somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা :: কাব্য-সংকলন [এখন পর্যন্ত সংকলিত - ৫৪টি]

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অর্ধশত সংগ্রহে ভূমিকা:
মাত্র ১০টি কবিতা দিয়ে শুরু করা এই সংকলনের কাব্য-সংগ্রহ ইতিমধ্যে ৫০ ছুঁয়ে গেল। এর মাঝে ব্লগারদের লেখা কবিতাও আছে ৩ (তিন)টি। বাকি প্রায় সবগুলোই বই-পত্র থেকে দেখে দেখে টাইপ করেছি - ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে জানাবেন নিশ্চয়ই। এই সংকলন করতে বসে 'মা'কে নিয়ে লেখা অসাধারণ সব কবিতা পড়ে ক্রমাগত মুগ্ধ হয়েছি, এবং এখনও হচ্ছি। সংযোজন অব্যহত থাকবে অবশ্যই...

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা:
'মা'-কে নিয়ে বাংলায় রচিত অনন্য সব কবিতা সংকলনের প্রয়াসে এই পোস্ট। এই পোস্ট নিয়মিত আপডেট হতে থাকবে - 'মা'কে নিয়ে লেখা কবিতা পাওয়ার সাথে সাথে এই পোস্টে যুক্ত হতে থাকবে। এই বিষয়ে ব্লগারদেরও কবিতা শেয়ার করার মাধ্যমে সহযোগিতা'র অনুরোধ জানাই।


কাব্য-সূচী:

১. মনে পড়া -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. জন্মকথা -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. কখনো আমার মাকে -- শামসুর রাহমান
৪. মা -- দিলওয়ার
৫. আম্মা -- আবদুল মান্নান সৈয়দ
৬. মায়ের চোখে -- দাউদ হায়দার
৭. স্মৃতি -- আবু হেনা মোস্তফা কামাল
৮. আমার হারানো মাকে -- পুর্ণেন্দু পত্রী
৯. একটি গ্রাম্য দৃশ্য -- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. আমাদের মা -- হুমায়ুন আজাদ
১১. আমার মায়ের চোখ -- রফিক আজাদ
১২. 'তোমার মা' -- হাবীবুল্লাহ সিরাজী
১৩. স্বপ্ন -- সঞ্জয় ভট্টাচার্য
১৪. মা থাকো -- দেবারতি মিত্র
১৫. আমার মাকে -- শামসুর রাহমান
১৬. নোলক --আল মাহমুদ
১৭. তাদের মাতা, জগৎমাতা -- জাহিদ হায়দার
১৮. মা-র কাছে ফেরা -- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
১৯. একটি সবুজ তারা -- শিহাব সরকার
২০. উনুন -- ত্রিদিব দস্তিদার
২১. ঋণ খেলাপ -- আবু হাসান শাহরিয়ার
২২. আর কত -- সিদ্ধার্থ সিংহ
২৩. জীবন দেবতা -- স্বপন বন্দোপাধ্যায়
২৪. মা -- সুজিত সরকার
২৫. মা -- শান্তি সিংহ
২৬. তুই কেমনতরো মা? -- কৃষ্ণ ধর
২৭. আলোর ভাসান -- সুনীলকুমার নন্দী
২৮. মা আমাকে ফিরিয়ে নাও -- মাহমুদ শফিক
২৯. মা -- জাহাঙ্গীর ফিরোজ
৩০. মা-কে নিয়ে -- আশিস স্যানাল
৩১. জন্মবৃত্তান্ত -- দিব্যেন্দু পালিত
৩২. মা-ও যেন কবিতা লেখেন -- জয় গোস্বামী
৩৩. একটি সজল ছায়ামূর্তি -- ইকবাল আজিজ
৩৪. সোনালী চুলের স্মৃতি -- ভাস্কর চক্রবর্তী
৩৫. মা -- পঙ্কজ সাহা
৩৬. আমার মা -- শ্যামলকান্তি দাশ
৩৭. মা -- সুমিত্রা দত্তচৌধুরী
৩৮. ঠিক কোনখানে -- প্রমোদ বসু
৩৯. মা আমার -- বৃন্দাবন দাস
৪০. গল্প লেখার মা-কে -- নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়
৪১. এক পৌরাণিক দেবীর গল্প -- দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায়
৪২. মা, তোমাকে -- বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য
৪৩. মা -- মল্লিকা সেনগুপ্ত
৪৪. আমার মা -- মাকিদ হায়দার
৪৫. মা-কে -- আবদুল গনি হাজারী
৪৬. বাঁচবো কি -- আবুল হোসেন
৪৭. মধুর আমার মায়ের হাসি -- প্রনব রায়
৪৮. মা -- অসীম সাহা


'ব্লগ থেকে পাওয়া কবিতা':

১. আমরা খুব গরীব ছিলাম -- সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই
২. মাতৃ-হারা -- রুহুল আমীন
৩. মা -- সায়েম মুন
৪. কখনো তুমি একা নও -- সায়েম মুন
৫. মা, চোখের পাতায় যেন ফুটে আছে ওজনের ফুল -- বাকী অরিন্দম ('অদৃশ্য';)
৬. যে কবিতার কোন নাম নেই -- সকাল রয়
৭. অগাথ দিয়েছো তুমি -- আহসান জামান




:::::::::::::::::::::::::::::::::: বই থেকে পাওয়া ::::::::::::::::::::::::::::::::::




১. মনে পড়া
-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে -
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।।

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন আশ্বিনেতে ভোরে শিউলিবনে
শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে -
পুজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে।।

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে,
জানলা দিয়ে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে-
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের 'পরে ধ'রে কবে দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে।।


******************************************************************

২. জন্মকথা
-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

খোকা মাকে শুধায় ডেকে,___'এলেম আমি কোথা থেকে
কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে?'
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে ___ খোকারে তার বুকে বিঁধে -
'ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।।

'ছিলি আমার পুতুল-খেলায়, ___ ভোরে শিবপূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি।
তুই আমার ঠাকুরের সনে ___ ছিলি পূজার সিংহাসনে,
তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি।।

'আমার চিরকালের আশায়, ___ আমার সকল ভালোবাসায়,
আমার মায়ের দিদিমায়ের পরানে,
পুরানো এই মোদের ঘরে ___ গৃহদেবীর কোলের 'পরে
কতকাল যে লুকিয়ে ছিলি কে জানে।।

'যৌবনেতে যখন হিয়া ___ উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া
তুই ছিলি সৌরভের মত মিলায়ে,
আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে ___ জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে
তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে।।

'সব দেবতার আদরের ধন ___ নিত্যকালের তুই পুরাতন
তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সি।
তুই জগতের স্বপ্ন হতে ___ এসেছিস আনন্দস্রোতে
নূতন হয়ে আমার বুকে বিলসি।।

'নির্নিমেষে তোমায় হেরে ___ তোর রহস্য বুঝি নে রে -
সবার ছিলি, আমার হলি কেমনে!
ওই দেহে এই দেহ চুমি ___ মায়ের খোকা হয়ে তুমি
মধুর হেসে দেখা দিলে ভুবনে।।

হারাই হারাই ভয়ে গো তাই ___ বুকে চেপে রাখতে যে চাই,
কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে -
জানি নে কোন মায়ায় ফেঁদে ___ বিশ্বের ধন রাখব বেঁধে
আমার এ ক্ষীণ বাহুদুটির আড়ালে।।


******************************************************************


৩. কখনো আমার মাকে
-- শামসুর রাহমান

কখনো আমার মাকে কোনও গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।

যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মিড়ে মিড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর

সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিনী। যতদূর
জানা আছে, টপপা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।

যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক'রে আজীবন এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে।


******************************************************************


৪. মা
-- দিলওয়ার

কোলে নিয়ে
দোল দিয়ে
বলেছিলো মা -
'চাঁদের কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।'

বলেছিলো সেই কবে
দুধে ধোয়া শৈশবে - না?
আ!

জানলাম মা-র কাছে
আমি এক রাজপুত
মানুষের দরবারে
জীবনের রাজদূত,
প্রকৃতি বলেছিলো - বাঃ !

তারপর ধীরে ধীরে ফুটলাম
অবলী আঁধার চিরে ফুটলাম
ঘুরন্ত গ্রহের সাথে ছুটলাম,

ছুটলাম দূর মহাশূন্যে
শৈশবে দেওয়া মা-র পূণ্যে,
চাঁদে গিয়ে রাখলাম পা
থরথর কাঁপে সারা গা
চাঁদের কপালে একী
বিশ্বের মা !!
আ!


******************************************************************


৫. আম্মা
-- আবদুল মান্নান সৈয়দ

তোমার পায়ের নীচে পড়ে আছে বেহেশত নীরবে -
মাটির বেহেশত। মুঠো মুঠো মাটির হিরায়
স্বপ্নে, অর্ধালোকে জীবনের সব ক্লান্তি আরামে জিরায়।
তোমার আহ্বানে যে-শিশু এসেছিলাম একদিন পৃথিবীতে কবে,
আবার কমলা ভোর, শ্রাবণের মেঘ, ফলশা-মাখা বেগনি ঘাসের
শৈশবে ফিরিয়ে নেয়,
কৈশোরের বাহুবন্ধে, খেলাশেষে ফেরার সন্ধ্যায়
তোমার আহ্বানে এই ধ্বস্ত শতাব্দীর নীড়
____________________ শেষ শুদ্ধতম বিশ্বাসের।

আম্মা শব্দে মাটি ফুঁড়ে জেগে ওঠে ঘাস।
আম্মা শব্দে ভরে ওঠে অফুরান নক্ষত্রে আকাশ।
আম্মা শব্দে দিবালোক পাতাল অবধি চলে যায়।
আম্মা শব্দে অন্ধ রাত্রি জ্বলে ওঠে বারেক আভায়।
আম্মা শব্দে নিভে যায় হাবিয়া দোজোখ।
আম্মা শব্দে বেহেশত থেকে মর্ত্যে নামে অমল আলোক।


******************************************************************




৬. মায়ের চোখে
-- দাউদ হায়দার

আমার মায়ের চোখে আমি ছাড়া যেন পৃথিবী'র কোন সুন্দর-ই
_______________ সহজে লাগে না আর তাঁর কাছে।
দিনের আলোর মত উজ্জ্বল ভালোবাসা সমস্ত শরীরে রেখে
_______________ বেঁচে থাকে পরম তৃপ্তিতে -
কখন তাঁর সোনালী প্রহর গড়িয়ে যায়; দৃষ্টি নেই সে দিকে
অথচ মায়াবী চোখে আমাকে নিয়ে খেলা করেন সারাদিন
__________________________________ এবং
মেলে রাখেন আত্মীয় পাড়াপড়শির কাছে !

