সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব-১)
সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব-২)
মার্কিন লেখিকা জিয়ান সেসন (Jean Sasson) এর বই Princess: A True Story of Life Behind the Veil in Saudi Arabia তে বর্ণিত রাজকন্যা সুলতানার জীবন কাহিনী অবলম্বনে।
সারার বিয়ের পর তার বাবা ৩ মাসের জন্য সুলতানা ও তার বোনদের সারার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন। তার বাবার বক্তব্য হোল সারা যেন ঐ পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে এই জন্যই এমন নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু সারার মা ও বোনদের ৩ মাস দেরী করার দরকার হোল না। বিয়ের পঞ্চম সপ্তায় সারা তার শ্বশুরবাড়িতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলো। একদিন সুলতানাদের গাড়িচালক ওমর হন্তদন্ত হয়ে এসে জানালো যে সারা বাসী মাংস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং তাকে জেদ্দার একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরবের লোকেরা মৃত্যু বা কঠিন অসুখের সংবাদ সরাসরি দেয় না। সংবাদবাহকের মুখ থেকে সত্যি কথা বার করতে অনেক সময় চলে যায়। কারও ব্যাপারে দুঃসংবাদ বলতে গিয়ে সাধারণত প্রথমে বলে সে ভালো বোধ করছে না। তারপর বলে তাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। আরও চাপ দিলে বলে সে হাসপাতালে ভর্তি আছে, তারপর বলে তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। একদম শেষে বলবে যে ডাক্তারের কাছ থেকে কোন খারাপ খবরের জন্য প্রস্তুত থাকতে। তবুও মৃত্যু হয়েছে একথা বলবে না।
সুলতানা ও তার মা তৎক্ষণাৎ প্রাইভেট প্লেনে জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। সুলতানা তার সাথে করে সারার রুম থেকে তার প্রিয় ছবির বইটি নিয়ে যায় সারাকে দেবে বলে। হাসপাতালে পৌঁছে ওরা জানলো যে সারা গ্যাসের চুলার উপর মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। হাসপাতালে সারার স্বামী ছিল না কিন্তু তার শাশুড়ি ছিল। শাশুড়ি সারাকে বকতে বকতে বলল কেন সে তার পরিবারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। সারার মা ওনাকে থামিয়ে দেন এবং উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করেন সারার স্বামী কী করেছিল যে কারণে সারা এই কাজ করতে গেল এবং শাশুড়িকে রুম থেকে বের করে দিলেন। সারার কাছ থেকে তারা জানতে পারলো যে তার স্বামী একজন ধর্ষকামী পুরুষ।
৩ দিন পরে সারার স্বামী হাসপাতালে আসে। সারার বাবাও হাসপাতালে চলে আসে। মেয়ের কষ্টে সেও অস্বস্তি বোধ করে কিন্তু কিছুক্ষন পরেই সারার স্বামী যখন তাকে আশ্বাস দেয় যে সারার সাথে তার সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে তখন সে ব্যাপারটা মেনে নিতে চায়। কিন্তু সারা কান্নাকাটি শুরু করে। সারার মা এর তীব্র প্রতিবাদ করে এবং তার স্বামীকে বলে যে সারা আর কখনও তার শ্বশুরবাড়িতে ফেরত যাবে না এবং সে প্রয়োজনে ব্যাপারটা বাদশাহ ও ধর্মীয় নেতাদের জানাবে। সুলতানার বাবা তার মাকে তালাক দেয়ার হুমকি দেয়। সুলতানার মা বলেন যে সে তালাকের পরওয়া করে না। সুলতানার বাবা শেষমেশ তার মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেয় ও সারার স্বামীকে তালাক দিতে বলে। সারার স্বামী সম্ভবত সারার বাবার সাথে তার ব্যবসায়ীক স্বার্থ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এটা মাথায় রেখে তালাক দিতে রাজি হয়। ২ জনকে সাক্ষী রেখে সে ৩ বার তালাক বলে এবং সারা তার কাছ থেকে অবশেষে মুক্তি পায়।
