শাফিক আফতাব
বাস থেকে যখন নামলাম তখন গোধূলীর অবসান । সন্ধ্যার হালকা আবছায় অন্ধকার সারা পৃথিবীকে গ্রাস করতে চলছে। পথে মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই ঘন অন্ধকার আমাকে গিলে ফেলেছে। সোডিয়াম লাইটের আলোর দিকে তাকালাম- বিবর্ণ মনে হলো। একটি লাইট পোস্ট পার হয়ে আরেকটি লাইট পোস্টের মাঝামাঝি যেতেই চারপাশে তাকালাম- দেখলাম কোথাও কেউ নেই। এই নির্জন পথে হাঁটছি- আমার ভিতরে কেমন যেন ভালোলাগা। একটা ঈষৎ শীরশীরে বাতাস আমার সমস্ত অস্তিত্বকে যেন দুলে যাচ্ছে- দামাল বাতাসে যেমন দোলে সরষে ক্ষেত। কিংবা তরুণীর স্পর্শে যেমন দোলে যুবকে হৃদয় মন। তেমন একটা দুলে ওঠা ক্রমাগত আমার চলার ছন্দে ছন্দ মেলাচ্ছে। আমি দু’ চোখ ভরে শহরটাকে দেখছি- এমন শান্ত ভদ্র শহর জীবনে কোথাও দেখিনি কখনও কোথাও। আমি হাঁটছি শহরের পথ নয় যেন জীবনের পথ। জীবনের পথ নাকি বন্ধুর- কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু; কোথাও তার সমতল। এই উঁচু-নীচু-সমতল পথ হাঁটতে আমার ভালোই লাগে কেন জানি? জানিনা।
সেই যাই হোক আমি খুঁজছি মিলন ভাইয়ের মেস। সেই মিলন ভাই, সবেমাত্র মাস্টার্স করেছে- তার মেস। কারণ রাত্রে আমি তার মেসে থাকবো। আগামীকাল ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। আমি সেই পরীক্ষা দিতে এই শহরে এসেছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা।
রাস্তার পশ্চিম প্রান্তে তাকালাম- যেন ঠিক জায়গায় এসে পড়েছি। এইতো এইটা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপজিটে মিলন ভাইয়ের মেস। কি জানি, নীর শান্তি নীড়? মাঝ বয়সি এক ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে যেতেই জিজ্ঞাসা করলাম আংকেল ৬২/২ ধরমপুর শান্তি নীড়টা কোন দিকে হবে। ভদ্র লোকটির বাসা হয়তো আশে পাশে কোথাও হয়ে থাকবে বললেন ঐ সাদা ৬ তালা দালানের পাশে ৪ তালা দালানটা।
একটু এগিয়ে দিয়ে শান্তি নীড়ের প্রায় কাছাকাছি গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে দু’ চোখ ভরে দেখতে লাগলাম। চোখে অজস্র শুভ্রতার ভীড় হৃদয়ের সমস্ত প্রান্তরে একটা উচ্ছ্বল ভালোলাগা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা বড় ভাইদের কাছে শুনেছি। একেবারে কল্প নগরীর কথা মনে হয়েছিল তখন। সেই কল্পনগরীতে এসে পড়েছি- আহা! কি যে ভালো লাগছে বোঝাতে পারবো না। এ শুধু অনুভব। কিন্তু হৃদয়ের ভিতর তবু একটা শূন্যতা। কারো পদধ্বনি-ক্রন্দন-দীর্ঘশ্বাস। মুহূর্তেই মনটা বিমর্ষ হলো যেন- আষাঢ়ের মেঘে যেমন ছেয়ে যায় সমস্ত আকাশ।