আমার মায়ের চোখে কোন দুরন্তপনাই ধরা পড়ে না কখনো; যেন
_______________ বিরাট গুণের অধিকারী
_______________ সুবোধ বালক আমি
ঠোঁটস্থ সকাল-বিকাল তাঁর আমার সমস্ত কাজ-বুঝি তাই
পরম স্নেহে চোখে মুখে ছুঁয়ে যায় আশীর্বাদের নরম হাত!

আমার মায়ের চোখে আজীবন দুধের শিশুই রয়ে গেছি আমি -
এখনো রাত্রিকালে তিনি সেই শিয়রে বসে দেখে যান; গেয়ে যান
________________________________ ঘুমপাড়ানিয়া গান!


******************************************************************


৭. স্মৃতি
-- আবু হেনা মোস্তফা কামাল

ঠান্ডা রোদে ভরে গেলে ঘর আশ্বিনের ভোরে
বুঝতে পারি স্নেহের আঁচলে বেঁধে একমুঠো শিউলি তুমি
বসেছো নামাজে; প্রার্থনার ইচ্ছেগুলি
পায়রা হয়ে উড়ে আসছে বাগানে উঠোনে
তুমি আমার জননী।


******************************************************************


৮. আমার হারানো মাকে
-- পুর্ণেন্দু পত্রী

পালকি, যাও, হারানো আমার মাকে খুঁজে নিয়ে এসো।
অস্পৃশ্যের মত এক পীড়নের দিনে চাই রাজবধূরূপে মাকে পেতে।
মাকে পেলে দুই গালে হাজার হাজার চুমু পাব
বৃষ্টি নামবে ফাটা ঠোঁটে, গজাবে নতুন পাতা কঙ্কালের হাড়ে
মা আমাকে ফিরে দেবে কেয়া-খয়েরের গন্ধে মাখামাখি ঘোর বাল্যকাল,
কী অসুখে কী রকম জলপটি সবই মার জানা।
যদি বলি, মাগো আমি হতে চাই এক বুক শস্যের সাগর
মা তাঁর আঁচল থেকে সুনির্দিষ্ট চাবি তুলে দেবে তৎক্ষণাৎ।
পালকি, যাও, উপড়ে আনো তৃণমূল থেকে মাতৃক্রোড়।


******************************************************************


৯. একটি গ্রাম্য দৃশ্য
-- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মাটির দাওয়ায় খুদে মাস্টার ক্লাস সিক্সের গুটুলি
হাতে বেত নেই, তর্জনি তোলা, নাকের ডগায় চশমা
খেলনা চশমা, চশমা ছাড়া কি মাস্টার সাজা মানায়?
মেঘ ভাঙা চাঁদ, পোষা বেড়ালটা এই দৃশ্যটা দেখছে।

ছাত্রী মাত্র একটিই, তার মন নেই পড়াশুনোয়
ছটফটে ভাব, পালাবার তাল, বড় চঞ্চল চাহনি
চুল বাঁধা নেই, শাড়ির আঁচল ঘাম মুছে মুছে ময়লা
কাতর গলায় জানাল, 'গুটুলি, এবার আমায় ছেড়ে দে?'

গুটুলি চক্ষু পাকিয়ে বলল, 'হাতের লেখাটা দেখাও
যা পড়া দিয়েছি শেষ না করলে কোথথাও যেতে পাবে না
ভারি ফাঁকিবাজ, এখনো নিজের নামের বানান শেখোনি
দীর্ঘ ঈ-কার লিখতে দু'বার চকখড়িখানা ভাঙলে!'

'মেঘ ডাকছে রে, ভিজে যাবে সব, খোলা আছে বুঝি জানলা!'
'এখনো বৃষ্টি আসেনি আগেই ওঠার জন্য ব্যস্ত?'
'রান্না-বান্না কিচ্ছু হয়নি, রাত্তিরে তোরা খাবি কী?'
'সে সব জানি না, পড়ার সময় শুনব না কোনো বায়না।'

কড়া মাস্টার গুটুলি কিছুতে ছাত্রীকে ছুটি দেবে না
মাতৃভাষাটা মাকে শেখাবেই ক্লাস সিক্সের ছেলেটা !


******************************************************************


১০. আমাদের মা
-- হুমায়ুন আজাদ

আমাদের মাকে আমরা বলতাম 'তুমি', বাবাকে 'আপনি'।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে
আর কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক'রে উঠতে পারতো না,
আমাদের মাকে বাবার সামনে খড়কুটোর মত এমন তুচ্ছ দেখাতো
যে মাকে 'আপনি' বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনে হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড়ো ছিল, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান,
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার ডাকে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়ল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই মুরগির
বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নীচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া স'রে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু, দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো ফুলের পাপড়ি, সারাদিন ঝ'রে ঝ'রে পড়তো
আমাদের মা ছিলো ধানখেত, সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো
আমাদের মা ছিল দুধভাত, তিনবেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর, আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কি না আমরা জানি না
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার আলিঙ্গনে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়ি্যে ধরে বাবা কখনো চুমো খেয়েছেন কি না।
চুমো খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোটো ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হ'তে থাকি।
আমাদের মা বড়ো ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হ'তে থাকে।
সিক্সে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম
সেভেন ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হ'তে থাকে।
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর ফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝ'রে পড়ে না
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না।
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করি না।
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।


******************************************************************




১১. আমার মায়ের চোখ - ৪
-- রফিক আজাদ

আমি তো সর্বদা তোর চোখের আড়ালে যেতে চাই -
মুর্গির বাচ্চার মতো কেন আগলে রাখিস আমাকে
পাখার আড়ালে?
সারাটি জীবন ধ'রে মাতৃক্রোড়ে থেকে যাবো নাকি?
তোর কোল থেকে নেমে হামা দেবো, হাঁটতে শিখবো না?
হামা-দেয়া শিশু নই, আজীবন শিশু থেকে যাবো?
বয়ঃপ্রাপ্ত হবো না কখনো, তোর স্নেহ-কোল থেকে
পড়ব ঢ'লে সরাসরি অনিবার্য অপর কোলটিতে?

এ্যাত্তোটুকু ছোট্ট শিশু মা গো তোর কোন কাজে লাগে?


******************************************************************


১২. 'তোমার মা'
-- হাবীবুল্লাহ সিরাজী

তাঁর ছায়া তাঁরই মতো থাকে
উঠোন, বাগান, শান বাঁধানো ঘাটে
সন্ধ্যা যখন নামে
হাতের মুঠোয় কমলালেবু, কমলালেবুর ঘ্রাণে
দীর্ঘ চুলে গন্ধ-বাতাস খেলে
আমার তখন কী-ই বা এমন বয়স। রাত পোহালে
একটি কোয়া যত্ন ক'রে খাবো -
পাতে যখন পড়বে মাছের পেটি
নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু মুছে
'জলদি বাবা, বেলা অনেক হলো !'

বেলা অনেক হলো। এখন তাঁর চোখে
কতোই বড় আমি -
চশমা খুলে আঁচলে কাচ ঘসে
'তোমার চুলেও পাক লেগেছে'
হাসির সঙ্গে মিলিয়ে ঠান্ডা ব্যথা
হাতের সুতো আলগা হ'য়ে আসে
ওড়া পাতায় সূ্র্য শেষের আলো
'তোমার ভুরু বাবাজানের মতো।'

'তোমার শখ, তোমার স্বাদ আর কে জানে বেশি, -'
অনেক দূরে এসে - মেঘে-মেঘে আকাশ নিচু হলে
পানের পাতা ফোঁটার ভারে কাঁপে,
মোহ এবং মায়ার টানে
শোক-দুঃখ এক জীবনে উঁচু-নিচু হ'লে
প্রতীক্ষা আর জ্যোৎস্না নিয়ে হাঁটে;
সংকটে আর নিঃসঙ্গতার ষোলো তলায় ব'সে
আমি কেবল চিঠির পাতা খুলে
ভারী চোখে পড়ি: 'তোমার মা' !


