সকাল থেকে কিবোর্ড কোলে করে বসে আছি। একটা দুর্দান্ত গল্প লিখতে হবে। বহুদিন লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম। প্রাক্তন প্রেমিকার মত ইদানীং মাথার ভিতর আবার তার ডাক শুনছি।
কিন্তু কি নিয়ে লিখব? কত আইডিয়া ঘোরাঘুরি করে মাথার ভিতর, কিন্তু তাকে অক্ষরের জালে বন্দী করতে গেলেই আঙুলের ফাঁক গলে পালিয়ে যায়। মহা মুশকিল। সকাল পেরিয়ে বাইরে দুপুরের কড়া রোদ উঠে গেছে, কিন্তু আমার মনিটরের সাদা বুকে একটা কাল অক্ষরও জায়গা করতে পারেনি।
জানালার বাইরে দিয়ে ব্যস্ত রাস্তা দেখা যাচ্ছে। একটা লোক রাস্তার উল্টোপাশে দাড়িয়ে আছে। উস্কোখুস্কো চুল, আধময়লা পাজামা পাঞ্জাবী। মুখে খোচাখোচা দাড়ি। হাড়গিলে চেহারা। কাধে একটা ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ। ইতিউতি তাকাচ্ছে, কাউকে খুজছে বোধহয়।
আচ্ছা, এই লোকটাকে নিয়েই লিখি না কেন? মনে মনে লোকটার আসল পরিচয় কল্পনা করার চেষ্টা করলাম আমি। লোকটার পেশা কি হতে পারে? সরকারি অফিসের কেরানী? মানিয়ে যায়। ছাপোষা চাকুরে। পরিবারের সদস্য সাত আট জন। জীবনের বোঝা বইতে গিয়ে কুজো হয়ে গেছে। ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন বাকি, হাড়িতে চাল চড়ছে না তিন দিন ধরে।
মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। একটা প্লট দাড়িয়ে যাচ্ছে। গল্পের সুচনা তৈরি করা গেল, এবার আস্তে আস্তে কাহিনী বিল্ড আপ করতে হবে। ধরা যাক একদিন সকালে উঠে লোকটা আর দশ পাচটা দিনের মতই অফিসে গেল। অফিসে গিয়ে শুনল, হিসাবে গরমিল থাকায় এবং অফিসের টাকাপয়সা খোয়া যাওয়ায় তাকে ছাটাই করা হয়েছে। সাথে তহবিল তছরুপের মামলা। এক সপ্তাহের মধ্যে দশ লক্ষ টাকা দিতে না পারলে বাকি জীবনটা জেলের ঘানি টেনে কাটাতে হবে তাকে। রাস্তায় বসবে পুরো পরিবারটা।
কি করবে এখন সে?
ছয় দিন পার হয়ে গেছে। গত ছয় দিনের মতই আজও ভোরবেলা বের হয়েছে লোকটা। কিন্তু কোথায় যাবে ঠিক করতে না পেরে এই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোজ নেয়া হয়ে গেছে তার। জমিজমা, বাড়িঘর এমন কিছুই নেই তার যেটা থেকে এত টাকার যোগাড় হতে পারে। স্কুল কলেজের যে দুয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ ছিল তারাও টাকার কথা শুনে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখে অন্ধকার দেখছে লোকটা, আত্মহত্যা ছাড়া কোন উপায় দেখছে না সামনে।
দারুন একটা কাহিনী সাজিয়েছি, চোখ বুজে নিজের মনেই আত্মপ্রসাদের একটা হাসি দিলাম আমি। এবার আর আমাকে ঠেকায় কে! গল্পের পটভূমি তৈরি হয়ে গেছে, এবার ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোতে হবে। এই ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সে কি করবে এখন? আত্মহত্যা করে সব যন্ত্রনার অবসান ঘটাবে? নাকি...
পাঠককে এখানে একটু টেনশনে রাখতে হবে। সাবধানে সাজাতে হবে গল্পের কথাগুলো, যাতে লোকটার মনের অবস্থা পাঠক অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারে। তারমতই সন্দেহের দোলাচলে ভোগে, আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কেমন লাগে সেটা উপলব্ধি করতে পারে।
ঠিক এই সময় দরজায় কারও টোকা পড়ল। ঠক ঠক ঠক! ঠক ঠক ঠক!
