ঢাকার ব্যস্ততম একটি এলাকায় ছয়তলা বিল্ডিংয়ের টপফ্লোরে আমাদের বসবাস। সংসারে কনিষ্ঠতম সদস্যের বয়স সাড়ে চার। রাস্তার পাশের বিল্ডিং হওয়ায় এমনিতেই শব্দদূষণ কম নয়। হঠাৎ করে পাশের প্লটে টিনের ঘরগুলো ভেঙে শুরু হয়েছে বিল্ডিং নির্মাণ। শুরু হলো দানবীয় শব্দ। বাচ্চাদের সান্তনা দেই, এই হলো নগরের যন্ত্রণা, সহজভাবে নাও। আমরা যে সুন্দর ফ্ল্যাটে আছি তা-ও এভাবেই তৈরি হয়েছে। একপাশের জানালাগুলো বন্ধ করে বিপরীত দিকের রুমগুলোতে কতগুলো দিন পার করতে হবে।
শব্দ-অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গেল যখন সারা রাত ধরে কাজ করা শুরু হলো। বউ-বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলো। বুঝলাম আর থাকা যাবেনা। দেশে কি আইন-কানুন কিছু নেই? একেবারে মগের মুল্লুক? সাধারণ জ্ঞানে জানি, আইনে এসবের প্রতিকার থাকা উচিত। এসবের দায়িত্ব কার? নিশ্চয়ই রাজউকের। তাদের ওয়েবসাইট ঘাটলাম। এক জায়গায় পেলাম, 'আবাসিক এলাকায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টায় পর্যন্ত কোনো নির্মাণ কাজ চলবে না এবং দিনে-রাতে কখনোই ক্র্যাশিং মেশিনে পাথর বা ইট ভাঙানো যাবেনা'। কাকে বলা যায়? পেলাম এলাকা-ভিত্তিক অথরাইজ অফিসারদের তালিকা এবং ফোন নম্বর। বাহ্, এইতো ডিজিটাল বাংলাদেশের আলামত।
ভাবলাম, যেহেতু ওরা আইন ভঙ্গ করছে, তাই পুলিশকে জানানো উচিত। তবে আরেক ভাবনা মনে উদয় হলো, বিল্ডিং যারা বানাচ্ছে তারা না-কি সন্ত্রাসী টাইপের। এর আগে আমাদের নিচের ফ্লাটে এক পরিবারকে তুচ্ছ কারণে নাজেহাল করেছে। নগরজীবনের ভীতু স্বভাব সক্রিয় হয়ে উঠলো, তবে আমার গোয়ার স্বভাবও কম নয়। ভাবলাম প্রয়োজনে এলাকা ত্যাগ করবো, তবুও এই অত্যাচার মেনে নিয়ে বউ-বাচ্চাদের কষ্ট মেনে নেওয়া যাবেনা। সুন্দর ফ্লাট আর যুক্তিসঙ্গত ভাড়ার কথা চিন্তা করে মোটামুটি একদিন ভাবলাম।
অবশেষে, রাত সাড়ে বারোটায় ধানমন্ডি থানায় ফোন দিলাম। সরাসরি নম্বরটি ব্যস্ত। ৯৯৯-এ ফোন করে ধানমন্ডি থানায় চাইলাম। জানালো, ৯৯৯-এর এক্সটেনশান নম্বরটি নষ্ট রয়েছে, আমি যেন সরাসরি ফোন করি। বললাম, ওটাতো ব্যস্ত। একটু ঝাজসহ উত্তর দিল, 'ব্যস্ততো থাকবেই।' কথাতো ঠিক।
অবশেষে পেলাম। ছালাম দিয়ে নাম পরিচয় উল্লেখ করে জানতে চাইল, 'বলুন স্যার'। বাহ্, বেশ ভদ্রতো। সমস্যা জানালাম, আইনের উল্লেখ করলাম। তিনি নাম ঠিকানা নিলেন, মোবাইল নম্বর চাইলেন। দিলাম। এরপর বললেন, 'একটি মোবাইল নম্বর নিন। তিনি এস আই শাকরুল হক খান। আপনার এলাকায় এখন ডিউটিতে আছেন। তিনি ব্যবস্থা নেবেন'। একটু বিরক্ত হলাম মনে মনে। আবার গোড়া থেকে বলতে হবে। যাক, চেষ্টা করি। রাত একটা নাগাদ ফোন দিলাম। এবার ছালাম-টালাম নেই। ভাবখানা এমন যে, বাড়ীর কেউ ফোন করেছে। সব বলার পর উৎসাহ নিয়ে লোকেশান জানতে চাইলেন। অনুভব করলাম বাংলা সিনেমার হিরোর মতো রওয়ানা হলেন। কিছু সময় অপেক্ষা করে আবার ফোন দিলাম, ভাই আপনি কি আসছেন? সে জানালো, আমরাতো আপনার কথামতো সেই লোকশানে। কিন্তু কৈ, কিছুতো দেখছিনা। আরেকটু ভেঙে বলার পর সে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছলো। গিয়েই হম্বিতম্বি। 'ঐ কাজ বন্ধ কর! এতরাতে কাজ করস, মানুষ ঘুমাইবোনা? এলাকাবাসী কমপ্লেইন করে। কাজ বন্ধ কর!!' পাইলিং যন্ত্র চালানো লোকজন ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেল। 'জ্বী স্যার, জ্বী স্যার। বন্ধ করতাছি।'
নায়ক এস আই আবার হুশিঁয়ারি দিল, আর কখনো রাতে কাজ করবিনা। মনে থাকে যেন। ওরা জানালো, 'জ্বী স্যার জ্বী স্যার'।
খুব শান্তি পেলাম। ধন্যবাদ দিতে ফোন করলাম। তার সেই কর্কশ ভাব। 'হ্যা, ওদের কাজ বন্ধ করে দিছিতো। আর করবেনা'। বললাম, থ্যাংক ইউ। সে খুশী হলো। এবার আমার আশঙ্কার কথা জানালাম। সে বললো, 'ওসব ক্যাডার-ফ্যাডার আমরা পাত্তা দেই না। আইনমতো চলতে হবে।'
আহ্ কী মধুর বাণী! ধন্যবাদ পুলিশ বিভাগ। আপনাদের মঙ্গল হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১২:৪৭