বই: ফাঁদ ও সমতলের গল্প
লেখক: মাহমুদ রহমান, এস এম মামুনুর রহমান
প্রকাশক: পারভেজ রানা, বাংলাদেশ রাইটার্স গিল্ড
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৯৪ (প্রথম প্রকাশে)
মূল্য: ২০০ টাকা (বইয়ের গায়ে)
প্রকাশকাল: নভেম্বর, ২০১৪
প্রচ্ছদ ও নামকরণ: বইয়ে প্রবেশ করতে হয় প্রচ্ছদের মাধ্যমে। পড়ারও আগে, কেনার সময়ই। তাই রিভিউয়ের শুরুটাও সেখান থেকে করা ছাড়া অন্য উপায় দেখছি না।
প্রচ্ছদে স্বাভাবিকভাবেই প্রধান ফোকাস'টা থাকে বইয়ের নামের দিকে। ‘ফাঁদ ও সমতলের গল্প' দুজন গল্পকারের প্রথম গ্রন্থ। এক ফাঁকে সূচী উলটে দেখে নিলাম, মাহমুদ রহমানের একটা গল্পের নাম ‘ফাঁদ' এবং এস এম মামুনুর রহমানের একটা গল্প আছে ‘আকাশ ও সমতলে' নামে। ধরেই নেয়া যায় দুজন লেখকের এদুটো শিরোনামকে সমন্বয় করেই বইয়ের নামকরণ। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ দুটোই কী বইয়ে তাদের আইকনিক গল্প? নাকি নামটা বেছে নেয়া হয়েছে গল্পগুলোর বিন্যাস আর ব্যাপ্তির পরিধি বোঝাতে? সেটা জানতে হলে সবটা পড়ে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু আমি দেখতে এসেছি প্রচ্ছদ আমাকে কতটুকু আমন্ত্রণ জানাচ্ছে (যেমনটা বললাম: পড়ারও আগে, কেনার সময়ই)। অতএব বইটা আবার বন্ধ করি।
প্রচ্ছদজুড়ে নীচে থেকে ক্রমে বেড়ে ওঠা এক গাছের ছায়া। আর তাতে বুভুক্ষু-দর্শন দুটা কাকেরও ছায়া। কিন্তু সবটাই ছায়া, ছবি নয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রচ্ছন্নভাবে নদী, নৌকা আর নগরীর উপস্থিতি বর্তমান। আর এই সমস্ত ছায়ার মাঝে সেই গাছের ডালে পেন্ডুলামের মত দুলছে একটা ঝাঁ-চকচকে একতারা! আকারে-অনুপাতে বিসদৃশ, কিন্তু ফোকাসে এবং বক্তব্যে প্রকট! সবটায় মনে হয়, লেখকেরা শোনাতে চেয়েছেন নাগরিক জীবনের এক “আকালের সুর”; কিন্তু একতারাটা এতটাই স্পষ্ট এবং আলোকিত যে, ধরে নেয়া যায় আকালের চেয়েও ‘সুর'টাই প্রাধান্য পেয়েছে মনোযোগে। কষ্টের লিরিকে গান সবাই-ই করে, পার্থক্য তৈরি হয় সুর এবং গায়কীর ভিন্নতায়!
