(কোনও এক মহাজগতের দৈব শিশুরা, যাদের আমরা পথশিশু বলি - তাদের জন্য)
রাত সুগভীর; কালো শহরটা সাদা কুয়াশায় ঢাকা
ল্যামপোস্টের হালকা আলোয় যাচ্ছে না পথ দেখা
দূরের আকাশ বা আরো দূরের তারাদের দিকে চেয়ে
খালি পায়ে হেঁটে চলছে একা ছোট্ট একটি মেয়ে।
ক্ষুধার জ্বালা পাচ্ছে না টের - অভিমানে নাকি শোকে !
কান্নাও তার পাচ্ছে না আর অদ্ভুত দু'টি চোখে।
সামান্য কিছু টাকা পেয়েছিল সারাটা দিন শেষে -
তাও কেড়ে নিল দুষ্টু মতন কয়েকটা ছেলে এসে...
বাড়িতে তার মামি আছে বসে - খালি হাতে ফিরে গেলে
হাড়-গোর বুঝি রাখবে না আর একবার কাছে পেলে !
বুঝবালিকা'র অবুঝ রুগ্ন পা-দুটো তার সাথে
বিদ্রোহ করে চলল না আর, পড়ল সে শুয়ে পথে
পাতলা কাপড় মানছে না আর - এত বেশি শীত আজ
দূর্বল ফুসফুসও যেন করছে না আর কাজ।
অশ্রুর ধারা ঝরে সাথে সাথে জমে হয়ে যায় কাঁচ
এমন শীতে যদি পেত সে একটু গরম আঁচ -
হঠাৎ দেখে আকাশ হতে লক্ষ তারায় হেসে
পরীর বেশে কে যেন তার সামনে নেমে এসে
আলতো করে তুলে ধরে তার শীর্ণ দু'হাত টানি
পরম আদরে কোলে তুলে নিল ছোট্ট সে দেহখানি!
হঠাৎ চমকে উঠে দেখে এযে তার মায়ের মুখ !
কাঁদতে লাগল কাঁচবালিকা - কান্নায় এত সুখ?
কাঁদতে কাঁদতে বলল, সজোরে মায়ের হাতটি ধরে
চলে যেও না একা ফেলে মা'গো আবার চুপটি করে?
পরম যত্নে টুকরো টুকরো কাঁচগুলো হাতে তুলে
মৃতা-মা তাকে কোলে নিয়ে নেচে মৃদু তালে দুলে দুলে
অদ্ভূত সুরে শুনিয়ে গেল স্বর্গের এক গান
অবাক মেয়ের হাসিতে সে রাতে জোছনাও হল ম্লান।
কিছু না ভেবেই এই পৃথিবী'র সব মোহ-মায়া ছাড়ি
মায়ের সাথে মেয়েও জমালো স্বর্গের পথে পাড়ি।
স্বর্গ থেকে লাখো দেবতারা নিয়ে এল মহারথ
কুড়ালো কাঁচের কণাগুলো - এযে স্বর্গেরই সম্পদ...
কাঁচ সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ছোট্ট সেই মেয়েটি
মৃত্যুর ওপারে পৌঁছে দেখে - জীবন কত্ত খাঁটি !
এক এক করে শেষ হয়ে আসে কাঁচের টুকরো তোলা
পরে থাকে পথে ছোট দেহখানি - চোখ দুটো তার খোলা...
পরদিন পত্রিকার একটি ছোট্ট খবর : "প্রবল শৈত্যপ্রবাহে আরও এক শিশুর মৃত্যু..." - একটি নৈমিত্তিক খবর। এসব খবর আমাদের অনুভূতিতে আর লাগে না।
কিন্তু এই খবরের সাধ্য কী যে এই মৃত্যুর মহিমা বোঝায়???
******************************************************************
এবার আলাদা করে বলার কিছু কথা। এ কবিতাটা বা কবিতার কিছু অংশ কারও কারও চোখে বেশ অপরিণত। স্বীকার করছি, কারণ এটা আমার প্রথম দিকের লেখা। আর যে কারও প্রথম দিকের লেখাই আবেগে থরো থরো ভাব থেকে যায়। জানুয়ারী'র এক শীত রাতে টিউশনি করে ফেরার পথে, বাসের জানালা দিয়ে দেখি ল্যামপোস্টের নীচে একা বসে একটা বাচ্চা কাঁপছে। শীতে নাকি কান্নায়? জানি না, বাস থেমে থাকে না। কিন্তু দৃশ্যটা থেমে ছিল আমার মাথায়। সে রাতে আর ঘুম হয়নি। কাঁচবালিকার জন্ম দিয়ে একটা গভীর কষ্ট নিয়ে ভোরের দিকে গাঢ় ঘুম হয়।
কাঁচবালিকা'দের তবু ঘুম হয় না। গতকাল রাতে উত্তর ঢাকা'র তাপমাত্রা দেখেছিলাম সেলসিয়াস স্কেলে ১৪। ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করার পরও দেয়ালের জমানো ঠান্ডায় আমার রুম হিম হয়ে ছিল। সুযোগ পেলেই লেপের নিচে পা-ঢুকিয়ে বসে ছিলাম। অথচ এটুকুও সবাই পায় না। বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো হাড়কাঁপানো শীতে অসহায়ের মত কাঁপছে, অশ্রু পর্যন্ত জমে যাচ্ছে...
আমি কোনও সচেতনতা সৃষ্টি করতে আসিনি, কারণ আমি জানি আপনারা সবাই-ই এসব বিষয়ে সচেতন। আমি আনুষ্ঠানিক কোনও উদ্যোগ নিয়েও আসিনি। আমি মোটেও সংগঠক-টাইপ কেউ না, পাঁচজনের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ঠিকমত কথা পর্যন্ত বলতে জানি না। শুধু বলতে চাই, ব্যক্তিগত পর্যায়ে হলেও, নিজেদের জায়গায় থেকে আমরা কী শুধুমাত্র একটি করে পরিবারকে সাহায্য করতে পারি না? যাদের কম্পিউটার-ল্যাপটপ আছে, যারা এই লেখা পড়ছেন; তাঁদের ঘরে দু'চারটা পুরোনো শীতের কাপড় থাকা এমন কিছু অস্বাভাবিক না, যেগুলো এখন খুব ব্যবহার হয় না। আমি জানি আপনারা অনেকে এমন সাহায্য করে থাকেন, তবু বলে বিরক্ত করলাম আবার। হয়তো বাকিদের জন্য।
(আচ্ছা, এই কবিতাটা কিন্তু রিপোস্ট। আমার পুরোনো পাঠক'রা এটা আগে পড়ে থাকতে পারেন। এই লেখাটা ব্লগে প্রথম যখন প্রকাশ করি তখন 'প্রথম পাতা'য় একসেস-ও পাইনি। সবার অগোচরে লেখাটা পেছনে পড়ে যায়। তাই নির্লজ্জের মত রিপোস্ট দিলাম)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৪০