পাক ঘুরে শান্তির নীড়ের দিকে একটু এগুতেই তিনটি যুবক আমাকে ঘিরে ফেললো। একজন কোমরে গোজা চকচকে একটা চাকু বের করে বলল: এই দেখ আমরা কারা। আমার গলা-মুখ শুকিয়ে এলো। ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছি। ততক্ষণে ওরা আমাকে হাতরাতে শুরু করেছে। অনতি দূরে কয়েকটা লোককে আসতে দেখে আমার প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে কেটে পড়লো ওরা। ভাগ্য ভালোই। প্রভু বাঁচালেন। টাকা কটা ছিলো সাইড ব্যাগে- মানিব্যাগে নয়।
সে যা হোক, ভাবতে লাগলাম এ কোন দেশে বাস করি আমরা। চুরি, ছিনতাই, দস্যূতা, ডাকাতি বেড়েই চলেছে দিনে দিনে। আমরা তো দিনে দিনে সভ্য হয়ে উঠছি- স্কুল কলেজের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে মুন্সি-মোল্লা-মাওলানা। পুলিশ বাহিনীতে তো প্রতি বছর কম কনেস্টবল, পুলিশ অফিসার নিয়োগ হয় না, তবু কেন ছিনতাই রাহাজানি দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে। অবশেষে শান্তিনীড় খুঁজে পেলাম। শান্তির নীড় তো নয়। বাহিরে চুনকালি করলেও- দালানের রংটা সাদা হলেও- ভিতরে শুভ্রতার কোন চিহ্ন নেই। আমি যে রুমটিতে ঢুকলাম সেখানে তিনটি চৌকি। টেবিল চেয়ারও তিনটি করেই। তিনটি বেডে তিনজন থাকেন। মিলন ভাই এক বেডে। অন্য দুইটিতে আর দুইজন ভদ্রলোক থাকেন। একজন চলে গেছেন গ্রামের বাড়ি। ঐ সিটটায় হলো আমার থাকার ব্যবস্থা।
রাত গভীর। থমথমে নীরবতা সারা শহরের ভিতর বয়ে এনেছে সীমাহীন স্তব্ধতা। মনে হয় কেউ জেগে নেই পৃথিবীতে। জেগে আমি, শুধু আমি। বাতাস বইছে। বাতাসের ভিতর একটা ক্রন্দন ধ্বনি শুনতে পাই। ক্রন্দনটি কার- আমার না অন্য কারো- টের পাচ্ছি না ভালোমত। কাল আমার বিশ্ববিদ্যায় ভর্তি পরীক্ষা। একটু তো বইপত্র দেখতে হবে। তার ভিতর কি না ক্রন্দন ধ্বনি। হোক না ক্রন্দন কারো- তাতে আমার যায় আসে কি? তবুও ক্রন্দনটা আমার হৃদয়ের অতল গভীরে গিয়ে করে আসত। আমি অস্থির হয়ে উঠি। নদীর জলের মত বড় চঞ্চল হয়ে উঠি। আমার হৃদয়ে খেলা করে অজস্র অস্থিরতা। আমি আর স্থির থাকতে পারিনে। একটা সাদা প্যাড বের করে লিখলাম-
চোখে জল নেই।
বেদনার বৃষ্টিতে
হৃদয়ের অবারিত প্রান্তর শুধু
সজল তটিনী।
রিক্ত আকাশের বিরাট হাহাকার
যেন ঘনঘোর আঁধারের প্রচ্ছন্নতা নিয়ে
এ জীবনে বয়ে আসছে অভোর রজনীর
নিসংসঙ্গতা।
কখন কোথায় কবে কে?
হারিয়ে গেলো
আমার জীবনের আলোঘন দীপিকা নিয়ে।
কেন মিলেছিলাম
ডাইনির দু’টি চোখে?
স্বৈরীনির বুকে মুখ রেখে কেন করেছিলাম
সুরা পান?