এর উপর গাঢ় নীল আর মেরুন রং-এ বইয়ের নাম লেখা। বইয়ের সাইডভিউ (শেলফে সাজিয়ে রাখলে আপনি যেই দিকটা দেখবেন) মেরুন শেডে আর বিপরীত দিকে (ফ্ল্যাপের দিকটায়) গাঢ় নীলের শেড।
সবটা মিলিয়ে প্রচ্ছদটা কোনও ক্লাসিকাল ফর্মেটে নয়, বরং কোলাজ টাইপের; যেখানে ভিন্ন করে কিছু বলতে চাওয়ার তাড়ণা আছে। এমন কোলাজ আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, কারণ এর সফলতা পুরোটাই নির্ভরশীল পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তাকানোমাত্রই আমি রায় দিতে পারি না: ‘বেশ হয়েছে' কিংবা ‘ধুরো, এইটা কী!’। যে তাকাবে, বিচারটা তার উপরই থাকবে।
লেখক মাহমুদ-এর গল্প আমি আগেই ব্লগে পড়েছি এবং আমি তার গল্প-লেখার মুগ্ধ পাঠক। সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ হয়ে থাকলে, ‘শুধু এই প্রচ্ছদ দেখে’ আমি বইটা কিনতাম কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
ফ্ল্যাপ: পাঠকভেদে ভিন্নতা থাকবেই, কিন্তু হার্ডকভার বইয়ের ক্ষেত্রে আমার কাছে ফ্ল্যাপ সবসময়ই ইন্টারেস্টিং কিছু। বুকশপে দাঁড়িয়ে আমি সবসময়ই নতুন বই হাতে নিয়ে আগে ফ্ল্যাপে কিছু থাকলে সেটা দেখে নিই। বইমাত্রেই লেখকের কল্পনার দীপপুঞ্জ। ফ্ল্যাপের কনটেন্ট আর লেখার স্টাইল দেখেই মোটামুটি বুঝা যায়, লেখক/প্রকাশক কোন ধরণের পাঠককে আমন্ত্রণ করার জন্য ব্রিজ-নির্মাণ করেছেন। সেটা যমুনা-সেতুর মত দীর্ঘ এবং মাল্টিপার্পাস হতে হবে, এমন কোনও কথা নাই; হোক সেটা হালদার উপর মদুনাঘাট ব্রিজের মত, কোনওভাবে যাতায়াত নিশ্চিত করাটাই যেখানে মুখ্য।
‘ফাঁদ ও সমতলের গল্প'-তে ফ্ল্যাপ থাকলেও, লেখকদের বা তাদের দীপপুঞ্জের বিষয়ে অন্য কারও বক্তব্য নেই। লেখক এস এম মামুনুর রহমান ছবির পাশাপাশি জানালেন তিনি কোথায় এবং কী বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং তার সাথে যোগাযোগের একটা মাধ্যম দিলেন। ওটুকুই। লেখক মাহমুদ রহমান যোগাযোগের জন্য ইমেইল আইডি দিলেও, অন্য কোনও তথ্য-বক্তব্য দিতে অস্বীকৃত হলেন, এমনকি কী এক অভিমানে তার ছবি প্রকাশ করলেও তাতে চেহারা প্রদর্শন করলেন না!
ফলে অন্য সকল রহস্য অটুট রেখেই এক অচেনা ভূমিতে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে পাঠককে। ‘নতুন কিছু পাবো বলে' ঝুঁকি নাহয় নিলামই! (তবে আগের অংশের শেষ লাইনটা এখানেও পুনরাবৃত্তি করাই যায়)
বাঁধাই ও বিন্যাস: হার্ডকভার বই। কাগজের মান এবং বাঁধাই ভাল। লেখার ফন্ট এবং মার্জিন ঠিকঠাক। দৃষ্টিকটু বা মনোযোগ নষ্টকারী নয়। ডিসেন্ট কাজ।
কন্টেন্ট: এবার যাই বইয়ের মূল পাঠ্যে। এস এম মামুনুর রহমানের লেখা ১০টা আর মাহমুদ রহমানের লেখা ৭টা ছোটগল্প নিয়ে এই বই। ছোটগল্পের প্যাটার্নটাই চির আধুনিক। পরিসর অল্প বলেই লেখকেরা নিজেদের মত খেলা করেন। টি-টোয়েন্টি ফর্মেটে কোনও শটই দোষনীয় নয়। তাই এমনতর সংকলনে স্বাভাবিকভাবেই বহুমাত্রিক গল্প পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসলাম।
যারা আমার রিভিউ পড়বেন, তাদের আগে থেকেই বলে রাখি: আমার সমস্ত কথাবার্তাই হবে খুব সাধারণ পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। গল্পলেখার নিবিড় ব্যাকরণ সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নাই। সাহিত্য সম্পর্কে আমার পড়ালেখা আপনাদের অনেকের মতই স্কুল/কলেজে বাংলা ফার্স্ট পেপার পর্যন্তই। তাই আমার বিশ্লেষনের সমালোচনা করতে চাইলে, আগেভাগেই জেনে রাখুন, আমি এই এলাকায় সমালোচনা পাওয়ারও অযোগ্য!