ঐ সময়ে সৌদি আরবে ছেলে বা মেয়ে কেউ কাউকে না দেখে বিয়েতে সম্মতি দিত। ছেলের মা ও বোনেরা মেয়ে দেখত। বড়জোর ফটো আদান প্রদান হতো। তবে সৌদি আরবে অনেক পিতা মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা মেয়ের মায়ের উপর ছেড়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে মায়েরাও মেয়েকে বিয়েতে জোরাজুরি করে। তাদের যুক্তি হোল যে অপরিচিত জায়গায় বিয়ের চেয়ে চেনা জানা পরিবারে বিয়ে হলে মেয়ের জন্য ভালো হবে। তারা মেয়েকে বুঝায় যে স্বামীর ভালোবাসা চিরদিন নাও থাকতে পারে তাই চেনা পরিবারে বিয়ে হলে বিপদ কম। আবার সুলতানার বাবার মত বাবাও আছে যারা আর্থিক লাভের জন্য মেয়েকে বিয়েতে বাধ্য করে। সারার এই ঘটনার পর থেকে সুলতানার মনোজগতে সৌদি মেয়েদের অধিকারের বিষয়টা জায়গা করে নেয়।
সারার গৃহে প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাস পরে সুলতার সবার বড় বোন নুরা তার বাবাকে বলে যে সুলতানা আর সারাকে সৌদি আরবের বাইরে কোথাও ঘুরতে নেয়া উচিত। যেহেতু সারা তার মানসিক আঘাত ভুলতে পারছিল না তাই হয়তো তার বাবা এতে সম্মতি দেয়। রাজকুমারী নুরাকে তার বাবা পছন্দ করতো কারণ সে ছিল শান্ত প্রকৃতির এবং তাকে যা বলা হতো তাই করতো। নুরা পরিবারের অপরিচিত একজনকে বিয়ে করে সুখে আছে এই কথা তার বাবা সব মেয়েকে বলতেন উদাহরণ হিসাবে। যদিও সুলতানার মতে নুরার স্বামী ছিল সুবিবেচক ও ভদ্র এই কারনেই আসলে নুরা সুখী ছিল বলে সে মনে করতো।
সৌদি আরবে স্ত্রী বা মেয়ের অশোভন আচরণের কারণে স্বামী বা পিতা কর্তৃক হত্যার ঘটনাও ঘটে। এটাকে প্রশংসা করে সংবাদপত্রে খবর ছাপা হয়। সামান্য চুম্বনের সন্দেহের কারনেও একটা মেয়ের জীবন চলে যেতে পারে সৌদি আরবে।
অবশেষে স্থির হোল যে নুরা ও তার স্বামীর সাথে সুলতানা ও তার ভাই আলী ইতালি বেড়াতে যাবে। পথে তারা মিশরও দেখবে। আলীর সাথে সুলতানার সম্পর্ক ছিল সব সময়ই সাপে নেউলে। তাই সুলতানা যখন শুনল যে আলীও তাদের সাথে যাবে সে রেগেমেগে আলীর ঘুটরা ( আরবের ছেলেরা মাথায় যে কাপড় পরে) মাথা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সারা ঘরে দৌড়াতে লাগলো। অবশেষে সুলতানা বাথরুমে ঢুকে জোরে দরজা লাগিয়ে দিল। আলী তাকে ধরার জন্য আসছিল এবং এক পর্যায়ে বাথরুমের দরজার কাছে পরে গিয়ে পায়ের একটা আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলল। সুলতানা আলীর মাথার ঘুটরা কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিল। বাথরুমের বাইরে আলীর সাথে তার আবার যুদ্ধ হোল। সুলতানা আলীর ভাঙ্গা আঙ্গুলে ব্যথা দিয়ে আলীকে দুর্বল করে ফেলল। অবশেষে তাদের মা ঘটনাস্থলে এসে আলীকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
এই সুযোগে রাজকুমারি সুলতানা আলীর রুমে ঢুকে আলীর আলমারি থেকে অনেকগুলি পর্ণ ম্যাগাজিন, ফিল্ম স্লাইড ( ছোট ভিউ মাস্টারে দেখার উপযোগী গোলাকৃতির ফিল্ম স্লাইড ) ও মদের ছোট বোতল উদ্ধার করলো। সুলতানা জানে আলীর পায়ের আঙ্গুল ভাঙ্গার কারণে তাকে বকা খেতে হবে তাই সে একটা বুদ্ধি বের করলো। দুপুর দুইটার দিকে বাসার কাছের মসজিদে মুসুল্লি থাকে না সে এটা জানে। সুলতানার তখনও নিকাব পরার বয়সও হয়নি ( ১৩ বছর বয়স)। সে আলীর পর্ণ পত্রিকা, ফিল্ম স্লাইড আর মদের বোতল একটা ব্যাগে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলো। সে আগেই ঠিক করে রেখেছে যে কেউ দেখলে সে বলবে যে সে তার বিড়াল খুজতে এসেছে। সৌভাগ্যক্রমে কেউ ছিল না এবং সে আলীর পর্ণ পত্রিকা, ফিল্ম স্লাইড আর মদের বোতল মসজিদের সিঁড়ির কাছে এক জায়গায় রেখে চুপিসারে বাড়ি ফিরে আসল।
