১৯৯৪ সাল। আমি প্রাইমারী স্কুলে ছোট ওয়ানে (বর্তমানে যেটাকে শিশু শ্রেণি বলা হয়) ভর্তি হয়েছি। আমাদের এলাকাটি ছিলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের। এখানকার দিনের মতো তখন খুব কম বাবা-মা স্কুলে গিয়ে সন্তানদের ভর্তি করতেন। শিশুদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হলে বাবা মা শুধু মুখে "স্কুলে যা…. স্কুলে যা" বলেই দায়িত্ব শেষ করতেন। ছোটরা বড়দের দেখাদেখি স্কুলে যেত। শিক্ষকগণ বছর শেষে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীর চেহারা দেখে নাম জিঙ্গেস করতেন, তারপর হাজিরা খাতায় নাম উঠাতেন। তাই আশি বা নব্বই দশকে স্কুল ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের বয়সের তুলনা কিছুটা বেশি। তবে আমি মোটামুটি ঠিক বয়সে স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছি। সেটা সম্ভব হয়েছে আমার পিঠাপিঠি বড় দু্ই ভাই সে সময় একই স্কুলে পড়ার কারণে ।
ছোট ওয়ানে পড়ার সময় একদিনকার ঘটনা। স্কুলের মাঠে রাস্তার পাশে আমি আর আমার সহপাঠি সুজন একে অপরের দিকে দুষ্টামি করে বালি ছুঁড়াছুড়ি করছি। হঠাৎ বালির কিছু অংশ আমার চোখে সরাসরি আঘাত করে। আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠি। আমার চিৎকার শুনে বড় ভাই কারণ জিঙ্গেস করলে কাঁদতে কাঁদতে সুজন কে দেখিয়ে দেই। এবার বড় ভাই সুজনের দিকে তেড়ে গেলেন এবং তাকে একটি থাপ্পর মাড়লেন। বড় ভাইয়ের থাপ্পর খেয়ে সুজনও কাঁদতে শুরু করে। সুজনের কান্না দেখে আমার কান্না কিছুটা থেমে গেছে। আমি শান্তনা পেয়েছি, বড় ভাই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। কিন্তু সুজনের কান্না চলতে থাকে। এমন সময় রাস্তার পাশ দিয়ে আমার মামা সম্পর্কের একজন তাকে কান্নার কারণ জিঙ্গেস করলে সে আমাকে দেখিয়ে দেয়। তখন মামা সম্পর্কের সে লোকটা কিছুটা তাচ্ছিল্য সূরে বলে, তোর মত দুই চার জন হিন্দুর বাচ্চা মারলে কি আসে যায়, তুই কাঁদলেই বা কী! যা.. যা. হেড স্যারের কাছে নালিশ কর। কিন্তু সুজন সেদিন নালিশ করতে পারেনি। হয়ত ছোট ছিলো বিধায় নালিশ করার সাহস ও পদ্ধতি তার জানা ছিলোনা। কিন্তু সেদিনকার ঘটনায় আমার ছোট্ট মনে খুব কম্পন সৃষ্টি করেছে। হিন্দু মারলে কি যায় আসে, হিন্দু....।
বড় ভাই রাতের বেলা মায়ের কাছে উক্ত ঘটনা খুলে বললেন, মা সমস্ত ঘটনা শুনে বড় ভাইকে বকা দিলেন। বললেন তাকে মারা ঠিক হয়নি। ভবিষ্যৎে মারতেও নিষেধ করলেন। তারপর বললেন, পোলাপানে পোলাপানে মারামারি করলে বড়দের জিদ দেখাতে নেই। কারণা তারা পোলাপান। তারপর মা বড় ভাইয়ের গালে আলতু চেপে বললেন তুইও তো পোলাপান। আমি হঠাৎ মাকে ‘হিন্দু’ কী..জিঙ্গেস করলে মা অবাক হয়ে যান। তারপর আমার উত্তরে মা বললেন, হিন্দু হলো আমাদের থেকে ভিন্ন একটি ধর্ম, একটি ভিন্ন ধর্মালম্বী সম্প্রদায়। আমরা মসজিদে নামাজ পড়ি, তারা মন্দিরে পূজা করে। আমরা পানি খাই, তারা জল খায়। এবার আমি বললাম, মা জল কি? মা উত্তর দিলন জল হলো পানি। তাহলে তারা জল খায় কেন? জল খাওয়া দরকার তাই খায়। তুমি যে বললে পানি খায়। এবার মা বললেন বড় হয়ে বুঝবি কেন জল খায়। এখন তবে ঘুমাও। তারপর মা তাদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা বললেন। বাবা তাদের দোকান থেকে হাটবারে মিষ্টি কিনে আনেন সে কথাও বললেন। আমার নানার দোকানের সাথে সুজনের দাদার মিষ্টি দোকান ছিল।
সুজনের সাথে সেই থেকে পথচলা, বিধর্মীর সাথে প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় বন্ধুত্বের নিয়মে বাঁধা পড়েছে। সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যে একজন। আমাদের বন্ধু সার্কেলদের মধ্যে অন্যতম। এখনো প্রতিনিয়ত সুজন ঘোষের কাপড় দোকানে সকাল কিংবা বিকালে আড্ডা বসে। লোকাল বন্ধুদের অনেকেই সেই আড্ডায় যোগ দেয়। আমারা অনেকে শহরে থাকার কারণে সেই আড্ডায় যোগ দিতে পারিনা। কিন্তু কাছে পেলে সুজন তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সব কথাই আমার কাছে খুলে বলে। তার জন্য পরিবার থেকে এক বছর ধরে মেয়ে চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু যে মেয়ে তার পছন্দ হচ্ছে সে মেয়ের পরিবার তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। তার নাকি একটাই দোষ, তারা আমাদের এলাকায় অনলি ওয়ান ফ্যামিলির লোক, তাদের নাকি আলাদা সমাজ নাই। তাদের ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে তুলনামূলক উচ্চ ঘোষ পরিবার অনীহা। তাইতো সে.. সেদিন দুঃখ করে বলেই ফেলল, দো্স্ত আমরা হলাম সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যা লঘু পরিবার। সংখ্যালঘু শব্দটি একটি আপেক্ষিক শব্দ।
“সংখ্যালঘু শব্দটি আপেক্ষিক শব্দ” কিভাবে ব্যাখ্যা করব সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। ।
ছবিঃ আমি নিজে ড্রয়িং করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৬