গল্পে চলে যাই।
এস এম মামুনুর রহমানের লেখা প্রথম গল্প ‘তোমার দ্যাশ কই বাউল?’। নামকরণেই গল্পকার এক কঠিন ফিলোসফি'র আশ্রয় নিলেন। এর উত্তর খোঁজা তো পুরোই নিরর্থক; শুধুমাত্র প্রশ্নটাই আপনাকে মাথায় ঢুকিয়ে দেবে, ‘সত্যি তো, বাউলের কি দেশ থাকে?’ গল্প আগায় চিরকালীন সব উদাসী দৃশ্যপটে।
"আউলা বাতাস পিরীত করে ঢেউয়ের লগে। দুইজন অচিন মানুষ বইসা থাকে নাউয়ের উপর। চুপচাপ। কেউ কোনো কথা কয় না।"
দুজন মানুষ – একজন সব পেয়ে হারিয়েছে, আরেকজন কিছু না পেয়ে বিরহী; কিন্তু দুজনে সমান বিষাদে বিবাগী। সুরের ভিন্নতায় মেলোডি সৃষ্টি করেছেন নবীন লেখক। শেষের চমকটা অনুমেয় হলেও মর্মস্পর্শী; চিরচেনা, কিন্তু কখনোই ক্লিশে হয় না।
পাঠকের অনুমিত দীর্ঘশ্বাসের পরমুহুর্তেই শুরু হয়ে যাবে ‘ম্যাজিক'! মাহমুদ রহমানের প্রথম গল্প এই বইয়ে। যে শ্রেণীর মানুষেরা ছোটগল্পের ভেতরে এবং বাইরে সবচে বেশি ডমিনেইট করে, তাদের নিয়ে লেখা গল্প ‘ম্যাজিক'। কাহিনীতে নতুনত্ব পাবেননা, দৃষ্টিভঙ্গিও অভিনব কিছু নয়, তবে আকর্ষণীয় মাহমুদের গল্প বলার স্টাইল। আছে তুখোড় কিছু লাইন সৃষ্টির চেষ্টা:
"নিহাকে দেখতে আসা পুরুষগুলোর মন যেহেতু কালো, তাই বস্তুজগতের নিয়ম মেনে কালো কালোয় মনযোগী হয় না।"
এইসমস্ত মানসিক দারিদ্র্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিতে চাওয়ার জন্যে ভাইবোনের আকুলতায় গল্প চলতে থাকে। বারবার শুরু হতে থাকে আর শেষ হতে থাকে। আমরাও অপেক্ষা করতে থাকি কোনও একটা ম্যাজিকের!
আবারও শ্বাস ফেলে পৃষ্ঠা ওল্টাতেই পৌঁছে যাই ‘আকাশে অথবা সমতলে'। গল্পকার মামুন প্রথম অনুচ্ছেদেই চরিত্রগুলোর সীমা আর সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করলেন সরলভাবে। তারপর ছোট ছোট বাক্যের দৃশ্যায়নে কাহিনী আগায়। একটু চলার পরই গতিজড়তায় আটকে পড়ি! রুদ্ধশ্বাসে খুঁজতে থাকি, আকাশের চিলটা কী দেখল? সমতলের মানুষেরা কী করছে? এবং শেষটায় অবাক আনন্দ পেয়েছি!
বিজ্ঞাপণের ব্যানারে ‘সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ' আমরা যে প্রায়সময়ই খুঁজে পাই না, এটা কী আসলে আমাদের খুঁজতে শেখার ভুলেই? মাত্র আড়াই পৃষ্ঠার একটা গল্প আমাকে দীর্ঘ সময় ভাবালো। কাহিনীর আবরণে আরও কিছু বেশি! এ নিশ্চয়ই লেখকের সার্থকতার নমুনা। কিন্তু আমি খটকায় পড়ে যাই, এই বই পড়া শেষে দার্শনিক-টার্শনিক কিছু হয়ে যাবো না তো?
রেশ কাটাতে খানিক বিরতি দিয়ে পড়লাম মামুনুর রহমানের পরের গল্প ‘আমার একজন বন্ধু আছে'। রহস্য রেখেই গল্পের শুরু, কিন্তু লেখকের রুপক-উপমা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষায় আমি শুরুতে বেশ আটকে যাচ্ছিলাম। নতুন কথকের কন্ঠে প্রাচীনতম বেদনার গান। মানুষের না-বলা গল্পগুলোতেও যেসব উপাখ্যান চিরকাল থাকবে। এই সুযোগে আকাশ থেকে সমতলে থিতু হওয়ার একটু ফুরসৎ মিললো।
কিন্তু তারপরই সোজা গিয়ে পড়লাম মাহমুদ রহমানের ‘ফাঁদ'-এ!
