২২ শ্রুতির হারমোনিয়াম
হারমোনিয়াম কোন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র নয়। এটা মুলত পশ্চিমের পাম্প অরগ্যানের পরিবর্তিত সংস্করণ। ১৮৪০ সালে ফ্রান্সের আলেকজান্ডার ডেবাইন প্রথম পায়ে পাম্প করা হারমোনিয়াম তৈরি করেন এবং পেটেন্ট গ্রহণ করেন। এটা আকৃতিতে অনেক বড় ছিল। ১৮৫০ সালের পরে ভারতে হাতে পাম্প করা হারমোনিয়াম তৈরি করেন একজন ভারতীয়।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ২২ ধরণের শ্রুতি আছে। শব্দের কম্পাঙ্কের উপর ভিত্তি করে এই শ্রুতি নির্ধারণ করা হয়েছে। শব্দের কম্পাকের উপর ভিত্তি করে ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রে তিন পর্যায়ের ধ্বনি সীমা আছে। এগুলি হোল উদারা, মুদারা এবং তারা। তারাতে শব্দের কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশী থাকে। প্রতিটি ধ্বনি সীমাতেই ২২ রকমের শ্রুতি আছে। তবে মুলত ১২ রকমের শ্রুতি (এগুলিকে স্বর বলে) বেশী ব্যবহৃত হয়। এই ১২ টার মধ্যে আবার ৭ টি শুদ্ধ স্বর ( সা রে গা মা পা ধা নি ) এবং ৫ টি কোমল স্বর। এছাড়াও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আরও ১০ টি বাড়তি শ্রুতি আছে। এই দশটি শ্রুতি এবং ১২ টি স্বর মিলেই মোট ২২ টা শ্রুতি। আদিকাল থেকে ভারতীয় সঙ্গীত বিশারদরা এই শ্রুতিগুলি ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু পশ্চিমের সঙ্গীতের যে কোন Octave (ধ্বনি সীমা) এ ভারতীয় ২২ এর বদলে ১২ রকমের স্বর (Note) আছে। এই ১২ টা স্বরের কম্পাঙ্কের সাথেও ভারতীয় ২২ টা শ্রুতির কম্পাঙ্কের সামান্য কিছু তারতম্য আছে। কম্পাঙ্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে উপরের অকটেভে এই পার্থক্য আরও বেড়ে যায়। নীচে ভারতীয় উদারা ধ্বনি সীমাতে ২২ টা শ্রুতি এবং পশ্চিমের ১২ টা স্বরের (Note) তুলনামুলক কম্পাঙ্ক দেয়া হোল।
এই কারণে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ১৯৪০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হারমোনিয়াম নিসিদ্ধ ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হারমোনিয়াম পছন্দ করতেন না। বঙ্গদর্শনের প্রবুদ্ধ বাগচী বলেছেন;
'হারমোনিয়াম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ে নানা মন্তব্য করেছেন। ১৯ জানুয়ারি ১৯৪০ এ লেখা একটি চিঠিতে কবি আকাশবাণী কলকাতার সেই সময়কার স্টেশন ডিরেক্টর অশোক কুমার সেন-কে লিখেছেন “I have always been very much against the prevalent use of Harmonium for purpose of accompaniment in our music and it is banished completely from our ashram. You will be doing a great service to the cause of Indian Music if you get it abandoned in the studio of All India Radio” এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আকাশবাণীতে হারমোনিয়াম ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। পরে স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুজিও কবির এই অনুরোধ বহাল রাখেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দিলীপকুমার রায়, শচীন দেববর্মণ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ আকাশবাণীতে গান গাওয়া বন্ধ করে দেন।