******************************************************************


১৩. স্বপ্ন
-- সঞ্জয় ভট্টাচার্য

মা-র কান্না শুনলুম:
আর চারদিক অরণ্য হয়ে গেল !
সেই ভয়ঙ্কর ছায়ায় মার-কান্না !
কেন যে আমি এখানে, জানি নে।
শুধু মা-র কান্না !
কী করে পৌঁছুব সে কান্নার কাছে?
তারপরই ধাপ-ধাপ পাথর, পৌঁছুবার সঙ্কেত।
আর আমি ভূমিষ্ঠ হলুম।


******************************************************************


১৪. মা থাকো
-- দেবারতি মিত্র

কলঘরে ভিজে মেঝে - বসে বসে চুল ছড়িয়ে কাঁদি -
তাও যদি ছিঁড়ে যায় আমার একটিমাত্র রক্তের বন্ধন !
মা, তুমি দাঁড়িপাল্লার যেদিকে রয়েছ, তার অন্য দিকে ব্রহ্মাণ্ড
সম্পূর্ণ ওজনশূন্য, ফাঁকা।

সমুদ্র-ঝিনুকে জন্ম, পড়ে আছি শুয়োরের পায়ের কাদায়।
জন্ম ও কর্মের হাত পাল্লা কষে -
নীল বাষ্পে সব রক্তকোষ ফেটে যায়
আমি যেন আকাশের বহুতলা উঠে গেছি
আলোয় যেন চির আকস্মিক।
রাক্ষস খোক্কস নেই এই দেশে,
রাক্ষসের ছেলে এসে বলবে না - দেখা আলজিভ।

পরি চাঁদ টি দিয়েছে, আহ্লাদ-কাজল দেবে মেঘ,
মা-গান শুনতে শুনতে তারাদের মধ্যিখানে তারা হয়ে কাঁপি।
মা থাকো মা থাকো মা থাকো
পরলোক কোনদিকে - সে জগতে
হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে একা অন্ধকারে হেঁটে
তোমাকে, যদি না খুঁজে পাই !


*****************************************************************


১৫. আমার মাকে
-- শামসুর রাহমান

মাকে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে
ছায়াবৃতা আপন সংসারে। তাকে চিনে
নিতে পারি সহজেই যখন নিভৃত অনুভবে বারবার
একটি ভাস্বর নদী, ফুলের বাগান, মাঠ আর
শস্যক্ষেত, দূরের পাহাড়
গলে গিয়ে একই স্রোতে বয়ে যায়, সীমা
মুছে যায় চরাচরে : স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা
অনন্য উপমা তার। কে যেন চকিতে চেনা স্বরে
বলে শুনি, ‘পাল্কি চড়ে, বেনারসী পরে
যেদিন এলেন তিনি আমাদের ঘরে
চেরাগের মতো কল্যাণের হাত ধরে-
তারই স্মৃতি আছে লেগে অদৃশ্য চাঁপার উন্মীলনে,
সোনার কলসে আর সাঁঝ-নামা দিঘির গহনে।’

মার চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চ দ্বীপ ভাসে?
চোখে বেনেবউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি
শঙ্কিত আভাসে আঁকা- ভাবি
রান্না আর কান্না গাঁথা রুক্ষ এই মরুর আকাশে
এখনো কি স্বপ্ন বোনে ঊর্ণনাভ চাঁদ
নাকি স্বপ্নের জরির পাড়ে সবি জাদুকরী ফাঁদ।
চেয়েছে বুকের সূক্ষ্ম সোনালি সুতোয় চিরদিন
সমস্ত জীবন হোক নক্সীকাঁথা : সে ইচ্ছার ঋণ
শুধে দিতে বুঝি হতে হয়
গাছের মতোই এই রৌদ্রজলে মৃন্ময়, তন্ময়।

মাকে দেখি। আজো দেখি কী এক মায়ায়
পাখি তার হাত থেকে স্নেহের খাবার খেয়ে যায়
দু’বেলা আবেগ ভরে। দেখি তসবী গুণে
সন্ধ্যার মিনারে
সত্তার কিনারে
ঐ দূরায়নী আজানের ধ্বনি শুনে
আর সুবে-সাদেকের তীব্র শুভ্রতায় নির্মেঘ আনন্দ শোকে
আজীবন সমর্পিতা কোরানের শ্লোকে।
আমার দুর্ভাগ্য সেই বিশ্বাসের অনড় জমিনে
দেখি না প্রোথিত কোনো অলীক পর্বত- যাকে চিনে
দ্বন্দ্বহীন জীবনের কাছে আত্মবিসর্জনের পাবো স্বর্গসুখ।
মাঝে মাঝে সংশয়ের গলিতে বিমুখ
প্রশ্ন তুলে ধরে ফণা :

আমি কি সঠিক জানি ভদ্রমহিলাকে
- আমি যার একান্ত বিস্তার অনন্ত শুভ্র লোকে-
চিনি তাকে?
ব্যথা হয়ে বাজে
মাঝে-মাঝে তারও চোখ
আমার অস্তিত্ব-পটে : ‘কে এই অচেনা ভদ্রলোক?’


****************************************************************




১৬. নোলক
--আল মাহমুদ

আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে ?
হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।

জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।

কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো !
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।


****************************************************************


১৭. তাদের মাতা, জগৎমাতা
-- জাহিদ হায়দার

চুল্লির গায়ে লেপছো মাটি
"চুল্লি" কথাটা বল না তুমি,
বলছো বরং : বানাই আখা।

তোমার শিশুরা ঘিরে বসে আছে
দেখছে ক্ষুধার দৃষ্টি মেলে -
ব্যস্ত রয়েছে আখা নির্মাণে
তাহাদের মাতা জগৎমাতা,
আখা-সভ্যতা গড়তে যেয়ে
জননীযুগের কাল হতে আজও শ্রমিক মাতা।

ময়দার মতো মৃত্তিকা গড়ে শিল্পকলা
ঈষৎ পরেই আসবে চুলোয় স্বপ্নের রুটি -
শিশুরা এমন ভাবলে এখন কোনো ক্ষতি নেই
: সব পারে সব তাদের মাতা।

চুল্লি বানায় বানায় রুটি
আখা-সভ্যতা যুদ্ধ করে
যুদ্ধ করছে তাদের মাতা।


****************************************************************


১৮. মা-র কাছে ফেরা
-- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

ওখানে ভীষণ খরায় ফসলের চরাচরে পাখা মেলে বোসেছে এক
বন্ধ্যার বাজপাখি, তার ঠোঁটের বিষ আমার রক্তের শহরে ঢুকেছে
শত্রুসেনারা যেমন বিজয়গর্বে ঢোকে পরাধীন দেশের ভিতর।
মা, এই পরাধীন শরীরে কোথাও মুক্ত আকাশ নেই, মাঠ নেই -
রক্তে মাংসে খরার পতাকা উড়িয়ে রেখেছে ভিন্ন শাসক সেনারা।

কতদিন ঘুমোই না মা ! সেই কবে কৈশোরের প্রথম সকালে
সংসারের গন্ধে ভেজা তোর সোঁদা বুকে মুখ লুকিয়ে নির্ভাবনায়
ঘুমিয়ে যেতাম স্বপ্নের নিরাকার সমুদ্রের ঘোলা লোনা জলে
সেই কবে, কতদিন আগে - কিছুক্ষণ বুকে রাখ, বুকের শান্তিতে।
কতোদিন ঘুমোইনি, নিদ্রার মতো জেগে আছি নিদ্রিত চোখে
_____________ কতোদিন, সেই কতোদিন...

ওখানে অভাব, মারী, দীর্ঘশ্বাসে আগুনের বিপুল জলোচ্ছ্বাস,
দেবদারুর শীর্ণ পাতাগুলো ঝ'রে গেছে মাটির হৃদপিণ্ডে।

সারারাত পথের নির্জনতা সরিয়ে সরিয়ে মানুষের মৃত হাড়
কান্নার কঙ্কাল দেখে আমি আর কোনোদিন কবরের পাশে যাই নি
সড়কের জীবন্ত কবর এসে বুকের ভূমিতে জেগেছে
_____________ সম্মিলিত মৃত্যুর উৎসব।

জানালাগুলো এখোনো খুলিস নি মা?
কতোদিন আকাশ দেখিনি, অনায়াসে পাখা মেলে উড়ে যাওয়া
পাখিদের পালক ঝরে পড়া, রঙিন প্রজাপতি, নক্ষত্র, মেঘ
কতোদিন ঝড়ের পূর্বাভাসে সঞ্চিত কালো মেঘ দেখিনি।

এ-দুটো অনিদ্রায় পোড়া পাথর চোখে
তোর মাতৃত্বের চুমু দিয়ে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দে
কতোদিন ঘুমোই নি মা, কতোদিন ঘুমোই না...


****************************************************************


১৯. একটি সবুজ তারা
-- শিহাব সরকার

মা আছেন আকাশে নক্ষত্রের মেলায়
কেউ জানে না, আমি জানি কোন তারাটি
আমার মা,
ঐ তারার আলোতে আমি পথ চলি
অন্ধকারে, ঝলমলে, দিনের ধন্দে

তারাটি ফুটেছে আটান্ন সালে,
মধ্যরাতে করাচির মার্টিন রোড ভরে গিয়েছিলো
অসহায় কান্না আর হতাশ্বাসে
হতবুদ্ধি পিতা চেপে ছিলো ঘুমভাঙা
বালকের হাত
বিছানায় নিস্পন্দ শরীর
সহসা মা হয়ে যান সবুজ শিখা
মা নেই চোখের সম্মুখে আমার
মা উঠে গেছে আকাশে,
বালকের কানে সমুদ্র গর্জায়
সেই থেকে কেবলি ঝড়, ভূমিকম্প, বাঘনখ।
আশ্চর্য, প্রতিবার বেঁচে যাই
ঘাতকের হাত থেকে খসে গেছে কিরীচ
ছোবল ভুলে গা ঘেঁষে গোক্ষুরে চলে গেলো কতবার
পথ হারাতে হারাতে চেনা দরজায় গিয়ে
নির্ভুল কড়া নেড়েছি।
সবুজ নক্ষত্রের আলোয় বধ্যভূমি
হয়ে যায় পবিত্র বাগান
সকলে জানে তুমি করাচিতে চিরনিদ্রায়
আমি জানি, আম্মা, তুমি আছো আমারই ওপর
অনন্তের গোপন হরিৎ তারা।