বাংলা ব্লগে গত ক'বছরে আমি গল্প পড়েছি বেশ অনেকগুলো। ভাল লাগা গল্পের সংখ্যাও নেহাত কম না। কিন্তু যে দু'টি মাত্র গল্প ব্যাখ্যাতীত কারণে আমার মাথায় স্থায়ীভাবে দাগ কেটে গেছে তাদের মধ্যে মাহমুদের ‘ফাঁদ' একটি (অন্যটা গল্পকার হামীম কামালের ‘মথ' )। মাহমুদ গল্প বলা শুরু করেন একদম প্রথম লাইন থেকে। খুব প্রাঞ্জল আর গতিশীল বয়ানে। ভাষা প্রমিত'র পাশাপাশি ভীষণরকম কথ্য। এমন লাইনগুলো যখন আসে, "একটু আগের টেনে নেয়া গন্ধ মাছের টুকরা হতে আরো স্পীডে বেরুচ্ছে।" – মনে হয় গল্পটা আমি শুধু পড়ছি না, গল্পকারের মুখ থেকে শুনছি সমান উত্তেজনায়! গল্প চলার সাথে সাথে আনন্দ পাই, কষ্ট পাই, আর বুঝতে পারি কেমন ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছি অবধারিতভাবে!
মাহমুদ রহমানের সাহিত্যিকজীবন দীর্ঘ হবে আর তিনিও আমাদের অনেক গল্প শোনাবেন, এই আশা রাখছি প্রার্থনায়। কিন্তু আমার মাথায় আটকে থাকবে - মাহমুদ হল সেই ছেলেটা, যে প্রথম বয়সে এক অপূর্ব ফাঁদ পেতে আমাকে অবাক করেছিল!
এরপর মামুনুর রহমান আসলেন তার ‘রাফখাতা' নিয়ে; এবং প্রথম লাইন থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীকে নির্দয় আক্রমণ করতে শুরু করলেন! ‘রাফখাতা' আমাদের সময়ের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর ইতিহাস; যারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে ব্যয় করে, আর ছাত্রজীবন শেষ হলে টের পায় – সবটাই ছিল ফাঁকি! এ নিয়ে ফিচার লেখা যায়, কলাম ছাপানো যায়, মামুন বেছে নিয়েছেন গল্প'কে তার প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে। এবং কাজটা সরল-সুন্দরভাবে করেছেন।
ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও, মাহমুদের ‘সাকিন' গল্পেও সমাজের কদর্য অংশ প্রকাশিত। স্বার্থপর মানুষ হিসেবে আমরা যেখানে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ খুঁজি এই বলে, "পাগল দেখলেই আমরা আশ্বস্ত হই আমরা ভাল আছি, আমরা সুস্থ আছি। আমরা ওদের মত নই।" যেখানে শুধু মানুষ পরিচয়টাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন একটা স্থায়ী ঠিকানা, একটা সাকিন। দুঃখের বিষয় এটাই যে, আমরা বেড়ে উঠছি এই কদর্যতায়, আমরা সবাই জানি'ও সেটা; অথচ এর বিরুদ্ধে তেমন সোচ্চার কেউ নই! সময়ের দলিল হিসেবে থেকে যাবে এইসমস্ত গল্পগুলো।
পরবর্তী গল্প মামুনের ‘সংসার'। ভিন্ন ধরণের গল্প। প্রবাহমান কাহিনী নেই; ফিল্মের মন্টাজ সিকুয়েন্সের মত একের পর এক পারস্পরিক এবং ধারাবাহিক দৃশ্যপট। সবটা মিলিয়ে গ্রামবাংলার এক ছোট্ট পরিবারের স্থিতিজড়তার গল্প। ঝুটঝামেলাবিহীন। যার চাহিদা-ই নাই, তার আবার অভাব কিসের? – এমন একটা বাস্তবতার স্বপ্ন বা স্বপ্নময় বাস্তবতা। অনেকটা প্রামাণ্যচিত্রের মত। আগ্রহ নিয়ে পড়বেন, কিন্তু পরিণতি'র আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। সহজ-সুন্দর পাঠ।
পরের গল্পটাও মামুনুর রহমানের লেখা, ‘রহমত সাহেবের গল্প'। সূচীতে লেখা ছিল গল্প শুরু হবে ৪৮তম পৃষ্ঠায়, শুরু হল ৪৭-এ। এরপর থেকে সবক'টা গল্পেই সূচীপত্রের সাথে এই ব্যবধান রক্ষা করা হয়েছে।
তো যাই হোক, গল্পকার মামুন এবার তার শক্তিমত্তারও পরিচয় দিলেন। আগের গল্পটার ঠিক বিপরীত ছাঁচে গল্প ফাঁদলেন। চাহিদা-যোগানবিধিতে দেখালেন মুদ্রার অপর পিঠে কী আছে। শেষের ট্যুইস্ট'টা চমকপ্রদ এবং নিজেকে নিয়ে ভাবা'র একটা সিরিয়াস উৎস তৈরি করে দেবে! শুরু থেকে হয়তো ভাবছিলেন, শেষে এসে নিশ্চিত করে জানবেন: গল্পটা রহমত সাহেবের না, গল্পটা আপনার!