রাতে ৩ জন মুতাওয়া (ধর্মীয় ক্ষমতা প্রাপ্ত পুলিশের মত বাহিনী ) তাদের বাসায় এলো। সুলতানাদের এক চাকরানীকে পোশাকের কারণে ২ সপ্তাহ আগে ঘরের বাইরে মুতাওয়া লাঠি দিয়ে মেরেছিল এবং তার পায়ের অনাবৃত অংশে লাল রঙ স্প্রে করে দিয়েছিল। তাদের বাবা তখনও বাসায় ফেরেনি। মুতাওয়ারা আলীর পর্ণ পত্রিকা, ফিল্ম স্লাইড ও মদের বোতলের একটা করে নমুনা তাদের ড্রাইভার ওমারের কাছে দিয়ে ঘটনা বর্ণনা করলো এবং বলল যে তারা পরে আবার আসবে। এগুলি দেখে আলীর তো অবস্থা সঙ্গিন। তবে ওমার যখন বলল যে আলীকে গ্রেফতারের জন্য মুতাওয়ারা পুলিশ ডাকতে গেছে তখন আলী হুঙ্কার দিয়ে বলল যে “আমি একজন রাজকুমার, ওরা আমাকে গ্রেফতার করতে পারবে না। এই ধর্মান্ধগুলি আমার কাছে পায়ের আঙ্গুলে কামড়ানো মশার মত”।
সুলতানার বাবা বাসায় এসে সব শুনল এবং পর্ণ পত্রিকা, ফিল্ম স্লাইড ও মদের বোতল নিজের চোখে দেখল। রেগেমেগে সে সুলতানা ও তার মাকে অন্য কক্ষে যেতে বলে আলীকে ভালো করে উত্তম মধ্যম দিল। সুলতানা না দেখলেও আওয়াজে বুঝল যে আলীর পিঠের উপর ভালোই পড়েছে। মুতাওয়ারা কয়েক ঘণ্টা পরে আসলো। তাদের সাথে অনেকক্ষণ ধরে দেন দরবার চলল। মুতাওয়াদের সব কিছু মানানো গেলেও একটা স্লাইডে এক মেয়ের সাথে একটা পশুর যৌন মিলনের দৃশ্য মুতাওয়ারা কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারছিল না। যাই হোক অবশেষে আলীর জন্য একটা অপেক্ষাকৃত হাল্কা শাস্তির ব্যবস্থা করা হোল। আলী রাজপুত্র বলে আদালতের মাধ্যমে শাস্তি থেকে সে অব্যাহতি পেল ( রাজার অনুমতি প্রয়োজন হয় )। অন্য কেউ হলে কয়েক বছর জেল খাটতে হতো এবং প্রতি সপ্তায় ১০ টা করে চাবুকের দোররা খেতে হতো। এক ফিলিপিনো ড্রাইভারের ভাগ্যে তাই ঘটেছিল। আলীর উপর শাস্তি ধার্য হোল যে আলীর বাবা ঐ মসজিদে একটা মোটা অঙ্ক দান করবে এবং আলীকে আগামী ১২ মাস ৫ ওয়াক্ত নামাজ ঐ মসজিদে গিয়ে পড়তে হবে এবং মসজিদের মোতাওয়াদের যে প্রধান তার সাথে দেখা করতে হবে। এছাড়া তাকে কাগজে ১০০০ বার লিখতে হবে ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমি ঈশ্বর বিহীন পশ্চিমা দেশের অনৈতিক কাজ অনুসরণ করে আল্লাহকে নাখোশ করেছি'। এছাড়া আলীকে বলতে হবে কে তাকে এই পর্ণ পত্রিকা ও ফিল্ম স্লাইড দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আলী পত্রিকাগুলি বিদেশ থেকে এনেছিল যখন সে বেড়াতে গিয়েছিল (রাজপরিবারের সদস্যদের শুল্ক পরীক্ষা হয় না বললেই চলে)। কিন্তু সে ফিল্ম স্লাইডগুলি কিনেছিল সৌদিতে কর্মরত একজন পশ্চিমা লোকের কাছ থেকে যার সাথে আলীর এক পার্টিতে পরিচয় হয়েছিল। আলী খুশি মনে ঐ লোকের নাম ও ঠিকানা বলে দিল নিজে বাঁচার জন্য।
সুলতানা পুরো ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়লো। পরিবারের এভাবে মানহানি হবে সে তা বুঝতে পারেনি। সে ধরা পরে যাবে এই ভয়েও সে আতঙ্কিত ছিল। মুতাওয়ারা যাওয়ার পরে আলীর সাথে সুলতানার চোখাচোখি হোল। সুলতানা বুঝতে পারলো যে আলী বুঝে ফেলেছে কে কাজটা করেছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হোল আলীর দৃষ্টিতে রাগের বদলে বেদনা খুঁজে পেল সুলতানা। সুলতানা তার কুকর্মের কথা চিন্তা করে কেঁদে ফেলল। তার বাবা ভাবল যে পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে সুলতানা কাঁদছে এবং এজন্য সে আলীকে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে আবারও উচ্চস্বরে তিরস্কার করলো। এই প্রথম তার বাবা সুলতানাকে বুকে টেনে নিলেন ও দুশ্চিন্তা না করতে বললেন। সুলতানার অবস্থা এবার সত্যিই সঙ্গিন হোল। পিতার স্নেহের উষ্ণতা পাওয়ার আজীবন লালিত বাসনা ও তা পাওয়ার যে আনন্দ সুলতানা সব সময় কল্পনা করতো তা মাটি হয়ে গেল এরকম একটা খারাপ কাজের অসিলায় তা অর্জিত হওয়ার জন্য। আলীর পায়ের আঙ্গুল ভাঙ্গা ও তার মাথার ঘুটরা টয়লেটে ফ্ল্যাশের মত কুকর্মগুলো আর প্রকাশ পেল না আলীর এই ঘটনার কারণে।
পরের পর্বে থাকবে নুরা ও সুলতানাদের ইতালি ও মিশর ভ্রমনের কাহিনী। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১১:৫৮