****************************************************************


২০. উনুন
-- ত্রিদিব দস্তিদার

উঃ উনুন, আঃ উনুন
তোমার বুকের রক্ত নিয়ে
_________ নাম রেখেছি আগুন।

আগুন-বেদি নিয়েই আমার তাপ
যেথাই অন্ন রক্ত বাড়ে
মধ্যবিত্ত সংগ্রামে যার
_________ নুন-পান্তার চাপ।

আঃ উনুন, উঃ উনুন
তোমার কাছেও ঋণ যে আমার
_________ মা-জননীর নুন।

মা যে আমার তোমার পাশে
কালি-ঝুলি মুখে
তোমার উষ্ণ আবেগ খোঁজেন
সন্তানদের দুখে।
উঃ উনুন, আঃ উনুন
তোমার বুকের রক্ত দিয়ে
_________ নাম রেখেছি আগুন।


****************************************************************




২১. ঋণ খেলাপ
-- আবু হাসান শাহরিয়ার

যে পুঁজিতে আজ অবধি স্বপ্নচারী
তার আদিবাস - গর্ভবাড়ি।

এক জীবনে এ-ওর কাছে
হাজার দেনাপাওনা আছে
সব হিসেবই বৃত্তে বাঁধা হালখাতাহীন
সব ভ্রমণই নাগরদোলা
জমা-খরচ মিললে থাকে শূন্য গোলা।
আজন্ম ঋণগ্রস্থ, আমি শূন্যতারই
মধ্যে খুঁজে ফিরি আমার গর্ভবাড়ি।

বিরান ভূমি, শূন্য গোলা, বন্ধ ঝাঁপি -
একজনারই কাছে কেবল ঋণখেলাপি।


****************************************************************


২২. আর কত
-- সিদ্ধার্থ সিংহ

তুমি যে একেবারে ঘেমে নেয়ে গেছো, মা

টুপটাপ ঝরে পড়া ডাল-পাতা ঝাঁট দিয়ে আর কত সরাবে
আর কত দিন উঠোন থেকে দাওয়ায়, দাওয়া থেকে ঘরে হাত ধরে তুলবে
ঝড় জল রোদের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে আর কত আগলাবে

তুমি যে একেবারে ঘেমে নেয়ে গেছো, মা

এবার অন্তত সদর দরজার বাইরে আমাকে একটু একা একা ছাড়ো।


****************************************************************


২৩. জীবন দেবতা
-- স্বপন বন্দোপাধ্যায়

একটি ছোট্ট শব্দ
কতো বড় মাত্রা নিয়ে আসে
_________ আমাদের সবার জীবনে...
আমরা তা জানি
জানে পশু-পক্ষী-কীট-পতঙ্গও।
আসলে 'দেবতা' বলে যদি কিছু থাকে...
তিনি 'মা'
অন্য কেউ নন।

সন্তান-বাৎসল্যে যিনি বুঝিয়ে দেন -
__________ কতো কষ্টে একটা জীবন !


****************************************************************


২৪. মা
-- সুজিত সরকার

সকলেই গেট খুলে ঢুকি
শব্দ হয়

ঘরের ভিতরে বসে
শব্দ শুনে
মা ঠিক বুঝতে পারে
কে এসেছে

সকলেই
যে যার নিজের মতো গেট খুলি


****************************************************************


২৫. মা
-- শান্তি সিংহ

'মা'-নামের মাঝে আছে অনন্ত বিস্তৃতি
ইড়া-পিঙ্গলায় জাগে অনাহত ধ্বনি,
চরাচরে ভালোবাসা মিহিন বাতাস
ঝিরিঝিরি সুরে বলে : মা, আমার মা !

সমস্ত প্রাণীর মাঝে মমতার টান
কোন আদিকাল থেকে ভবিষ্যের দিকে,
সমস্ত প্রলয়-বাধা দুঃখ-অনটন
সহজে উজিয়ে যায় 'মা' নামের গান !

আগে তো জননীবোধ, জায়াভাব পরে -
পুরুষের কাছে এই চিরসত্য কথা,
উচ্ছল যৌবন দিনে দ্বন্দ্ব-সমুচ্চয়
প্রেমিকার মাঝে তবু জেগে থাকে মা !

মা, আমার মা - এই অতিপ্রিয় কথা
অনাদ্যন্ত কাল ধরে মধুক্ষরা ধ্বনি,
নানা বিবর্তন মাঝে চিরকাল জুড়ে
শোক-তাপ নানা দুঃখে সন্তাপহরণী !


****************************************************************




২৬. তুই কেমনতরো মা?
-- কৃষ্ণ ধর

জন্মেছিলাম তোরই ঘরে ফুটোচালের ছাতা মাথায়
বর্ষা যখন ঝেঁপে এলো কে জানে তুই গেলি কোথায়?
রক্তমাখা আঁচলে তোর শুয়েছিলাম চোখটি বুজে
শুনিনি তোর উলুর শব্দ দেখিনি তোর চন্দ্রসূর্যে।
এখন তো তোর মুখের দিকে চাইতে গেলে আঁতকে উঠি
বলেছিলি সোহাগ করে, 'সোনা হবে ধুলোমুঠি'
এখন তো তুই কথা বলিস না
দু'চোখে তোর জল ঝরে যায়, তুই কেমনতরো মা?


****************************************************************


২৭. আলোর ভাসান
-- সুনীলকুমার নন্দী

হারিয়ে গেলে মাগো, আমার আলোর সরোবর

বুক আঁধারে মখ ডুবিয়ে কাঁদুক এখন ঘর -
ভাঙুক এবার কোটি কন্ঠ, করুণ অবসাদ
ঝরুক যতই চোখে-মুখে শীতল নদীর হাত
রাখবে না কেউ। তুমি তো আজ সুদূর, ব্যবধান
বিশাল আকাশ। পুড়ছে ঘরে প্রভাতবেলার গান।

তোমার কোলে মাথা রেখে শোলক-শোনা মন
পাড়ি দিত গহন সাগর, আলোর অন্বেষণ
আলোর মায়া স্বপ্ন চোখে, - ভালোবাসার ধন
তোমার চোখেই দেখেছিলাম, আকুল প্রস্রবণ
তোমার আলোয় পথ ভেঙেছে অন্ধকারের পাড় -

এরই মধ্যে আলোর ভাসান ! অপার অন্ধকার
আমি তোমার আলোয় মাগো, অবিশ্বাসী স্বর
কেঁপে উঠল; তোমার আলোয় আমার কৃপন ঘর
শরিক হতে পারল না আর। রাতের মোহনায়
দিনের আলো ডুব দিল, ওই কালসন্ধে ছায় -
বইছে হাওয়া এলোমেলো, ভাঙছে বুঝি ঘর।


****************************************************************


২৮. মা আমাকে ফিরিয়ে নাও
-- মাহমুদ শফিক

অস্ফুট পাখির শিসের মতো
ব্রিজের ওপর দিয়ে
চলেগেছে একটি ধূসর রেলগাড়ি
মেঘের ওপারে ঘন বিদ্যুতের মতো
চকচকে বল্লম নিয়ে বসে আছি আমি
আমার হাতের দশটি আঙুল থেকে
অবিরাম ঝরছে বৃষ্টিধারা
মা আমাকে ফিরিয়ে নাও
খরশান রাত
দু টুকরো করেছে আমায়
ঘুম আর জাগরণে দু ভাগে আমি
আত্মার ধনে টের পাই
অন্য এক আলোর উদ্বোধন
মা আমাকে ফিরিয়ে নাও।


****************************************************************


২৯. মা
-- জাহাঙ্গীর ফিরোজ


স্বপ্নের ফুল দিয়ে যে মালাটি গড়ি
সেটি মা তোমাকে দিলাম।
জন্মের নাড়ি কেটে একা করে
জীবনে দিয়েছ;
এই জীবনের স্বপ্নটুকু
মা-য়ের সমান দেশমৃত্তিকার পদতলে
______________ রাখিয়া গেলাস।


তুমি চৈতন্যের তারাবাতি জ্বেলে জ্বেলে
শেষ হয়ে যেও না এখনি
অপরূপ সন্ধ্যায় অপেক্ষায় থেকে
জ্বলে যেও না একাকী
উৎসবের প্রাণ ছুঁয়ে আলো
তোমাকেই জ্বেলে দিতে হবে।


****************************************************************


৩০. মা-কে নিয়ে
-- আশিস স্যানাল

হারিয়ে গেছো অনেক দূরে তুমি।
তবু আমার মা,
দু-চোখ মেলে দেখি জগৎ জুড়্ব
তোমার মহিমা।

যখন রাতের হিংস্র কুটিলতায়
কুয়াশা দেয় আড়ি,
খুঁজে বেড়াই শব্দবিহীন একা
সমস্ত ঘর-বাড়ি।

যেতে যেতে দেখায় পথে আজও
আলোর উত্তরণে
ছড়িয়ে গেছে তোমার গান দীর্ঘপথের শেষে
সবুজ পাতার বনে।

হারিয়ে গেছো অনেক দূরে তুমি।
তবু আমার মা,
অন্ধকারে ধূসর পথে তুমি
ভোরের চেতনা।


****************************************************************



৩১. জন্মবৃত্তান্ত
-- দিব্যেন্দু পালিত

মা-কে নিয়ে আমার খুব গর্ব ছিল
আমার জন্মের সময় আমি তো জন্মাইনি -
সুতরাং, জন্মদাত্রী ব'লে নয়।

আসলে
মা খুব গুছিয়ে বলতে পারত
জন্মের গল্প।

মা বলত
সেই জ্যোৎস্নায় ফুটফুটে রাতের কথা,
যখন
আমি আসব ব'লে
চাঁদ ঢুকে পড়েছিল আমাদের কুঁড়েঘরে -
আর
কোথা থেকে যেন
একটা চক্রধর সাপ
আমারই মাথার পাশ দিয়ে চ'লে গেল
ক্ষমা দেখিয়ে।

মা জানত
মানুষের জন্মের কাহিনী
ঠিক কতটা বললে সুন্দর হয়।
ঠিক কতটা বললে
সাপের ছোবলেও ঝ'রে পড়ে মধু।

সেজন্যে
বেমালুম চেপে গিয়েছিল
রক্তে ভেসে যাওয়া নিজের
সেই যায়-যায় অবস্থার কথা -
নাড়ির ভিতরের যন্ত্রণার কথা।

মা নিজের মৃত্যু দেখেনি।


****************************************************************


৩২. মা-ও যেন কবিতা লেখেন
-- জয় গোস্বামী

পাঁচপ্রদীপের শিখার ওপর হাত

পাতায় নিয়ে সামান্য ওমটুকু
তোদের মাথায় ছোঁয়াই খোকাখুকু

কিন্তু কখন কেউ জানে না কবে
এ হাতখানি পঞ্চপ্রদীপ হবে

মাথার ওপর থমকে দাঁড়ায় রাত

টেবিলবাতির তলায় খোকাখুকুর
স্বাধীন বই, চিরস্বাধীন মুকুর

বইয়ের দুটি হাতের মধ্যে হোম
ছেলেমেয়ের মনের ওপর থেকে
দূর হয়ে যা যক্ষ রক্ষ যম !