স্বৈরীনি আমার জীবনকে আজ বিষিয়ে তুলেছে সর্পের কামড়ে যেমন বিষিয়ে ওঠে শুদ্ধ শরীর। নিজেকে বড় অসহ্য লাগলো। বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু শীর শীরে থমথমে বাতাস বইছে। আকাশের দিকে তাকালাম- দেখলাম কাস্তের মত বাঁকা চাঁদ উঠছে আকাশে। প্রভা তার ক্ষীণ। তবুও উদ্ভাসিত করছে পৃথিবীর আকাশকে। কোথাও কোন শব্দ নেই। এমন নিরবতায় অজানায় কোথাও হারিয়ে যেতে চায় মন।
অনতিদূরে দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে দুটি শব্দ করলো। কাল পরীক্ষা। উচ্চ শিক্ষা লাভের এ্যাডমিশন টেস্ট। আমি ঘুমাতে চেষ্টা করছি। চোখে ঘুম আসছে না- এক ফোটা ঘুম আসছে না। মনে পড়ছে- খুব ভালো করে মনে পড়ছে। আমার সমস্ত শরীরকে অবশ করে তুলছে। যতবার আমি ভুলে যেতে চাই- ততবার বিদ্ধ হই তার প্রেমে। সেই যে অঞ্জনা- যার জন্য এই শুভ্রস্বচ্ছ রাতের ভিতর ক্রন্দন ধ্বনি ভেসে আসে- সেই অঞ্জনা যে আমার হাতে হাত রেখে বলেছিলো-আমি আজ পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে আসলাম।
যে ছিলো আমার জীবন মন প্রাণ। যার বুকে মাথা রেখে পৃথিবীকে দেখতে শিখেছিলাম- সেই যে অঞ্জনা ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় হেমন্তের এক বিকেলে। পল্লীর মেঠো বাঁকা কাঁচা পথে। ওর বাবা ছিলেন রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা। সেবার ওরা গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলো। ওকে প্রথম দেখায় বুঝতে পেরেছিলাম এ এক অব্যক্ত অনুভবের পুলক। দেহ মনে কি যে অনুভব বয়ে ছিল সে শুধু আছে আমার অনুভবে। যাবার বেলায় একটি চিরকুটে ওদের বাসা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট যেতে বলেছিলো আমাকে। অতঃপর আমাদের কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে- নীল নীলিমায় নীলান্তে। আমরা একাকার হারিয়ে ছিলাম অজানায় অসীমে অনন্তে। একদিন হঠাৎ করে ওদের বাসায় গিয়ে দেখি ওর বাবা ভাড়াটে বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। এরপর কত অজস্র বার শহরের অলি-গলি পথে ওকে আমি খুঁজেছি। কিন্তু ওর আবাসের কোন সন্ধান পাইনি। মনে মনে ভেবেছি ও কি বেঁচে আছে। ও এমন করে হারিয়ে গেল কেন? জীবন পথের বাঁকে ওকে পেলাম, তবে সোহনার কেন কেন ওকে হারালাম......
গ্রামের বাড়িতে ওর বাবার যে ভিটা বাড়ি ছিলো ওর সাথে প্রথম দেখার সময় ওর বাবা সম্পূর্ণ সম্পত্তি বিক্রয় করে দিয়ে শহরে এসেছিলো। প্রকৃত ভালোবাসার সংজ্ঞা আমি বুঝি না। সে একদিন আমার হাতে হাত রেখে কেঁদেছিলো। সেই কান্নার জল কি আমার জন্য প্রেম। ভাবতে ভাবতে চোখে এলো অনেক জল। মনে হলো সমস্ত বেলকুনি ভিজে সিড়ি গড়িয়ে পড়ছে আমার চোখের জল- আমার প্রেম- আমার ভালোবাসা। অনেক ভাবনার পর বিছানায় গেলাম। ঘুম এলোনা চোখে। এলো একটু তন্দ্রা। একটু পরে শুনতে পেলাম আজানের ধ্বনি-কয়েকটা মোরগের ডাক-বাঁশের ঝাড়ে ঘুম ভাঙ্গা পাখিদের কুজন।
সকাল। একটা সূর্যকে দেখলাম। একটা অন্যরকম সূর্য। সারা শহরকে আলোয় উদ্ভাসিত করেছে সকালের সূূর্যটা। কিন্তু আমাকে উদ্ভাসিত করতে পারছেনা। আমার ভিতরে সাহারার উত্তপ্ততা বাহিরে অন্ধকার- বিশাল ব্যাপক অন্ধকার। এই অন্ধকার কোথ থেকে আসছে আমি জানি না। এই উত্তপ্ততা কিসের তাও জানিনা। শুধু জানি একজন আমার জীবন থেকে চলে গেছে। তই বলে অন্ধকার এত উত্তপ্ততা? আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।
