ইতালি থেকে দেশে ফেরার পর সুলতানা তার মাকে অসুস্থ অবস্থায় বিছানাতে পেল। সুলতানার মা ছিলেন খুব সহজ, সরল ও পরহেজগার একজন মহিলা। সুলতানার মায়ের বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন সে তার মা ও বাবাকে হারায়। সুলতানার নানা ছিলেন অনেক দয়ালু এবং স্বভাবের দিক থেকে তিনি গড়পড়তা বেদুইনদের মত ছিলেন না। তিনি তার মেয়ে এবং ছেলেদের একই রকম ভালবাসতেন। অন্য বেদুইনরা মেয়ে জন্মগ্রহন করলে যখন মুখ গোমড়া করতো তখন তিনি তাদেরকে বলতেন যে আল্লাহর কাছে শোকর করো, কন্যা সন্তানের কোমল স্পর্শ তোমাদের পরিবার পেয়েছে বলে। সুলতানার মা বলতেন যে তার বাবা বেঁচে থাকলে তাকে এত কম বয়সে বিয়ে দিতেন না।
সুলতানার মা স্বপ্নের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যে তার এই পৃথিবী থেকে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। প্রথম স্বপ্নটা তিনি দেখেন সারার আত্মহত্যার চেষ্টার ৪ দিন আগে। তিনি দেখেন যে মরুভুমিতে একটা তাবুর ভিতরে আছেন যেমনটা ছোটবেলায় তার পরিবারের সাথে ছিলেন। সেখানে তিনি তার বাবা ও মাকে দেখে খুব আশ্চর্য হলেন। বাইরে তার ভাইদের আওয়াজ তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি তার বাবা ও মায়ের দিকে ছুটে গেলেন। কিন্তু তারা তাকে দেখতেও পাচ্ছিল না শুনতেও পাচ্ছিল না। এই সময় তার এক ভাই তাবুতে প্রবেশ করলো এবং একটা কাপ থেকে দুধ খেতে লাগলো। তার বাবা কফি বানানোর জন্য বিন চূর্ণ করছিলেন আর এই কবিতাটা আবৃত্তি করছিলেন;
‘নদী বয়ে যাচ্ছে,
গাছেরা ছায়া দিয়ে রোদ আড়াল করছে,
ফলমূল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পায়ের কাছে,
দুধ আর মধুর কোনও কমতি নেই,
নিকটাত্মীয়রা অপেক্ষা করছে
পৃথিবীতে আটকে পড়া আত্মীয়দের জন্য।‘
এই স্বপ্নটাকে তার মা তেমন গুরুত্ব দেননি। সারার বাড়ি ফেরার এক সপ্তাহ পর সুলতানার মা দ্বিতীয় স্বপ্নটা দেখেন। তিনি দেখেন যে একটা পাম গাছের নীচে তার পরিবারের মৃত আত্মীয়রা বসে আছে। তারা রুপার পাত্রে ভালো খাবার খাচ্ছিল। তাকে দেখে তার বাবা স্বাগত জানায়। সে তার মেয়ের হাত ধরে খাবার খাওয়ানোর জন্য বসানোর চেষ্টা করে। সুলতানার মা ভয় পেয়ে যায় ও দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার বাবা তার হাত শক্ত করে ধরে রাখে। সে তার বাবাকে বলে যে আমি এখন খেতে পারবো না কারণ আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে হবে। তার মা উঠে এসে তার কাঁধে হাত রাখলো এবং বললো ‘ফাদিলা, আল্লাহ তোমার মেয়েদের দেখবে। তাদেরকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়ার সময় এসে গেছে।‘ তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো এবং তখনই সে বুঝলো যে পৃথিবীতে তার দিন শেষ হয়ে আসছে।
সুলতানারা মিশর যাওয়ার ২ সপ্তাহ পর তিনি পিঠ ও ঘাড়ে ব্যথা বোধ করতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন যে তার মৃত্যু নিকটবর্তী। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায় যে তার স্পাইনাল কর্ডে টিউমার হয়েছে। এই সময় তিনি তৃতীয় স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখেন যে তিনি তার মৃত বাবা, মা, দাদা, দাদি, ভাই ও গোত্রীয় ভাইবোনদের সাথে অনেক আনন্দ করে খাচ্ছেন। তিনি ছোট কয়েকটি শিশুকে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে প্রজাপতি ধরতে দেখে হেসে ফেলেন। তার মা তাকে বলেন ‘ফাদিলা, তুমি তোমার ছোট বাচ্চাগুলিকে খেয়াল করছো না কেন? তুমি কি বুঝতে পারছো না যে এগুলি তোমারই সন্তান?’ হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন যে এই বাচ্চাগুলি তার সেই ৫ সন্তান যারা অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল। তিনি তখন ওদেরকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন।