****************************************************************


৩৩. একটি সজল ছায়ামূর্তি
-- ইকবাল আজিজ

এক হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো ছায়াপথ থেকে
একটি সজল ছায়ামূর্তি ভেসে আসে -
হেঁটে আসে মহাশূন্য পার হয়ে।
মহাশূন্যে জটিল নক্ষত্রপুঞ্জ -
সৌরমেঘ সৌরঝড় প্রতিনিয়ত।
এখানে ওখানে কৃষ্ঙহ্বর আর কিছুদূরে
দু একটি ম্রিয়মাণ সাদা বামন নক্ষত্রের পাশ দিয়ে
একটি সজল ছায়ামূর্তি হেঁটে আসে পৃথিবীর দিকে

সন্তানের মঙ্গল কামনায় আজো জোছনার রাতে
গড়াই নদীর চরে সেই সজল মানবী হেঁটে বেড়ায়।
গড়াই ব্রিজের পাশ দিয়ে হুহু করুণ বাতাস
_____________ বয়ে যায় -
অনেক অনেক রাতে কুষ্টিয়া স্টেশন থেকে ট্রেন
মোহিনী মিলের পাশ দিয়ে মিশে যায় তেপান্তরে।
সেই মানবী হেঁটে বেড়ায় -
কখনো বা অতিশয় খেয়ালি সন্তানের জানালার পাশে
_____________ দাঁড়িয়ে থাকে
চারিদিকে গোলাপ আর হাস্নুহানার সুগন্ধ...
এক হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরের
কোনো ছায়াপথ থেকে ফিরে
সেই সজল মানবী একা একা হাঁটে -
পৃথিবী নামক গ্রহে তার সন্তান
আজ বড় বেশি মাতৃহীন - আজ বড় বেশি কষ্টে আছে।

সেই ছায়ামূর্তি আজো তার সন্তানের ছায়ার পাশে ঘোরে
স্নেহময় ছায়া হয়ে -
নিঃশব্দে কাঁদে তার সন্তানের জন্যে -
সেই ছায়ামূর্তি আমার মা !


****************************************************************


৩৪. সোনালী চুলের স্মৃতি
-- ভাস্কর চক্রবর্তী

মা বলতেন, কেন বাড়ি থাকিস না
আমি জানি। ঝাঁ ঝাঁ দুপুর
মেঝেতে শুয়ে থাকতাম দুজনে। পাশেই
যে নদীটা বয়ে যেত
তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঝিমিয়ে এসেছিল।
সম্ভবত নীল রঙের একটা গান
ঘরছাড়া করত আমাকে, পথখরচ
থাকত সামান্যই, আমি
এ তল্লাট থেকে সে তল্লাটে ভেসে বেড়াতাম
আধকাপ কফির একটা দুপুর
বিকেলবেলার দুয়েক টুকরো ভাঙা স্বর
আজকাল ভাবি, হাওয়া
কোথা থেকে এসে কোথায় যায় ! চওড়া লালপেড়ে
শাড়িটা পড়ে কে জানে কোথায় এখন
বিড়বিড় করছেন মা
থমথমে একটা তুফান আবার জট পাকাচ্ছে মাথায়
সব কথা কি লেখা যাবে কোনোদিন?


****************************************************************


৩৫. মা
-- পঙ্কজ সাহা

ওই যে মা বসে আছে
নীল রক্ত পায়ে
আঙুলে তরমুজের জল
গর্ভে দ্বিতীয়ার চাঁদ
ঠোঁটে বনতুলসী শ্রান্তি,

গোলাপি বেগুনি সমতলে
ঘিরে আছে জাফরানি জমি,
মা বসে আছে
অলখ ভগ্ন সবুজ শাড়িতে,
হিম সাদা হাতে
কেন ভোরের আবছা আলো !


****************************************************************




৩৬. আমার মা
-- শ্যামলকান্তি দাশ

আমাদের ভাঙা দরজা পাহারা দেয়
গ্রহ-উপগ্রহ।

বাবা রাত জেগে আকাশের লেখা পড়ে

সওদাগরের মেয়ে আমার মা, এখন বনে বনে
ঘাসপাতা কুড়োয়।

কুড়নো ঘাসপাতায় আগুন রচনা করে
আমাদের জনমদুখী ভাই
ক্ষুদিরাম।

আর সেই আগুনে জ্বলে-পুড়ে সোনা হয়ে ওঠে
আমার হতভাগিনী দিদি
অপরূপা।

রাত শেষ হওয়ার আগে আমাদের এই হবিবপুর গ্রামে
শূন্য থেকে উড়ে আসেন
সুন্দর।

তখন আমাদের এই মেঘমেদুর কুটির
চাঁদের আলোয় ভেসে যায়।


****************************************************************


৩৭. মা
-- সুমিত্রা দত্তচৌধুরী

তোমার দক্ষিণ হাত রাখো মাথার ওপরে
মা আমার বড় ভয় করে
এই পৃথিবীর এত বেশি আলো
আমার সর্বাঙ্গে আগুনের আঁচসম জ্বলে
আমার সত্য থেকে আমি প্রতিদিন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাই
আমার প্রেম থেকে আমি প্রতিনিয়তই সত্যভঙ্গ করি
আমার আত্মার প্রার্থিত মুখ ছাই ওড়া প্রান্তরে হারিয়ে যায়
সবুজ ফসলে জেগে থাকে নষ্ট কীটের গোপন ছবি

ঐ শীর্ণ আঙুল থেকে আজ শান্তি ঝরে থাকে
চিরকাল আমি যেন কারো সন্তান হয়ে থাকি,
তোমার দক্ষিণ হাত রাখ মাথার ওপরে
মা আমার বড় ভয় করে।।


****************************************************************


৩৮. ঠিক কোনখানে
-- প্রমোদ বসু

মা, ঠিক কোনখানে ব্যথা লাগছে বলো,
ব্যবহারে, নাকি অসুখে তোমার?
সকাল থেকে কেঁপে উঠছে ঠোঁট, অথচ
সত্য বড় দেরিতে জন্মায় !

কোনখানে ব্যথা লাগছে বলো,
সন্তানে, না সংসারে তোমার?

হাওয়া এসে গুটিয়ে দিচ্ছে চাদর,
আলো এসে খেলা করছে আজ,
তবু চোখের আলোয় কেন এত অন্ধকার?

কোনখানে ব্যথা লাগছে বলো,
কেঁদে উঠি একবার।


****************************************************************


৩৯. মা আমার
-- বৃন্দাবন দাস

যত গুরু-কথা বলি,
কিংবা অযথা,
সবই তার কাছে উৎসব,
সবই মহার্ঘ ধ্বনির ভাঁড়ার;

গোটা পৃথিবী শুয়ে এখন
কঠিন অসুখে,
একমাত্র সে-ই জানে -
সন্তান তার, মরতে শেখেনি;

খরা হোক, ঝঞ্ঝা হোক,
হাড়কাঁপানো শীত, -
বিজন দাওয়ায়, নিঝুম রাতেও
একাকী, নিপুন,
শীর্ণ হাতে, আঁধার তাড়ায় -
শুধু, আমারই জন্যে।


****************************************************************


৪০. গল্প লেখার মা-কে
-- নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়

আগুন রাঙা অন্ধকারে ছড়িয়ে আছে তোমার ভাঙা মুখের ছবি,
তোমার ঘরে ফেরার পথে শববাহকের বাজনা, সবুজ সুরের আলোয়
ঝলসে ওঠে খিদে; নিজের পুত্র, পিতা, স্বামী, মৃত শিশুর মুখের
আদল দেখে সুখ পেয়েছে? জন্ম নেবার আগেই যাকে নুন চেনালে?

মা গো, তোমার মাংস কেটে বেচব, আমার ভাবতে মোটেও ভয় করে না
কে তোমাকে ডাইনি ডেকে ঢিল ছুড়েছে, বিষ্ঠা বমি নিষ্ঠীবনের আলকাতরায়
আমি তো মুখ ঘুরিয়ে রাখি, অমন করে চেয়ে রয়েছ, ভয় পেয়েছ?
তোমার অমল অন্ধকারে ভীষণ ঋণী, নুন শেখালে, চোখ ফোটালে -

ভয় তো শোকের চন্দ্রতাপে কঙ্কালী কলঙ্করেখায় জড়িয়ে আছে
লিঙ্গমূলে, মুখ ও পিঠের চাবুক দাগে, আমার তবু শোক হলো না
শববাহকের সবুজ আলোয় সেতুর গাঢ় স্মৃতির গন্ধ উপচে যেতেই
মা গো, আমি তোমার ঘৃণায় আগুন রাঙা অন্ধকারে প্রাণ পেয়েছি

সেতুর ছায়ায়, চন্দ্রাতপে, জীবন, আমার মরণমায়া, বাহান্ন পীঠ -
তোমার ছেঁড়া মুখের ছবি সত্যি ভালোবাসতে পেলাম, দেখতে পেলে?