ন’টা বেজে গেলো। টেবিলে আমার চোখের সামনে ছিলো গাইড বুক। মিলন ভাই টের পায়নি কিছু।
আমাকে বললো: সময় হয়ে গেছে তৈরি হয়ে নাও। কুয়াশা পড়েছে ভীষণ। দিগন্তকে দিয়েছে ছেঁয়ে। এই কুয়াশার সকালে খিচুড়ি খেতে আমার ভালোই লাগে। সেই খিচুড়ি রান্না হয়েছে মেসে- সাথে ডিম ভাজি।
নাস্তা সেরে মিলন ভাইয়ের সাথে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। দেখলাম ‘সাবাশ বাংলাদেশ।’ আমার ইচ্ছে হলো দেশের জন্য যুদ্ধ করে যদি প্রাণ দিতে পারতাম- তাহলে এই সাবাশ বাংলাদেশের গর্ব হতো আমার।
কলা ভবনের পাশে তিনটি মেয়ের সাথে দেখা হলো মিলন ভাইয়ের। একজনকে মনে হলো অন্য রকম। ডান চোখটা একটু টেরপা মনে হলো আমার। নাকি ইচ্ছে করেই টেরপা করে প্রেমকে ইঙ্গিত করছে।
সিট প্লানে গিয়ে দেখলাম আমার সিট পড়েছে কলা ভবনের চতুর্থ তলায়। যথারীতি সিটে গিয়ে বসলাম। পরীক্ষা শুরু হলো। আমি পরীক্ষা দিচ্ছি ‘জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদে।’ ভূগোল ছিল আমার বেস্ট চয়েজ। পৃথিবীর প্রকৃতির প্রতি আমার ছিল বড় মোহ- সেই মোহ থেকে ভূগোল পড়ার তীব্র আকাংখা জমেছিলো আমার।
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। দুইজন টিচার পড়েছে আমার রুমে। একজন মহিলা। হ্যান্ডসাম। যৌবন উঠেছে উথলে। শিক্ষক ভাবনা বাদ দিয়ে তার প্রতি জমে একটু আকর্ষণ। অন্যজন পুরুষ। দেখে শুনে মনে হলো- আমি যে হোসেন আলীর কথা শুনেছিলাম- ইনিতো সেই। হায়রে হোসেন আলী স্যার। মেধা মানুষকে কতদূর নিয়ে এসেছে। শুনেছিলাম- ওনার আব্বা দর্জিগিরি করত। সংসার চলতোনা ভালো। উপোস থেকে কাটাতে হতো দিন।
পাটের আটি দিয়ে বালিশ বানিয়ে রাত্রি যাপন করতো। সেই হোসেন আলী আজ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক। বিয়ে করেছে অমন একজন কে।
পরীক্ষা শেষ হলো। হল থেকে বাহির হয়ে দেখলাম ভাইয়া অন্ধের যষ্ঠির জন্য অপেক্ষা করছে। কাছে আসতে জড়িয়ে ধরে বললো- পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস জামান। টিকবি তো রে।
ভাইয়ার রাজশাহী বোর্ড কলেজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আজ কাজ হবেনা বলে সংশ্লিষ্ট বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলেছে। তাই থাকতে হলো সেদিন রাজশাহী। আমরা প্রবাসি হোটেলে উঠলাম। দূপুরে হোটেলেই খেতে হলো।
বিকেল। একটা সুন্দর বিকেল। মিষ্টি বিকেল। যদিও ভিতরে আমার ভীষণ শূন্যতা- অফুরন্ত ক্রন্দন তবুও সমুদ্রের ডাক শুনতে পাই- যেন কোথাও জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। বসন্তের মাঝামাঝি- শীর শীরে মাতাল বাতাস হোটেলের ভাঙ্গা জানালা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে আমাকে কেমন যেন উতলা করে তুলছে। ভিতরে আর থাকতে পারলাম না।
ঘুরে ঘুরে হাটলাম চারপাশ। বিচিত্র বর্ণের অজস্র ফুল, গাছপালা, ঘাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ এইসব প্রকৃতি শোভিত নীলিমা বিশ্ববিদ্যালকে সাজিয়েছে যেন কল্পপুরীর মত। এখানে সেখানে দেখতে পেলাম ছেলেমেয়েদের আড্ডা, অজস্র চকোর-চকোরী, টুনটুনি, ঘুঘু আর পায়রা। মনে মনে ভাবলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে এইসব পাখীদের ভীড়ে আমি মিশে যাবো- অসীম অনন্ত অজানায়। তুমি চলে গেছো- যাও- বহুদূরে যাও- সুখে থাকো- তবে মনে রেখো, মনে রেখ একটি বিকেল- সেই বিকেল.......
সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার সব দুশ্চিন্তা ঝাড়া দিয়ে এসেছি। তবুও হোটেল কক্ষে প্রবেশ করার পর একটা হাহাকার ফিরে এলো হৃদয়ে আমার। আমি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। কক্ষে আমি একা। ভাইয়া বিশেষ কাজে গেছে বাহিরে। মিলন ভাইয়ের সাথে ক্যাম্পাস ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয় বুক স্টল থেকে কিনেছিলাম একটা ডায়েরী। কি আর করা। ভাঙ্গা চেয়ারটাতে ঠেস দিয়ে লিখতে বসলাম.....
রাত দশটার দিকে ভাইয়া হোটেলে ফিরলো। ততক্ষণে আমি আমার কবিতার খাতাটি গুটিয়ে ব্যাগে ভর্তি করতে চেষ্ট করছি। ভাইয়া আমাকে দেখে কী যেন কি একটা বুঝতে পেরেছে। আমাকে বলল- তুই এবার ভর্তি পরীক্ষায় টিকবি না।
-কেন ভাইয়া?
-তোকে আমি ঠিকমতো লক্ষ্য করছি। তুই সব সময় অন্যমনস্ক হয়ে থাকিস। কি যে ভাবিস। ভাবিস আর কি আমি সব জানি। তোকে শেষ বার বলছি তুই এসব আজে বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে ঠিকমতো লেখাপড়া কর।
ভোর। মোরগের ডাক শুনতে পাওয়া গেলনা। শোনা গেলো আজানের ধ্বনি। শহরে মোরগ নাই। ডাক শোনা যাবে কেমনে। তবুও আমার ভিতরে মোরগটা ডাকছে। ভীষণ ভোর ভোর ডাকছে। মানুষের ঘুম ভাঙ্গাতে নয় দিবসের আগমনে আলোর উচ্ছ্বাসে নয়। ডাকছে তো মিষ্টি সুরেই ডাকছে।
সকাল আটটার দিকে বাসে উঠলাম। বাসটি নাটোরের দীক্ষাপতির রাজবাড়ীর প্রান্ত দিয়ে অনেক শাল শেগুনের গাছ পেরিয়ে পিচঢালা পথ দিয়ে শো শো করে চলতে থাকলো। জানালার পাশে বসলাম আমি। ওটা আমার জন্মগত অভ্যাস। প্রান্ত-দিগন্ত-দিনান্ত- সব মিলে মিশে হৃদয়ে অজস্র পুলক দিতেছিলো। ক্লান্ত অবসন্নতার ভিতর বাড়ি ফিরলাম।
সাত দিন পর চলে এলাম ঢাকা। শীতলক্ষার তীরে বসে অতীত ভাবছিলাম আর ঢেউ গুনছিলাম। এমন সময় ভাইয়ার চিঠি পেলাম। চিঠিতে লেখা ছিলো
“তবে কিছু মনে করবি না তুই। কষ্ট করে এম এ পাস কর তোকে এমন মেয়ে দিয়ে বিয়ে দিবো- যাতে কেউ অপছন্দ না করতে না পারে।”
দু’মাস পর শুনেছিলাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। কিন্তু আমি আর রাজশাহী যাইনি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি।
আজ রাত দশটার সংবাদ শুনতে গিয়ে দেখলাম অঞ্জনা টিভির পর্দায় সংবাদ পাঠ করছে। আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে ও। ভাবলাম, ও হয়ত সুখেই আছে। জীবনে তাকে না পাই ও যে বেঁচে আছে এই আমার সান্ত্বনা।