সবেমাত্র গল্পের প্লট সাজিয়ে নিয়ে কীবোর্ডে ঝড় তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এ সময় এই অযাচিত উপদ্রবে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে উঠলাম। কে রে বাবা এই অসময়ে? নিজের মনে গজগজ করতে করতে উঠলাম চেয়ার থেকে।
দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে দেখলাম, একটু আগে দেখা সেই উস্কোখুস্কো চুলের আধপাগল টাইপ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে! আমার চোখে চোখ পড়তেই এমন ভাবে হাসল যেন আমার কতদিনের চেনা। 'কেমন আছেন, বিখ্যাত লেখক আশরাফ মাহমুদ সাহেব?' জিজ্ঞেস করল আমাকে। হাসিমুখেই করল প্রশ্নটা, কিন্তু কেমন জানি একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর!
হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠলাম আমি। ভাবলাম, জানালা দিয়ে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে হয়তো। কিন্তু আমার নাম জানল কিভাবে?
যেন আমার মনের কথা পড়তে পেরেছে লোকটা, এমন ভাবে বলল লোকটা, ‘আপনার নাম জানলাম কিভাবে সেটা ভাবছেন তো? বলছি সবই। ভেতরে আসতে পারি?’ বলেই আমার অনুমতির অপেক্ষা না করেই একরকম আমাকে ঠেলে সরিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
‘আরে আরে, কি করছেন? কে আপনি?’ বলে প্রায় চিৎকারই করে উঠলাম। কিন্তু কোন বিকার দেখা গেল না লোকটার মধ্যে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকটার কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম আমি। একজন অপরিচিত মানুষ সাধারণত নতুন কোন জায়গায় আসলে চারদিকটা ভালভাবে দেখে নেয় আগে। কিন্তু লোকটার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল আমার ঘরটা তার অনেক দিনের চেনা। ঢুকেই কোন দিকে না তাকিয়ে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়ল। একটা পা তুলে দিল টেবিলের পাশে আমার এলোমেলো বিছানার উপর। তারপর টেবিলের উপর পড়ে থাকা ল্যাপটপের খালি স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নতুন গল্প লিখছেন নাকি?’ ঠিক প্রশ্ন নয়, অনেকটা স্বগতোক্তির সুরে।
আমি একটু মাথাগরম টাইপের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্র রাজনীতির সাথে বেশ ভালভাবেই জড়িত ছিলাম, সামান্য কারণে মারপিট বাঁধিয়ে দিতাম যার তার সঙ্গে। ঝামেলায় যে পড়িনি এমন নয়, কিন্তু প্রতিবারই বেঁচে গেছি বিভিন্ন ভাবে। তবে যেদিন আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার রুমমেট রায়হান বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতে মার খেয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এই লাইন আমার নয়। টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিল, একটা পত্রিকায় সাংবাদিকের চাকরী নিয়ে সরে এসেছিলাম রাজনীতি থেকে। মনে মনে ভয় ছিল, দলের বড়ভাইরা কোন ঝামেলা করে কিনা এই ভেবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তারা যেন ভুলেই গিয়েছিল আমার কথা।
এতদিনে মাথার বেয়াড়া রগটা ঝিমিয়ে এসেছিল। আজ এই লোকটার অদ্ভুত আচরণে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। দুপদাপ করে পা ফেলে লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই মিয়া? সমস্যা কি আপনার? কথা নেই বার্তা নেই এভাবে একটা লোকের ঘরে ঢুকে পড়াটা ঠিক নয়, এই কথাটা আপনার জানা নেই?’ মনে মনে ঠিক করেছি সোজা কথায় কাজ না হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
‘আশরাফ সাহেব, অস্থির হবেন না। আপনার জীবন থেকে শুধু কয়েকটা মিনিটের অপচয় ঘটাব আমি। দয়া করে শান্ত হয়ে বসুন।’ সম্পূর্ণ ঠান্ডা গলায় বলল লোকটা। ইশারা করল বিছানার দিকে, আমাকে বসতে বলছে।
অনিচ্ছাসত্বেও বসলাম আমি। ‘বলুন, কি বলবেন।’
‘আপনি তখন ভাবছিলেন যে আমি আপনার নাম জানলাম কিভাবে, তাই না? এখনও হয়তো তাই ভাবছেন, শুধু রাগের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছে প্রশ্নটা। রাগ খুব খারাপ জিনিস, বুঝলেন আশরাফ সাহেব? অনেক বড় বড় মানুষকে শুধু ঠিক সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে না পারার কারণে অকালে মরতে দেখেছি আমি।’ মুচকি হাসল লোকটা।
লোকটার কথার ভিতরে এমন কিছু একটা ছিল যে আরও ক্ষেপে ওঠার বদলে কেমন যেন মিইয়ে গেলাম আমি। ‘কি বলতে চান?’
