লোক সমগ্র ভারতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এমনকি তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের কারণেও পশ্চিমবঙ্গে উত্তরের বেশ কিছু জেলাতে বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে। সেখানকার স্থানীয় জনগণ বাস্তুচ্যুতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০১১ সাল নাগাদ এ ব্যারেজের বিরুদ্ধে ১৫০টি মামলাও দায়ের করেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইনকে বিবেচনায় না নিয়ে রাজ্য সরকার কর্তৃক নদীটির উৎস সিকিম থেকে গজলডোবা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের রংপুর-রাজশাহী অঞ্চল মরুকরণের শিকার হচ্ছে। অথচ এই অঞ্চল বাংলাদেশের সবচাইতে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চল।
কিছুদিন আগে মমতা ব্যানার্জি চিস্তা চুক্তিতে শুধু সম্মত হয়েছিলেন, তাতেই লালমনিরহাটে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। তিস্তা পাড়ের কৃষক মজিবর রহমান ব্রিট্রিশ আমলে মেট্রিক পাশ করেছেন এখন তিনি বয়সের ভারে আর চলতে পারেন না। পানির চুক্তির ব্যাপারে মমতার সম্মতির খবর শুনতেই তিনি খুশিতে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। তিনি তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এখন তিস্তা নদী ফিরে পাবে তার চির চেনা খরাস্রোতা রূপ। ফিরে আসবে নদীটির প্রমত্তা যৌবননের স্বাদ। নদীতে পানিতে ঘটবে চির চেনা জীব বৈচিত্রের সমারহ। নদী কেন্দ্রিক কয়েক হাজার পেশা জীবি আবারও মাছ ধরে সংসারে সচ্ছলতা ফিরাবে। দুর হবে বেকার সমস্যা। তিনি শুধূ মুখের কথা নয়, দ্রত চুক্তি বাস্তবায়ন দেখতে চান।
সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি, এই মানুষ গুলো এই সংবাদেই এত্তোটা খুশি হয়েছে তাহলে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে তারা কতোই না খুশি হবে! সম্ভব হলে, এই তিস্তা পাড়ের মানুষদের আনন্দ ফিরিয়ে দিন! তিস্তা কে তার চিরচেনা যৌবনে ফিরে যেতে ঐকান্তিক ভূমিকা পালন করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৪০