অবশেষে তার শেষ দিন ঘনিয়ে এলো। অন্তিম মুহূর্তে তার মেয়েরা বিছানার চারদিকে তাকে ঘিরে বসে ছিল। সুলতানার মা একে একে প্রত্যেক মেয়ের দিকে দীর্ঘক্ষণ নিরব দৃষ্টি মেলে অবলোকন করলেন। সুলতানার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন তিনি, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার এই অনমনীয় মেয়েটার জীবনই সব চেয়ে কঠিন হবে। অবশেষে সামান্য কষ্ট ভোগ করে সুলতানার মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
প্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে তাকে সমাহিত করার ব্যবস্থা করা হোল। সুলতানা ও তার পরিবারের সদস্যরা কবর দেয়া পর্যন্ত কবরের কাছে ছিল। তার মাকে কবরে শায়িত করার পর প্রথম মাটি কবরে দেয়ার সময় সুলতানা হঠাৎ আঁতকে উঠল। এই মায়ের সব চেয়ে ছোট মেয়ে সে। যাকে সে এত ভালবাসে তার গায়ে যখন মরুভুমির লাল বালু ঢেলে দেয়া হচ্ছিল তখন দার্শনিক খলিল গিব্রানের একটা কবিতার কয়েকটি চরণ হঠাৎ তার মনে আসল;
‘হয়তো মানুষের কাছে যেটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ফেরেশতাদের কাছে তা বিয়ের ভোজের মত’।
সুলতানা কল্পনায় দেখতে পায় যে তার মা তার নানা, নানী আর শিশু বয়সে মারা যাওয়া তার মৃত ভাইবোনদের মাঝে দাড়িয়ে আছে। ঐ মুহূর্তে সে নিশ্চিত হয়ে গেলো যে একদিন সে আবার তার মায়ের ভালবাসার ছোঁয়া পাবে, তার কান্না থেমে গেলো এবং মনের মধ্যে একটা আনন্দ আর প্রশান্তি সে অনুভব করলো। তার বোনেরা একটু দূরে দাড়িয়ে ছিল। তার এই প্রশান্তি ভরা চেহারা দেখে বোনেরা কিছুটা আশ্চর্য হোল। সুলতানা কবিতার চরণগুলি আর পবিত্র কোরআনের আয়াত তার বোনদের শুনাল যা তার মনকে শান্ত করেছিল। তার বোনেরাও মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন দিল। আলীও অনেক কষ্ট পেয়েছিল তার মায়ের জন্য। কিছু সময়ের জন্য সে হত বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। ধু ধু মরুভুমির শূন্যতার মধ্যে প্রানপ্রিয় মাকে রেখে ভাইবোনেরা ফিরে চলল বাড়ির পথে। এই সহজ, সরল, অসহায় মা যিনি আরব সমাজের বিভিন্ন প্রতিকুলতার মাঝেও তার সন্তানদের স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে এতগুলি বছর আগলে রেখেছিলেন তার জন্য হয়তো বড় কোন ধর্মীয় আয়োজন হোল না, এমন কি তার কবরটাকেও কোনও পাথর দিয়ে চিহ্নিত করা হোল না, তার পরও সুলতানা জানে এই মায়ের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে সব চেয়ে বড় উপহার হোল সে তার বাবা, মা, ভাইদের সাথে আবার মিলিত হয়েছে।
মার্কিন লেখিকা জিয়ান সেসন (Jean Sasson) এর বই Princess: A True Story of Life Behind the Veil in Saudi Arabia তে বর্ণিত রাজকন্যা সুলতানার জীবন কাহিনীর সারসংক্ষেপ।
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব-১)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব-২)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব-৩)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব-৪)
ছবি – ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:৪৫