পরের গল্প মাহমুদের ‘ইলিশ'। আমাদের বর্তমান সময়ে, ইলিশকে অনায়াসেই ধরে নেয়া যায় অর্থনৈতিক আর সামাজিক স্ট্যাটাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডেক্স হিসেবে। মাহমুদ এর সাথে যোগ করেছেন ‘রাজনীতি'; আর তার লেখায় সহজাত মানবিক চিন্তাগুলোর পোর্ট্রেইট তো আছেই। গল্পে আশা এবং আশঙ্কা সমান্তরালে আগায়, একটা ভালরকম ক্লাইম্যাক্স এবং এরপর অবধারিত পরিণতি। কাহিনীর দিক থেকে এইটুকুতে হয়ত অভিনবত্ব নেই, কিন্তু গল্পকার দু'কদম এগিয়ে গিয়ে শেষটায় নিজেকে স্বতন্ত্র করলেন! পরিণতির'ও আফটার-ইফেক্ট দেখিয়ে তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, গল্প শেষ হয় শুধুমাত্র নতুন করে শুরু হওয়ার জন্য আবার! পরিচিত শোকের অনুভূতিকেও নগণ্য করে ফেলে আরও আদিম অদম্য এক তাড়না: ক্ষুধা! জীবন শুরু হয় আবার...
তবে বেসিক ইন্সটিংক্ট'গুলো বাদেও জীবনে আরও অনেক রহস্য অমীমাংসিত থাকে। শরীর ছাপিয়ে মনের উপর আছর করে জ্বীন। মামুনের ‘কবিরাজ' গল্পের প্লটও এমন এক অদ্ভুতুড়ে জনপদে; যেখানে সরলতম মানুষগুলো আধ্যাত্মবাদে নিজেদের সমর্পন করে নিশ্চিন্ত হয়েছে! আর ভয়ানক কৌতুহলের সাথে অপেক্ষায় থেকে দেখছে, জ্বীন কি নামবে? কবিরাজ নামাতে পারবেন তো? প্রথম গল্পের বাউলের মত এ গল্পেও মামুনের লেখায় একধরণের মায়াবাদী ঘোর দেখা যায়, যেই আবেশ মাঝেমাঝেই প্রকাশ হয়ে পড়ে তার অন্য গল্পগুলোর বয়ানভঙ্গিতেও।
এদ্দুর আসার পর পাঠককে আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, রিভিউ-এর সবটাই আমার মত এক অনভিজ্ঞ পাঠকের অপিনিয়ন মাত্র, প্রচলিত অর্থে সাহিত্যের মূল্যায়ন তো নয়-ই। সম্ভাবনা আছে, ভবিষ্যতে আমি নিজেই এর অনেকাংশের বিরুদ্ধপক্ষে রায় দিব।
মনগড়া স্বাধীনতায় পরের লেখায় যাই। মামুনুর রহমানের ‘অসংলগ্ন কিছু মুহূর্ত'। আক্ষরিক অর্থেই অসংলগ্ন কিছু স্বপ্নদৃশ্যের মিথস্ক্রিয়া, লেখক অনর্গল বলে গেছেন কবিতা বা মুক্তগদ্যের মত করে। তবে গল্পগ্রন্থে যেহেতু ঠাঁই দিয়েছেন, গল্পও হবে নিশ্চয়। না পাওয়ার সেই চিরচেনা সুর, হিসেব না মেলার নিরন্তর গল্প এটাও।
পরের গল্প ‘ভিখারিনী’-তে মাহমুদ-ও দেখালেন মিথস্ক্রিয়ার খেলা। শোনালেন আত্ম-উপলব্ধির ভিন্ন একটা স্বর। গল্পের একদম শেষের লাইনটা এতক্ষণ ধরে তৈরি হতে থাকা মনের দেয়ালের রংটা আমূল পালটে ফেলে আচমকা। আর আমার আবারও মনে হতে থাকে, দুই তরুণ লেখক আমাকে দার্শনিক বানাবার একটা পায়তারা করছেন মোটামুটি নিশ্চিত!
