সেখান থেকে স্থানীয় সাহাবাড়ী হয়ে ঘোরা পথে উপজেলা সদরে যেতে
বাধ্য হন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এ প্রতিবেদক গৃহবধূর পথরোধকারীর কাছে গিয়ে এ রকম করার কারণ জানতে চাইলে তিনি নিজেকে ছারছিনা দরবার শরিফের খাদেম আবদুল খালেক মাতুব্বর বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘ওই সাইনবোর্ডটি পড়েন।’ অদূরেই সড়কের পাশে সাইনবোর্ডের কাছে যান এ প্রতিবেদক। তাতে লেখা, ‘এই পথে মহিলাদের যাতায়াত নিষেধ।’ দেখা গেল, সাইনবোর্ডের কাছেই পথের এক পাশে ছারছিনা দারুস সুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসা এবং উল্টোপাশে ছারছিনা দরবার শরিফ। স্থানীয় লোকজনের দেওয়া তথ্যমতে, ছারছিনা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন এ রাস্তায় সাইনবোর্ডটি স্থাপন করেছে।
জানা গেছে, বিতর্কিত পীর মরহুম শাহ্ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ ১৯৭৩-৭৪ সালে এ রাস্তায় নারীদের চলাচল নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চালান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর থেকে এ রাস্তায় নারীদের চলাচলে বাধা দেওয়া শুরু হয়। ফলে ওই দুই গ্রামের (মাগুরা ও ছারছিনা) সহস্রাধিক নারীকে সাহাবাড়ীর পথ ধরে প্রায় দ্বিগুণ দীর্ঘ বিকল্প সড়কে উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়।
রাস্তায় নারীদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা হয় স্বরূপকাঠি সদরে অবস্থিত শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজের একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে, যাঁদের বাড়ি ছারছিনা ও মাগুরা গ্রামে। স্মাতক দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই আমরা মেয়েরা এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে পারি না। এ সড়কে বোরকা পরে হাঁটতে গিয়েও হুজুরদের গালমন্দ শুনতে হয়।’ তিনি জানান, সাহাবাড়ী, জগৎপট্টি হয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলেজে যেতে সময় বেশি লাগে। কিন্তু মাগুরা-ছারছিনা-স্বরূপকাঠি সড়ক দিয়ে মাত্র আধাকিলোমিটার গেলেই কলেজে পৌঁছা যায়।
জানা গেল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় ছারছিনার পীর মাওলানা শাহ ছুফী মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ স্বউদ্যোগে ওই রাস্তায় সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ছারছিনা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ রাস্তায় এ-সংক্রান্ত সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর সেটি খুলে ফেলা হয়। কিন্তু এখনো সন্ধ্যার পর জনসাধারণ এ রাস্তা ব্যবহার করতে পারে না।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ছারছিনার বাসিন্দা হাফেজ মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দালাল আইনে আটক ছারছিনার তৎকালীন পীর শাহ্ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ ২৩ মাস কারাভোগের পর ছাড়া পেয়ে ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে এক দিন আমাকে তাঁর বাসায় ডেকে নেন। আমি তখন স্বরূপকাঠি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। মাগুরা-ছারছিনা-স্বরূপকাঠি সড়কে মহিলারা যাতে চলাচল করতে না পারে, এ জন্য তিনি আমার সহযোগিতা চান। তাঁর (পীরের) যুক্তি, মহিলারা দরবার শরিফের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় জোরে কথা বলবে, তাতে মাদ্রাসার ছাত্র এমনকি মাহফিলে আসা মুসল্লিদের সমস্যা হবে।’ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই পীর সাহেবের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছি। কিন্তু বিভিন্ন সময় রাস্তাটিতে শুধু মহিলা নয়, সাধারণ পুরুষদেরও চলাচলে বাধা দিয়ে আসছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে প্রশাসনকেও জানানো হয়েছে। তবে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
স্থানীয় বাসিন্দ সায়াদাতুল্লাহ বলেন, ১৯৭৯ সালের দিকে ছারছিনা মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্রদের ওপর বহিরাগতরা হামলা করেছে- এমন অভিযোগ তুলে শিক্ষক-ছাত্ররা স্বরূপকাঠিতে মিছিল করে। ওই সময় তারা রাস্তাটি বন্ধের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে। কিন্তু এলাকাবাসীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে প্রশাসন রাস্তাটি বন্ধ করেনি।
স্বরূপকাঠি থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মজিবুর রহমান বলেন, ‘চারদলীয় জোট সরকারের সময় থেকে ওই রাস্তায় মহিলাদের চলাচলে বাধা দিয়ে আসছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি আমরা প্রশাসনকে বলেছি। কিন্তু প্রশাসন থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।’
স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নূরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাস্তায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে মহিলাদের চলাচল নিষিদ্ধ করা হবে- এটা তো ধর্মীয় বিধানেও নেই। পীর সাহেব বা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এ ধরনের কোনো কাজ করে থাকলে আমি তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলব, যাতে তারা রাস্তাটি মহিলাদের চলাচলে জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।’ রাস্তা উন্মুক্ত করতে এলাকাবাসীর আবেদনের ব্যাপারে ইউএনও বলেন, ‘সাত মাস হয়েছে, আমি এখানে দায়িত্বভার নিয়েছি। এ সময়ের মধ্যে আমার কাছে এ ধরনের কোনো আবেদন আসেনি।’
সর্বশেষ গতকাল সোমবারও সাইনবোর্ডটি দেখা গেছে বলে স্বরূপকাঠির একাধিক স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল ছারছিনা মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সৈয়দ মো. সরাফত আলীর মোবাইল ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করা হয়নি।
-রফিকুল ইসলাম, ছারছিনা থেকে ফিরে
সূত্র: কালের কণ্ঠ (http://www.kalerkantho.com)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:৩৩