****************************************************************




৪১. এক পৌরাণিক দেবীর গল্প
-- দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায়

এক চন্দন-ঘষা রাতে ছোট্ট পুতুলের মতো
এই পৃথিবীতে বেড়াতে এলেন মা।
শেকলের গোলাকার দোলনাগুলি
হাওয়ার হাতে একটু মজার দোল দিতে দিতে
তিনি চলেছেন, চলেছেন, চলেছেন...

গোমেদবর্ণ একটি চৌকো বাড়ির খেজুর গাছে
ডাঁশা খেজুরের ওপর হঠাৎ একটি পাখি এসে বসলো,
মা খেলাচ্ছলে ঢুকে পড়লেন সেই বাড়িতে।
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিদের মত রেশমলাল চুল পুড়ে গেল,
ওপল পাথরের সাদা চামড়া কুঁচকে গেল,
বাড়িটির জানলার দিকে তিনি ছুটে গেলেন
আইকন বাতির আলো জ্বলা পথটি
আর দেখতে পেলেন না,
যে পথ দিয়ে তিনি পৃথিবীতে নেমেছিলেন।
গোমেদবাড়ির দরজাগুলিও কখন নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেছে !
ক্রমে ক্রমে তিনি স্বামী পেলেন, কুৎসিত বর্ণের কিছু সন্তান।
তিনি অপর্ণার মত তপস্যা শুরু করলেন।
তারপর একদিন আকাশে আবার আইকন বাতির পথ তৈরি হলো।
তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ একদিন চলে গেলেন।


****************************************************************


৪২. মা, তোমাকে
-- বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য

মাটি-ফাটা রোদে নামিয়েছিলে বর্ষা
শয়তানের সামনেও বুক পেতে দাঁড়ানোর
বিষয়গুলো শিখিয়েছিলে;
শুধুই চলতে চলতে কত খেয়ালি অভিশাপ পান করেছি,
খেয়েছি সততার শাখা-প্রশাখা।
সারাদিন অক্লান্ত স্পর্শসুখ বিনিয়োগ,
মাতাল জীবন অনেকটা খন্ডচিত্র;
এ-সময়ে চুপিসাড়ে খুঁজি মা তোমার হাতখানি,
ঐ হাতখানি বুকের ওপর রামধনু এঁকে দিত,
ভুল হয়, আজও খোঁজা-শৈশবের গন্ধ-মাখানো আঁচল।
তোমার হাতের বেড়ে দেওয়া নুনভাত, কাঁচালঙ্কা
আজীবন না-ভোলা-বেদনা জাগিয়ে রাখে।
তবু বল কী সুখ আছে ঐ সাদা থানে?
কার মহিমা প্রচার কর তুমি?
এখনো প্রহর জাগি, সাঁকো পার হই -
মা, তোমাকে ধরে অনুর্ধ্ব-চল্লিশেও।


****************************************************************


৪৩. মা
-- মল্লিকা সেনগুপ্ত

মা শুনলে ভেসে ওঠে সিঁদুরের টিপ
লাল পেড়ে শাড়ি, কোলে দুধের সন্তান
যামিনী রায়ের ছবি, সে তো তুমি নও !
কোথায় লুকিয়ে আছ অন্তরালে, রক্তমাংসময়ী?

মা হওয়া মুখের কথা নয়
হাসিমুখে টিপ সেজে যিনি ঠিক বেছে নেন
শিশুযোগ্য হরলিক্স, বেবি সফট পণ্য রাশি রাশি
সে তো শুধু বিজ্ঞাপন টিং টং স্বপ্নের বাজার !

শিশুর আঙুল ধরে মা চলেছে ইস্কুলে ইস্কুলে
মুখ ধোয়া, ছুঁচু করা, পেনসিল কেনা - মা চলেছে
বাবা শুধু মাঝে মাঝে নিয়ে যায় চিড়িয়াখানায়
প্রতিটি মায়ের মুখে খুঁজে দেখি জননী তোমাকে
'হাসিমুখে সব সয় সেই তো জননী'
হাজার বছর ধরে শুনে শুনে কান পচে গেল
কে বলেছে সব সইবার দায় শুধু মায়ের?
মাতৃত্ব মহান যদি কুকুরী মায়ের গায়ে ঢিল কে মেরেছে !
ডাস্টবিনে কার শিশু কুকুরীর স্নেহে বেঁচে ওঠে !

মায়ের গা থেকে যতো অতিকথা কবিতা কল্পনা
পলেস্তারা খুলে ফেলে দেখ, তার রক্তের উত্তাপ
তারও বুকে ধক্ ধক্ করে হৃদরোগ, প্রণয়ের ভাষা
মাতৃহত্যা মনে পড়ে ওরেস্টেস, পরশুরামের !
জঠরে দেবকী তুমি পালনে যশোধা হতে হবে
গার্ডিয়ানশিপ তবু এই রাষ্ট্র তোমাকে দিল না

মায়ের পেটের মধ্যে তিলে তিলে ন'মাস ন'দিন
হোমোসেপিয়েনগুলি বেড়ে উঠে ভুলে যায় তাকে


****************************************************************


৪৪. আমার মা
-- মাকিদ হায়দার

ফিরে তোদেরকে আসতেই হবে, যেখানে
যাবি বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলি সকালবেলা
তোরা এখন নিজেরাই ফিরে আসতে
_______________ ব্যস্ত বিধায়
তোকেও ফিরে আসতে হবে।

আমার সহোদরেরা সকলেই ঘরে বসে থেকে
সারাদিন ফেলে আসা স্মৃতির ভেতর দিয়ে
হেঁটে গিয়ে
পৌঁছে যায় অন্যতটে
_______ ঠিক তক্ষুনি,
_______ আমার না ডাক দেয়, খোকা তোরা
_______ সব ঘরে আয়।

চারদিকে সন্ধ্যা হয়ে এলো।


****************************************************************


৪৫. মা-কে
-- আবদুল গনি হাজারী

আমার বিশ্বাস, মা আমার, তোমায় উদ্বিগ্ন করেছে
আমার অবিশ্বাসে, জননী, তোমার আতঙ্ক
তোমার অশ্রুর সিঞ্চনে তবু
__________ কি অপ্রমেয় প্রাণের বীজ।


****************************************************************


৪৬. বাঁচবো কি
-- আবুল হোসেন

বাঁচবো কি? আর কী করে বাঁচবো?
গাল ভরে হু হু কান্নার ঢেউ,
বুকের মধ্যে ছারখার জ্বালা
ফুলে ফুলে ওঠে,
গনগনে সীসে ঢালা ঝাঁঝাঁ কানে,
বালবের ছেঁড়া তারের মতোন
থরথর হাত।
ছড়ানো টেবিলে পড়ে আছে তার -
মা নেই আমার।

মনে পড়ে সেই তেরো বৎসর
আগে এক দূর ঝকঝকে গ্রামে
দু'চোখ অন্ধ, দমও বন্ধ,
দুপুরে দরজা হাতড়ে বেড়ানো -
বুকের খাঁচায় হাড়ে আটকানো
ময়নাটার সে পাখা ঝাপটানো।

তবু বেঁচে আছি।
সকালে নাশতা, দুপুরে আপিস
সন্ধ্যায় তাস, রাত্রে বালিশ,
মাঝে মাঝে ছুটি হাওয়া বদলানো,
ঘরোয়া তর্কে আকাশ ফাটানো।
কখনো বা ঢাকা কখনো করাচি।
সময়ের সীমাহীন দরিয়ায়
জীবন জাহাজ পাড়ি দিয়ে যায়,
চেনা মুখ ক্রমে স্মৃতির রেখায়
দিগন্তে সূর্যাস্তে মিলায়,
ফেলে চলে যায় জানা বন্দর,
হারায় পুরানো পাখির বহর,
সঙ্গী কেবল হাঙরের ঢেউ।
থামবে যেখানে সেখানে কি কেউ
গরম চায়ের বাটি হাতে করে
ঘাটে বসে আছে সারাদিন ধরে।
সেখানে কি কেউ অচেনা শহরে
হাত ধরে পথে নিয়ে যাবে ঘরে?