‘সবই বলব। একটু সময় নিন, মাথা ঠান্ডা করুন। ফ্রিজ আছে না আপনার ঘরে? দয়া করে এক গ্লাস পানি খান। আমাকেও এক গ্লাস দিতে পারেন, বাইরে খুব গরম পড়েছে।’
কোন কথা না বলে উঠে গেলাম আমি। ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে এসে দিলাম লোকটাকে। নিজে খেলাম না। পানির গ্লাসটা এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেলল লোকটা। তারপর বলল, ‘আপনি খেলেন না? ঠিক আছে। খেলেই কিন্তু ভাল করতেন।’
‘পানির পিপাসা লাগেনি আমার। দয়া করে আপনার পরিচয়টা দিন, তারপর কি কাজে এসেছেন আমার কাছে সেটা বলে বিদেয় হোন। আমি ব্যস্ত আছি।’
‘হ্যা হ্যা, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’ ল্যাপটপের দিকে ইঙ্গিত করে বলল লোকটা। ‘ঠিক আছে, আমার হাতেও বেশি সময় নেই। আপনার কাছে আমার কাজটা শেষ করেই চলে যাব।’ পানির গ্লাসটা ল্যাপটপের পাশে নামিয়ে রাখল লোকটা।
‘প্রথমে তাহলে আমার পরিচয়টা জানতে চাচ্ছেন আপনি। যদি সহজ কথায় বলি তাহলে আমি একজন লেখক। আপনার সমগোত্রীয় প্রাণী আর কি।’
‘তাই নাকি?’ চেষ্টা করেও গলা থেকে ব্যঙ্গের সুরটা লুকাতে পারলাম না আমি। তারপর মনে হল, কেন লুকাব? এই ব্যটার কাছে আমাকে ভদ্রতা দেখাতে হবে নাকি? লোকটার আপাদমস্তক চোখ বুলালাম আমি, ‘আমার সমগোত্রীয় একটা প্রাণীর যদি এই করুণ দশা হয়, তাহলে বলতে হবে যে গোত্র পরিবর্তন করার সময় এসে গেছে। তা কি লেখেন আপনি?’
‘আমি গল্প লিখি। জীবনের গল্প।’ আমার খোঁচাটা যেন সহজভাবেই নিল লোকটা।
‘জীবনের গল্প? ওরে বাবা। খুবই কঠিন সাবজেক্ট। এজন্যেই বোধহয় আপনার এই অবস্থা।’
‘হা হা হা... খারাপ বলেননি। তাছাড়া আমার গল্প পড়ার মত পাঠক এখনও তৈরি হয়নি, আর প্রকাশকও এখনও বাজারে আসেনি। আমি নিজেই আমার গল্পের লেখক, পাঠক।’
দারুন পাগলের পাল্লায় পড়েছি, বুঝতে পারলাম আমি। কিন্তু এই পাগলের হাত থেকে নিস্তার পাই কিভাবে? বললাম, ‘বুঝতে পেরেছি। খুবই উচ্চমার্গীয় সাহিত্যিক আপনি। পাঠকের মাথার তিন হাত উপর দিয়ে যায় আপনার লেখা, তাই বোধহয় কেউ পড়ে না। এখন বলুন, আমার কাছে আপনার কি দরকার?’