‘মেঘপ্রেমে নিষ্ক্রান্ত জীবন' – মামুনুর রহমানের পরবর্তী গল্প। আমি জানি না গল্পকার কিসের ভিত্তিতে গল্পগুলো বিন্যস্ত করেছেন, তবে এটুকু বুঝতে পারছি, তার গল্প-বলার প্রবণতা কমে আসছে; প্রাধান্য পাচ্ছে মুক্তগদ্যের ফর্মেট। আমি এই ধারার নিয়মিত পাঠক নই। তবে পড়ে যেতে খারাপ লাগেনি। এটুকুই বলতে পারি আপাতত।
তবে অচিরেই কঠিন বাস্তবে ফিরলাম মাহমুদের গল্প ‘দায়'-এর মাধ্যমে। শুরুটাই হল চড়া মেজাজে! এক মধ্যবিত্ত আর এক রিকশাওয়ালা – সমাজের দুই ‘অর্থনৈতিক মানুষ' গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে নিজেদের সুবিধামত দাবিতে চ্যাঁচাচ্ছে। লেখক একজনের বয়ানে গল্প বলে অন্যজনের উপর রাগ ঝাড়লেন খুব করে। কিন্তু হঠাৎ একটা ঘটনা বা দূর্ঘটনা তাদের এক মানবিক পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। গল্পশেষে লেখকের বক্তব্য নিশ্চয়ই ‘চরম খারাপ কেউই না'। কিন্তু তার শেষ লাইনের ওকালতির সাথেও আমি পুরোপুরি একমত নই। যে মানুষ কমপক্ষে দশটা জীবন সরাসরি নষ্ট করে নির্বিকার আছে, একমুহুর্তের ভালমানুষিতেই সে দেবদূত হয়ে যায় না অবশ্যই। তবে এটাও স্বীকার্য যে ঐ মুহুর্তটাও অনন্য!
বইয়ে মামুনুর রহমানের শেষ গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে গল্পের নামের মতই ‘প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিপরীতে'। এ এক প্রেমিক হৃদয়ের নির্মাণকাব্য। বাস্তবতার সকল বালাই দূরে ঠেলে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠিত সমাজ থেকে দূরে; আদিম যুথবদ্ধতায় বিভোর হতে! আর স্বপ্নালু চোখে এক ভিন্ন বাস্তবতায় দৃষ্টি রেখেই এবারের মত শেষ হল এস এম মামুনুর রহমানের গল্প পড়া।
আর মাহমুদ রহমানের শেষ গল্পটা ‘বেহুদা এক জীবনের বয়ান'। ‘গল্প বলা' নিয়ে গালগল্প করেছেন মাহমুদ, আর এর মাঝেই মিশিয়ে দিয়েছেন কোন এক আটপৌরে জীবনের নিয়তির দীর্ঘশ্বাস। আর শেষটায় রেখে দিলেন ফিলোসফির সেই প্রাচীন প্রশ্ন, যা আমরা খুঁজে বেড়াই অক্ষরে আর নিউরনে; যা লেখকদ্বয় খুঁজে বেড়িয়েছেন ‘ফাঁদে আর সমতলে'!
তো এই ছিল আমার ‘বুক রিভিউ'। ইতিপূর্বে ব্লগারদের বই-পরিচিতি নিয়ে সংক্ষেপে পোস্ট করলেও, পুরো বই-পর্যালোচনা বা রিভিউ এই প্রথম। চেষ্টা করেছি, গল্পের প্লট খুব প্রকাশ না করে গল্পগুলোকে নিয়েই গল্প করতে।
লেখকদের জন্য আমার শুভকামনা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি ব্লগার আরজু পনি আপু'র এই পোস্ট'টার জন্য, যেখান থেকে আমি রিভিউ সম্পর্কে প্রাথমিক আর প্রাঞ্জল ধারণা পেয়েছি।
এত বড় পোস্ট পড়ে যারা ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের অভিনন্দন আর ভাল লাগা জানাই!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১:৫৫