পৃথিবীর যে কোন সমাজেই অনেক দম্পতির জন্য সন্তানহীন থাকা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমাদের দেশের মত ধর্মীয় গোঁড়ামির দেশে অনেক সময় সহজ সরল নিঃসন্তান নারীরা সন্তান লাভের আশায় ভণ্ড পীরের কাছে যায়। নারীরা অলৌকিক সাহায্য আশা করে পীরের মাধ্যমে কিন্তু দেখা যায় ভণ্ড পীর অলৌকিক সাহায্য না বরং নিজের জৈবিক শক্তির সাহায্যে বাচ্চা হওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে । আমাদের সমাজে এই ধরণের ঘটনা অনেক সময় শোনা যায়।
উন্নত বিশ্বে পীর ফকির কম। তাই সেখানে এই ধরণের প্রতারণা কম হয় সম্ভবত। তবে সেখানকার অনেক ডাক্তার অনেক সময় বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সাহায্যে সন্তান কামনা করা দম্পতিদের প্রতারিত করে থাকেন। বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই বিজ্ঞানের কল্যাণে সন্তানহীন দম্পতিরা ‘টেস্টটিউব বেবি’ পদ্ধতির মাধ্যমে মাতা বা পিতা হচ্ছেন। এই পদ্ধতির আধুনিক নাম ‘ইন ভাইট্রো ফারটিলাইজেশন’ বা আইভিএফ। পুরুষদের বীর্য সংরক্ষণের জন্য স্পারম ব্যাংক থাকে। এখন ভারতেও স্পারম ব্যাংক আছে। রোগিণীর স্বামী বা পার্টনারের স্পারম থেকে সম্ভব না হলে ঐ দম্পতির অনুমতি সাপেক্ষে স্পারম ব্যাংক থেকে স্পারম নিয়ে টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন বিনা অনুমতিতে অন্য মানুষের বীর্যের সাহায্যে বাচ্চা জন্ম দেয়া হয়ে থাকে।
বেশ কিছু ঘটনা আছে যেখানে ডাক্তার নিজে রোগিণীকে না জানিয়ে তার নিজের বীর্যের সাহায্যে আইভিএফ পদ্ধতিতে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। এই ধরণের কিছু ঘটনা নীচে দেয়া হল।
কুইন্সি ফরটিয়ার নামের লাস ভেগাসের একজন চিকিৎসক নিজের বীর্যের সাহায্যে তার রোগিণীদের টেস্ট টিউব বেবি উপহার দিতেন। এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল ষাটের দশকে এবং রোগী বা তার পার্টনার জানতো না যে ডাক্তার নিজে তার বীর্য দিয়েছেন । একজন বা দুইজন না এইভাবে সে নিজের বীর্য দিয়ে ২৬ টা টেস্টটিউব বেবির জন্ম দিয়েছিলেন। তার জীবন দশায় এগুলি কেউ জানতো না। ২০১৮ সালে একজন মা ডিএনএ টেস্ট করতে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারে। এই ঘটনা নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি হয়েছে যেটার নাম ‘বেবি গড’। এই ধরণের ঘটনা নিয়ে আরও কয়েকটি ডকুমেন্টারি এবং টিভি সিরিজ আছে।
সেসিল জ্যাকবসন নামের যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একজন ডাক্তার আশির দশকে একই কাজ করেছেন। সে রোগীদেরকে না জানিয়ে নিজের বীর্য দিয়ে ১৫ টি টেস্টটিউব বেবির জন্ম দিয়েছেন। একজন মহিলাকে বলা হয়েছিল যে তার স্বামীর স্পারম ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্ত প্রকৃতপক্ষে স্বামীর বদলে ডাক্তার তার নিজের স্পারম ব্যবহার করেছিল।
ওয়াশিংটন রাজ্যে এই ধরণের একটা ঘটনা প্রকাশ পায় ২০১৮ সালে। এই ক্ষেত্রে বড় হওয়ার পরে টেস্টটিউব বেবি নিজ উদ্যোগে ডিএনএ টেস্ট করে এবং জানতে পারে যে তার বায়লজিকাল বাবা আসলে তার মায়ের ডাক্তার নিজেই। আশির দশকে সেই বাচ্চার জন্ম হয়েছিল। এই ধাপ্পাবাজির জন্য সে ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করে। ডাক্তার তার মা এবং বাবাকে বলেছিল অজানা কারও স্পারম ব্যবহার করা হবে। কিন্তু সম্ভবত খরচ বাঁচিয়ে লাভবান হওয়ার জন্য ডাক্তার সাহেবে নিজের বীর্য ব্যবহার করেছিলেন।