কিন্তু মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ তে চন্দননগরে মোরাম সাহেবের বাগান বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর কাটানো সময়ের যে স্মৃতিযাপন করেছেন সেখানে তিনি লিখছেন: “আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার জলে উৎসর্গ করা পূর্ণ বিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো-বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম যন্ত্র যোগে বিদ্যাপতির “ভরা বাদর মাহ ভাদর” পদটিতে মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিনী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম”। ফলে গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে হারমোনিয়াম একদমই পরিত্যাজ্য এমন কোনও স্বতঃসিদ্ধ কখনও ছিল না'।
ঐ সময় ব্রিটিশ শাসন চলছিল। শোনা যায় যে কয়েকজন ব্রিটিশ সঙ্গীতজ্ঞও মনে করতেন পশ্চিমের সঙ্গীত রীতিতে তৈরি করা হারমোনিয়াম ভারতীয় সঙ্গীতের সাথে খাপ খায় না। অনেকে এটার মধ্যে উপনিবেশিকতার বিরূপ প্রভাব রয়েছে বলেও মনে করতেন। তবে এটা সত্যি যে আগের যুগের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীরা হারমোনিয়াম ব্যবহার করতে চাইতেন না।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তারের বাদ্যযন্ত্রের প্রাধান্য বেশী। বীণা, সরোদ, সেতার, সারঙ্গী ইত্যাদি তারের বাদ্যযন্ত্রে ২২ টা শ্রুতি বাজানোর উপায় আছে। তারের যন্ত্রের সুবিধা হোল একজন দক্ষ বাদক চাইলে সঙ্গীতের প্রয়োজনে সেতারের তার একটু আগে পিছে করে কম্পাঙ্ক সামান্য বাড়াতে বা কমাতে পারেন । কিন্তু হারমোনিয়াম বা অর্গানে এটা সম্ভব না।
এত বিতর্কের পরেও এ কথা বলা যায় যে হারমোনিয়াম একটি অতি জনপ্রিয় ও সুলভ বাদ্যযন্ত্র। অতীতের বিতর্ক হারমনিয়ামের জনপ্রিয়তাকে হ্রাস করতে পারেনি। তাছাড়া হারমোনিয়াম আকৃতিতে ছোট এবং দাম অপেক্ষাকৃত কম। আর তাছাড়া ২২ রকমের শ্রুতির পার্থক্য ধরার মত সঙ্গীত প্রতিভা সাধারণ শিল্পীদের থাকে না। আরেকটা ভালো খবর হোল কয়েক বছর আগে ২২ টা শ্রুতি সম্বলিত হারমোনিয়াম তৈরি করেছেন একজন ভারতীয় নাগরিক। এই ব্যাপারে পরে লেখার ইচ্ছা আছে।
সুত্র -
https://www.livemint.com/Opinion/Y12e6GYxhWINryCuW3AifI/The-harmonium-complex.html https://simple.wikipedia.org/wiki/Harmonium
https://en.wikipedia.org/wiki/Pump_organ#In_the_Indian_subcontinent
http://ijmaa.in/v7n1/245-252.pdf
https://en.wikipedia.org/wiki/Shruti_(music)
http://onushilon.org/music/gen/sruti.htm
http://www.22shruti.com/research_topic_6.asp
https://en.wikipedia.org/wiki/Just_intonation
https://im.saske.sk/~jhaluska/haluska/haluskaPAPERS/2000pytha-h.pdf
https://pages.mtu.edu/~suits/fifths.html
https://www.phys.uconn.edu/~gibson/Notes/Section3_4/Sec3_4.htm
https://en.wikipedia.org/wiki/Arabic_maqam#Notation
https://sevish.com/2016/microtonal-piano-roll-for-ableton-live/
https://en.wikipedia.org/wiki/31_equal_temperament
https://en.wikipedia.org/wiki/19_equal_temperament
https://en.wikipedia.org/wiki/Arab_tone_system
https://en.wikipedia.org/wiki/Pythagorean_tuning
https://en.wikipedia.org/wiki/Meantone_temperament
https://en.wikipedia.org/wiki/Equal_temperament
https://en.wikipedia.org/wiki/Microtonal_music
https://www.classicfm.com/discover-music/music-theory/why-are-there-only-12-notes-in-western-music/
https://pages.mtu.edu/~suits/notefreqs.html
https://ptolemy.berkeley.edu/eecs20/week8/scale.html
https://www.livemint.com/Opinion/Y12e6GYxhWINryCuW3AifI/The-harmonium-complex.html
http://www.kholakagojbd.com/public-opinion
https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/tagore-song-and-harmonium
ছবি- https://www.youtube.com/watch?v=7BePHjWIFgw
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৪:০০