‘আশরাফ সাহেব, আপনি তো একজন দেশবরেন্য লেখক। আজ দেশের প্রতিটা সাহিত্যপ্রেমী মানুষ আপনার নাম জানে, আপনার লেখা পড়ার জন্য হা পিত্যেস করে বসে থাকে। প্রকাশকরা আপনাকে নিয়ে টানাটানি করে। আপনার ‘মেঘের চোখে জল’ উপন্যাসটা বাংলাদেশে বেস্টসেলার তালিকায় রয়েছে ছয় মাস ধরে, এমনকি দেশের বাইরেও অনুবাদ হচ্ছে। সিনেমাও নাকি তৈরি হবে বইটা থেকে। পাঁচ বছর হল লেখালেখি শুরু করেছেন, এর ভিতরে এমন উন্নতি খুব কম লেখকের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। তাই না?’
নিজের প্রশংসা শুনে আমার রাগ একটু হলেও কমতে শুরু করল। হাজার হোক প্রশংসাবাক্য, হোক সেটা কোন পাগলের মুখ থেকে শোনা। গলাটা একটু নরম করলাম। বললাম, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। আপনি নিশ্চয়ই আমার প্রশংসা করতে আসেননি? কি জন্য এসেছেন সেটা বলুন।’
‘আমি নিজেও একজন লেখক। গল্প লিখি। প্রচুর গল্প লিখেছি আমার এই জীবনে, কিন্তু কখনও কাউকে পড়তে দিইনি সেটা। আপনিই হবেন আমার গল্পের প্রথম পাঠক।... ঠিক ধরেছেন। নতুন একটা গল্প লিখেছি আমি, সেটা আপনাকে পড়তে হবে। পড়ে আমাকে জানাবেন কেমন হয়েছে। কেমন?’
এতক্ষণে ব্যাটার মতলব ধরা গেল তাহলে। রিকমেন্ডেশন নিতে এসেছে। গল্পটা পড়াবে আমাকে দিয়ে, তারপর কোন পত্রিকার সম্পাদক বরাবর একটা অনুরোধ লিখে দিতে বলবে গল্পটা ছাপানোর জন্য। মনে মনে লোকটাকে ভাগানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছি আমি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কই আপনার গল্প?’
মৃদু হাসল লোকটা। আমার ব্যস্ত ভাবটা ধরে ফেলেছে নিশ্চয়ই। কাঁধে ঝোলানো আধময়লা ঝোলাটার ভেতরে হাত ঢোকাল। ভেতর থেকে বের হয়ে আসল এক তাড়া সস্তা নিউজপ্রিন্টের কাগজ। বহু নাড়াচাড়ায় মলিন হয়ে গেছে কাগজের কিনার। এখানে ওখানে ময়লা আঙুলের দাগ। গল্প পড়ার জন্য এমনিতেই কোন আগ্রহ অনুভব করছিলাম না, কাগজের অবস্থা দেখে এবার বিতৃষ্ণা জেগে উঠল মনের ভেতর।
‘আপনি ওটা রেখে যান আমার কাছে। এক সপ্তাহ পরে আসবেন, আমি জানাব কেমন হয়েছে।’
‘না আশরাফ সাহেব। আপনি ওটা এখনই পড়বেন। এই মূহুর্তে।’ মৃদু মৃদু হাসছে লোকটা। এক ঘুষিতে ব্যাটার মুখের মানচিত্র বদলে দিতে ইচ্ছে করল আমার। কিন্তু পাগল ছাগল বলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ভাবছি কি করা যায়। গলাটা যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বললাম, ‘দেখুন, এভাবে হুট করে বললেই তো আমি কাজটা করতে পারব না। সবকিছুর একটা আলাদা সময় আছে। তাছাড়া এখন অন্য একটা কাজ আছে আমার হাতে।’
‘আহ, সেই তখন থেকে কাজ কাজ করে বকবক করে যাচ্ছেন। কি ছাই কাজটা করেছেন শুনি? সকাল থেকে তো বসে ছিলেন ওই ল্যাপটপ নিয়ে। একটা শব্দও লিখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত আমাকে নিয়েই গল্প লেখার চেষ্টা করছিলেন। হ্যাহ, আমাকে বানিয়েছেন সরকারী অফিসের কেরানি! আপনার কল্পনাশক্তির দৌড় কতটুকু খুব ভালভাবেই জানা আছে আমার।’
মেরুদন্ডের ভেতর শিরশির করে ভয়ের একটা ঢেয় বয়ে গেল আমার। চোখে নগ্ন বিস্ময় আর আতঙ্ক নিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। যে কথা আমি এখনও আমার মাথার বাইরেও বের করিনি তা এই লোক কিভাবে জানল? এটা কিভাবে সম্ভব? প্রশ্ন করতে চাইলাম, কিন্তু গলা দিয়ে বিদঘুটে একটা আওয়াজ ছাড়া কিছুই বের হল না।