পড়ন্ত রোদে চোখ মেলে আজ
দেখি জীবনের বিশাল জাহাজ
ছোট হয়ে আসে। বারে বারে তাই
ভেজানো দরজা শুধু হাতড়াই।
যাবার জন্য প্রাণ উথলানো
সেই সময়টা থামছে না আর
যখন তখন আসছে আবার।


****************************************************************


৪৭. মধুর আমার মায়ের হাসি
-- প্রনব রায়

মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে ।।

তার মায়ায় ভরা সজল বীথি
সেকি কভু হারায়
সে যে জড়িয়ে আছে
ছড়িয়ে আচ্ছে
সন্ধ্যা রাতের তারায়
সেই যে আমার মা ।।
বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা

মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে ।।

তার ললাটের সিঁদুর দিয়ে
ভোরের রবি উঠে
আলতা পড়া পায়ের ছোয়ায়
রক্ত কমল ফোটে ।।

প্রদীপ হয়ে মোর শিয়রে
কে জেগে রয় দুখের ঘরে
সেই যে আমার মা ।।
বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা

মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে ।।


****************************************************************


৪৮. মা
-- অসীম সাহা

সময় হয়নি, তবু দূরের আকাশখানি ঢেকে গেল ঘন কালো মেঘে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই
সবুজ পাতা হলুদ হয়ে খসে পড়তে লাগলো ঘাসে,
অসংখ্য কাক 'কা-কা' শব্দে ডেকে উঠলো হাওয়ায়।
তখনই আকাশ থেকে চাঁদের রূপালী ছায়া নেমে এলো দিগন্তের কোলে।
উষ্ণ আগুনে দগ্ধ হলো পৃথিবীর মাটি
বিপদের আশঙ্কায় আমার চোখের পাতা নড়ে উঠলো একবার।
ঠিক তক্ষুণি তুমি এসে ছায়ামূর্তির মত দাঁড়ালে শিয়রে,
তোমার কম্পমান হাত আশীর্বাদের ভঙ্গিতে উঠে এলো মাথার উপরে;
তোমার মধ্যে আমি দ্বিখন্ডিত মৃত্তিকার স্পষ্ট ছায়া দেখলাম।

মাত্র কদিন আগেই তুমি গেলে অশ্রুসজল চোখে একাকিনী
তোমার অভিমানী মুখে ফুটলো না-ফেরার গান
যেন যাবার জন্যেই তুমি এসেছিলে।
অথচ আর কটা দিন পরেই ঘুরে আসবে সেই দুঃখময় রাত
তোমার ছায়ায় আমরা সবাই পাখির ছায়ার মতো
_______মুখ লুকোবার জন্যে ছুটে যাবো প্রাচীন আঙিনায়,
যেখানে তোমার নিঃসঙ্গ দিন কাটে - ভয়ার্ত রাত কাটে একা;
ঘরের পাশে গাছপালাগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে
____________প্রবল বেগে ছুটে যায় দূরের বাতাস;
তোমার চোখের জল হয়ে ওঠে নদী।
আর তোমার শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরে পড়ে।
তোমার সেই রক্তকণিকার ভেতর থেকে জেগে উঠি আমি।
বারবার মনে হয়, তোমার রক্তে জন্ম নিয়ে
যে পৃথিবী ও প্রকৃতি আমার ভেতরে লুপ্ত হয়ে গেছে
যে ঝর্নার উৎসমুখ খুলে গিয়ে পতিত হয়েছে স্রোতস্বিনীতে
তারই আর এক নাম বুঝি রক্তগঙ্গা।
সেই নদীর তলদেশ থেকে উঠে আসা আমি তোমার অবুঝ সন্তান
আর তুমি আমার মা
মৃত্তিকার উপমায় আমার চিরকালের জননী
সর্বংসহা পবিত্র রূপের মত জ্বলে উঠছো গভীর উপমায়।

আমি তাই নতুন করে তোমার ভেতরে জন্ম নেবার জন্যে
মৃত্যুকে বারবার আলিঙ্গন করছি;
আমি তাই মৃত্যুর ভেতর থেকে তোমার রক্তের মধ্যে
প্রস্ফুটিত হবার জন্যে জন্মকে আলিঙ্গন করছি।

তুমি আমাকে আরেকবার জন্ম দেবে না, মা !


****************************************************************





:::::::::::::::::::::::::::::::::: ব্লগ থেকে পাওয়া ::::::::::::::::::::::::::::::::::


১. আমরা খুব গরীব ছিলাম
-- সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

আমার মায়ের একটা টিনের স্যুটকেস ছিল, যার রং ছিল জংপরা সবুজ
কাড়ের এক কোণে ওটা সযত্নে তুলে রাখতো মা, আর মাঝে মাঝে নামিয়ে তা থেকে
বের করতো পাতাবাহারের ছাপাঅলা একটা লাল পলিয়েস্টার শাড়ি;
আমরা ছোটো ছোটো ভাইবোনেরা উৎসুক চোখে দেখতাম স্যুটকেসের ভিতরে
মায়ের মহামূল্য সম্পদগুলো- গোলমতো একটা সিঁদুরের কৌটো ছিল,
আমি এখনো জানি না আমার মুসলমান-জননীর কী প্রয়োজন ছিল ঐ সিঁদুরের।
আর যা যা ছিল, যদ্দূর মনে করতে পারি, কয়েকটা স্বর্ণের বালা, দুল, কিছু চুড়ি;
একটা বহুদিনের পুরোনো তিব্বত স্নো'র কৌটোও ছিল, হয়তোবা।

আমার মায়ের স্যুটকেসটা জীর্ণ হতে হতে ওর আংটা-টা হয়ে গিয়েছিল খুব ঢিলে;
একটা তালাও ছিল তাতে, চাবিটা কোথায় যেন লুকিয়ে রাখতো মা,
কেননা, তার আঁচলের গোছায় কয়েকটা চাবি ঝনাৎ শব্দ করতো, স্যুটকেসের চাবিটা
নিশ্চয়ই ওখানে দেখি নি।

মা যখন ভাঙা স্যুটকেসটা নামাতো, ওটা খুব ঝনঝন বা ঠনঠন শব্দ করতো।

মাঝে মাঝেই মাকে দেখতাম স্যুটকেস নামিয়ে
তা থেকে শাড়িটা বের করতো, আর মলিন মুখে তা পরতো। শাড়ি পরে আমার মা
কোথাও বেড়াতে না গিয়ে রসুই ঘরে ঢুকতো রান্না করতে, কিংবা ধান ভানতে,
কিংবা রাস্তার ওপার হতে নাড়ার আঁটি এনে গুছিয়ে রাখতো দুয়ারে।
তারপর বাবা যেদিন মেঘুলা বাজার থেকে একটা নতুন কাপড় কিনে আনতো
মায়ের জন্য, মা তার পরনের শাড়িটি খুলে, বহু যত্নে ভাঁজ করে ভাঙা স্যুটকেসের
ভিতর সাজিয়ে রাখতো। শৈশব হতে শুরু করে আমার ১৩-১৪ বছর বয়সে মায়ের
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাকে শাড়িটি পরতে দেখেছি।
মা আমাকে প্রায়ই বলতো, 'আমার এই শাড়িড্যা তর বউরে দিমু।' মায়ের বালা,
চুড়িগুলোও কোনো একদিন আমার বউয়ের হবে, মা বলতো।
আমি পরিবারের বড় ছেলে, এজন্য এটাই নিয়ম।

আমরা সে-সময় অতিশয় গরীব ছিলাম। আমার বাবা ছিল একজন দরিদ্র চাষা,
যার নিজের কোনো জমি ছিল না; আমার মা সেই দরিদ্র চাষার আহ্লাদী
ও লক্ষ্মী স্ত্রী ছিল, যাকে পরনের কাপড়ের অভাবে প্রায়ই তুলে-রাখা
শাড়ি পরতে হতো। আমরা অতিশয় গরীব ছিলাম, আর আমার বাবা ও
মায়ের ছিল দুরবিন চোখ- তার সন্তানেরা ভবিষ্যত পালটে দেবে।

৩০ কি ৩২ বছর পেরিয়ে গেছে। মায়ের ভাঙা স্যুটকেসটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে, জানি না। পাতাবাহারের ছাপাঅলা লাল শাড়িটা আমার চোখে এখনো দিব্যি ভাসে।
ওটার খবরও জানি না।

কাববোর্ডের ভিতর থকে থকে সাজানো স্ত্রীর শাড়িগুলোর দিকে তাকাই-
অকস্মাৎ বেহেশ্‌ত হতে নেমে এসে আমার মা যদি এগুলো দেখতে পেতো,
আনন্দে অজ্ঞান না হয়ে সে যেতোই না- তার গরীবের ঘরে আজ কী
সুন্দর সুন্দর চাঁদ ফুটেছে, একঝাঁক নাতি-নাতনি, যারা জানে না
তার দাদিমা একদিন কত্তো গরীব ছিল, যাকে পরনের কাপড়ের অভাবে
প্রায়ই তুলে-রাখা শাড়ি পরতে হতো।


******************************************************************


২. মাতৃ-হারা
-- রুহুল আমীন

মাগো তুমি আমায় ছেড়ে কোথায় গেলে চলে,
ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেলে কিছু নাহি বলে।
আমায় ছেড়ে নিঠুর মাগো কেমন করে থাকো,
আমার কথা একটুও কি মনে পড়ে নাকো ?

সবাই বলে - গেছ তুমি মরন পারের দেশে,
সেথায় গেলে আবার কেহ ফিরে নাহি আসে।
কিসের মায়া সে দেশে মা, সে দেশটি কেমন?
মা বলে কি ডাকে কেহ আমি ডাকতাম যেমন !

কিসের টানে আমায় ছেড়ে সেথায় তুমি গেলে ?
দুষ্ট বলে আমায় কিগো গেছ তুমি ফেলে ?
মামার বাড়ী যেতে তুমি – আমি যেতাম সাথে,
কৈ বারণ তুমি একটুওত করনিকো তাতে !

বাবার সাথে থাকবো বলে যদি ধরতেম আড়ি,
বলতে তুমি “খোকন” ছাড়া থাকতে কিগো পারি?
স্কুল থেকে আসতে যদি একটু দেরী হতো ,
পথের পানে থাকতে চেয়ে ভাবতে বসে কত?

একটু যদি অসুখ হতো, একটু সর্দি কাশি,
সারা রাতি কাটিয়ে দিতে আমার পাশে বসি।
আমায় ভুলে থাকতে তুমি পাওনা বুঝি ব্যাথা ?
অনেক খোকন আমার মতন আছে বুঝি সেথা !