ডোনালড ক্লাইন নামের আরেক ডাক্তার এই ধরণের কাজ করার জন্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। ঘটনা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানাপলিসে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে। ৯৪ টা টেস্টটিউব বেবির বাবা ছিলেন এই ডাক্তার। রোগী বা তার পার্টনার সেটা জানতো না। ২০১৪ সালে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এই প্রতারণা ধরা পড়ে। এই ঘটনার কারণে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্ব প্রথম এই বিষয়ে আইন আসে। আগে এই ধরণের অপরাধের জন্য কোন আইন ছিল না।
উপরে বর্ণিত এই ধরণের বেশ কিছু ঘটনা ডাক্তাররা ঘটিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বারটন ক্যালডওয়েল নামের এক ডাক্তার এই ভাবে নিজের বীর্যের সাহায্যে ২২ টা টেস্টটিউব বেবির জন্ম দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল এইভাবে জন্ম নেয়া একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে পরবর্তীতে ডেটিং করা শুরু করে। তখন এটা নিয়ে অনেক লেখালেখি এবং সমালোচনা হয়। কারণ এই ছেলেমেয়ে দুটির বায়োলজিক্যাল বাবা একই ব্যক্তি অর্থাৎ ডাক্তার সাহেব ।
যুক্তরাষ্ট্রের মেডিক্যাল স্টুডেন্টরা বেশ বুদ্ধিমান। ষাট এবং সত্তুরের দশকে অনেক মেডিকাল স্টুডেন্ট নিজের স্পারম জমা রাখতেন স্পারম ব্যাংকে। ধারণা করা হয় পরবর্তীতে নিজের সাফল্যের প্রয়োজনে এই স্পারম তাদের অনেকে টেস্ট টিউব বেবি জন্ম দিতে ব্যবহার করেছে রোগীর অনুমতি ছাড়া । এই ধরণের ধাপ্পাবাজির জন্য কোন আইন আগে ছিল না। এখনও দুই একটি দেশে আইন আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৭ টি রাজ্যে এই বিষয়ে আইন আছে।
পিনাকী ভট্টাচার্য তার একটা ইউটিউব ভিডিওতে এই বিষয়ে একটা মজার ঘটনা বলেছেন। তার এক ডাক্তার বন্ধু (সে নিজেও ডাক্তার) বা বড় ভাই এই ধরণের ফারটাইলিটি সমস্যার চিকিৎসা করে থাকেন। এক রোগীনিকে সেই ডাক্তার বলেছিলেন যে আপনার স্বামীর বীর্যের দ্বারা আপনার পক্ষে টেস্টটিউব পদ্ধতিতে মা হওয়া সম্ভব না। পরবর্তীতে সেই রোগিণী ভারতে চিকিৎসার জন্য যায় এবং নবজাতক সহ দেশে ফেরে। ফেরার পরে সে ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে যে আপনি বলেছিলেন যে আমার স্বামীর বীর্যে আমি মা হতে পারবো না, কিন্তু দেখুন আমি ভারতে গিয়ে সফল হয়েছি। ডাক্তার সাহেব তাৎক্ষনিকভাবে বিব্রত হলেও তিনি ঐ বাচ্চার ডিএনএ পরীক্ষা করেন নিজ খরচে এবং জানতে পারেন যে ঐ বাচ্চার বাবা ঐ মহিলার স্বামী না।
পিনাকীর সব কথা বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই গল্প শুনে না হেসে পারলাম না। আমার ধারণা ভারতে গিয়ে যারা টেস্টটিউব বেবি নিয়ে আসেন তাদের অনেকেই হয়তো এই ধরনের প্রতারণা শিকার। বাংলাদেশেও এখন এই ধরণের চিকিৎসা হচ্ছে। এই বিষয়ে যেন কোন ধাপ্পাবাজি না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় নজরদারি এবং আইন প্রণয়ন জরুরী।
সূত্র
দা গার্ডিয়ান
দা নিউ ইয়র্ক টাইমস
এন পি আর
metro.co.uk/2022/05/11/our-father-who-is-dr-donald-cline-and-where-is-he-now-16619778/
vtdigger.org/2022/03/28/former-fertility-doctor-takes-stand-admits-using-own-sperm-to-impregnate-woman/
timesofsandiego.com/crime/2020/09/16/san-diego-woman-sues-doctor-for-alleged-artificial-insemination-with-own-sperm/
ছবি - এনবিসি ইউটিউব