আফসোসের ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ল লোকটা। ‘এজন্যেই বলেছিলাম, পানিটা খেয়ে নিলে ভাল করতেন। এখন আর সে সময় নেই। নিন, পড়া শুরু করুন।’
লোকটার উন্মাদ দৃষ্টির সামনে নিজেকে হঠাৎ করেই খুব ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হল। ভয়ে ভয়ে একবার ঢোক গিয়ে টেবিলের উপর থেকে কাগজের তাড়াটা তুলে নিলাম। প্রথম পাতাটা খালি। পুরনো এবং সস্তা কাগজ। এক কোনায় লাল সাদা রঙের সুতো ঢুকিয়ে সবগুলো পাতাকে এক সাথে বাঁধা হয়েছে। প্রথম পাতাটা আস্তে আস্তে উল্টালাম। ওপাশে জড়ানো হস্তাক্ষরে কাগজের এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে সারি সারি শব্দ। পড়তে শুরু করলাম আমি।
“১২ জানুয়ারী ২০০৯।
মধ্যরাতের নির্জন রাস্তায় ঘন কুয়াশা ভেদ করে ভেসে আসছে একটা পায়ের শব্দ। দৌড়াচ্ছে পায়ের মালিক। প্রাণ হাতে করে দৌড়াচ্ছে। পেছন পেছন ধাওয়া করে আসছে চার- পাঁচজন ষন্ডামার্কা যুবক। সবার হাতে ধারালো অস্ত্র। ঢাকা শহরের এই গলিতে আরও একটি রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠছে।
সামনের যুবক দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করেই ডানে মোড় নিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট এক গলির ভেতর ঢুকে গেল। এখানে এক মেসে তার বন্ধু রায়হান থাকে। রাস্তার প্রায় সাথেই তার রুমের দরজা। হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় টোকা দিল সে। প্রায় সাথে সাথে দরজাটা খুলে গেল। দৌড়ে আসা যুবক সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে পড়ল, কিন্তু তার পেছন পেছন আসা লোকগুলো ততক্ষণে তাকে দেখে ফেলেছে।
রায়হান তার বন্ধুকে রুমের ভেতর দিকে সরু একটা দরজা দিয়ে বাইরে বের করে দিল। সামনের দরজায় ততক্ষণে দমাদম বাড়ি পড়তে শুরু করেছে। পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দিল রায়হান, তারপর কিছুক্ষণ দ্বিধা করে সামনের দরজাটা খুলল। সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে পড়ল ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ জন গুন্ডা। একজন রায়হানের কলার চেপে ধরল, বাকিরা রুমের চারদিকে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করল। মিনিটখানেকের মধ্যেই তারা বুঝতে পারল, উড়ে গেছে পাখি। পেছনের দরজাটা খুলে দুইজন বের হয়ে গেল পলাতক যুবকের খোঁজে। এবার বাকিরা রায়হানকে চেপে ধরল মেঝের সাথে। নেতাগোছের লোকটা হাতের চাপাতিটা তুলে ধরে দাঁড়াল রায়হানের ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনে, তারপর হাত আর পায়ের নির্দিষ্ট কয়েকটা জায়গায় গায়ের জোরে কোপাতে শুরু করল। রায়হান চিৎকার করে উঠতে গেলে একজন তার মুখ চেপে ধরল। কয়েকমিনিট পর কাজ শেষ করে লোকগুলো রুম থেকে বের হয়ে গেল। পেছনে পড়ে থাকল রায়হান। রক্তাক্ত, জ্ঞানহীন।
ওদিকে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া যুবক তখনও দৌড়াচ্ছে। পেছনে ধাওয়া করে আসছে আততায়ীর দল...
যুবকের নাম আশরাফ মাহমুদ।"
(আগামী পর্বে সমাপ্য)