শত মায়েরে ফাকি দিয়ে যারা সে দেশে গেছে চলি,
তাদের তুমি কোলে তুলে নিলে নিজের খোকাকে ভুলি !
আমি কিন্ত ভুলিনি তোমারে একটি দিনেরও তরে,
তোমার ছবিটি সদাই আমার থেকে থেকে মনে পড়ে।

আকাশের ঐ নীল তারাটি সে বুঝি মা তুমি,
তাইতো রাতে চুপিসারে এসে আমারে যাও চুমি।
মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে তোমায় স্বপ্নে দেখি,
জাগিয়া দেখি তুমি নাই পাশে –সবই মিথ্যা ফাঁকি।




******************************************************************


৩. মা
-- সায়েম মুন

মা আমার
লক্ষী নারী
এক শাড়ীতে
বছর পার
হাঁড়ির কালি
উনুনের ধোয়া
চোখের জলে
জীবন সাবার।

সাহেবদের তালপুকুরে
শালুক ভাসে
মা তোর
এক চিলতে হাসি
শালুকের খইয়ে
মাখা আছে।

রেখেছি মা তোর ছবি
তোর ডুরে শাড়ীর ভাঁজ
সযতনে
তালপাতার পাখায়
তোর হাতের
শীতল বাতাস।

সবই আছে
যেমন ছিল
আকাশের চাঁদ
দাওয়ায় বসা
পোষা বিড়ালের
ইলিশের লোভ
সাদা গাভীটির ক্রুর চোখে
দুধ দোয়ানোর ক্ষোভ।

সব দৃশ্য আজ শুধু
এক পটে বাঁধা
তুই নেই তাই মা
সব কিছু ধাঁধা।


******************************************************************


৪. কখনো তুমি একা নও
-- সায়েম মুন

তুমি একান্ত শূন্যতায় চলতে চলতে
পৃথিবীর শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছো
তারপর ধরো
পৃথিবীতে কেউ নেই তোমার
চারিদিকে শ্মশান গোরস্থান
যেসব প্রাণী বেঁচে ছিল বাঁচার তাগিদে
কাক শকুনে ছিবড়ে খাচ্ছে রক্ত পিন্ড।

দেয়ালে দেয়ালে রাজপথে মিছিলে
যারা বাঁচার জন্য বাঁচতে চেয়েছিল
তাদের কন্ঠ শুকনো পাতার শব্দ
হাড়গোড় ভাসছে বেনোজলে।

পথিক তুমি একা
কোথাও দাঁড়াবার ঠাঁই নাই
পৃথিবীতে কোন শব্দ নাই
এক মূঢ় বধির প্রান্তরে তুমি
চোখ বুজে কিছু দৃশ্য পড়
"ভূমিকম্পে অট্টালিকা ধ্বসে
আগ্নেয়গিরির লাভার নিচে
বুভুক্ষু আফ্রিকার কঙ্কাল সারিতে
কিংবা মহাপ্লাবণে জলের তলে
বুক পেতে জীবশ্রেষ্ঠ মানব বাঁচাতে
জীবন দিয়ে জীবন বাঁচাতে"
একমাত্র কাকে দেখি?

সে তোমার মমতাময়ী 'মা'

তোমার সার্বিক মঙ্গলার্থে যিনি
সর্বদা জায়নামাজে বসে আছেন।


******************************************************************


৫. মা, চোখের পাতায় যেন ফুটে আছে ওজনের ফুল
-- বাকী অরিন্দম (ব্লগার "অদৃশ্য")

আমি দুরে আছি
তোমার থেকে খুব দুরে আছি মা

যতসব লৌহ আবরনে এই দেহটা আটকে আছে, আমার গতি কমে গেছে গ্রিবা ঝুলে গেছে
নিঃশ্বাসে মেখে আছে পোড়া সব ধুল

মা
চোখের পাতায় যেন ফুটে আছে ওজনের ফুল

আমি পাথরের ঘরে বাস করি, পাহাড়ে নয়
মৃত বৃক্ষের ছাতিতে শুয়ে থাকি, কোমল ধুলি বা তৃণফুলে নয়

এখানে পায়ের নীচের পাথরে জীবন নেই মা
এখানে
পায়ের নীচের পাথরে তোমার পদস্পর্শের কোন অনুভব নেই

চারপাশে হাহাকার করে দুর্ভিক্ষের ছায়া

সেখানেই আমি থাকি, ছাতির ভেতর গাদা গাদা দুর্গন্ধ আর
হৃদপিন্ড ফুঁড়ে যাওয়া দৃশ্যের চারপাশে অগনিত
অদৃশ্য কাঁটা

মা
এখানে সমস্থ পাঁপড়িতে মেখে আছে বিষাক্ত মধু উপভোগে মৃত নয় মাদকীয়তা, বহু আগেই হয়ে গেছে ভ্রমরার নেশা, বৃষ্চিকের হুলে গেঁথে থাকে অনেকের যুবতীবেলা

আমারও রক্তিম চোখ
আঁধারের মাঝে জ্বলে থাকে ললোপ হিংস্রতা
জ্বীভ থেকে গলে পড়ে জংলী আঠা

দুরে আছি
তোমার থেকে খুব দুরে আছি মা

আমার শেকল ধর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলো
যেখানে দেহের পাশে প্রকৃতি ও সবুজের আঁশে বাতাসের হৃদপিণ্ডে ভরে থাকে তোমার সৌরভ


আমার দু'চোখ ফেটে গেলে যে দু'দানা নরম কলিজা
উত্তাপে শুকাবার আগেই তোমার চলার পথে জমাতে থাকি

মা
সেই কলিজার জল
তোমার পায়ের নীচে নিও, হেঁটে যেও

তোমার পায়ের মাপে চীরকাল বানিয়ে যাব কলিজার জুতো।।


******************************************************************


৬. যে কবিতার কোন নাম নেই
-- সকাল রয়

আমার দেখতে ইচ্ছে করে মা’ তোর
কেমন করে শাঁখ বাঁধা হয়েছিলো
এই সজনে গাছের তলায়
কেমন করে হাত দু’ খানি লাল চুড়িতে ঢাকা ছিলো
গলাটা কেন ফাঁকা ছিলো।
ললাট ছিল কেন শাখাহীন মাঠ।

তোর ওই বালুচরী প্রিন্ট শাড়ির ভাজে
কেন দুঃখ লুকিয়ে নেচেছিল
ছাদনা তলায় সেই কান্না বাসর দেখার বড় স্বাদ জাগে!

মা’ তোর আঁচলে কেন শূন্যতা ঢাকা ছিল
কেন চোখে জল ছিল
কেন মুখে বিষণ্নতা ছিল
সেসব জানতে ইচ্ছ জাগে

সাতটি পাকে সাত জনমের বাঁধায় বন্দি হয়ে
সন্ধি কেন করেছিলি
ভালবেসে হাত যার ধরেছিলি
যার রক্তচক্ষু চিরটাকাল গেল তরে কাঁদায়ে
মা’ তোর বুকের মাঝে হাজার রাতের সন্ধি রাজে
যাকে আপন করে ভেবে জীবন না’য়ে সঙ্গী করেছিলি
সে কেন তোকে ছুড়েছিল

আমার জানতে ভীষন ইচ্ছে করে
কেন সে তোকে ছেড়ে মায়ের ন্যাওটা ছেলেকে ছেড়ে
নতুন স্বপ্ন চোখের ভেতর বন্দি করে পালিয়ে ছিল।

মা আমার ভীষন জানতে ইচ্ছে
তোর কৃষ্ণের আরও কি কোন রাধা ছিল?


******************************************************************

৭. অগাথ দিয়েছো তুমি
-- আহসান জামান

ষ্টেশন ছেড়ে দিনের শেষ ট্রেন চলে গেলে
যে শুনশান নিরবতাটুকু পড়ে থাকে
তোমার দু'চোখে তার রেশ ভেসে ওঠে অবাধ
অসংখ্য স্মৃতির নক্সায়; চাঁদমুখে জমেছে অজস্র
কুঁচিকুঁচি ভাঁজ বয়সের প্রবল চাপে।

চোখের কোঠরে চেয়ে আছে
অক্লান্ত নির্ঘুম রাতের নিঃসঙ্গতা
শীতের হুহু বাতাসে শিউরে ওঠে
বুক; অন্ধকারের প্রতিচ্ছায়ায় কাকে খোঁজো
আজ এই বিলুপ্ত ভিটামাটির বিচ্ছিন্নতার ভিতর।
কেনো আজও কান পেতে বসে থাকো সেই
সুরেলা বাঁশির আঙ্খাকায়; এই ভুতুমের দেশে।

বিমুর্ষ চাদর মুড়ে তসবিহ দানার ফাঁকে
তোমার দু'ফোঁটা তপ্ত জলের বিরহ; হাতছানি দেয়
পুরানো কালের চাকায়। অতীতের অজস্র রাত্রিকে
তুমিই দিয়েছো বির্সজন, আয়েশের প্রহর পাশে রেখে
কী আনন্দযন্ত্রনায় লালন করেছো আমাকে;
দিয়েছো জীবন, আলোর দিশারী। অবচেনায়
অবাক ভাবান্তর এসে প্রশ্ন করে আজ;
কতটা নির্ঘুম রাত এভাবে কাটালে
মা, জননী হওয়া যায়!

মাঝে মাঝে তোমার সেই গল্পের বিষণ্ণ অনুচ্ছেদে
ভেসে ওঠে শৈশবের তেপান্তরের মাঠ;
শূন্যতা উড়িয়ে এক ধবল ঘোড়ার পিঠে চড়ে
কে যেন এসে, হঠাৎ খুলে দেয় আজ
গচ্ছিত ক্রন্দনের সিন্দুক।

শিমুলতুলোর চুল তোমার, তুলতুলে মুখ;
নক্ষত্রের রঙ মেখে বসে থাকো দিবারাত্রিকাল।
ভুলোঝড়ে মুছে গেছে স্নায়ুর সংযোজক
মনঘরে চৈত্রখরা; কোথাও স্মৃতি নেই, কেবলই ভীতি।

চারিদিকে হৈ-হৈ রৈ-রৈ, আমরা মুখরা;
অগাথ দিয়েছো তুমি;
কী দিবো ফিরিয়ে তোমার
কিছুতো বাকী রয়ে যায়, অমূল্য রতন।


সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৯
৩৫টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×