দেশবরেন্য আলেম ও ইসলামি নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে যারা উল্লসিত এবং যারা ব্যাথিতঃ ইসলামপন্থীদের উপর নির্যাতন যুগে যুগে - ১
Click This Link
সাইয়েদ কুতুব ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। প্রথম তিন বছর চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হন। আত্মীয়-স্বজনদেরকেও দেখা করতে দেয়া হত না। পরবর্তীতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়। লেখালেখির সুযোগ দেয়া হয়। তাঁকে পনের বছরের সশ্রম করাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৬৪ সালে ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম আরিফ কায়রো সফর করেন। ইরাকের আলেমদের আবেদনে ইরাকী প্রেসিডেন্ট মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের সাথে বৈঠককালে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানান। ইরাকের প্রেসিডেন্টের সাথে নাসেরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নাসের এ ঘনিষ্ঠতা আরো বৃদ্ধি করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই সাইয়েদকে মুক্তি দেন। মুক্তির পর কারাগারের উপকণ্ঠে অবস্থানকালে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কড়া দৃষ্টি রাখে, কারা কারা সাইয়েদের সাথে দেখা করতে আসে তা জানার জন্যে। সে সময় সাইয়েদের পরামর্শ নেয়ার জন্য সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাঁর কাছে ছুটে আসতেন। জেল থেকে মুক্তির পর সাইয়েদকে ঘিরে এক মজার অপপ্রচার শুরু হয়। ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা হয়- “সাইয়েদ কুতুব ইসলামের কথা বলেন, অথচ তাঁর জীবনে ইসলাম নেই। সাইয়েদ কুতুব জেল থেকে মুক্তি পাবার পর কায়রোর পথ দিয়ে যাবার সময় তাঁর সাথে ছিল তার স্ত্রী ও বড় মেয়ে। তাঁরা উভয়ে ছিল নগ্নপ্রায়। তাঁদের মাথায় স্কার্ফ পর্যন্ত ছিল না।”এ ধরনের ভিত্তিহীন অপপ্রচারের সম্মুখীন হন সাইয়েদ কুতুব। অথচ তিনি জীবনে বিয়েই করেননি।
সাইয়েদ কুতুব জেল থেকে মুক্তির পর কায়রোতে নিযুক্ত ইরাকী রাষ্ট্রদূত তাঁর সাথে দেখা করে ইরাকে সম্মানজনক চাকুরীর প্রস্তাব দেন। সাইয়েদ প্রতিউত্তরে বলেন- “আমি মিসরের অধিবাসী। মিসরেই আমি জন্মেছি। দেশের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আমি দেশেই অবস্থান করবো। আমি দুঃখিত এ জন্য যে, আপনার প্রস্তাবিত পদ গ্রহণ করতে পারছি না। "সাইয়েদ দেশের বাইরে গেলেন না দেশের প্রতি তাঁর দরদ ছিল বলেই। কিন্তু সরকার অজুহাত খুঁজছেন কিভাবে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা যায়। এ জন্য একটি নাটক সাজানো হলো, এক গোয়েন্দা পুলিশ পকেটে ইখওয়ানের সদস্য ফরম রেখে জামাল আব্দুন নাসেরের জনসভায় যায়। সভার কাজ শুরু হলে সে নাসেরকে লক্ষ্য করে পরপর ১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। কিন্তু গুলি কারো গায়ে লাগেনি এবং যে ব্যক্তি গুলি ছুঁড়েছে সেও পালাবার কোন চেষ্টা করেনি। পুলিশ গ্রেফতার করে ঐ ব্যক্তিকে নাসেরের সামনে নিয়ে গেলো। নাসের বললো, তার পকেট তল্লাশী করে দেখো ইখওয়ানের কোন কাগজ আছে কি না। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলতে শুরু করলো, হ্যাঁ, আমি ইখওয়ানের লোক। প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার জন্য ইখওয়ান আমাকে পাঠিয়েছে। সাথে সাথে পুলিশের লোকেরা চিৎকার করে উঠলো, স্যার, এই যে দেখুন ইখওয়ানের সদস্য ফরম তার পকেটে। নাসের তো এই অজুহাতটির খোঁজেই ছিল। সাথে সাথে শুরু হল গণ গ্রেফতারী। মিসরের প্রেসিডেন্ট ইখওয়ান কর্মীদের বিচারের জন্য স্পেশাল সামরিক আদালত বসালেন। এক অধ্যাদেশ জারি করে গণ গ্রেফতারীর বিরুদ্ধে আদালতে আপীল করার সুযোগ রহিত করেন। সাইয়েদ কুতুবকে মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার আখ্যায়িত করে ইখওয়ানকে তার পদাঙ্কানুসারী বলে প্রচারণা চালিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। সে সময় চল্লিশ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। সাইয়েদ কুতুব দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হলেন। এবার গ্রেফতারী পরওয়ানা দেখে নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, ’’আমি জানি যালিমরা এবার আমার মাথাই চায়। তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। নিজের মৃত্যুর জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমার তো বরং সৌভাগ্য যে, আল্লাহ্র রাস্তায় আমার জীবনের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। আগামী কালের ইতিহাসই এটা প্রমাণ করবে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমীন সঠিক পথের অনুসারী ছিল, নাকি এই জালিম শাসকগোষ্ঠী সঠিক পথে ছিল’’।
গ্রেফতারকৃতদের মাঝে সাইয়েদা জয়নাব আল গাযালীও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ষাট বছরের বেশি। তিনি ছিলেন মহিলা সংগঠনের নেত্রী। তাঁকে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। হাসান হোদাইবী ও তাঁর ছেলে মামুন আল হোদাইবী ইসমাইল, মেয়ে সাইয়েদা খালেদা, স্ত্রী ও পুত্রবধূকেও কারাগারে আটক করা হয়। কারাবন্দী নারী-পুরুষের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।
একজন মহিলা যিনি দ্বীন প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন তাঁর ভাই ও তাঁকে জেলে আনা হয়। ভাইকে বলা হয়, তুমি লেখো আমার বোন দুশ্চরিত্রা মহিলা এবং দেহ ব্যবসায়ী। তিনি এ কথা লিখতে অস্বীকার করায় তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।
বোন তাকে আবেদন জানায়- ‘ভাইয়া, আপনি এ কথা লিখে দিন এবং শাস্তির হাত থেকে জীবন রক্ষা করুন।’ ভাই বোনকে বললেন- ‘বোন, তুমি আমার জন্য উত্তম আদর্শ এবং আমিও তোমার জন্য আদর্শ হয়ে থাকবো।’ এরপর নির্যাতনে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। শাওকী আব্দুল আযীয নামক একজন ইখওয়ান কর্মীকে সম্পূর্ণ নগ্নদেহে ছাদে লটকানো হয়। তারপর ফোঁটা ফোঁটা পেট্রোল তার মাথায় ঢালা হয়। তখন তার দম বন্ধ হয়ে আসতো। প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা এ শাস্তি চলতো। জেল দারোগা কটাক্ষ করে তাকে জিজ্ঞেস করতো, তুমি কি এখনও পাক্কা মোমেন রয়েছো? তিনি জবাব দিতেন- “হে আল্লাহ্! তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হও তাহলে এ শাস্তিকে আমি পরওয়া করি না। "একথা শোনার পর তাঁকে আরও চাবুক মারা হত। গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরা হত। মহিলাদের কাঠের সাথে বেঁধে অর্ধনগ্ন করে নির্যাতন করা হত। রক্ত ও পুঁজে তাদের শরীর ভরে যেত। পুরুষদের কাপড় খুলে শিশুর মতো উলঙ্গ করে হাত কাঁধ পর্যন্ত উঁচু করে রাখতে বাধ্য করা হত। লোহার শিকলের সাথে বেঁধে হিংস্র কুকুর ছেড়ে দিত। অনেককে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করত। ভাইয়ের সামনে বোনকে বিবস্ত্র করা, অবিরাম ক্ষুধার্ত রাখা, বৈদ্যুতিক শক দেয়া, ঘুমাতে না দেয়া এসব ছিল শাস্তিপ্রদানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
সাইয়েদ কুতুবের ভাই-বোনরাও কারাবরণ করেন। সাইয়েদের ছোট ভাই মোহাম্মদ কুতুব। ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে গ্রেফতার করে কোথায় রাখা হয়েছে তা কেউ জানতো না। তাকে এত বেশি অত্যাচার করা হয় যে, তাঁর দিকে তাকালে তাঁকে চেনাই যেত না। তিনি ইখওয়ানের নেতা ছিলেন না। তিনি লিখতেন। তাঁর লেখনিতে ইখওয়ান কর্মীরা উদ্দীপ্ত হত। এটাই ছিল তাঁর অপরাধ। সাইয়েদের পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন হামিদা কুতুব। ছোটবেলা থেকে সাহিত্য চর্চার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি কারারুদ্ধ ইখওয়ান নেতা- কর্মীদের সেবা-যত্ন করতেন। সাইয়েদ কুতুবের বাণী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছাতেন। তিনিও বর্ণনাতীত নির্যাতনের শিকার হন। তাঁকে দশ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। ছয় বছর চার মাস কারাবরণের পর তিনি মুক্তি পান। ড· হামুদী মাসউদের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বর্তমানে তাঁরা ফ্রান্সে বসবাস করছেন। সাইয়েদের আরেক বোন আমিনা কুতুব। তিনি উচ্চ শিক্ষিতা এক মহিলা। দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে আপন ভাইয়ের সাথে শরীক ছিলেন। সমাজ সংস্ড়্গারে তিনি অনেক লেখালেখি করেন। তিনিও অনেক নির্যাতন ভোগ করেন। দীর্ঘদিন কারাগারে অন্তরীণ থাকেন। কারাগারেই ১৯৫৪ সালে কামাল ছানানী নামক জনৈক ইখওয়ান কর্মীর সাথে দেখা হয়। সেখানে থেকেই বিয়ের প্রস্তাব। কারামুক্তির পর উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত হাজার হাজার ইখওয়ান কর্মীকে গ্রেফতার করে। কামাল ছানানীও গ্রেফতার হন। কারাগারে পাশবিক নির্যাতনে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। সাইয়েদ কুতুবের আরেক বোন যার নাম খুবই কম শোনা যায়, তিনি হচ্ছেন নাফীসা কুতুব। তাঁকেও অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর বড় ছেলের নাম রিফাত। সে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তাকেও গ্রেফতার করা হয়। মামার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু তিনি রাজি হননি। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। কারার চার দেয়ালের ভিতরই তিনি শহীদ হন। সাইয়েদের অপর ভাগিনার নাম আযম। সে মেডিক্যালের ছাত্র ছিল। তাকেও কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। সাইয়েদ কুতুবের ভাই-বোন সকলেই কারা নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ধৈর্যের সাথে তাঁরা ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২১